বিটুল মামা রাশিয়া যাচ্ছেন। এই খবর শুনে মন্টু প্রথমে হতভম্ব হওয়ার চেষ্টা করেও পারল না। কারণ, হতভম্ব হতে হলে যে পরিমাণ অবাক বা বিস্মিত হতে হয়, তার চেয়ে ডাবল ট্রিপল বিস্মিত হওয়ায় বোধ হয় সে ঠিক হতভম্ব হতে পারল না। তবে সে দেরি করল না। একছুটে বিটুল মামার বাসায় গিয়ে হাজির হলো। বিটুল মামা তখন উল্টো করে পেপার পড়ছিলেন। এটা নাকি তাঁর মর্নিং আই এক্সারসাইজ। এতে একই সঙ্গে চোখের মণি আর মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। মন্টুকে দেখে বিটুল মামা পত্রিকা সোজা করে উঠে বসলেন।
: কিরে তুই সাতসকালে?
: তুমি নাকি রাশিয়া যাচ্ছ?
: হ্যাঁ, সে রকমই চিন্তাভাবনা করছি। কেন দেখিসনি?
: কী দেখব?
: রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা দিয়েছেন, দেশ-বিদেশের যে কাউকে রুশ সরকার দুই একর জমি দেবে দেশটির পূর্বাঞ্চলে। ভাবছি, এই সুযোগ হারানো ঠিক হবে না। গুগল সার্চ দিয়ে জায়গাটা দেখেছি, অসাধারণ। বরফে ঢাকা গাছপালাও কিছু আছে আর আছে শত শত ভালুক।
: তুমি ওখানে গিয়ে কী করবে?
: কিছু একটা করব। খুব সম্ভবত দেশীয় ফ্রিজের এজেন্সি নিয়ে ওখানে ফ্রিজ সেল করব।
: বরফের দেশে তুমি ফ্রিজ বেচবে মানে?
: আরে ওখানে যে ঠান্ডা মাইনাস থার্টি ডিগ্রি। আমাদের দেশের ফ্রিজ ওখানে নিয়ে গেলে ভেতরে ঢুকে বসে থাকবে ওরা। ওখানে যে ঠান্ডা এর থেকে আমাদের দেশের ফ্রিজের ভেতর গরম।
এই হচ্ছে বিটুল মামা। উদ্ভট সব চিন্তা তাঁর মাথায়। সাধারণত কাজ ছাড়া ঘর থেকে বের হন না। রাস্তা পার হতে হবে দেখে চা খান না। কারণ, চায়ের দোকান রাস্তার ওপারে। সেই তিনি যাচ্ছেন রাশিয়া! তা কি সম্ভব? তবে বিটুল মামা কিন্তু তাঁর আসল নাম না। তিনি আদৌ কারও কোনো মামাই নন। তাঁর নাম মাহিন মাহতাব বিটুল। বিটুল তাঁর ডাকনাম। তিনি মাহিন মাহতাবকে সংক্ষেপ করে ‘মামা’ আর ডাকনামটাকে নিয়ে এসেছেন সামনে। সবাই ডাকনাম রাখে পেছনে, তিনি সেটা নিয়ে এসেছেন সামনে। এর কারণ আছে অবশ্য একটা।
: ডাকনাম সামনে কেন? একবার মন্টু আর সৌমেন জানতে চেয়েছিল।
: একবার একটা জনপ্রিয় পত্রিকায় একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম। লেখাটা ওরা ছেপেছে ঠিকই, কিন্তু ডাকনামটা ফেলে দিল। এরই প্রতিবাদে এই নতুন নামকরণ।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে। বিটুল মামা পাড়ার ছোটদের কাছে অস্থির টাইপের হিরো। আর বড়দের কাছে ‘প্যারা’বিশেষ, মানে অপদার্থ নাম্বার ওয়ান। বড়দের কাছে নাম্বার ওয়ান অপদার্থ আর ছোটদের কাছে অস্থির হিরো হয় কীভাবে? সেটা বুঝতে হলে একটা ঘটনা জানতে হবে।
যেমন একবার ক্লাস এইটের মিলির নতুন জ্যামিতি বক্সের চাঁদাটা হারিয়ে গেল। মিলি বিটুল মামার কাছে এসে ফিচ ফিচ করে কাঁদতে লাগল।
: কাঁদিস কেন?
: আমার নতুন জ্যামিতি বক্সের চাঁদাটা হারিয়ে গেছে।
: বলিস কী? কখন, কীভাবে, কোথায়? বিটুল মামা এতই সিরিয়াস হয়ে গেলেন যে মিলি পর্যন্ত ঘাবড়ে গেল। বিটুল মামা ততক্ষণাৎ তাঁর নোটবুক বের করে মিলিকে প্রশ্ন করতে লাগলেন পাকা গোয়েন্দাদের মতো। আর টুকতে লাগলেন নোটবুকে।
: কখন টের পেলি চাঁদা নেই?
: স্কুল থেকে বাসায় এসে।
: ক্লাসে কোন বেঞ্চে বসেছিলি?
: সেকেন্ড বেঞ্চে জানালার পাশেরটায়।
: ক্লাসে জ্যামিতি বক্স খুলেছিলি?
: খুলেছিলাম।
: চাঁদা বের করেছিলি?
: হ্যাঁ।
: তোর দুপাশে কে কে বসেছিল?
: চাঁদনী আর মৌরী।
: তারা জ্যামিতি বক্স খুলেছিল?
