নন্দলালের মন্দ কপাল

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

নন্দলালের ভারি রাগ, অঙ্কের পরীক্ষায় মাস্টার তাহাকে গোল্লা দিয়াছেন। সে যে খুব ভালো লিখিয়াছিল তাহা নয়, কিন্তু তা বলিয়া একেবারে গোল্লা দেওয়া কি উচিত ছিল? হাজার হোক সে একখানা পুরা খাতা লিখিয়াছিল তো! তার পরিশ্রমের কি কোনো মূল্য নাই? ওই যে ত্রৈরাশিকের অঙ্কটা, সেটা তো তার প্রায় ঠিকই হইয়াছিল, কেবল একটুখানি হিসাবের ভুল হওয়ায় উত্তরটা ঠিক মেলে নাই। আর ওই যে একটা ডেসিমেল অঙ্ক ছিল, সেটাতে গুণ করিতে গিয়া সে ভাগ করিয়া বসিয়াছিল, তাই বলিয়া কি একটা নম্বরও দিতে নাই? আরও অন্যায় এই যে এই কথাটা মাস্টার মহাশয় ক্লাসের ছেলেদের কাছে ফাঁস করিয়া ফেলিয়াছেন। কেন? আর একবার হরিদাস যখন গোল্লা পাইয়াছিল, তখন সে কথাটা তো রাষ্ট্র হয় নাই?

সে যে ইতিহাসের এক শর মধ্যে পঁচিশ পাইয়াছে, সেটা বুঝি কিছু নয়? খালি অঙ্ক ভালো পারে নাই বলিয়াই তাহাকে লজ্জিত হইতে হইবে? সব বিষয়ে যে সকলকে ভালো পারিতে হইবে, তাহারই বা অর্থ কী? স্বয়ং নেপোলিয়ান যে ছেলেবেলায় ব্যাকরণে একেবারে আনাড়ি ছিলেন, সে বেলায় কী? তাহার এই যুক্তিতে ছেলেরা দমিল না এবং মাস্টারের কাছে এই তর্কটা তোলাতে তাঁহারাও যে যুক্তিটাকে খুব চমত্কার ভাবিলেন, এমন বোধ হইল না। তখন নন্দলাল বলিল, তাহার কপালই মন্দ—সে নাকি বরাবর তাহা দেখিয়া আসিয়াছে।

সেই তো যেবার ছুটির আগে তাহাদের পাড়ায় হাম দেখা দিয়াছিল, তখন বাড়িসুদ্ধ সকলেই হামে ভুগিয়া দিব্যি মজা করিয়া স্কুল কামাই করিল, কেবল বেচারা নন্দলালকেই নিয়মমতো প্রতিদিন স্কুলে হাজিরা দিতে হইয়াছিল। তারপর যেমন ছুটি আরম্ভ হইল, অমনি তাহাকে জ্বরে আর হামে ধরিল—ছুটির অর্ধেকটাই মাটি! সেই যেবার সে মামার বাড়ি গিয়াছিল, সেবার তাহার মামাতো ভাইয়েরা কেহ ছিল না—ছিলেন কোথাকার এক বদমেজাজি মেসো, তিনি উঠিতে–বসিতে কেবল ধমক আর শাসন ছাড়া আর কিছুই জানিতেন না। তাহার ওপর সেবার এমন বৃষ্টি হইয়াছিল, এক দিনও ভালো করিয়া খেলা জমিল না, কোথাও বেড়ানো গেল না। এই জন্য পরের বছর যখন আর সকলে মামার বাড়ি গেল, তখন সে কিছুতেই যাইতে চাহিল না। পরে শুনিল, সেবার নাকি সেখানে চমত্কার মেলা বসিয়াছিল, কোন রাজার দলের সঙ্গে পঁচিশটি হাতি আসিয়াছিল, আর বাজি যা পোড়ানো হইয়াছিল, সে একেবারে আশ্চর্য রকম! নন্দলালের ছোট ভাই যখন বারবার উত্সাহ করিয়া তাহার কাছে এই সকলের বর্ণনা করিতে লাগিল, তখন নন্দ তাহাকে এক চড় মারিয়া বলিল, ‘যা যা! মেলা বকবক করিসনে!’ তাহার কেবল মনে হইতে লাগিল, সেবার সে মামার বাড়ি গিয়াও ঠকিল, এবার না গিয়াও ঠকিল! তাহার মতো কপালমন্দ আর কেহ নাই।

