ধুপপুর জঙ্গলে এলিয়েন

অলংকরণ: তুলি

—রোল চৌদ্দ?

মবীন স্যার মুখ তুলে তাকালেন। তাঁর ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল। তিনি চেঁচালেন—

—রোল চৌদ্দ...আজরফ আলী?

উত্তর নেই।

—আজরফ আসেনি?

—না, স্যার।

স্যার খুব অবাক হলেন।

স্যারের সঙ্গে সঙ্গে গোটা ক্লাসের সবাই অবাক হলো। আরে তাই তো, আজরফ আজ স্কুলে আসেনি। এটা তো একটা বিরাট ঘটনা!

হ্যাঁ, আজরফ স্কুলের একমাত্র ছাত্র, যে কখনো স্কুল কামাই দেয় না। কখনোই না। একবার তাদের এলাকায় ভয়ংকর টর্নেডো হয়েছিল। পুরো মফস্বল শহরটা তছনছ করে দিয়েছিল সেবার। তাদের স্কুলের ক্লাস নাইনের ক্লাসরুমের টিনের ছাদ উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিনও আজরফ স্কুলে এসে হাজির। হেড স্যার শুধু স্কুলে ছিলেন। কারণ, তাঁর বাসা স্কুল কম্পাউন্ডে। তিনি আজরফকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন!

—তুই?

—স্যার, আজ ক্লাস হবে না?

—কী, কী বললি?

—স্যার, আজ ক্লাস হবে না?

আবার বলে আজরফ। স্যারের গলায় কথা আটকে যায়। তারপরই হঠাত্ গর্জন করে ওঠেন, ‘হারামজাদা...ফাজলামো পেয়েছিস? আজ স্কুলে এসেছিস তুই?’

তারপর যা হলো পৃথিবীর স্কুল ইতিহাসে বোধ হয় আর কখনো ঘটেনি। হেড স্যার স্কুলে আসার জন্য আজরফকে শাস্তি দিলেন। কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন আধা ঘণ্টা।

আরেকবার অষ্ট-আশির বন্যায় সারা শহর ডুবে গেল। আজরফ কোত্থেকে একটা ভেলায় করে স্কুলে এসে হাজির। সেবারও হেড স্যার তাকে আধা ঘণ্টা কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, তা-ও আবার ওই ভেলার ওপরই।

সেই আজরফ আজ স্কুলে আসেনি, তা কি হয়?

স্কুল ছুটির পর আজরফের কয়েক বন্ধু মিলে গেল আজরফের বাসায়। ওরা জানত আজরফ থাকে তিন রাস্তার মোড়ে বটগাছের পাশের লাল বিল্ডিংটায়। ওটাই ওর বাসা। কিন্তু গিয়ে ওরা হতভম্ব। ওটা কোনো বাসা না। একটা মেস। আর তার থেকেও আশ্চর্যের ব্যাপার আজরফ থাকে মেসে। ক্লাস এইটের একটা ছেলে একা একা মেসে থাকে!

ওরা মেসের ম্যানেজারকে খুঁজে বের করল। লোকটা একটা ছোট্ট ঘরে উবু হয়ে শুয়ে ‘খালু গো খালু গো’ বলে চেঁচাচ্ছিল। ওদের দেখে কোনোমতে ঘুরে তাকাল। চোখ দুটো লাল।

—তোমরা কারা, কী চাও?

—আমরা মডেল স্কুলের ছাত্র, আজরফের বন্ধু।

—বুঝলাম, আমার কাছে কী?

—আজরফ এখানে থাকে না?