: জ্যামিতির ক্লাস তো, সবাইকেই খুলতে হয়।
: জ্যামিতির ক্লাস কয়টায়?
: বারোটায়।
: ছুটি হয় কয়টায় ?
এ রকম ডজন খানেক প্রশ্ন করে, নোটবুকে টুকে বিটুল মামা শার্ট-প্যান্ট পরে রেডি হয়ে গেলেন। মিলি জিজ্ঞেস করল, মামা কই যাও?
: তোদের স্কুলে।
এরপরের ঘটনা ভয়াবহ! বিটুল মামা স্কুলে গিয়ে দপ্তরিকে দিয়ে ক্লাস এইটের দরজা খোলালেন। তারপর তন্নতন্ন করে সারা ক্লাস খুঁজলেন। বিশেষ করে জানালার কাছের সেকেন্ড বেঞ্চের নিচে। দপ্তরি বিটুলের চেনা। সে বলল, ‘মামা কী খুঁজেন? এমনে তো পাইবেন না, ঝাড়ু দিয়া সব নিয়া গেছে।’
: কে নিছে?
: পরিমল।
বিটুল মামা পরিমলকে পাকড়াও করলেন।
: পরিমল ক্লাস এইটের রুমে ঝাড়ু দেওয়া ময়লা সব কই ফেলছ?
: ক্যান, ডাস্টবিনে।
: কোন ডাস্টবিন?
: স্কুলের পেছনের গেটের কাছেরটায়।
না, শেষ পর্যন্ত পেছনের গেটের ডাস্টবিন ঘেঁটেও কোনো চাঁদা পাওয়া গেল না। বিটুল মামা এবার গিয়ে হাজির হলেন মৌরীদের বাসায়। রাত তখন বারোটা। দরজা খুলল মৌরীর বাবা। লোকটা ‘তেড়িয়া’ টাইপের।
: মৌরী আছে?
: কী দরকার? মৌরীর বাবার ভ্রু কুঁচকে গেল।
: ওকেই একটু দরকার।
: না, এত রাতে ও বাইরে আসবে না।
: বাইরে আসতে হবে না। দরজায় দাঁড়ালেই হবে। এমন সময় মৌরী নিজেই এসে হাজির হলো। বিটুল মামাকে সেও চেনে। এ পাড়ায় বিটুলকে সবাই চেনে।
: কী ব্যাপার বিটুল মামা?
: দেখো তো তোমার জ্যামিতি বক্সে কয়টা চাঁদা?
: কেন, একটা?
: না না দেখে এসে বলো।
মৌরী দেখে এসে বলল, ‘একটা’।
: ঠিক আছে। বিটুল মামা চলে গেলেন। এবার গন্তব্য চাঁদনীদের বাসা। ওদিকে মৌরীর মা ছুটে এলেন।
: এত রাতে কে এসেছিল?
: আর কে! ওই ফাজিলটা। বললেন মৌরীর বাবা।
: কোন ফাজিল?
: আরে ওই বিটলেটা...আসলে এসেছিল চাঁদা চাইতে। রাত-বিরেতে চাঁদাবাজ। যেই আমাকে দেখল, হয়ে গেল জ্যামিতি বক্সের চাঁদা। ফাজিলের ফাজিল।
তবে চাঁদনীর জ্যামিতি বক্সে পাওয়া গেল দুটো চাঁদা। অবশ্যই একটা মিলির। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এই কাজ হয়েছে। একজনের চাঁদা আরেকজনের জ্যামিতি বক্সে ঢুকে গেছে। মিলির চাঁদা উদ্ধার করে রাত একটার সময় মিলির বাসায় গিয়ে হাজির বিটুল মামা। দরজা খুলল মিলির বড় বোন চৈতি।
: এত রাতে আপনি?
: পাওয়া গেছে।
: কী পাওয়া গেছে?
: মিলির জ্যামিতি বক্সের চাঁদা। বলে চাঁদাটা এগিয়ে দিল বিটুল, ‘মিলি নেই?’
: ও ঘুমিয়ে গেছে। রাত কত হয়েছে জানেন?
: কেন? একটা।
: ও, আপনার কাছে এটা কোনো রাত না? আপনার কি মাথা ঠিক আছে নাকি? চৈতি বিশেষ বিরক্ত হয়ে চাঁদা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল একরকম বিটুলের মুখের ওপরই। তা লাগাক, বিটুলের ডিউটি শেষ।
সেই পরোপকারী বিটুল মামা কিনা হঠাৎ নিখোঁজ। প্রথমে সবাই ভাবল, সত্যি সত্যি বোধ হয় রাশিয়াই চলে গেল মাহির মাহতাব বিটুল; কাউকে না বলে। কিন্তু ঘরে পাওয়া গেল তাঁর ব্যাগ—যেটা নিয়ে তিনি রাশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বিটুল মামা একটা পরিবারের সঙ্গে সাবলেট হিসেবে থাকতেন। সেই পরিবারের লোকজনও অবাক। তাই তো ছোঁড়া গেল কই? পাড়ার ছোটরা চিন্তিত। কিন্তু বড়রা খুশি, যাক আপদ যেখানেই যাক বিদেয় হয়েছে। পাড়ার ছোঁড়াগুলোর মাথা খাচ্ছিল।
কিন্তু যেদিন পুলিশ এসে হাজির হলো বিটুল মামার বাসায়, সেদিন সবার টনক নড়ল। তার মানে ভয়ানক কিছু ঘটেছে। কী ঘটতে পারে? পুলিশ আশেপাশে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করল। বড়দের, ছোটদের সবাইকে। যেমন, মন্টুকে পুলিশ যেসব প্রশ্ন করল সেগুলো এ রকম—
: বিটুলকে তোমরা পছন্দ করতে?