স্কুলেও ঠিক তা-ই। সে অঙ্ক পারে না, অথচ অঙ্কের জন্য দু-একটা প্রাইজ আছে—এদিকে ভূগোল-ইতিহাস তাহার কণ্ঠস্থ, কিন্তু ওই দুইটার একটাতেও প্রাইজ নাই। অবশ্য সংস্কৃতেও সে নেহাত কাঁচা নয়, ধাতু প্রত্যয় বিভক্তি—সব চটপট মুখস্থ করিয়া ফেলে—চেষ্টা করিলে কি পড়ার বই আর অর্থ-পুস্তকটাকেও সড়োগড়ো করিতে পারে না? ক্লাসের মধ্যে ক্ষুদিরাম একটু-আধটু সংস্কৃত জানে, কিন্তু তাহা তো বেশি নয়। নন্দলাল ইচ্ছা করিলে কি তাহাকে হারাইতে পারে না? নন্দ জেদ করিয়া স্থির করিল, ‘একবার ক্ষুদিরামকে দেখে নেব। ছোকরা এ বছর সংস্কৃতের প্রাইজ পেয়ে ভারি দেমাক করছে, আবার অঙ্কের গোল্লার জন্য আমাকে খোঁটা দিতে এসেছিল। আচ্ছা, এবার দেখা যাবে।’

দেখিতে দেখিতে বছর কাটিয়া আসিলে, পরীক্ষার সময় প্রায় উপস্থিত। সকলে পড়ার কথা, পরীক্ষার কথা আর প্রাইজের কথা বলাবলি করিতেছে...

নন্দলাল কাহাকেও কিছু না জানাইয়া সেই দিন হইতেই বাড়িতে ভয়ানকভাবে পড়িতে শুরু করিল। ভোরে উঠিয়াই সে ‘হসতি হসত হসন্তি’শুরু করে, রাত্রেও ‘অস্তি গোদাবরী তীরে বিশাল শল্মলীতরু’ বলিয়া ঢুলিতে থাকে। কিন্তু ক্লাসের ছেলেরা এ কথার বিন্দুবিসর্গও জানে না। পণ্ডিত মহাশয় যখন ক্লাসে প্রশ্ন করেন, তখন মাঝে মাঝে উত্তর জানিয়াও সে চুপ করিয়া মাথা চুলকাইতে থাকে, এমনকি কখনো ইচ্ছা করিয়া দু-একটা ভুল বলে, পাছে ক্ষুদিরাম তাহার পড়ার খবর টের পাইয়া আরও বেশি করিয়া পড়ায় মন দিতে থাকে। তাহার ভুল উত্তর শুনিয়া ক্ষুদিরাম মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে, নন্দলাল তাহার কোনো জবাব দেয় না; কেবল ক্ষুদিরাম যখন নিজে এক-একটা ভুল করে, তখন সে মুচকি মুচকি হাসে, আর ভাবে, ‘পরীক্ষার সময় অমনি ভুল করলেই এবার ওকে সংস্কৃতের প্রাইজ আর পাইতে হবে না।’