—থাকে তো।

—ও স্কুলে যায়নি, ওর খোঁজে এসেছি।

লোকটা আবার ‘খালু গো খালু গো’ বলে কিছুক্ষণ চেঁচাল। তারপর একটু থেমে বিড়বিড় করে বলল, ‘বুঝলা, পিঠের ব্যথার কোনো চিকিত্সা নাই। কত ডাক্তার দেখাইলাম...মাঝে মাঝেই উঠে...সহ্য করতে পারি না। তোমরা আজরফের খোঁজে আইছ? ও তো নিখোঁজ!...উপরে ডাইন দিকে ৬ নম্বর রুমটা ওর, যায়া দেখো...’ বলে ফের ‘খালু গো খালু গো’ বলে কঁকাতে লাগল।

ওরা মানে আজরফের ক্লোজ ফ্রেন্ড মৃদুল, মুকিত আর ফজলু ওপরে উঠে ডান দিকের ৬ নম্বর রুমটার সামনে দাঁড়াল। দরজা খোলাই ছিল। আজরফের স্কুল ড্রেস, বই-খাতা সব ঠিকঠাক সাজানো। ওরা তিনজন কী করবে বুঝতে পারছে না। আজরফ একা একা এখানে থাকে—এই বিষয়ই ওরা নিতে পারছিল না। মৃদুল দেখে আজরফের ছোট্ট টেবিলটার ওপর একটা কাগজ খোলা, তার ওপর বড় বড় করে লেখা ‘এলিয়েন...ধুপপুরের জঙ্গল’। পাশে একটা এলিয়েনের ছবি আঁকা।

—বুঝলি কিছু? ফিসফিস করে ফজলু।

—কী?

—আজরফকে নির্ঘাত এলিয়েন ধরে নিয়ে গেছে।

—ধেত্, গাধার মতো কথা বলিস।

—এই যে এলিয়েনের ছবি আঁকা, পাশে লেখা...

—বাহ্, তাতেই ধরে নিলি ওকে এলিয়েন ধরে নিয়ে গেছে?

—হতেও তো পারে!

মেসে কোনো হদিস না পেয়ে ওরা আমতলায় মিটিংয়ে বসল। আমতলায় আসলে ওরা খেলে কিন্তু কাল বৃষ্টি হওয়ায় মাঠ পানিতে থইথই করছে। তারা তিনজন একটা শুকনো জায়গায় দাঁড়াল।

—চলো, ধুপপুর জঙ্গলে যাই।

—ওখানে কী?

—বাহ্, দেখলি না ও খাতায় লিখেছে ‘এলিয়েন...ধুপপুরের জঙ্গল’। নিশ্চয়ই ওখানে কোনো কাহিনি আছে।

—কিন্তু ধুপপুর জঙ্গলটাই বা কোথায়, জীবনে নামও শুনিনি।

—কোনো রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে।

—তা ঠিক।

শেষ পর্যন্ত দুপুরের দিকে মৃদুল আর ফজলু একটা সাইকেলে করে রওনা দিল ধুপপুরের জঙ্গলের উদ্দেশে। মুকিত গেল না। তার নাকি পেট ব্যথা করছে। তা ছাড়া সাইকেলে তিনজন যাওয়াও যেত না। ধুপপুর জঙ্গলটা মূল শহর থেকে মাইল চারেক দূরে। মাটির রাস্তা, তবে রাস্তা সুন্দর। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল জঙ্গলে। অবশ্য মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতে হয়েছে।

জঙ্গলটা দেখে ওরা অবাক। শহরের এত কাছে এমন একটা জঙ্গল আছে তারা জানেই না। কিন্তু আশপাশে কেউ নেই। জঙ্গলের ভেতর দু-একটা সরু রাস্তা ঢুকে গেছে এদিক-ওদিক। তারা কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করল। কিন্তু খামোখা। কেউ কিছু বলতেও পারল না। এদিকে খুব শিয়ালের উপদ্রব, কেউ খুব একটা আসেও না। ফজলু চিপসের প্যাকেট এনেছিল আর এক বোতল পানি। সেটাই তারা দুজন ভাগাভাগি করে খেল।

—এখন কী করবি? মৃদুল জিজ্ঞেস করে।

—চল, চলে যাই। এখানে আজরফকে কোথায় পাব?