: হ্যাঁ, করতাম।
: অনেক পছন্দ করতে?
: হ্যাঁ...অনেক ।
: কেন?
: তিনি খুব মজার মানুষ। অন্য রকম।
: যেমন?
: যেমন উনি পেপার পড়তেন উল্টো করে। ফেসবুক দুই চোক্ষে দেখতে পারেন না। সেলফি তুলতে তাঁর খুব আপত্তি। আমাদের ছোটদের যেকোনো সমস্যা উনি সিরিয়াসলি নিতেন। যেন সেটা তাঁর নিজেরই সমস্যা।
: ইন্টারেস্টিং! আচ্ছা, পেপার উল্টো করে পড়তেন কেন?
: ওনার ধারণা উল্টো করে পেপার পড়লে নাকি চোখের ব্যায়াম হয়।
: উনি যে রাশিয়া যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছিলেন, তোমাদের বলেছেন?
: হ্যাঁ, বলেছেন। আচ্ছা উনি সত্যিই রাশিয়া চলে গেছেন?
: না, তাঁর পাসপোর্টই নেই।
: তাহলে উনি গেলেন কোথায়?
এই পর্যায়ে পুলিশ অফিসার একটা সিগারেট ধরিয়ে উদাস হয়ে গেলেন। লোকটাকে ঠিক পুলিশ পুলিশ মানাচ্ছে না। এই লোকটা লেখক বা কবি হলে মানাত। মন্টুর কেন যেন তা-ই মনে হলো। লোকটা অদ্ভুত কায়দায় ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একসময় বিড়বিড় করে বললেন, ‘মাহির মাহতাব বিটুলের সব রহস্য আসলে অন্য জায়গায়। ওই ফোনটা না পেলে কে জানত এত কিছু...কী বল?’ বলে মন্টুর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘আচ্ছা, ধন্যবাদ। তুমি যেতে পারো।’
মন্টু চলেই যাচ্ছিল। পুলিশ অফিসার আবার ডাকলেন।
: আচ্ছা আর একটা প্রশ্ন...
: বলেন।
: তাঁর ঘরে একটা চেরাগ ছিল তুমি জানতে?
: হ্যাঁ, জানতাম। তাঁর ঘরে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিস থাকত।
: চেরাগটা সম্পর্কে কিছু বলত তোমাদের?
: বলতেন ওই চেরাগে নাকি সত্যি জিনি আছে।
: হুম...তোমরা দেখেছ জিনি?
: নাহ্।
: জিনির কথাবার্তা শুনেছ?
: নাহ্।
: হুম...যেদিন বিটুল অদৃশ্য হলো, সেদিন থেকে ওই চেরাগটাও নেই।
তারপর বেশ কিছুদিন চলে গেল। পুলিশ আর এল না। তারা অবশ্য যাওয়ার সময় ঘরটা সিলগালা করে দিয়ে গেল। আর বলে গেল বিটুল সম্পর্কে কোনো তথ্য পেলে যেন আমরা থানায় জানাই। ওই অফিসার একটা ফোন নম্বরও দিয়ে গেলেন সবাইকে। তাঁর ব্যক্তিগত ফোন নম্বর।
এর কিছুদিন পর ব্যাপারটা প্রথম চোখে পড়ল মন্টুর। মন্টু খেয়াল করল, একটা লোক ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় পরা, খালি পা। বিটুল ভাইয়ের বাসার সামনের মাঠটায় পড়ে থাকা মরা গাছটার গুঁড়িতে বসে থাকেন। আর বিড়ি ফোঁকেন। মাঝেমধ্যে বিটুল ভাইয়ের ঘরটার দিকে তাকান। একদিন মন্টু মাঠের ভেতর দিয়ে শর্টকাট মেরে দোকানে যাচ্ছিল। লোকটার সঙ্গে চোখাচোখি হলো তার। লোকটা ইশারায় তাকে ডাকল। মন্টুর কেমন যেন ভয় ভয় লাগল! ছেলেধরা না তো? যদি তাকে বস্তায় ভরে নিয়ে যায়। তারপরও কী মনে করে এগিয়ে গেল।
: তুমি এই পাড়ায় থাকো?
: হুঁ।
: আচ্ছা এই পাড়ায় মন্টুরে চেনো?
মন্টু হতবাক হয়ে বলল, ‘আমিই তো মন্টু!’
: তুমি মন্টু? উফ্ তোমারে কত বিছরাইতাছি...শোন ঘটনা তো একটা ঘইটা গেছে জটিল, আমার পুরা মাথা নষ্ট।
: আপনি কে?
এবার লোকটা গলা নামিয়ে ফেলল। প্রায় ফিসফিস করে বলল, যদিও আশেপাশে কেউ নেই। ‘আমারে এলাকায় সবাই ত্যানা চোরা বইলা ডাকে। একসময় ত্যানা-ম্যানা যা-ই পাইতাম চুরি করতাম। এই কারণে ত্যানা চোরা। কিন্তু এখন আমি অন্য লাইন ধরছি। দামি জিনিসপত্র চুরি করি। মাসে একটা জিনিস চুরি করি, মাগার দামি জিনিস। যেমন ধরো তোমাগো বিটুল মিয়ার চেরাগটা চুরি করছিলাম।
: বিটুল ভাইয়ের চেরাগ আপনার কাছে? বিটুল ভাইকে চেনেন? বিটুল ভাই কোথায় আছে বলতে পারেন?
