নাচুনে মূর্তি অভিযান

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

টেবিলের ওপর একটা কাগজ ছুড়ে দিয়ে হোমস বলল, ‘দেখো তো বুঝতে পারো কিনা?’

কাগজটা হাতে নিয়ে আমি অবাক। কতগুলো ছবি আঁকা। কিন্তু দেখে কিছুই বুঝলাম না। বললাম, ‘মনে তো হচ্ছে কোনো বাচ্চা ছেলের আঁকিবুঁকি।’

‘তোমার তা-ই মনে হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ। এর আর কোনো মানে আছে নাকি?’

‘সেটা জানতেই তো নরফোকের মিস্টার হিলটন কুবিট আজ সকালে ডাকে পাঠিয়েছেন ওটা। উনি পরের ট্রেনেই এখানে আসছেন। ওয়াটসন, ওই যে শোনো, কেউ একজন দরজায় বেল টিপেছেন।’

সিঁড়িতে ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকলেন লম্বামতন এক ভদ্রলোক। তাঁর দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। চোখ দুটো উজ্জ্বল নীল। পরিচয় পর্ব সেরে চেয়ারে বসতে গিয়ে মিস্টার হিলটনের চোখে পড়ল টেবিলে রাখা কাগজটায়। বললেন, ‘মিস্টার হোমস, ওগুলোর কোনো মানে বের করতে পারলেন?’

হোমস বলল, ‘বিষয়টা অদ্ভুত। প্রথমে দেখলে মনে হচ্ছে, কোনো ছেলের হাতে আঁকা আঁকিবুঁকি। এগুলোর কোনো মানে আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এগুলোকে আপনি এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?’

‘মিস্টার হোমস, আসলে আমি না, আমার স্ত্রী গুরুত্ব দিচ্ছে। এ কাগজটা পাওয়ার পর থেকে মুখে কিছুই না বলছে না। কিন্তু তার চেহারা দেখে বুঝতে পারছি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। সে কারণেই এর একটা ফয়সালা চাইছি।’

হোমস কাগজটা তুলে ধরল আলোতে। কাগজটা খাতা থেকে ছেঁড়া একটা পাতা। পেনসিলে আঁকা ছবিগুলো এমনভাবে সাজানো:

হোমস ছবিটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার পকেট বইয়ে যত্ন করে রেখে দিল। তারপর বলল, ‘রহস্যটা বেশ অভিনব। মিস্টার কুবিট, চিঠিতে কিছু কিছু বিষয়ে লিখেছিলেন আপনি। তা বিস্তারিত বললে ভালো হয়। তা ছাড়া আমার বন্ধু ওয়াটসনও এ বিষয়ে কিছুই জানে না।’

মিস্টার হিলটন হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘আমি ভালো বক্তা নই। গুছিয়ে বলার চেষ্টা করব, তারপরও খটকা লাগলে বলবেন।...আমার বিয়ে হয়েছিল গত বছর। আমি তেমন ধনী নই। নরফকের বিড়লিং থর্পে প্রায় ৫০০ বছর ধরে আমাদের পরিবারের বসবাস। তাই ওই অঞ্চলে আমাদের খুব মান্য করে লোকজন। পুরো নরফকে আমাদের নাম সবাই জানে। গত বছর লন্ডনে এক উৎসবে এসেছিলাম। উঠেছিলাম রাসেল হাউসের কাছে এক বোর্ডিংয়ে। সেখানে এলসি প্যাট্রিক নামে এক মার্কিন তরুণীও উঠেছিল। তার সঙ্গে আলাপের পর লন্ডনে থাকতে থাকতেই তাকে বিয়ে করি। হয়তো ভাববেন, এভাবে বিয়ে করাটা উচিত হয়নি। কিন্তু আপনি এলসির সঙ্গে কথা বললেই বুঝতে পারবেন, কেন তাকে বিয়ে করেছি। যদিও বিয়ের আগে এলসি আমাকে বারবার ভেবে দেখতে বলেছিল। বলেছিল, ওর সঙ্গে এমন সব লোকের পরিচয় ছিল, যারা মোটেও ভালো নয়। ওদের নাকি এলসি ভুলে যেতে চায়। আরও বলেছিল, ওকে বিয়ে করলে তোমাকে কখনোই লজ্জায় পড়তে হবে না। ওর অতীত নিয়ে কোনো দিন জানতে চাইতেও নিষেধ করেছিল এলসি। বিয়ের ঠিক আগের দিন এলসি এই কথাগুলো বলেছিল। সেদিন তার শর্ত মেনে নিয়েছিলাম আমি। সত্যি বলছি, আজ পর্যন্তও সে কথা রেখেছি আমি।

‘আমাদের বিয়ের বয়স এক বছর। ভালোই চলছিল। মাস খানেক আগে আমেরিকা থেকে এলসির নামে একটা চিঠি এল। চিঠিটা পেয়ে এলসি ভয়ে শক্ত হয়ে গেল। চিঠিটা পড়েই ফায়ার প্লেসের আগুনে ফেলে দিল সে। এ বিষয়ে সে কথাও বলেনি। আমিও জিজ্ঞেস করিনি। চিঠি পাওয়ার পর তাকে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে দেখেছি। আমাকে বিশ্বাস করে সব কথা খুলে বললে ভালো করত। এমনিতে এলসি খুব সত্যবাদী। ওর অতীতে যা ঘটেছে, তার জন্য আসলে সে দায়ী নয়। আমার বিশ্বাস, আমাদের বংশের গৌরবে কোনো ক্ষতি হওয়ার মত কোন কাজ করবে না এলসি।