—তাই...খামোখা এসেছি। চল, ফিরে যাই। যাওয়ার আগে শেষ একটা ঘুল্লি দিয়ে যাই।

—বেশ, চল।

জঙ্গলের ভেতর বেশ অনেকটা ঢোকার পর তারা কিসের একটা শব্দ পেল যেন। শব্দটা ধরে এগিয়ে দেখে একটা নিচু জায়গায় এবং আরেকটু এগিয়ে দুজনের চোখই ছানাবড়া। একি? একটা ফ্লাইং সসার।

—দেখ, ফ্লাইং সসার।

—আরে তাই তো, সত্যি সসার! দেখ দেখ!

—সবুজ কিছু মানুষ।

—এলিয়েন! হায় আল্লাহ, এসব কী দেখছি। আমাদের মফস্বল শহরের জঙ্গলে ফ্লাইং সসার, নিজের দুচোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

আর ঠিক তখনই যা ঘটল তার জন্য ওরা প্রস্তুত ছিল না। দেখে, দুজন সবুজ রঙের মানুষ একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে আনছে। বাচ্চা ছেলেটা আর কেউ নয়, তাদের আজরফ! আজরফকে নিয়ে তারা যাচ্ছে ঠিক ফ্লাইং সসারটার দিকে। দম আটকে আসে যেন মৃদুল আর ফজলুর।

—যা ভেবেছিলাম তা-ই সত্যি হলো...

—হ্যাঁ, ওরা মনে হয় আজরফকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এখনই কিছু করতে হবে।

—কী করবি?

—চল, পুলিশকে খবর দিই।

—তাই চল, কিন্তু পুলিশ কি আমাদের কথা বিশ্বাস করবে? তা ছাড়া পুলিশকে খবর দিতে দিতে ওরা যদি চলে যায়?

—কিন্তু এ ছাড়া আর কী করার আছে আমাদের?

—তাই, চল।

ওরা পাগলের মতো সাইকেল চালিয়ে চলে এল শহরে। যাওয়ার সময় লেগেছিল দুই ঘণ্টা, এবার পৌনে এক ঘণ্টায় চলে এল। সোজা থানায় গিয়ে একদম ওসি সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ওসি সাহেব একটা খাতায় কিছু একটা লিখছিলেন। লিখতে লিখতেই তাকালেন ওদের দিকে।

—কী ব্যাপার?

—স্যার, আমরা একটা জরুরি ব্যাপারে এসেছি।

—কী জরুরি ব্যাপার?

—আমাদের এক বন্ধুকে এলিয়েনরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

—কে ধরে নিয়ে যাচ্ছে?

—এলিয়েন।

—কে?

—এলিয়েন...ভিনগ্রহের প্রাণী ওরা। ধুপপুর জঙ্গলে ফ্লাইং সসার নিয়ে এসেছে। আমরা নিজের চোখে দেখে এসেছি।

ওসি সাহেব এবার লেখা থামিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কোন স্কুলে পড়ো?

—মডেল স্কুলে।

—আজ স্কুল নেই?

—আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল ছিল।

ওসি সাহেব আবারও সিগারেটে লম্ব্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর হুংকার দিয়ে উঠলেন, নেশা করো?

—না না।

—ফেন্সি? পলি চলে?

—না না, কী বলছেন?

—আমার সাথে ইয়ার্কি? এলিয়েন এসেছে ধুপপুর জঙ্গলে! এই কনস্টেবল, এ দুটাকে লকআপে ঢোকাও...

মৃদুল আর ফজলু খুব শিগগিরই নিজেদের আবিষ্কার করল একটা লকআপের ভেতরে। লকআপের ভেতরে একটা লোক লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, আর কেউ নেই। তারা দুজনই হতভম্ব! এখন কী হবে? এই সময় ঘুমন্ত লোকটা উঠে বসে হাই তুলল। ওদের দিকে তাকিয়ে এক চোখ খুলে বলল, এই ছেলে, তোমাদের কাছে বিড়ি আছে?

