দুই জগতের রাজা

শীতের সকালের মজার ঘুমটা ভেঙে গেল অ্যালার্মের ঝনঝন শব্দে। কম্বল ছাড়তে ইচ্ছাই করছে না, তবু অলসতা কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দেখি দরজার সামনে আম্মু অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আম্মু বলে উঠল, ‘এই ছেলে, কতবার বলেছি ঘড়িতে অ্যালার্ম দিবি না।’

আমি বললাম, ‘তাহলে তো স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাবে, ইয়ে...।’

আম্মু অবাক হওয়ার ভান করল, ‘ওমা, স্কুলে যেতে দেরি হলে কি কেউ তোকে বকা দেয়?’

আমি মাথা নিচু করে রইলাম।

হাত-মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে এসে দেখি আব্বু ল্যাপটপে কাজ করছে। আর আম্মু নাশতা তৈরি করছে। এই ফাঁকে আমি পত্রিকা তুলে বসে পড়লাম। আজকে নতুনের জানালায় ‘কোয়ার্ক’ নিয়ে সুন্দর একটা নিবন্ধ দিয়েছে। কোয়ার্ক নিয়ে কত ধ্যান-ধারণাই না রয়েছে, ভাবলেই কিন্তু অবাক লাগে। এমন সময় আব্বু জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা সৈকত, টুইটারে তোর ফলোয়ার সংখ্যা এত কম কেন? খাটছিস না মনে হয়।’

আমি যতটা সম্ভব ‘আই কন্ট্যাক্ট’ পরিহার করলাম। আম্মুও তখন যোগ করল, ‘লাট সাহেব যদি সারা দিন বই, পত্রিকা নিয়ে পড়ে থাকে, তাহলে খাটবে কীভাবে?’ আব্বু তখন বলা শুরু করল, ‘শোন, তোর সময়ে আমরা কিন্তু অনেক পরিশ্রমী ছিলাম, কষ্ট করেই এখানে এসেছি। তুই যদি এখন এসব জিনিসে এত সময় নষ্ট করিস, তাহলে তো তোর ভবিষ্যত্ই ধ্বংস হয়ে যাবে। মনে থাকবে কথাটা?’

‘হুম্।’

‘গুড, এবার স্কুলে যা।’

খাওয়া শেষ করে স্কুলব্যাগে ল্যাপটপ আর প্লে-স্টেশন নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। লুকিয়ে একটা বিজ্ঞান বইও নিয়ে নিলাম। কেউ টের পেল না। বলাই বাহুল্য, আব্বুর উপদেশগুলো সব মাথার ওপর দিয়ে গেছে।

স্কুলের প্রথম পিরিয়ড ছিল ফেসবুকের ওপর। আজকে একটা পরীক্ষাও ছিল। যে যত ভালো স্ট্যাটাস দিয়ে বেশি বেশি লাইক পাবে, সে-ই উত্তীর্ণ হবে। অবশ্য আমি যথারীতি ফেল। পরের পিরিয়ডটা গেমিংয়ের ওপর। মাহমুদ স্যার সবাইকে অ্যাংরি বার্ডসের লেভেলগুলো শেষ করার ক্লাস-ওয়ার্ক দিল। আমার এই গুলতি দিয়ে পাখি ছোড়া জিনিসটা একদমই ভালো লাগে না। তাই এক ফাঁকে ব্যাগ থেকে বিজ্ঞানের বইটা বের করে পড়তে লাগলাম। কেউ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করল না, ‘থিওরি অব রিলেটিভিটির’ সহজ ব্যাখ্যা আছে বইটিতে, একবার পড়লেই পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। এমন সময় আমার পেছনে বসা রাইসা নামের মেয়েটি টের পেয়ে গেল। তার আবার ক্লাসে অতিরিক্ত কথা বলার সুখ্যাতি রয়েছে। সে সবাইকে ব্যাপারটা জানান দেওয়ার মহত্ দায়িত্বটি পালন করল। আর আঁতেল পার্টির হেড ইনতিসারের কানে যাওয়ার পর স্যারও জেনে গেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে প্রধান শিক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর আম্মু-আব্বুকেও ডাকা হলো। তাদের অনেক কথা শোনানো হলো। বেশ বোঝা গেল আমার কপালে আজ শনির দশা। এক সপ্তাহের জন্য সাসপেন্ড হয়ে গেলাম।

বাসায় ফিরে আসার পর আম্মু-আব্বু আমার সঙ্গে একটা কথাও বলল না, আমার মনটাই ভেঙে গেল। এই প্রথম তাদের নীরবতার কষ্টটা আমি অনুভব করতে পারলাম। রাতে ল্যাপটপের সামনে বসে আছি। ফেসবুকে মেসেজগুলো পড়ে দেখলাম। ইনতিসার লিখেছে, ‘ভালো হয়ে যাও’। রাইসা লিখেছে, ‘সরি ফর এভরিথিং’। যাক, একজন আছে যে আমাকে অন্তত সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল, এতক্ষণ নিজেকে খুব একা একা মনে হচ্ছিল। মনটা যখন একটু ভালো হলো, তখনই মাথায় অদ্ভুত কিছু চিন্তা এসে ভিড় করল। আচ্ছা, এমন কোনো স্বপ্নের দুনিয়া থাকতে পারল না, যেখানে বই পড়াই হতো আমাদের কাজ আর গেম, ফেসবুকের জন্য পেতাম বকাঝকা? অবশ্যই থাকতে পারে, কে জানে হয়তো বা আছেও! সে দুনিয়ায় আমিই তো রাজা। আর আমি যদি রাজা হয়েই থাকি, তাহলে এ দুনিয়ায় কেনই বা রাজা হতে পারব না? এত কঠিন কী-ই বা আছে? আজব তো, কঠিন কিছুই নেই। জীবনে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে আর আব্বু-আম্মুর মুখে সর্বদা হাসি ফুটিয়ে রাখতে হবে, তাহলে আমিও হয়ে যাব রাজা, দুই জগতের রাজা!