‘সপ্তাহ খানেক আগে, মানে গত মঙ্গলবার লক্ষ করলাম, জানালার কাচে বেশ কিছু নাচুনে মানুষের ছবি আঁকা। ভাবলাম, আস্তাবলের ছেলেটির কাজ। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, সে এ কাজ করেনি। রাতে কেউ এসে এঁকে রেখে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। এলসিকে কথাটা জানাতেই সে খুবই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পরে অনুনয় করে আমাকে বলল, এমন ছবি নজরে এলে যেন তাকে দেখাই। ওর আচরণে আমি সত্যি অবাক হয়েছি। গতকাল সকালে বাগানে সূর্যঘড়ির কাছে একটা কাগজ পড়েছিল। কাগজটা এনে এলসিকে দেখাই। ওটা দেখেই এলসি অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর থেকেই সে এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে। ঠিক ওই সময় আপনাকে চিঠি লিখে তার সঙ্গে ওই কাগজটা পাঠিয়েছিলাম। এমন বিষয় নিয়ে পুলিশের কাছে গেলে হেসেই উড়িয়ে দেবে। তাই আপনার কাছে এসেছি। আগেই বলেছি, আমি তেমন ধনী নই। তবে আমার স্ত্রীর বিপদ হলে তাকে বাঁচাতে আমার সবটুকু খরচ করতে প্রস্তুত আছি।’

হোমস মন দিয়ে মিস্টার হিলটনের কথা শুনল। কিছুক্ষণ পর হোমস বলল, ‘মিস্টার কুবিট, আপনার কি মনে হয়, এ অবস্থায় আপনার স্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা দরকার? গোপন কথা যদি থেকে থাকে, তা জেনে নেওয়া ভালো।’

হিলটন কুবিট মাথা নাড়লেন। ‘মিস্টার হোমস, প্রতিজ্ঞা যখন করেছি, তখন ভাঙব না। স্বেচ্ছায় না বললে এলসিকে চাপ দেব না। তবে আমার কর্তব্য আমি ঠিক করব, সেটা করার অধিকার আমার আছে।’

‘মিস্টার কুবিট, আমি আপনাকে সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত। এখন বলুন, আপনাদের পাড়ায় ইদানিং নতুন কাউকে দেখেছেন কি না?’

‘আমাদের বিড়লিং থর্প গ্রামটি বেশ নির্জন। তাই নতুন কেউ এলে নিশ্চয়ই গ্রামের কারও চোখে পড়বেই। আর সে খবর চাপা থাকবে না। আমাদের গ্রাম থেকে অল্প কিছু দূরে কয়েকটি বাড়ি আছে। সেখানে মাঝেমধ্যে বাইরে থেকে লোক এসে থাকে।’, বললেন মিস্টার কুবিট।

‘ছবিগুলো দেখে মনে হায়ারোগ্লিফ। তার অর্থ, এর কোন মানে আছে। আর তা না হলে এর কোনো মানে বের করা যাবে না। নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতিতে আঁকা হয়ে থাকলে আমি এর অর্থ বের করতে পারব। কিন্তু এই কাগজের টুকরো লেখাগুলো খুবই ছোট ছোট, এর থেকে কোনো অর্থ বের করা যাবে না। আর আপনি যেসব তথ্য দিয়েছেন, তা যথেষ্ট নয়। আমার পরামর্শ, নরফকে ফিরে যান। আবার যদি এমন আঁকা পান, তাহলে হুবহু এঁকে নেবেন। জানালায় যে ছবি আঁকা ছিল, তার নকল যদি থাকত, তাহলে ভালো হতো। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করবেন, এলাকায় ইদানিং নতুন কাউকে দেখেছে কি না। নতুন তথ্য পেলে কিংবা কোন ঘটনা ঘটলেই সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন। সঙ্গে সঙ্গে আপনার ওখানে চলে যাব আমি।’, বলল হোমস।

মিস্টার হিলটন কুবিটের সঙ্গে কথা শেষে হোমস চুপচাপ হয়ে গেল। বেশ চিন্তিত থাকতে দেখলাম তাকে। এভাবে ১৫ দিন চলে গেল।

সেদিন বাইরে বের হব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক তখনই হোমস বলে উঠল, ‘ওয়াটসন, আজ বের না হয়ে ঘরেই থাকো।’

‘কেন?’

‘আজ সকালেই মিস্টার কুবিট টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন। ১টা ২০ মিনিটে তিনি লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশনে পৌঁছাবেন। টেলিগ্রাম পড়ে মনে হচ্ছে, বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে ওখানে।’

এর কিছুক্ষণ পরেই মিস্টার হিলটন আমাদের বাসায় চলে এলেন। দেখে মনে হলো, বেশ চিন্তিত তিনি। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ।

‘মিস্টার হোমস, বিষয়টা আমার নার্ভের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি করছে।’ কথা বলতে বলতে একটা চেয়ারে বসলেন তিনি। ‘অচেনা কিছু লোক আপনাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলছে—এমন চিন্তা মানুষকে অস্থির করে তুলবেই। তার ওপর যদি তাতে আপনার স্ত্রীকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে কী অবস্থা হতে পারে! এটা কি সহ্য করার মতো?’

‘আপনার স্ত্রী কি কিছু বলেছেন?’