—আমাদের কাছে বিড়ি থাকবে কেন?

—ও, বিড়ি খাও না?...ভালো। তা কী করছিলা? ছিনতাই, না চুরি?

—ধেৎ, আমরা এসব করব কেন?

—তাইলে এইখানে ঢুকলা কি বেড়াইতে?

লোকটা আড়মোড়া ভাঙল। তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘তোমগো বয়সে আমি একবার বিরাট চুরি করছিলাম...অনেক টাকা...কিন্তু রাখতে পারি নাই...আফসোস!’ লোকটা জিবে চুকচুক করে শব্দ করে।

—কী করো তোমরা?

—স্কুলে পড়ি।

—কোন কেলাসে?

—এইটে...

—শোনো...লোকটা আবার গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘শোনো, ছোটখাটো চুরি কইরা লাভ নাই, ডাকাতি করো...ব্যাংক ডাকাতি।’

—উফ! বললাম তো আমরা এসব করি না, আমরা স্কুলে পড়ি। ফজলু কড়া গলায় বলার চেষ্টা করে।

—ওহ, স্কুলে পড়লে তো হবে না, স্কুল ছুটি হইতে হইতে ব্যাংক বন্ধ হয়া যায়, ডাকাতি করবা ক্যামনে! লোকটা বিড়বিড় করে আরও কী সব বলে, সব কথা বোঝা যায় না।

এই সময় একটা কনস্টেবল এগিয়ে এসে লকআপ খুলে ওদের বের করে ওসি সাহেবের সামনে নিয়ে যায়। ওসি সাহেবের মুখটায় এখন একটু হাসি হাসি। তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, বসো।

ওরা বসল।

—ভয় পাইছিলা?

ওরা মাথা নাড়ে।

—একটু মজা করলাম তোমাদের সঙ্গে। পোলাপানের সঙ্গে মজা করতে কোনো দোষ নাই।

ওদের দুটো জুস দেওয়া হলো। ওসি সাহেব বললেন, খাও। লকআপে ঢোকার কারণেই কি না কে জানে, ভয়ে গলাটা শুকিয়ে এসেছিল। ওরা দুজনেই চো চো করে জুস শেষ করল। ওসি সাহেব এবার ওদের দুজনের দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন। বইয়ের নাম উন্নত জীবন যাপন, লেখক সূত্রধর।

‘সূত্রধর আমার ছদ্মনাম।’ ওসি সাহেব হাসিমুখে বললেন। এটা আমার লেখা বই। বইটা তোমাদের দিলাম, মনোযোগ দিয়ে পড়বে। খুবই শিক্ষামূলক বই। আর সায়েন্স ফিকশন পড়া বাদ দেবে, এসব অপসাহিত্য, বুঝলা? ওই সব পড়ে পড়েই মাথায় ফ্লাইং সসার, এলিয়েন ঢুকছে। যতসব ফালতু। যাও যাও, বাসায় যাও...আর কখনো যেন থানা চত্বরে না দেখি। শিশুরা থাকবে স্কুলে আর খেলার মাঠে, থানায় কেন? হোয়াই? আনসার মি? শেষের দিকে ওসি সাহেবের গলা বেশ চড়ে গেল।

শেষ পর্যন্ত ওসি সাহেবকে কোনো ‘আনসার’ না দিয়েই ওরা থানা থেকে বের হয়ে এল।

—এখন কী করা যায় বল তো? পুলিশ তো আমাদের কথা বিশ্বাস করল না। উল্টো লকআপে ভরে রাখল আধা ঘণ্টা।