: উফ্ এত প্রশ্ন এক লগে করলে উত্তর দিমু ক্যামনে? হ, বিটুল মিয়ারে চিনি। পাগলা কিসিমের, তবে লোক ভালো। সে এখন আমার জিম্মায় আছে। তবে বিরাট অসুবিধায় আছে। তোমারে খবর দিছে।
: মানে?
: মানে তোমারে লয়া যাইতে কইছে। মন্টুর ভয় হলো, সে যাবে? লোকটা কি মিথ্যা বলছে? যদি কোনো ফাঁদ হয়? লোকটা যেন তার মনের কথা টের পেল। বলল, ‘ভয়ের কিছু নাই। তুমি গেলেই বুঝবা বিটুল মিয়া কত বিপদে আছে। ওই চেরাগ চুরি কইরা অপ্রাধ করছি স্বীকার যাইতেছি...মাগার চুরি না করলে বিটুলের বিপদ আরও বাড়ত। আর যে ঘটনা ঘটছে, পুলিশরে জানাইলে পুলিশ বিশ্বাস করত না। বুঝলা না জিন-ভূতের ব্যাপার আছে এর মধ্যে...
: ওই চেরাগে জিন আছে?
: চলো না, গেলেই সব বুঝবা, জটিল কাহিনি।
শেষ পর্যন্ত অচেনা লোকটার সঙ্গে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল মন্টু। লোকটা চোর হতে পারে। কিন্তু ভালোই মনে হচ্ছে। বিটুল ভাইয়ের জন্য ‘ফিলিংস’ আছে!
লোকটার সঙ্গে একটা ভাঙাচোরা সাইকেল আছে। তাঁর সামনের কানেক্টিং রডে বসল মন্টু। লোকটা সেই সাইকেল চালিয়ে রওনা দিল। যেতে যেতে লোকটা বলল, ‘মন্টু মিয়া ভয় নাই। তোমারে আমি আবার নামায়া দিয়া যাব। আমি চোর হইলেও মানুষ খারাপ না।’
২০ মিনিটের মধ্যে তারা একটা জায়গায় পৌঁছে গেল। জায়গা বলতে জংলামতো জায়গা। চারদিকে গাছপালা, আশপাশে কেউ থাকে না। ঝোপঝাড় এড়িয়ে একটা ভাঙা ইটের পুরোনো দালানের ভেতর ঢুকল দুজন। লোকটা বলল, ‘আমি এইখানেই থাকি। সাপের ডরে এই এলাকায় কেউ আসে না।’
: সাপ আছে! মন্টু আঁতকে উঠল।
: আছে না! লোকটা নির্বিকার। ঘরের কোনায় একটা ইট সরিয়ে চেরাগটা বের করল লোকটা। তারপর মেঝের ওপর রাখল। মেঝে মানে ভাঙাচোরা ইট বিছানো একটা জায়গা। লোকটা বলল, ‘কথা বলো।’
: কার সঙ্গে কথা বলব?
: বিটুল মিয়ার সঙ্গে। বলে চেরাগের কাছে গিয়ে লোকটা চেঁচাল, ‘বিটুল মিয়া মন্টু আসছে কথা বলেন...’
আর তখন আশ্চর্য হয়ে মন্টু খেয়াল করল চেরাগের ভেতর থেকে বিটুল ভাইয়ের গলা ভেসে এল!
: মন্টু এসেছিস?
: হ্যাঁ, বিটুল ভাই। তুমি কোথায়?
: আর বলিস না, আমি তো বিরাট বিপদে পড়েছি। আমি এই চেরাগের ভেতরে আটকা পড়েছি।
: বলো কী! কীভাবে??
: তোকে বলেছিলাম না, এই চেরাগে জিনি আছে?
: হ্যাঁ, বলেছিলে।
: তোরা তো বিশ্বাস করলি না। আসলে সত্যিই একটা জিনি ছিল। একদিন চেরাগে ঘষা দিলাম সত্যি সত্যি জিনি বের হয়ে এল।
: তারপর?
: তারপর জিনি বলল, ‘হুকুম করুন মালিক! কী চাই আপনার?’
বিটুল: কয়টা বর দেবেন?
জিনি: একটা।
বিটুল: কেন তিনটা না দেয় জিনিরা? গল্প-উপন্যাসে পড়েছি।
জিনি: আরে গল্প উপন্যাসে থাকে লেখকদের বানানো কাল্পনিক জিনি। তারা তিনটা কেন, দশটা বর দিতে পারে। আমরা সত্যি জিনি একটার বেশি পারি না। সামনে যে দিন আসছে একটাও দিতে পারব কি না কে জানে! তা বলেন মালিক, কী চাই আপনার? এক কোটি টাকা ক্যাশ? নাকি বারিধারায় একটা ফ্ল্যাট? নাকি একটা বিএমডব্লিউ গাড়ি? কিংবা আপনার ছেলে বা মেয়ে থাকলে মেডিকেলে চান্স পাইয়েও দিতে পারি...যা-ই চান। কিন্তু...একটা...