ওদিকে ইতিহাসের ক্লাসে নন্দলালের প্রতিপত্তি কমিতে লাগিল। কারণ, ইতিহাস আর ভূগোল নাকি একরকম শিখিলেই পাস করা যায়—তাহার জন্য নন্দর কোনো ভবনা নাই। তাহার সমস্ত মনটা রহিয়াছে ওই সংস্কৃত পড়ার ওপরে, অর্থাৎ সংস্কৃত প্রাইজটার ওপরে! একদিন মাস্টার মহাশয় বলিলেন, ‘কী হে নন্দলাল, আজকাল বুঝি বাড়িতে কিছু পড়াশোনা করো না? সব বিষয়েই সে তোমার এমন দুর্দশা হচ্ছে, তার অর্থ কী?’ নন্দ আর একটু হইলেই বলিয়া ফেলিত, ‘আজ্ঞে সংস্কৃত পড়ি’ কিন্তু কথাটাকে হঠাৎ সামলাইয়া ‘আজ্ঞে সংস্কৃত, না সংস্কৃত নয়’ বলিয়াই সে থতমত খাইয়া গেল। ক্ষুদিরাম তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, ‘কই সংস্কৃতও তো কিছু পারে না।’ শুনিয়া ক্লাসসুদ্ধ ছেলে হাসিতে লাগিল। নন্দ একটু অপ্রস্তুত হইল বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল—ভাগ্যিস তাহার সংস্কৃত পড়ার কথাটা ফাঁস হইয়া যায় নাই।

দেখিতে দেখিতে বছর কাটিয়া আসিলে, পরীক্ষার সময় প্রায় উপস্থিত। সকলে পড়ার কথা, পরীক্ষার কথা আর প্রাইজের কথা বলাবলি করিতেছে, এমন সময় একজন জিজ্ঞাসা করিল, ‘কী হে! নন্দ এবার কোন প্রাইজটা নিচ্ছ?’ ক্ষুদিরাম নন্দর মতো গলা করিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘আজ্ঞে সংস্কৃত, না সংস্কৃত নয়।’ সকলে হাসিল, নন্দও খুব উত্সাহ করিয়া সেই হাসিতে যোগ দিল। মনে ভাবিল, ‘বাছাধন, এ হাসি আর তোমার মুখে বেশি দিন থাকছে না।’

যথাসময়ে পরীক্ষা আরম্ভ হইল এবং যথাসময়ে শেষ হইল। পরীক্ষার ফল জানিবার জন্য সকলে আগ্রহ করিয়া আছে, নন্দও রোজ নোটিশ বোর্ডে গিয়া দেখে, তাহার নামে সংস্কৃত প্রাইজ পাওয়ার কোনো বিজ্ঞাপন আছে কি না। তারপর একদিন হেডমাস্টার মহাশয় এক তাড়া কাগজ লইয়া ক্লাসে আসিলেন, আসিয়াই গম্ভীরভাবে বলিলেন, এবার দুই-একটা নতুন প্রাইজ হয়েছে আর অন্য বিষয়েও কোনো কোনো পরিবর্তন হইয়াছে। এই বলিয়া তিনি পরীক্ষার ফলাফল পড়িতে লাগিলেন। তাহাতে দেখা গেল, ইতিহাসের জন্য কে যেন একটা রুপার মেডেল দিয়াছেন। ক্ষুদিরাম ইতিহাসে প্রথম হইয়াছে, সে-ই ওই মেডেলটা লইবে। সংস্কৃতে নন্দ প্রথম, ক্ষুদিরাম দ্বিতীয়, কিন্তু এবার সংস্কৃতে কোনো প্রাইজ নাই।

হায় হায়! নন্দর অবস্থা তখন শোচনীয়! তাহার ইচ্ছা হইতেছিল সে ছুটিয়া গিয়া ক্ষুদিরামকে কয়েকটা ঘুষি লাগাইয়া দেয়। কে জানিত, এবার ইতিহাসের জন্য প্রাইজ থাকিবে, আর সংস্কৃতের জন্য থাকিবে না। ইতিহাসের মেডেলটা তো সে অনায়াসেই পাইতে পারিত। কিন্তু তাহার মনের কষ্ট কেহ বুঝিল না—সবাই বলিল, ‘বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে—কেমন করে ফাঁকি দিয়ে নম্বর পেয়েছে।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া নন্দ বলিল, ‘কপাল মন্দ!’