—চল, স্কুলের মাঠে যাই।

—তাই চল, ওখানে সবাইকে পাব।

স্কুলের মাঠে ওদের ক্লাসের অনেককেই পাওয়া গেল। তাদের নিয়ে জরুরি মিটিংয়ে বসা হলো। সবাইকে বলা হলো পুরো ঘটনা। কী করা যায়, কী করে আজরফকে এলিয়েনদের হাত থেকে উদ্ধার করা যায়। কে জানে এতক্ষণে হয়তো ওকে নিয়ে ফ্লাইং সসার করে চলেই গেছে কি না। সব শুনে সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে গেল। এখনই যাবে সবাই, যেকোনো মূল্যে আজরফকে এলিয়েনদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। তখন তখনই ছয়টা সাইকেল জোগাড় হয়ে গেল। মোট বারো জনের একটা মারদাঙ্গা দল তৈরি হয়ে গেল। যুবায়ের তার এয়ারগানটা নিল, বজলু নিল তার রাবারের গুলাল আর বিশটা গুল্লি, তাপস নিল তার হকিস্টিকটা। হকিস্টিক দেখে অবশ্য মৃদুল মৃদু আপত্তি করল, ‘ধেত্, হকিস্টিক নিলি কেন? আমরা কি মারামারি করতে যাচ্ছি নাকি?’

—আমরা বুদ্ধি দিয়ে আজরফকে উদ্ধার করব।

—ঠিক ঠিক, বুদ্ধি দিয়ে।

—কিন্তু আমাদের মাথায় এত বুদ্ধি আছে নাকি?

শেষ পর্যন্ত বুদ্ধির জন্য নেওয়া হলো ওদের ফার্স্ট বয় আজমলকে। যদিও আজমলের বুদ্ধির ওপর অনেকেরই সন্দেহ আছে। আজমল সঙ্গে নিল তার বাইনোকুলারটা।

যাত্রা হলো শুরু। বারো জনের দল ছুটল ছয়টা সাইকেলে। হাতে খুব বেশি সময় নেই। এখন বাজে চারটা। পৌঁছাতে লাগবে বড়জোর এক থেকে দেড় ঘণ্টা, জোরে চালালে। তবে দেখা গেল তারও আগেই তারা দিব্যি পৌঁছে গেল! কারণ, পথে হঠাত্ একদল পাগলা কুকুর তাড়া করল ওদের (একসঙ্গে এত সাইকেল দেখে হয়তো ওরা খেপে গিয়েছিল)। ফলে কুকুরের হাত থেকে বাঁচতে এমন জোরে সাইকেল চালাল সবাই যে এক-দেড় ঘণ্টার রাস্তা পৌনে এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেল ওরা।

জঙ্গলের সেই ফাঁকা জায়গাটায় একটা ঢিবির পাশে তারা সবাই উবু হয়ে বসল। এখান থেকে ফ্লাইং সসারটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কী আশ্চর্য মৃদুল আর ফজলু যেমনটা দেখেছিল সেই একই দৃশ্য, দুজন এলিয়েন ধরে নিয়ে যাচ্ছে আজরফকে ফ্লাইং সসারের দিকে। তার মানে কী? দুই ঘণ্টা আগেও ওরা দুজন দেখেছিল আজরফকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ফ্লাইং সসারের দিকে। এখনো নিয়ে যাচ্ছে। দশ গজ রাস্তা পার হতে এতক্ষণ লাগে? এর মানে কী?

—ওরা সময়কে একটা জায়গায় আটকে দিয়েছে। বিজ্ঞের মতো বলল ফজলু। ‘ওরা সব পারে!’

—এখন আমরা কী করব? মৃদুল তাকায় ফার্স্ট বয় আজমলের দিকে।

আজমল তখনো তার বাইনোকুলারে দুচোখ লাগিয়ে তাকিয়ে আছে। সবাইকে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল।

—কী দেখছিস?

—দেখার কী আছে, চল আমরা অ্যাটাক করি। ঘাড়ে গর্দানে মোটা জিতু বলে। তার হাত-পা নিশপিশ করছে। সে চাইছে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা কিছু করে ফেলতে।

—অ্যাটাক করবি মানে?