‘না, কোনো কথাই বলছে না। অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। প্রসঙ্গ তুলেছি। কিন্তু পরমুহূর্তে প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছে সে।’

‘কিছু কিছু বিষয় তো আপনি নিজেই বলতে পেরেছেন।’

‘হ্যাঁ, পেরেছি। আমি আরও অনেকগুলো ছবি আঁকা কাগজ পেয়েছি। ওগুলো সঙ্গে এনেছি। আর এবার লোকটাকেও দেখতে পেয়েছি। লোকটা ছবি আঁকছিল, সে সময় দেখেছি। বাড়ির গুদামের দরজায় এক সারি ছবি দেখতে পাই। তার হুবহু নকল করে এনেছি।’ এক কপি কাগজ টেবিলের ওপর রাখলেন তিনি।

‘বেশ! বেশ!’ হোমস বলল, ‘এরপর কী হলো?’

‘নকল শেষে আমি মূল ছবিগুলো মুছে ফেললাম। কিন্তু ঠিক দুদিন পর আবার এক সারি ছবি দেখতে পেলাম। সেটার নকলও এনেছি। এই যে সেই নকল ছবি।’

ছবিগুলো দেখতে দেখতে হোমস বলল, ‘আমাদের হাতে অনেকগুলো তথ্য এসে গেছে।’

‘তিন দিন পর সূর্যঘড়ির ওপর একটা কাগজে আবার ছবি কুড়িয়ে পাই। এই কাগজটা পাওয়ার পর ঠিক করলাম লুকিয়ে থাকব, যাতে আঁকিয়েকে হাতেনাতে ধরতে পারি। রিভলবার হাতে বসার ঘরের জানালায় বসে রইলাম। রাত তখন দুটা বাজে। হঠাৎ আমার পেছনে পায়ের শব্দে ঘুরে তাকাই। দেখি, আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে। আমাকে শুয়ে পড়ার জন্য চাপ দিতে লাগল। বললাম, কে বা কারা আমাদের সঙ্গে বদমাইশি করছে, তা দেখতে চাই। স্ত্রী বলল, “ওটা নিশ্চয়ই কেউ দুষ্টুমি করছে। অত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।” কয়েক দিন বাইরে থেকে ঘুরে আসার প্রস্তাবও দিল সে। আমি বললাম, ওদের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব নাকি? এ সময় হঠাত্ দেখি, আমার স্ত্রীর চেহারা ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। ওর একটা হাত আমার কাঁধের ওপর ছিল, সেই হাত আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল।

‘ভালো করে তাকিয়ে দেখি, গুদামের দরজার সামনে কেউ একজন উবু হয়ে বসেছে। রিভলবার হাতে ছুটে যেতে চাইলাম। আমার স্ত্রী তখন আমাকে তার শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল। চেষ্টা করলাম নিজেকে ছাড়াতে। একপর্যায়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখি ছায়ামূর্তি নেই, উধাও। গুদামের দরজায় দেখলাম নাচুনে মানুষের ছবি। এই ছবি আমি আগেও দেখেছি। নকল করলাম। লোকটা আশপাশে কোথাও লুকিয়ে ছিল, কারণ পরদিন সকালে নতুন ছবি দেখতে পেলাম। ওই ছবিগুলো নকল করেছি, এই যে সেই ছবিগুলো।’

ছবিগুলো দেখে হোমস বলল, ‘এবার মনে হচ্ছে, আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।’

মিস্টার কুবিট আবার বলতে শুরু করলেন, ‘সে রাতে আমার স্ত্রীর ওপর আমি খুব রেগেছিলাম। ও যদি বাধা না দিত তাহলে তাকে ধরেই দেখতাম। এটা স্পষ্ট যে আমার স্ত্রী ওই লোকটাকে চেনে। আর এই আঁকাগুলোর মানেও বোঝে সে। আমার যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে সে খুব সতর্ক। আমি বাগানে পাহারাদার বসাতে চাই, আপনি কি বলেন?’

‘না, তার দরকার নেই। তাতে সমস্যা সমাধান হবে না। আপনি লন্ডন কত দিন থাকতে পারবেন?’

‘আজই ফিরে যেতে হবে। আমার স্ত্রীকে একা ফেলে আসা যাবে না।’

‘ঠিকই বলেছেন। আপনি ফিরে যান। আমরা আসছি আপনার ওখানে দু-এক দিনের ভেতর।

মিস্টার কুবিট চলে যাওয়ার পর ছবি আঁকা কাগজগুলো নিয়ে কয়েকদিন ধরে গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে গেল হোমস। একসময় চেয়ার ছেড়ে পায়চারি শুরু করল। একটা টেলিগ্রাম লিখল। উত্তর ডাকে আসতে দুদিন দেরি হলো। তাতে লেখা ছিল: ‘সব শান্ত। শুধু সকালে সূর্যঘড়ির গায়ে একটা নতুন ছবি পাওয়া গেছে। ছবিটা বেশ বড়।’ ছবির নকলটাও সঙ্গে ছিল।

হোমস মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল, বিষয়টা অনেকদূর গেছে। ওয়াটসন কাল সকালে প্রথম ট্রেনেই নর্থ ডায়ালনামে যাওয়ার ট্রেন ধরব। আর দেরি করা ঠিক হবে না।’

নর্থ ওয়ালসাম স্টেশনে নামার পর পরই হঠাৎ স্টেশনমাস্টার এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি লন্ডন থেকে আসা ডিটেকটিভ?’

