নিখোঁজ

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

ঘটনাটা চোখের পলকে ঘটে গেছে।

ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স কংগ্রেস থেকে বের হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন বিজ্ঞানী গওহর মাহফুজ। সঙ্গে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী দুজন দেহরক্ষীও ছিল। হুট করে ভোজবাজির মতো কোথা থেকে যেন একটা কালো রঙের শেভরোলেট ভ্যান হাজির হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই দেহরক্ষীর কপালে পিস্তল ঠুকে দিয়ে গওহর মাহফুজকে উঠিয়ে নিয়ে গেল ওরা।

এরপর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এখনো হদিস মেলেনি তাঁর।

‘ধ্যাৎ’। স্পেশাল ব্রাঞ্চের তরুণ অফিসার আদনান হাতের ফাইলটা এত জোরে টেবিলের ওপর ফেললেন, ফাইলটার প্রাণ থাকলে নিশ্চয়ই সেটা ‘আউচ’ বলে চিৎকার করে উঠত। ‘স্যারকে আগেই বলেছিলাম, এই সময় ব্রাজিল যাওয়াটা আপনার জন্য নিরাপদ না। কথা শুনলেন না।’ আদনানের গলায় বিরক্তি আর রাগের মিশেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে গওহরের ছাত্র ছিলেন আদনান, স্যারের প্রতি আলাদা টান আছে তাঁর।

গত মাসে একটা ফর্মুলা আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছিলেন অধ্যাপক গওহর। বলেছিলেন, ‘আমার ফর্মুলা পৃথিবী বদলে দেবে! ’ মুশকিল হলো, তাঁর এই আবিষ্কার যতটা উপকারী, ততটাই ভয়ানক। এটা ব্যবহার করে ক্যানসারের প্রতিষেধক আবিষ্কার করা সম্ভব। আবার একই ফর্মুলায় এমন ড্রাগও তৈরি হতে পারে, যার মাধ্যমে মানুষের অনুভূতি ‘খুন’ করে ফেলা যায়। ভালোবাসা, রাগ, ভয়, কষ্টের অনুভূতিহীন এক নিষ্ঠুর মানুষ! ভাবা যায়? কোনো দেশের সেনাবাহিনী কিংবা জঙ্গিগোষ্ঠী যদি এর অপব্যবহার করতে চায়, পরিণাম হবে ভয়াবহ।

এমন একটা কিছু যে ঘটতে পারে, সেই তথ্য অবশ্য ইন্টেলিজেন্সের কাছে আগেই ছিল। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানী গওহর মাহফুজের শরীরের ভেতর ছোট্ট একটা ট্র্যাকিং ডিভাইস বসানো আছে। ব্রাজিলের ইন্টেলিজেন্স বলছে, অপহরণের পরপরই তাঁকে অন্য কোনো দেশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কোন দেশ, সে ব্যাপারে তাঁদের কোনো ধারণাই নেই। এখন গওহর যেখানে আছেন, তার কাছাকাছি কোনো একটা লোকেশন না জানা পর্যন্ত কিছুই করা যাচ্ছে না। তিনি যে শক্তিশালী একটা চক্রের হাতে পড়েছেন, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, আফ্রিকা, এমনকি এশিয়ার যেকোনো দেশেই তাঁকে বন্দী করে রাখা হতে পারে।

আদনান আর তাঁর পুরো দল যখন বসে থেকে থেকে প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছে, ঠিক তখনই ফোনটা এল। কাউকে কিছু বলে দিতে হলো না। কল ট্র্যাকিং, ভয়েস অ্যানালাইসিসের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের এক ডজন আইটি বিশেষজ্ঞ।

ফোনের ওপাশে প্রায় তিন সেকেন্ডের ‘দীর্ঘ’ নীরবতা। এরপর হঠাৎই একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘শুভ দুপুর। আপনারা নিশ্চয়ই জেনে আনন্দিত হবেন, গওহর মাহফুজ আমাদের সঙ্গেই আছেন। কে কথা বলছেন জানতে পারি?’

‘আদনান হাফিজ। অফিসার, স্পেশাল ব্রাঞ্চ।’ ঠান্ডা গলায় বললেন আদনান।

‘বাহ্, বেশ বেশ। আপনারা যে এরই মধ্যে গওহর মাহফুজের বাসার কেয়ারটেকারের দায়িত্ব নিয়েছেন, জেনে ভালো লাগছে। তা আদনান সাহেব, আপনার পাশে বসে যেই ছাগলগুলো অযথাই কল ট্র্যাক করার চেষ্টা করে করে ক্লান্ত হচ্ছে, তাদের থামতে বলুন। লাভ নেই।’

‘তা-ই নাকি? অবাক কাণ্ড! ছাগলের পাল যদি আমার পাশেই থাকে, ভ্যা ভ্যা ডাকটা ফোনের ওপাশ থেকে শুনতে পাচ্ছি কেন?’ এমন গুরুতর মুহূর্তেও কড়া গলায় পাল্টা জবাব দিলেন আদনান।

‘কাজের কথায় আসি?’