বিটুল: আরে না এসব লাগবে না। আর আমি বিয়েও করিনি যে ছেলেমেয়েকে মেডিকেলে চান্স পাইয়ে দিতে হবে।
জিনি: তাহলে কী চান মালিক?
বিটুল: আমি জানতে চাই, মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য।
জিনি: সে তো মানুষ আস্তে আস্তে জানছেই। প্রতিদিনই গবেষণায় কিছু না কিছু নতুন নতুন তথ্য বেরোচ্ছে।
বিটুল: না, আমি একবারে জানতে চাই।
জিনি: হুম...সে ক্ষেত্রে আমাকে চেরাগ থেকে বেরোতে হবে।
বিটুল: কেন তুমি তো চেরাগ থেকে বেরিয়েছই।
জিনি: না মালিক। এই বের হওয়া পুরোপুরি বের হওয়া না। পুরোপুরি বের হওয়া মানে আমাকে মুক্ত হতে হবে। স্পেস ডিসপ্লেসমেন্ট রিঅ্যাকশন করে চেরাগের ভেতর একজন ঢুকবে আর আমি বের হয়ে আসব।
বিটুল: বুঝলাম না। সেটা কীভাবে?
জিনি: কেন মালিক, কেমিস্ট্রিতে পড়েন নাই, স্পেস ডিসপ্লেসমেন্ট রিঅ্যাকশন...মানে বাংলায় স্থানিক প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া...আমার শরীরের অ্যাটমগুলো সব বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, আপনারগুলোও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তারপর আমরা জায়গা বদল করব। আপনি ঢুকে যাবেন চেরাগের ভেতরে, আমি পুরোপুরি বাইরে। অ্যাটমগুলো আবার রিঅ্যারেঞ্জমেন্ট হবে আগের মতো করে।
বিটুল: বলো কী! এ তো পুরা সায়েন্স! তুমি তো ভালো সায়েন্স জানো।
জিনি: তা কিছু তো জানতেই হয়।
বিটুল: আইডিয়া খারাপ না। আমি রাজি। তারপর তুমি বাইরে এসে কী করবে?
জিনি: আমি বাইরে এসে আপনার সৃষ্টিরহস্যের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। এর উত্তর আমার একার পক্ষে বের করা বা জানা মুশকিল। আমাদের মধ্যে যারা মেন্টর শ্রেণির জিনি, তাদের সাথে কথা বলতে হবে। মানে টক শোর মতো বৈঠক করতে হবে।
বিটুল: বেশ তো আমি রাজি।
জিনি: ঠিক তো, মালিক?
বিটুল: ঠিক।
বিটুল মামা চেরাগের ভেতর থেকে চেঁচাল, ‘মন্টু শুনছিস?’
: শুনছি।
: তারপর তো ওই জিনির সঙ্গে স্পেস ডিসপ্লেসমেন্ট রিঅ্যাকশন করে আমি চেরাগের ভেতর চলে এলাম। ও এখন বাইরে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই চেরাগের ভেতর আমি টিকতে পারছি নারে। ভাপসা গরম। আর কিছু করারও নেই। খুবই অসুবিধার মধ্যে আছি। তুই আমাকে বাঁচা...মানে বের করার ব্যবস্থা কর।
: আমি এখন কী করব বলে দাও।
: তুই তোর দলবল নিয়ে ওই জিনিটাকে খুঁজে বের কর। তারপর তাকে বলবি আমাকে যেন চেরাগ থেকে বের করে দেয়। আমার সৃষ্টিরহস্য জানার দরকার নেই।
: ওকে কোথায় পাব?
: ও বলেছে ও আশেপাশেই থাকবে। এই পাড়াতেই থাকবে। কারণ, চেরাগ ছেড়ে তিন কিলোমিটার ডায়ামিটারের মধ্যেই নাকি ওদের থাকতে হয়। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে, ও কোনো ট্রিকস করে আমাকে আটকে দিয়ে নিজে বের হয়ে গেছে কি না, কে জানে। তোকে আরেকটা কাজ করতে হবে, চেরাগটা তোর বাসায় নিয়ে ফ্রিজে রাখ। তাহলে একটু আরাম হবে আমার।
: বেশ। কিন্তু জিনিকে আমরা চিনব কীভাবে?
: কেন, মাথায় পাগড়ি, থুতনিতে চিকন দাড়ি। হাত দুটো বেশ লম্বা।
: মোটাসোটা কেমন?
: না, মোটাসোটা না, চিকন। বেশ চিকন খাড়া নাক।
: জিনির নাম কী?
: হাবুল কাবুল। আর শোন, বাসায় নিয়ে আমাকে আবার ডিপ ফ্রিজে রাখিস না, তাহলে কিন্তু জমে যাব। নরমাল ফ্রিজে রাখবি।
: আচ্ছা।
ত্যানাচোরাকে ধন্যবাদ দিয়ে মন্টু চেরাগটা নিয়ে রওনা হলো বাসার দিকে। উত্তেজনায় মন্টুর বুকটা ধুকপুক করছে। বিটুল ভাইকে পাওয়া গেছে। এটাই বিরাট ব্যাপার। এখন জিনিকে পেলে হয়। ত্যানাচোরা বলল ‘তোমারে পৌঁছায়া দিয়া আমু?’