—মানে ঝাঁপিয়ে পড়ে আজরফকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি এলিয়েনদের হাত থেকে।

—কিন্তু ওদের হাতে শুনেছি লেজারগান থাকে।

—কই, ওদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। আর মনে হচ্ছে ওরা সংখ্যায় মাত্র দুজন।

—তার বোধ হয় আর দরকার হবে না। হতাশ গলায় বলে আজমল।

—কেন?

—ওরা আজমলকে ফ্লাইং সসারে করে নিয়ে যাচ্ছে না।

—তুই কীভাবে বুঝলি?

—বাইনোকুলারে দেখেই বুঝেছি।

—কী বুঝলি?

—তোরা বুঝতে পারছিস না ব্যাপারটা? এলিয়েনরা বারবার আজরফকে ফ্লাইং সসারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে, আবার নিয়ে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে...একই ব্যাপার বারবার কখন হয়?

—সময়কে যখন আটকে ফেলা হয়। ফজলু আবার বিজ্ঞের মতো বলে। ‘আমি একটা সায়েন্স ফিকশন মুভিতে দেখেছি একটা লোক ঠিক বারোটার সময় আটকে যায়। একই ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে।’

—আরে না, ওসব কিছু না। বাইনোকুলারে আমি যখন দেখলাম...

—ধেত্ তোর বাইনোকুলার। বলে হঠাত্ জিতু যুবায়েরের এয়ারগানটা ছিনিয়ে নিয়ে ছুটল...তার পিছে পিছে গুলাল আর পকেটে বিশটা গুল্লি নিয়ে ছুটল বজলু...আর তার পিছে পিছে তাপস তার হকিস্টিক নিয়ে ছুটল। এসব দেখে অন্য সবাইও ছুট লাগাল ওদের পেছনে। শুধু ফার্স্ট বয় আজমল গালে হাত দিয়ে বসে থাকল আর বিড়বিড় করে বলল, ‘গাধার দল!’

এরপর যা ঘটল তা সত্যিই মর্মান্তিক। আজরফকে দুপাশ থেকে দুজন সবুজ রঙের এলিয়েন ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ফ্লাইং সসারের দিকে। আজরফ হঠাত্ দেখে মার মার ভঙ্গিতে ছুটে আসছে তার ক্লাসেরই সব বন্ধু। সে অবাক হওয়ারও সময় পেল না। ওরা ছুটে এসে ঘিরে ধরল আজরফ আর দুই এলিয়েনকে। কিন্তু আজরফের মুখটা হাসি হাসি কেন? তাকে এলিয়েনরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তার মুখে থাকবে ভয়, চিন্তা বা আতঙ্ক, কিংবা হয়তো উদ্ধার করতে বন্ধুরা সব দল বেঁধে এসেছে দেখে সে খুশি হয়ে গেছে। আজরফ ওদের একসঙ্গে দেখে বলেই ফেলল, তোরা কোত্থেকে? হাতে এয়ারগান কেন?

আর তখনই একটা বাজখাঁই গলা শোনা গেল। ‘কাট কাট কাট...দিল আমার শটটা নষ্ট করে। একটা শটও ওকে হচ্ছিল না। যেটা ওকে হতে যাচ্ছিল, সেটার বারোটা বাজাল এরা। এই তোমরা কারা?’

—আঙ্কেল, ওরা আমার বন্ধু। আজরফ হাসি হাসি মুখে বলে।

—উফ, এত বন্ধু একসঙ্গে? তোমরা কি সব দল বেঁধে যুদ্ধ করতে এসেছ নাকি?

