দুই অন্ধ

অলংকরণ: শিখা
অনুবাদ: মৃত্যুঞ্জয় রায়

একদিন বিকেলে এক অন্ধ লোক তার দ্বীপটাতে হাঁটতে বের হলো। হাঁটার সময় হঠাৎ সে তার বাহুতে যেন কার ধাক্কা খেল। সেও আসলে একজন অন্ধ, দেখতে না পেরে চলার সময় হঠাৎ একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে। ধাক্কা খেয়ে আগন্তুক লোকটি রেগে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কানা নাকি? আমাকে দেখতে পাও না?’

দ্বীপবাসী লোকটিও বিস্ময়ে বলে উঠল, ‘তোমারও তো আমাকে দেখা উচিত ছিল। তুমিও কি দেখতে পাওনি?’

‘অবশ্যই আমি দেখতে পেয়েছি। আমি এ দ্বীপে নতুন এসেছি। এইমাত্র জাহাজ থেকে নামলাম। আমি এ দ্বীপের কিছুই চিনি না। আচ্ছা, তোমরা কি একজন পর্যটকের সাথে এই রকম ব্যবহার করো? হয়েছে। এবার দয়া করে আমাকে যাওয়ার পথটা দেখাও।’

‘ওহ, সত্যিই দুঃখিত আমি। আমি বুঝতেই পারিনি যে তুমি এ দ্বীপের লোক নও, নতুন এসেছ। রেগো না। চলো, আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে ঘুরে ঘুরে এ দ্বীপটা দেখাব।’ দ্বীপবাসী লোকটি এই বলে তার কাছে ক্ষমা চাইল। এরপর দুজন হাঁটতে শুরু করল।

দ্বীপবাসী লোকটি আগন্তুক লোকটিকে বলল, ‘এই দিকে এসো। এই পথে অনেক নারকেলগাছ আছে। আমরা যেতে যেতে নিশ্চয়ই সেসব নারকেলগাছ থেকে কচি ডাবের পানি খেতে পারি।’

আগন্তুক লোকটি দ্বীপবাসীর এরূপ প্রস্তাবে খুশি হলো এবং তার কথায় রাজি হয়ে হাঁটতে শুরু করল, সে বলল, ‘চমত্কার কথা! চলো, একসাথে গিয়ে নারকেল পেড়ে তার পানি খাওয়া যাক।’ কথা বলতে বলতে দুই অন্ধ এগিয়ে যেতে লাগল।

যাওয়ার সময় কিছু একটা আন্দাজ করেই একে অপরকে শুধু প্রশ্ন করতে লাগল, ‘ওটা দেখতে পাচ্ছ কি? আর এটা?’ প্রতি প্রশ্নেই একে অপরকে উত্তর দিচ্ছে ‘হ্যাঁ’ বলে। হাঁটতে হাঁটতে দ্বীপবাসী লোকটি একটা নারকেলগাছের কাছে এসে গাছটাকে স্পর্শ করে বলল, ‘ও! এই তো সেই নারকেলগাছ। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?’

আগন্তুক লোকটি হাতড়াতে হাতড়াতে নারকেলগাছটাকে ছুঁয়ে বলল, ‘জি, জি আমি নারকেলগাছটাকে দেখতে পাচ্ছি।’

তখন দ্বীপবাসী লোকটি বলল, ‘বন্ধু, আজ তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগে আমি অনেকগুলো নারকেলগাছে উঠেছি। এতে আমার পায়ের তলার চামড়া পাতলা হয়ে গেছে। তাই এ গাছটাতে এখন তুমিই ওঠো। তুমি উঠে নিচে নারকেলগুলো ফেলে দাও। আমি ওগুলো সুন্দর করে কেটে রাখব। তুমি গাছ থেকে নেমেই পানি খেতে পারবে।’

এ কথায় রাজি হয়ে আগন্তুক লোকটি তর তর করে গাছ বাইতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর দ্বীপবাসী তাকে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘উঁহু। ওটা নয়। ওই দিকের কাঁদিটা ধরো। ওই ডাবগুলো বেশি ভালো। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?’ গাছে ওঠা লোকটি এ কথার জবাবে বলল, ‘জি আমি দেখতে পাচ্ছি।’

এমন সময় দ্বীপবাসী লোকটি হঠাৎ ধপাস করে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনতে পেল। ‘এটা তো নারকেল পড়ার শব্দ না। কী হলো? কী করেছ কী তুমি?’

আগন্তুক লোকটি মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে উত্তর দিল, ‘ঠিক। না, এটা নারকেল না, এটা আমি।’

আসলে ওই নারকেলগাছটা ছিল একটা মরা গাছ। ওটার কোনো মাথাই ছিল না। মরা গাছের কাণ্ডটা শুধু খাড়া দাঁড়িয়েছিল।