‘কেন জানতে চাইছেন?’ হোমস জিজ্ঞেস করল।

‘নরউইকের পুলিশ ইন্সপেক্টর মার্টিন অল্পক্ষণ আগে এখান দিয়ে গেলেন। আপনারা কি ডাক্তার? শুনেছি ভদ্রমহিলা এখনো বেঁচে আছেন। আপনারা তাড়াতাড়ি গেলে হয়তো বাঁচাতে পারবেন। তারপরও ফাঁসির দড়ি থেকে তাকে বাঁচাতে পারবেন কি না সন্দেহ।’

উদ্বেগের সঙ্গে হোমস জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে বলুন তো?’

স্টেশনমাস্টার বলল, ‘রিডলিং থর্প ম্যানের মিস্টার হিলটন আর তাঁর স্ত্রী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বাড়ির লোকেরা বলছে প্রথমে স্ত্রী স্বামীকে গুলি করে নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। মিস্টার কুবিট মারা গেছেন, তবে মিসেস কুবিটের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’

হোমস কথা না বাড়িয়ে একটা ভাড়া গাড়িতে উঠে বসল। স্টেশন থেকে রিডলিং থর্প সাত মাইলের পথ। একসময় গাড়ি রিডলিং থর্প ম্যানের হাউসে এসে থামল। গাড়ি থেকে নামতেই গুদামঘরের দরজা চোখে পড়ল। একটু দূরে সূর্যঘড়িটাও দেখা গেল। আমরা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা গাড়ি এসে থামল। একজন বেঁটেমতো ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামলেন। তিনি নরফোক পুলিশ স্টেশনের ইন্সপেক্টর মার্টিন। হোমসের সঙ্গে পরিচিত হতেই তিনি বিস্ময়ে থ। বললেন, ‘কীভাবে সম্ভব? খুন হয়েছে ভোর তিনটায় আর আপনি লন্ডনে বসে খবর পেয়ে গেলেন! কী করে? এত দ্রুত হাজিরই বা হলেন কী করে?’

‘আমি এমনটাই আশঙ্কা করেছিলাম। সেটা যাতে না ঘটে তাই সকালেই রওনা দিয়েছি।’

‘তাহলে তো আপনি ভেতরের খবর কিছু জানেন। যতদূর জানি, দুজনই আদর্শ স্বামী-স্ত্রী ছিলেন।’

হোমস বলল, ‘এখন পর্যন্ত শুধু একটাই প্রমাণ পেয়েছি আমি। সেটা পরে বুঝিয়ে বলব। এখন বলুন আপনি কি রহস্য সমাধানে আমাকে সহযোগিতা করবেন, নাকি আলাদাভাবে তদন্ত করবেন?’

‘আপনার সঙ্গে তদন্ত করতে পারলে নিজেকে সম্মানিত মনে করব।’ ইন্সপেক্টর মার্টিন বলল।

‘তাহলে চলুন দেরি না করে কাজে নেমে পড়ি।’ হোমস বলল।

ইন্সপেক্টর মার্টিন হোমসের কোনো কাজে বাধা দিচ্ছিল না। মিসেস কুবিটকে যে ডাক্তার দেখেছেন তিনি জানালেন, ‘ভদ্রমহিলার আঘাত গুরুতর, তবে আশঙ্কামুক্ত। বুলেট মাথার সামনে ছুঁয়ে গেছে। জ্ঞান ফিরতে একটু দেরি হবে।’ তিনি এও জানালেন, গুলিটা খুব সামনে থেকে করা হয়েছে। বাড়িতে ছিল একটা পিস্তল, তা থেকে দুটো গুলি ছোড়া হয়েছে। একটা বুলেট মিস্টার কুবিটের হৃদপিণ্ডে সরাসরি লাগে। পিস্তলটা দুজনের দেহের মাঝখানে পড়ে ছিল।

হোমস জিজ্ঞেস করল, ‘মিস্টার কুবিটের মৃতদেহ কি সরানো হয়েছে?’

‘মিসেস কুবিট ছাড়া আর কিছু সরানো হয়নি।’

‘আপনি কখন এসেছেন?’ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল হোমস।

‘ভোর চারটায়’

‘আর কেউ এসেছিল?’

‘একজন কনস্টেবল।’

কনস্টেবলকে হোমস জিজ্ঞেস করল, কোনো কিছু হাত দিয়েছে কি না।

‘না।’

‘আপনি জানলেন কী করে?’

‘বাড়ির কাজের মেয়ে সন্ডার্স জানিয়েছে।’

‘তারা কোথায়?’

‘রান্নাঘরে।’

আমরা পুরোনো হলঘরে গেলাম। মহিলা দুজনকে আনা হলো। একজনের নাম মিসেস কিং অন্যজন সন্ডার্স। সহজভাবেই বলে গেল দুজনে। প্রচণ্ড শব্দে ওদের ঘুম ভাঙে। প্রথম শব্দটা হওয়ার এক মিনিট পর আরেকটি শব্দ হয়। ওরা দুজনই পাশাপাশি ঘরে শোয়। দুজনই দৌড়ে নিচে নেমে এসে দেখে, স্টাডি রুমের দরজা খোলা। টেবিলে মোমবাতি জ্বলছিল। মিস্টার কুবিট ঘরের মাঝে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। জানালার কাছে মিসেস কুবিট দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ছিলেন। আহত এবং বেশ হাঁপাচ্ছিলেন। কথা বলতে পারছিলেন না। মুখের একপাশ রক্তে ভেসে গেছে। ঘরের ভেতর ধোঁয়ায় ভর্তি। বারান্দার জানালার ছিটকিনি ভেতর থেকে লাগানো। ওরাই ডাক্তার আর পুলিশকে খবর পাঠিয়েছিল। বাড়ির অন্যদের ডেকে তারা মিসেস কুবিটকে ধরাধরি করে তাঁর ঘরে নিয়ে যায়।