: না, দরকার নেই। আমি যেতে পারব।
: আর শোনো, এখন বুজছো তো চেরাগ চুরি কইরা কী বিপদে পড়ছিলাম। শোনো, সাবধানে যাইও। আর এই বিটুল মিয়ারে চেরাগ থাইকা বাইর করতে পারলে আমারে একটু খবর দিয়ো। মোবাইল নম্বরটা লেইখা লও। আর ওই চিকনা দাড়ি জিনিরে যদি আমি পাই তোমগো খবর দিমু নে।
: জি আচ্ছা।
মন্টু পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে জরুরি মিটিং ডাকল। পুরো ব্যাপারটা সবাইকে খুলে বলল—ত্যানাচোরা থেকে শুরু করে বিটুল ভাইয়ের চেরাগে বন্দিজীবন সম্পর্কে সমস্ত কিছু। এখন সবাইকে সেই হাবুল কাবুল জিনিকে খুঁজে বের করতে হবে। মন্টুর মনে হলো বিষয়টা কেউ বিশ্বাস করল না। প্রথম প্রশ্নটা করল সৌমেন।
: চেরাগটা কোথায় আছে?
: আমার বাসার ফ্রিজে
: ফ্রিজে কেন?
: বিটুল ভাই বলেছেন চেরাগের ভেতর খুব গরম। তাই তাঁকে ফ্রিজে রাখি। মিলি ছাড়া সবাই এবার হো হো করে হেসে উঠল।
: হাসলি ক্যান তোরা?
: কারণ, তোর গল্পটা বেশ মজার। আচ্ছা, বিটুল ভাইকে খেতে দিস কী? নাকি বিটুল ভাই ফ্রিজের ভেতর থেকে নিজেই খেয়ে নেন? রকিব বলল। এ সময় পাশ থেকে সাবের বলে উঠল, ‘মন্টু, তোদের ফ্রিজের কাছে একটা ওভেন রেখে দিস। তাহলে বিটুল ভাই কোনো কিছু গরম করে খেতে চাইলে চট করে পাশের ওভেন থেকে গরম করে নেবেন।’
এবারও সবাই একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল। মন্টু বুঝতে পারল, সবাই তার সঙ্গে ইয়ার্কি করছে। চেরাগের গল্প কেউ বিশ্বাস করেনি। একসময় সবাই উঠে হইহই করে সাত চারা খেলা শুরু করল। বসে রইল শুধু মিলি আর মন্টু। মন্টুর মন খারাপ হয়ে গেল কেউ তার কথা বিশ্বাস করল না বলে। সে নিজে চেরাগের ভেতর থাকা বিটুল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছে।
: আমি তোর কথা বিশ্বাস করেছি। বলল মিলি।
: সত্যি?
: হ্যাঁ, সত্যি। তোর সঙ্গে আমি হাবুল কাবুল জিনিকে খুঁজতে বের হব।
: আচ্ছা।
ওই দিন রাতেই মন্টুর মা মন্টুকে ধরলেন।
: কিরে ফ্রিজের ভেতর এটা কী রেখেছিস?
: অ্যাঁ ইয়ে মানে একটা জিনিস!
: জিনিস তো বুঝতেই পারছি। জিনিসটা কী?
: একটা চেরাগ।
: চেরাগ ফ্রিজে রাখতে হবে কেন?
: এটা বিশেষ ধরনের চেরাগ।
: বিশেষ কী রকম?
: অ্যাঁ ইয়ে...এই চেরাগটা লোহার তৈরি। তবে নিকেলের পার্সেন্টেজ বেশি, কোবাল্ট কম।
: নিকুচি করি তোর নিকেল...এক্ষুনি সরা...সরা বলছি। মন্টুর মা হুংকার দিয়ে উঠলেন। এমনিতেই তিনি বেশ রাগী টাইপের। মন্টু কী আর করবে, চেরাগটি সরিয়ে ফেলল। তারপর খুব শিগগির ফোন দিল মিলিকে।
: মিলি, একটা সমস্যা হয়েছে।
: কী সমস্যা?
: আমার মা তো চেরাগটা ফ্রিজে রাখতে দিচ্ছে না। কী করি, বল তো। বাইরে তো গরমে বিটুল ভাইয়ের কষ্ট হচ্ছে।
: আমার কাছে নিয়ে আয়। আমাদের ফ্রিজ বড় আছে। এক কোনায় রেখে দেব। কেউ টেরও পাবে না।
: ঠিক আছে, তাহলে এখনই নিয়ে আসছি।
: হ্যাঁ, নিয়ে আয়।
পরের দুদিন সারা শহরে মন্টু একাই ঘুরে বেড়াল জিনির খোঁজে। মিলির থাকার কথা ছিল সঙ্গে। কিন্তু জ্বর বলে ও যেতে পারেনি। তৃতীয় দিনে একটা চায়ের দোকানে বসেছে মন্টু। একটা শিঙাড়া খাবে বলে। গরম শিঙাড়াটায় যেই কামড় দিতে যাবে, তখন দেখল লোকটাকে—লম্বা, রোগা, থুতনিতে চিকন দাড়ি। হাত দুটি তো লম্বা মনে হচ্ছে না। কিন্তু মাথায় পাগড়ি নেই। বেশ রোগা সোগাই। এই লোকটা কি হাবুল কাবুল জিনি হতে পারে? লোকটাও একটা চা নিয়ে ঠিক মন্টুর পাশেই এসে বসল। মন্টু যখন প্রায় নিশ্চিত যে এই লোক হাবুল কাবুল না, তখনই লোকটা তার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘তুমি মন্টু?’
: জি...আ-আপনি?