‘নিশ্চয়ই। তার আগে গওহর মাহফুজের কণ্ঠস্বরটা শুনতে চাই।’

ওপাশে আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। সম্ভবত নিজেদের মধ্যে খানিকটা আলাপ করে নিল ওরা। তারপর বলল, ‘আমরা কী চাই, কীভাবে চাই, সেটা কাল জানাব। আপাতত ফোনটা মিসেস মাহফুজকে দিন। গওহর মাহফুজ আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন না।’

আনিকা নাওয়ার, মানে মিসেস মাহফুজ পাশেই ছিলেন। এমন বিপাকে পড়েও বেশ শক্ত আছেন তিনি। স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘হ্যালো।’

‘হ্যালো।’

ফোনের ওপাশে স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না আনিকা। কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

গওহর মাহফুজ বললেন, ‘আমি এখানে ভালো নেই আনিকা। বারবার তোমার কথা মনে পড়ে। রিয়ার কথা মনে পড়ে। রাতে বিছানায় শুয়ে আমি বিড়বিড় করে ঘুমপাড়ানি গান গাই, ‘আয় ঘুম আয়, আয় আয় ঘুম, খুকুর কপালে চাঁদের চুম। কিন্তু রিয়া যে নাই...!’

বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন গওহর। ওপাশে খানিকক্ষণ নীরবতা। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘রিয়া যে আমার পাশে নাই, সেটা মনে থাকে না। ওকে আমার আদর দিয়ো।’

ব্যস, এটুকুই। খট করে লাইনটা কেটে গেল। ঘরের ভেতর পিনপতন নীরবতা। এমনকি আনিকা নাওয়ারও একদম চুপ।

কম্পিউটার অ্যানালিস্টরা দুই পাশে মাথা নেড়ে জানাল, কিছুই পাওয়া যায়নি। মিসেস মাহফুজের সামনে চেয়ার টেনে বসলেন আদনান। বললেন, ‘রিয়া। আপনাদের মেয়ের নাম?’

‘না। ওর নাম সারিয়া।’

‘আচ্ছা। গওহর স্যার কি ওকে রিয়া বলে ডাকতেন।’

‘না। আগে কখনোই এই নামে ডাকেনি।’

‘কণ্ঠস্বরটা তো স্যারের, তা-ই না?’

‘হ্যাঁ, সেটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু...কী যেন মিলছে না। যত খারাপ অবস্থাতেই থাকুক, কেঁদে ফেলার মতো দুর্বল মানুষ গওহর না। এমন অপ্রাসঙ্গিক, আবেগী কথা ও কখনো বলে না। আমার মনে হয়, ও আপনাদের কোনো মেসেজ দিতে চাচ্ছে।’

চট করে দাঁড়িয়ে গেলেন আদনান। ‘ফোনের কথোপকথনটা প্লে করো। জলদি। সবাই তাঁর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো। তিনি কোথায় থেমেছেন, কোথায় সময় নিয়েছেন, কোন কথাগুলো রিপিট করেছেন, সবকিছুর নোট নাও। শব্দগুলো এদিক-ওদিক করে দেখো। গওহর স্যার জানেন, লোকেশনের একটা ক্লু পেলেই আমরা তাঁকে খুঁজে বের করে ফেলতে পারব। তিনি জানেন, আমাদের দরকার শুধু একটা দেশের নাম। ইমতিয়াজ, আমাকে একটা ম্যাপ দাও। এক্ষুনি।’

ঘরের ভেতর সবাই কাজে লেগে পড়ল।

একবার, দুবার, তিনবার কথোপকথনটা শোনা হলো। হঠাৎই আদনান বলে উঠলেন, ‘থামো।’ ম্যাপে একবার চোখ বোলালেন। তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হাসিমুখে বললেন, ‘ব্রিলিয়ান্ট! জিনিয়াস! ইমতিয়াজ, আজ রাতের মধ্যে ফ্লাইট বুক করো।’

‘স্যার আমরা কোন দেশে যাচ্ছি?’

‘এখনো বোঝোনি?’ রহস্যময় হাসি হাসলেন আদনান। ‘আমি তো বুঝে ফেলেছি।’

আদনান হাফিজের মতো তোমরাও নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছ কোথায় আছেন বিজ্ঞানী গওহর মাহফুজ? শাবাশ! জানতাম, তোমরা পারবে। আর যারা ভাবছ, ‘দূর, এত সময় আছে নাকি ভাবার?’ তাদেরও চিন্তার কিছু নেই। আগামী সংখ্যায় পাবে উত্তরটা।

উত্তর

গওহর মাহফুজ ফোনে তাঁর মেয়েকে ‘রিয়া’ বলে ডেকেছিলেন। অথচ মেয়েকে কখনোই এ নামে ডাকতেন না তিনি। তিনি বলছিলেন, ‘রিয়া যে নাই’। এতেই খটকা লাগে আদনান হাফিজের। একটু ভেবেই তিনি বুঝে ফেলেন, ‘রিয়া যে নাই’ মানে আসলে নাইজেরিয়া। নাইজেরিয়াতেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল গওহর মাহফুজকে।