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

তাঁরা আরও জানান, মিস্টার আর মিসেস কুবিট দুজনই রাতে বিছানায় শুয়েছিলেন। কারণ, দুজনেরই পরনে রাতের পোশাক ছিল। দুজনের ভেতর ঝগড়া হতে তারা দেখেনি। ইন্সপেক্টর মার্টিনের এক প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল, বাড়ির সবগুলো দরজা বন্ধ ছিল। তার মানে বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। হোমসের প্রশ্নের উত্তরে ওরা জানাল, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বারুদের গন্ধ পেয়েছিল। স্টাডি রুমে ঢুকতেই মিস্টার কুবিটের মৃতদেহটা চোখে পড়ল। গুলিটা তাঁর হৃদপিণ্ডে সরাসরি লেগেছে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।

হোমস জানতে চাইল, ‘মিসেস কুবিটের শরীরে যে গুলিটা আঘাত করেছিল, সেটা কি আপনি পেয়েছেন?’

‘জটিল এক অপারেশন করে ওটা বের করতে হবে। পিস্তলে চারটা গুলি ছিল। নিশ্চয়ই মাত্র দুটো খরচ হয়েছে।’

‘তা ঠিক, কিন্তু জানালার যে গুলিটা লেগে আছে ওটা ওখানে কী করে গেল?’ হোমস ঘুরে জানালার দিকে আঙুল তুলে দেখাল জানালার নিচের চৌকাঠে একটা বুলেটের গর্ত।

ডাক্তার বললেন, ‘তার মানে তৃতীয় একটা গুলি ছোড়া হয়েছে। অর্থাৎ তৃতীয় একজন ব্যক্তির উপস্থিতি এখানে ছিল। প্রশ্ন হলো, লোকটা কে আর পালাল কী করে?’

‘এই উত্তরটাই বের করতে হবে,’ হোমস বলল। ‘আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বাড়ির মেয়ে দুজন বলেছিল, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বারুদের গন্ধ পেয়েছিল ওরা। তাতে বোঝা যাচ্ছে, ঘরের জানালা ও দরজা দুটোই খোলা ছিল। নইলে বারুদের গন্ধ এত দ্রুত বাড়ির ভেতর ছড়াত না। খুবই অল্প সময়ের জন্য জানালা দরজা খোলা ছিল। দেখুন, ঘরের মোমবাতিটি গলেনি এখনো। যে সময় গোলাগুলি হচ্ছিল তখন জানালাটি খোলা ছিল। তৃতীয় ব্যক্তি জানালার বাইরে ছিল এবং সেখান থেকে গুলি ছোড়ে। সেই লোকটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে সেই গুলি জানালায় আঘাত করার আশা বেশি। এটাই খুঁজছিলাম।’

ইন্সপেক্টর বলল, ‘জানালাটা তাহলে বন্ধ হলো কী করে?’

‘মহিলাদের স্বভাব হলো জানালা দরজা বন্ধ করা। কিন্তু ওটা কী?’

টেবিলের ওপর একটা মহিলাদের হাতব্যাগ পড়েছিল। ব্যাগের ভেতর কুড়িটা পঞ্চাশ পাউন্ডের নোট পাওয়া গেল। আর কিছু ছিল না। ইন্সপেক্টরের হাতে ব্যাগ আর টাকা তুলে দিয়ে যত্ন করে রাখতে বলল হোমস। আরও বলল, ‘এবার তৃতীয় বুলেটটার খোঁজ করা দরকার। যেভাবে কাঠ উঠে গেছে তাতে বোঝা যায় ভেতর থেকে চালানো হয়েছে। আচ্ছা মিসেস কিং, যে প্রচণ্ড শব্দে আপনার ঘুম ভাঙে দ্বিতীয় শব্দটা কি প্রথমটার চেয়ে বেশি ছিল?’

‘না তা বলা যায় না।’

‘ইন্সপেক্টর এখানে আর জানার কিছু নেই। এবার বাইরে বাগানে চলুন। সেখানে কিছু পাওয়া যেতে পারে। স্টাডি রুমের জানালার নিচে ফুলগাছ। সেখানে নরম মাটিতে পায়ের ছাপ। হোমস তন্ন তন্ন করে বাগানটা খুঁজে দেখল। একসময় খুশি মনে একটা পোড়া লম্বা জিনিস শিস দিতে দিতে তুলে নিল। বলল, ‘পিস্তলের সঙ্গে ইজেক্টর লাগানো ছিল। এটাই তিন নম্বর বুলেট। ইন্সপেক্টর আমাদের তদন্ত শেষ।’

‘কাকে সন্দেহ করছেন?’

‘পরে বলব সেটা। আপনি অনেক কিছুই এখনো জানেন না। রহস্য সমাধানের সূত্র আমার হাতে। মিসেস কুবিটের জ্ঞান না এলেও কাল রাতে কী কী ঘটেছে আমি প্রমাণ করতে পারব। এখানে এলরিজেস নামে কোনো হোটেল আছে?’

বাড়ির কেউ বলতে পারল না। তবে আস্তাবলের ছেলেটি বলল, ইস্ট রাস্টনে ওই নামে একজন চাষি আছে।

হোমস জানতে চাইল, ‘কাল রাতে এখানে যা যা ঘটেছে তার খবর নিশ্চয়ই ওখানে পৌঁছায়নি?