: আমি হাবুল কাবুল।
: জিনি হাবুল কাবুল?
: হ্যাঁ।
: আপনাকেই তো খুঁজছি।
: আমিও তোমাকে খুঁজছি।
: কেন?
: চেরাগটা তোমার কাছে না?
: হ্যাঁ।
হাবুল কাবুল একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল ‘আমি ভেবেছিলাম, তোমাদের বিটুলকে চেরাগের ভেতরে রেখে বাকি জীবন চেরাগের বাইরেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু যা বুঝলাম, পৃথিবীর অবস্থা খুবই খারাপ। বাইরে থাকা নিরাপদ না। বরং চেরাগের ভেতরে থাকাই নিরাপদ। পৃথিবীর পরিবেশ তো তোমরা পুরো নষ্ট করে দিয়েছ!
জিনি হাবুল কাবুল পৃথিবীর গ্রিনহাউস ইফেক্টের ওপর বিশাল এক বক্তৃতা দিয়ে ফেলল। বেশ গুরুগম্ভীর বক্তৃতা।
: তার মানে আপনা-আপনি চেরাগে ঢুকে বিটুল ভাইকে বের করে দিতে চাচ্ছেন?
: হ্যাঁ, এই জন্য চেরাগটার কাছাকাছি যাওয়া দরকার। চেরাগটা আছে কোথায়?
: আমার...মানে মিলির বাসায় ফ্রিজে।
: ফ্রিজে কেন?
: বিটুল ভাই বলছিল খুব গরম লাগে ভেতরে তাই।
: হুম...তা অবশ্য গরম লাগারই কথা। আমাদের একটা সিস্টেম আছে, যেটা তোমাদের মানুষের নেই। তাহলে চলো চেরাগটার কাছে যাই।
: চলেন
যেতে যেতে মন্টু বলল, ‘আচ্ছা বিটুল ভাই যে সৃষ্টিরহস্য জানতে চেয়েছিল, সেটা তাঁকে জানাবেন? আপনি বলেছিলেন আপনার মেন্টরদের সঙ্গে কথা বলে পরে জানাবেন।’
: নাহ্, আসলে এসব আমরা জানি না। তোমরা মানুষেরাই বরং এসব বিষয়ে বেশি জানো। বিটুলকে মিথ্যা বলে বের হয়েছিলাম। সমস্যা নেই, মালিকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। সে অবশ্য এখন আর আমার মালিক না। চেরাগ থেকে একদম বের হয়ে গেলে জিনির আর কোনো মালিক থাকে না। এটাই নিয়ম।
ওরা মিলির বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। তখন রাত নয়টার মতো বাজে। জিনি গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ‘তুমি বলছো, এই বাড়ির ফ্রিজের ভেতরে বিটুল আছে? মানে চেরাগটা আছে?’
: জি।
: ডিপ ফ্রিজে না নরমাল ফ্রিজে?
: নরমাল বড় ফ্রিজে। ওদের ড্রয়িংরুমেই আছে।
: ঠিক আছে, আমি বিটুলের সঙ্গে স্থানিক প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া করে এখন চেরাগে ঢুকে যাব, বের হয়ে আসবে বিটুল। আরেকটা ব্যাপার বিটুলকে বলবে। আমি চেরাগে ঢুকে গেলে কিন্তু আর কথা বলতে পারব না। সুপার হাইবারনেশনে চলে যাব। বিটুল যেন অতি অবশ্য আমার চেরাগটা সমুদ্রে ফেলে আসে। ঠিক আছে?
: জি ঠিক আছে, মনে থাকবে।
: বেশ। এখন তুমি চলে যাও। হাবুল কাবুল বিদায়ের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল। মন্টুও হাত নাড়ল। ফিস ফিস করে বলল, ‘বিদায়’। একটু দূরে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখে একটু আগেও যেখানে হাবুল কাবুল দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে সে আর নেই। তবে কি হাবুল কাবুল চেরাগে ঢুকে গেছে? আর বিটুল ভাই বের হয়েছে চেরাগ থেকে? বের হলেও কখন বের হবে? কোথায় বের হবে কে জানে?
রাত নয়টার বেশি বাজে। মিলিরা সবাই খেতে বসেছে। মিলির মা-বাবা, বড় বোন চৈতি, আর মিলির ছোট চাচা বদিউল আলম। বাবা হঠাৎ বললেন: আচ্ছা, ওই বিটলে ছোঁড়াটার কোনো খবর পাওয়া গেল না?
: বিটলে না বাবা, ওর নাম বিটুল। চৈতি বলল।
: ওই হলো! আজকালকার নামধাম সব ওই রকম।
: আহা বেচারা কই গেছে, কে জানে? কেউ হয়তো মেরেই ফেলেছে। মিলির মায়ের গলায় আফসোস।
: আরে ওকে নিয়ে তো একটা মজার গল্প শুনলাম। বলল ছোট চাচা বদি।
: কী গল্প? মিলির বাবা আগ্রহ দেখায়।
: ওর খোঁজ পাওয়া গেছে।
: পাওয়া গেছে? কোথায়? ভেতরে ভেতরে চমকে উঠে মিলি।
: একটা চেরাগের ভেতরে। চেরাগটা আবার আছে মন্টুদের ফ্রিজে।
মিলি ভয় পেয়ে গেল। এই গোপন খবর পাচার হলো কীভাবে? ছোট চাচার কানে গেল কীভাবে? ছোট চাচার কথা শুনে এবার মিলির বাবা দম ফাটিয়ে হেসে উঠলেন, ‘হা হা আলাদিনের চেরাগের ভেতরে বিটলে আটকে আছে? হা হা, দারুণ খবর। তাও আবার ফ্রিজের ভেতর। হা হা।’ ঠিক এ সময় মিলির মা তাকালেন মিলির দিকে।
: আচ্ছা, মিলি ফ্রিজে তুমি কি একটা রেখেছ চেরাগের মতো? মিলি প্রমাদ গুনল। হায় হায়...এখন?