অলংকরণ: তুলি

ততক্ষণে পুরো ব্যাপারটা...সবকিছু জলবত্ তরলং হয়ে গেছে সবার কাছে। একটা সায়েন্স ফিকশন নাটকের শুটিং চলছিল এখানে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটা সায়েন্স ফিকশনের গল্পের নাট্যরূপ, তার শেষ সিনটার শট এখানে নেওয়া হচ্ছে। আজরফ এই নাটকের একটা অংশে অভিনয় করছে। আর সবুজ এলিয়েনরা সব অভিনেতা, সবুজ রঙের পোশাক পরে আছে, মুখেও সবুজ রং মাখা। নাটকের ডিরেক্টর হতাশ হয়ে মাইকে ঘোষণা দিল, ‘আধা ঘণ্টা টি ব্রেক, সবাইকে চা দাও।’

এই সময় হঠাত্ ‘খালু গো খালু গো...’ বলে চিত্কার শোনা গেল। সবাই তাকিয়ে দেখে আজরফের মেসের সেই ম্যানেজার। তিনি পিঠে হাত দিয়ে বসে পড়েছেন একটা চেয়ারে। ফজলু আর মৃদুল চিনল। আজরফ তো চেনেই।

—আপনি এখানে? ফজলু বলেই ফেলে।

—হ, তোমগো মতো আজরফের শুটিং দেখতে আইছিলাম।

বলে তিনি হাঁপাতে লাগলেন। একটু সুস্থির হয়ে বললেন, ‘তোমরা জানলা ক্যামনে এইখানে শুটিংয়ের কথা?’

—আপনি জানতেন আজরফের শুটিংয়ের কথা? পাল্টা প্রশ্ন করে মৃদুল।

—জানমু না কেন? নাটকের ডাইরেক্টর মিনহাজ তো আমার ভাইগনা। সে এইখানে শুটিং করতে আইসা কইল একটা ছেলে লাগব। আমি আজরফরে কইলাম। আজরফও রাজি। ব্যস...

—কিন্তু আমাদের বললেন না কেন ওই দিন?

—ক্যামনে বলি, বলা নিষেধ ছিল, সবাই জানলে শুটিং দেখতে ভিড় করব। শুটিংয়ে নাকি অসুবিধা হয়। ভাইগনা কইল তাই তোমাগো কাছে বিষয়টা ভাঙ্গি নাই।

—আচ্ছা আঙ্কেল, একটা প্রশ্ন করতে পারি? ফাঁক দিয়ে মৃদুল বলে।

—করো, একটা কেন এখন দশটা প্রশ্ন করলেও সমস্যা নাই। পিঠের ব্যথাটা এখন গেছে।

—আপনি পিঠের ব্যথা উঠলে খালুগো খালুগো বলে চেঁচান কেন? ব্যথা উঠলে সবাই বাবাগো-মাগো বলে চেঁচায় আর আপনি...

মেস ম্যানেজার বদিউল আলমের মুখে চিকন হাসি দেখা গেল। ‘আরে আমিও তো বাবাগো বাবাগো বইলাই চেঁচাই, পাবলিক বোঝে না।’

—কই, আপনি তো খালুগো খালুগো বলে চেঁচান।

—তাইলে শোনো আসল কাহিনি...বলে কেশে গলা পরিষ্কার করেন তিনি।

—আমার ছোটবেলায় মা মারা যায়। আমার বাবা তখন আমারে মানুষ করার জন্য আমার আরেক খালারে বিয়া করেন। তাইলে কী হইল, বাবা খালু হয়া গেল না? সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আর তখনই ডিরেক্টর মিনহাজ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘সাইলেন্স! সাইলেন্স!...লাস্ট টেকটা আমরা নেব এখন। এক শটে ওকে করতে হবে...লাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল শট। লাইট ক্যামেরা..রেডি?’

—রেডি

—ক্যামেরা রোল...