‘সম্ভবত না।’

হোমস কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবল। বলল, ‘শোনো, আস্তাবলে গিয়ে একটা ঘোড়ায় জিন পরিয়ে আসো। একটা চিঠি এখনি এলরিজদের বাড়িতে পৌঁছুতে হবে।’ হোমস স্টাডি রুমের টেবিলের ওপর নৃত্যের ছবির কাগজগুলো বের করে ছড়িয়ে রেখে কিছু একটা করল। ছেলেটাকে বলে দিল যার নাম লেখা আছে খামে, তার কাছেই দিতে হবে। কারও কোনো প্রশ্নের উত্তর যেন না দেয়।

তারপর হোমস ইন্সপেক্টরকে বলল, ‘আপনি হেড অফিসে খবর পাঠিয়ে শক্ত সমর্থ কনস্টেবল আনুন। আপনার আসামি কিন্তু ভয়ংকর প্রকৃতির। আস্তাবলের ছেলেটার হাতেই একটা টেলিগ্রাম দিয়ে দিন।’

ছেলেটা চলে যাওয়ার পর বাড়ির সবাইকে ডেকে হোমস বলল, ‘কেউ যদি এসে মিসেস কুবিটের খোঁজ করে, তাকে তার আঘাতের কথা বলার দরকার নেই। সরাসরি তাকে বসার ঘরে নিয়ে বসাতে হবে।’

এরপর আমাদের সবাইকে নিয়ে বসার ঘরে এল। ডাক্তার তার রোগী দেখার দরকার তাই চলে গেল।

হোমস বলল, ‘ইন্সপেক্টর আপনাকে পুরো বিষয়টা খুলে বলছি। মিস্টার হিলটন কুবিটের সঙ্গে আমার কীভাবে পরিচয় হলো তা আপনার জানা দরকার। আমার সামনে দেখতে পাচ্ছেন ছবি আঁকা সেই কাগজগুলো। এগুলোকে বাচ্চা ছেলেদের আঁকা হিসেবে ফেলে দেওয়া যেতে পারত। কিন্তু ছবির ভেতর একটি দুর্ঘটনার পূর্বাভাস ছিল। বিশ্বের যত গুপ্তলিপি আছে তার বেশির ভাগই আমার জানা আছে। এই লিপি যারা সৃষ্টি করেছে, তারা চায় সাধারণ মানুষ ভাবুক, এগুলো বাচ্চাদের কাজ। কিন্তু এর ভেতরেই লুকানো অনেক অর্থ। কিন্তু যখন বুঝলাম এগুলো গুপ্তলিপি তখন পাঠোদ্ধার করতে দেরি হয়নি।

এই ছবিটির মানে হলো ইংরেজি E হরফ। প্রথম ছবিতে বারবার এই ছবিটা আছে। তাই আমি ধরে নিলাম এটা E অক্ষর। কোনো কোনো ছবিতে দেখা গেছে, লোকটা পতাকা হাতে আবার কোনেটাতে নেই। পতাকা ছবিটি মানে হলো ফুলস্টপ। লাইন শেষ হওয়ার পর ওটা আসছে। কিন্তু ভেজালটা শুরু হলো এর পরেই। এরপর হলো T, A, O, I, N, S, H, R, D L চিন্তাভাবনা করে কিছুই বের করতে পারলাম না। নতুন ছবির অপেক্ষায় রইলাম। দ্বিতীয়বার দেখায় মিস্টার হিলটন কাগজ দিলেন দুটো। একটা দিলেন যাতে ছিল মাত্র একটি শব্দ। এখানে কোনো পতাকা ব্যবহার করা হয়নি। এখানে পাঁচটি অক্ষরের ভেতর দ্বিতীয়টি এবং চতুর্থ অক্ষরটি ঊ হলো। শব্দটা হতে পারে NEVER LEVER কিংবা SEVEN। আবার অন্য কিছুও হতে পারে। বুঝতে পারলাম এটা কোনো আবেদনের জবাব ছিল। আমার মনে হলো এটা মিসেস কুবিট লিখেছেন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ওই তিনটি ছবি হলো N, V, R।