: ইয়ে...হ্যাঁ ওটা চেরাগ।
: ফ্রিজে চেরাগ কেন? সবাই অবাক হলো
: এই চেরাগেই বিটুল মামা আটকে আছেন। চেরাগটা মন্টুদের ফ্রিজে ছিল, এখন আমাদের ফ্রিজে। টেবিলে হঠাৎ সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। ছোট চাচা বললেন, ‘তার মানে, এই ফ্রিজের ভেতর চেরাগটার মধ্যে আমাদের বিটুল আটকে আছে?’
: হ্যাঁ তা-ই। রাগের গলায় বলে মিলি।
হতবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে আছে মিলির দিকে। পিনপতন নিস্তব্ধতা যেন। একটা পিন পড়লে এখন যেন অ্যাটম বোমা ফাটার শব্দ হবে। অল্প কিছুক্ষণ...তারপর হঠাৎ সবাই একসঙ্গে একটা অট্টহাসি দিল। আর তখনই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। মিলিদের বিশাল ফ্রিজটা কেঁপে উঠল যেন। কেমন একটা শব্দ হলো ফ্রিজের ভেতর। তারপর ঠাস করে ফ্রিজের দরজাটা খুলে গেল। সবাই হতভম্ব হয়ে দেখে ভেতর থেকে বের হয়ে আসছেন বিটুল মামা। সবার দিকে তাকিয়ে বিটুল মামা হাত নাড়েন। তার বাঁ হাতে চেরাগটা ধরা। বললেন, ‘সরি, চেরাগটার ভেতরে ছিলাম তো...এ কারণে এখান থেকেই বের হতে হলো। ইয়ে ফ্রিজে একটা পনিরের টুকরো ছিল খেয়ে ফেলেছি...স্যরি! মিলি তোদের দরজাটা কোন দিকে? যাই আমি... রাত কত হলো কে জানে?’
সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। সবার মুখ হাঁ হয়ে আছে। মিলির বাবা সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছেন, মুখ দিয়ে গ্যাজলার মতো বেরোচ্ছে। ছোট চাচা ফ্রিজ হয়ে চেয়ারের সঙ্গে সেঁটে আছেন। অন্যদের কথা না বলাই ভালো। তবে মিলি অবাক হলেও সামলে নিয়েছে নিজেকে! তাকে যে শেষ পর্যন্ত ফ্রিজে চেরাগ রাখার জন্য হাসির পাত্র হতে হয়নি, সে তাতেই খুশি।
রাশিয়া না শেষ পর্যন্ত বিটুল মামা কক্সবাজার যাচ্ছেন। সঙ্গে মিলি আর মন্টু। সকালে যাবেন, বিকেলে চলে আসবেন—এ রকমই পরিকল্পনা। কাজ একটাই—সমুদ্র সৈকতে গিয়ে হাবুল কাবুল জিনির চেরাগটা সমুদ্রে ছুড়ে ফেলা। তারা যাচ্ছে প্লেনে। ফিরেও আসবে প্লেনে। দিনে দিনে কাজ শেষ।
: এত টাকা কোথায় পেলে বিটুল মামা? এই যে আমরা তিনজন প্লেনে যাচ্ছি। বলেই ফেলে মন্টু।
বিটুল মামা হাসে। গলা নামিয়ে বলে, ‘জিনির একটা বর দেওয়ার কথা ছিল না আমাকে? সেটা তো দিতে পারল না। তাই যাওয়ার সময় না চাইতেই বেশ কিছু নগদ টাকা দিয়ে গেছে।’
: কত?
: গুনিনি। উদাস হয়ে যায় বিটুল মামা, হাই তোলেন, ‘...ওই দিন ঘরে ফিরে দেখি, ঘরের মধ্যে মেঝেতে বিরাট চটের একটা বস্তা। ভেতরে সব ১০০০ টাকার নোট!’
: বলো কী? একসঙ্গে আঁতকে ওঠে মিলি আর মন্টু!
: একদিন তোরা এসে গুনে দিস তো।
: ঠিক আছে। রাজি হয় মিলি আর মন্টু।
: তবে কক্সবাজার থেকে ফিরে এসে সত্যি সত্যি রাশিয়া চলে যাব ভাবছি। এখন তো আর টাকার সমস্যা না। কী বলিস তোরা?
তারা দুজনেই মাথা নাড়ে। তাদের মাথা নাড়ার ভঙ্গিতে অবশ্য বোঝা যায় না যে তারা তাঁর রাশিয়া যাওয়ার ব্যাপারে একমত না দ্বিমত পোষণ করছে। নভো এয়ারের ছোট্ট ফকার প্লেনটা তখন গর্জন করে আকাশে উঠে গেছে কক্সবাজারের উদ্দেশে। নিচে ঢাকা শহরটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসতে শুরু করেছে। প্লেনের জানালা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে টুকরো টুকরো ধবধবে সাদা মেঘ।