বিকেলের আলো মরে আসছিল বলে চারদিকে বেশ কয়েকটা সানগান জ্বালানো হলো। সেই আলোয় সেই শেষ শটটা নেওয়া হচ্ছে...আজরফকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দুজন সবুজ এলিয়েন...এই শটে আজরফকে শেষ পর্যন্ত তোলা হলো প্লাইউডের তৈরি ফ্লাইং সসারে। আজরফ দারুণ অভিনয় করল। সে পৃথিবীতে থাকার জন্য চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল...আর দুই সবুজ এলিয়েন ওকে টেনেহিঁচড়ে ফ্লাইং সসারে তুলতে লাগল। রোমহর্ষক করুণ দৃশ্য! আজরফের কান্না দেখে তাপস, ফার্স্ট বয় আজমল আর ফজলুর চোখেও পানি চলে এল। শটটা দারুণভাবে ওকে হলো। ডিরেক্টর মহা খুশি। হ্যান্ডমাইকে তিনি হাসিমুখে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘জোন প্যাকআপ...’

শুটিং প্যাকআপ করে ফেরার পথেও মজা কম হলো না। সবাই অবশ্য সাইকেলে ফিরল না। শুটিং ইউনিটের বড় গাড়িতে করে আরামে আজরফের সঙ্গে ফিরল কেউ কেউ। ফিরে এসে সবাই আজরফের মেসে উঠল। কারণ, এখানে সন্ধ্যায় ব্যাপক খাওয়া-দাওয়া হবে। আয়োজন করেছেন ডিরেক্টরের মামা মেস ম্যানেজার বদরুল আলম। মাঝে মাঝে পিঠে ব্যথা উঠলে ‘খালুগো...খালুগো’ বলা ছাড়া তার আর কোনো সমস্যা নেই। এমনিতে তিনি বেশ মজার মানুষ। তিনি আজরফের সব বন্ধুকে যেতে দিলেন না। খেয়ে যেতে হবে সবাইকে। খেতে বসে তিনি অনেক মজার কাহিনি বললেন। ডিরেক্টর মিনহাজকেও বেশ মজার মনে হলো। তিনি ঘোষণা দিলেন, তাঁর নেক্সট নাটক হবে বাচ্চাদের নিয়ে একটা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি, সেখানে চাইলে আজরফের সব বন্ধুই অভিনয় করতে পারে। সবাই রাজি। শুধু ফার্স্ট বয় আজমল বেঁকে বসল, সামনে ফাইনাল পরীক্ষা না!

সবাই যখন ফিরে গেল বাসায় খুশিমনে...তখন থানায় ওসি সাহেবের কাছে ফোন এল। সদর থেকে এসপি সাহেব ফোন করেছেন, হ্যালো, ওসি সাহেব, এসপি মজিবুল্লাহ বলছি।

—জি জি, স্যার।

—কী করেন, ঘাস কাটেন নাকি?

—কী, কী বলছেন স্যার, ঘাস কাটব কেন?

—ধুপপুর জঙ্গলে ফ্লাইং সসার নেমেছে, খবর রাখেন আপনি? এখনই দৌড়ান, আমাকে রিপোর্ট করেন জলদি। ওসি সাহেবের চোয়াল ঝুলে পড়ে। তখন তখনই ছুটলেন। তাঁর মনে পড়ল বিকেলে বাচ্চা ছেলে দুটোর কথা। ওদের ঠিকানাটা রাখা দরকার ছিল। জিপে ছুটতে ছুটতে ওসি সাহেবের নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো। অবশ্য মাথায় তাঁর ছেঁড়ার মতো খুব বেশি চুলও অবশিষ্ট নেই। কী করা। জিপ ছুটে চলছে ধুপপুরের জঙ্গলের দিকে। জিপকে পাশ কাটিয়ে একটা ট্রাক ছুটে গেল উল্টো দিকে। ওসি সাহেব খেয়াল করলে দেখতে পেতেন, প্লাইউডের একটা ফ্লাইং সসার নিয়ে যাচ্ছে ট্রাকটা ঢাকার দিকে। তবে তারপুলিনে ঢেকে।