এখানে এসে আটকে গেলাম। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এল, তার ফলে বেশ কিছু অক্ষর উদ্ধার করতে পারলাম। যদি কোনো মহিলাকে বার্তা পাঠানো হয়, তাহলে দুটো E-এর মাঝে খঝও থাকার কথা। খোঁজা শুরু করলাম পেয়েও গেলাম। চারটা কাগজ ঘেঁটে দেখলাম ELSIE-এর আগে একটা মাত্র শব্দ আছে, সেই শব্দের শেষ অক্ষরটা হলো E। তাহলে এটা হবে COME। CO এবং M তিনটি অক্ষর পড়ার পরই প্রথম যে চিত্রলিপিটা পেয়েছি সেটা পড়ার চেষ্টা করলাম। তাতে লেখা ছিল M.ERF. E. SL. NE। এখানে প্রথম অক্ষরটা অ হতে পারে। এই অক্ষর লিপিটিতে তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয় শব্দের প্রথম অক্ষরটা ঐ হবে বলে মনে হলো। তাহলে চিত্রলিপির একটা মানে দাঁড়ায়, ‘AM HERE A.E. SLANE। SLANE-এর শেষ অক্ষরটি মনে হয় Y হবে। এবার দেখুন কী দাঁড়াল AM HERE A.E. SLANEY। আমি ওটাকে দাঁড় করালাম AM HERE ABE SLAHEY। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল ওটা পাঠোদ্ধারের পরে। এরপর দ্বিতীয় চিত্রলিপিটি পড়লাম। তাতে লেখা ছিল A.ELRI.ES। ফাঁকা জায়গায় দুটো অক্ষর বসালে একটা মানে দাঁড়ায়। অক্ষর দুটো হলো T আর G । AT ELRIG ES। আমার কাছে মনে হয়েছে চিত্রলিপি লেখক কোনো জায়গার নাম বলেছে। আর একটা বিষয় আমার কাছে মনে হয়েছে। এই ABE SLANEY লোকটা আমেরিকান। আমার কাছে আরও মনে হলো এখানে নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ জড়িয়ে আছে। কারণ, মিসেস কুবিট তার স্বামীকে অতীত জীবনের কথা বলতে চায়নি। আমি তখনি নিউইয়র্কে আমার বন্ধু পুলিশ অফিসার উইলসন হারগ্রিভকে টেলিগ্রাম পাঠালাম। ফিরতি বার্তায় সে জানাল যে, ‘অ্যাবে ম্লেনি শিকাগোর একজন বড় ধরনের অপরাধী’। যেদিন বার্তাটি পাই সেই মিস্টার কুবিট আমাকে শেষ চিত্রলিপিটা দিয়ে যান। একই পদ্ধতি ব্যবহার করে বের করলাম, ELSIE, RG. ARE TO MEET THY GO. এখানে P এবং D শূন্য জায়গায় বসালেই লিপির বার্তা সম্পূর্ণ হয়। বোঝা গেল বদমাশটা ভয় দেখিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাইছে। শিকাগোর অপরাধীরা দ্রুত কাজ সারে। ম্লেনিও দেরি করবে না বুঝতে পেরে আমি আর ওয়াটসন নরফোকে চলে আসি। কিন্তু আমাদের আসার আগে দুর্ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেছে।’

ইন্সপেক্টর মার্টিন সব শুনে বলল, ‘এমন একটি রহস্য উদ্ঘাটনে আপনার সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। কয়েকটা প্রশ্ন করব, রাগ করবেন না। আমাকে ওপরওয়ালার কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এখন এই অপরাধী যদি পালিয়ে যায় তাহলে আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না ওপরওয়ালারা।’

‘ভয় পাবেন না, ও পালাবে না।’

‘বুঝলেন কী করে?’

‘পালালেই তো প্রমাণিত হয়ে যাবে ও অপরাধী।’

‘ওকে গ্রেপ্তার করে ফেললেই সব ঝামেলা শেষ।’

‘ও এখনি এখানে আসবে।’

‘এখানে? মানে বুঝতে পারলাম না মিস্টার হোমস। আপনার চিঠি পেয়ে ও পালাবে।’

‘না আমি ওর টোপটা বুঝতে পেরেছি। আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে স্লেনি আসছে।’

দেখা গেল একজন লম্বা লোক সামনে রাস্তা দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। দেখতে সুদর্শন। রং গাঢ়। ছাই রঙের প্যান্ট পরনে। পাজামা-টুপি পরা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে। খাড়া নাক। লোকটার হাতে একটা মোটা লাঠি। বেল টিপল।

হোমস বলল, ‘দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ুন। ওর সঙ্গে আমি কথা বলব। ইন্সপেক্টর হ্যান্ডকাফ রেডি রাখুন।’

ঘরে ঢুকল অ্যাবে স্লেনি। হোমস নিমেষেই ওর মাথায় পিস্তলটা ঠেকাতেই ইন্সপেক্টর মার্টিন হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলেন। লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব কাজ শেষ। একটু স্থির থেকে অট্টহাসি দিয়ে হেসে উঠল।

এবার সত্যি সত্যি আমাকে বোকা বানালেন। কিন্তু আমি তো মিসেস কুবিটের চিঠি পেয়েই এসেছি। তিনি যে আমাকে ওভাবে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেছেন বললে বিশ্বাস করব না।’

‘তিনি গুরুতর আহত। বাঁচবেন কি না সন্দেহ আছে।’

লোকটা প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘ভুল বলছেন। মিস্টার কুবিট আহত হয়েছেন, মিসেস কুবিটের কিছুই হয়নি।

হোমস বলল, ‘তাঁর স্বামী মৃতদেহের পাশেই তিনি পড়েছিলেন। তিনি বাজে রকমের আঘাত পেয়েছেন।’

হতাশ হয়ে লোকটা সোফায় বসে পড়ল। হ্যান্ডকাফ পরা হাতে মুখ গুঁজে রেখে বসে রইল নীরবে। তারপর বলতে শুরু করল সে নিজেই।

‘গোপন করার কিছুই নেই। আমাকে কেউ গুলি করলে আত্মরক্ষার জন্য আমি গুলি ছুড়লে, সেটা আইনত কোনো অপরাধ নয়। আপনারা যদি ভেবে থাকেন আমি মহিলাকে কষ্ট দিয়েছি, তাহলে বলব আপনারা আমাকে চেনেন না। ওর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ছিল। এই মিস্টার কুবিট লোকটা আমাদের মাঝে এসে পড়ল। আমার সঙ্গে এলিসের বিয়ে ঠিক হয়েছিল বলেই আমি ওকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম।’

হোমস বলল, ‘আপনার ভয়ে মিসেস কুবিট ইংল্যান্ডে পালিয়ে আসেন। এখানে বিয়ে করে সুখেই ছিলেন। আপনি ওর জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। তিনি তাঁর স্বামীকে খুব ভালোবাসতেন। আপনি একজনকে হত্যা করেছেন আর একজনকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন। মিস্টার অ্যাবে স্লেনি এর জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতেই হবে।’

‘এলসি মারা গেলে আমার যাই হোক না কেন কিছু যায় আসে না।’ স্লেনি নিজের মনেই কথাগুলো বলল। তারপর হাতের মুঠোয় দোমড়ানো কাগজের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে বোকা বানাতে চাইছেন মনে হয়। এলসি যদি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে থাকে তাহলে এ চিঠিটা লিখল কী করে?

‘আপনাকে ওখানে আনতেই ওই চিঠিটা আমিই লিখেছি।’ হোমস বলল।

‘আপনি? আমাদের দলের বাইরে এই গুপ্তলিপির কথা কেউ জানে না।’

‘একজন মানুষ মাথা খাটিয়ে গুপ্তলিপি বের করতে পারলে আরেকজন সেটা উদ্ধার করতে পারবে না কেন? সে যাই হোক, মিস্টার স্লেনি, আপনাকে নিতে নরফোক থেকে গাড়ি এসেছে। জীবনে অনেক অপরাধ করেছেন এবার একটা ভালো কাজ করুন। যাবার আগে বলে যান, মিসেস কুবিট যা কিছু ঘটেছে এর জন্য দায়ী নন।’

‘নিশ্চিত থাকুন সত্যই বলব’ স্লেনি বলল।

ইন্সপেক্টর মার্টিন বললেন, ‘আপনি যা কিছু বলবেন সবই আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে দাখিল হবে।’

‘এলসিকে সেই ছোটবেলা থেকেই চিনি। ওর বাবার নাম প্যাট্রিক। তার একটা সাতজনের দল ছিল। প্যাট্রিক মাথা খাটিয়ে এই গুপ্তলিপিটা বের করে। আমাদের কাজের খবর এলসি রাখত। আমাদের কাজগুলো তার ভালো লাগত না। এলসির কাছে সৎপথে আয় করা টাকা ছিল। সেই টাকা নিয়ে সে ইংল্যান্ডে চলে আসে। আমি যদি সৎভাবে রোজগার করতাম তাহলে এলসি হয়তো আমাকে বিয়ে করত। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি ও গেলটা কোথায়। ওই ইংলিশম্যানকে বিয়ে করার পর আমি এলসির খোঁজ পাই। চিঠি লিখি। কিন্তু উত্তর দেয়নি। তারপর আসি এখানে। চিঠিতে যখন কোনো কাজ হচ্ছে না তখন গুপ্তলিপিতে লেখা শুরু করলাম। মাস খানেক হয় আমি এখানে আছি। প্রতি রাতে ভাড়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতাম। কিন্তু এলসির সামনাসামনি যোগাযোগটা হচ্ছিল না। আমার গুপ্তলিপি যে ওর চোখে পড়েছে তাতে সন্দেহ ছিল না। কারণ, একটা চিঠির জবাব সে দিয়েছিল। চিঠি পড়ে আমার মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছিল। তারপর তাকে শাসাতে লাগলাম শেষ পর্যন্ত সে মিনতি করে একটা চিঠি লিখল। আমাকে এখান থেকে চলে যেতে অনুরোধ করল। এলসি বলল, রাতে ওর স্বামী ঘুমিয়ে পড়লে ও আমার সঙ্গে দেখা করবে। ও এসে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বলল চলে যেতে। আমি রেগে ওর হাত ধরে টান দিলাম। ঠিক তখনই ওর স্বামী এসে হাজির। এলসি মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল আর ওর স্বামীর হাতে পিস্তল দেখতে পেলাম। ওর স্বামীকে ভয় দেখাতে পিস্তল তাক করলাম। আমাকে লক্ষ করে গুলি করে, আমি পাল্টা গুলি করি। আমারটা ওর গায়ে লেগেছিল। কিন্তু আমাকে গুলি করতে ব্যর্থ হয় সে। তারপর আজ ছেলেটার হাতে চিঠিটা পেয়ে খুশিতে এখানে এলাম। আর আপনারা আমাকে ধরে ফেললেন।’

ইন্সপেক্টর মার্টিন বললেন, ‘এবার থানায় যেতে হবে।’

‘যাওয়ার আগে কি ওর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?’

‘না উনি অজ্ঞান হয়ে আছেন। মিস্টার হোমস আশা করি এ জটিল তদন্তে আপনার সাহায্য পাব।’

গাড়িটা স্লেনিকে নিয়ে চলে গেল। হোমস স্লেনিকে দেওয়া সেই গুপ্তলিপিটা টেবিলের ওপর বিছিয়ে ওয়াটসনকে বলল, ‘দেখো তো চিঠিটার পাঠোদ্ধার করতে পারো কি না। আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিলাম সেভাবে পড়লে দাঁড়ায় COME HERE AT ONCE। চলো এবার যাওয়া যাক। তিনটা চল্লিশের ট্রেনটা ধরতে পারলে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাব।

শেষ করার আগে জানিয়ে দিই। স্লেনির ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ওদিকে মিসেস কুবিট সুস্থ হয়ে ওঠেন খুব দ্রুত। তিনি আর বিয়ে করেননি। স্বামীর স্টেটে থাকেন আর গরিব মানুষের সাহায্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।