নিজেকে কুকুর ভাবত যে বিড়াল আর নিজেকে বিড়াল ভাবত যে কুকুর

সন্তানের মতো সন্তান নাকি একটাই যথেষ্ট। ইদিশ ভাষা জননীর তেমনই এক গুণধর ছেলে আইজ্যাক বাশেভিস সিঙ্গার। এই এক পুত্রের কল্যাণেই জগেজাড়া ইদিশ ভাষার আজ কত সুনাম। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদিদের ভাষা ইদিশ। পরে ইহুদিদের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য মহাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে এই ভাষা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইদিশভাষীর সংখ্যা ছিল প্রায় সোয়া কোটি। ইউরোপের ব্যাপক ইহুদি নিধনের পর আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় এই সংখ্যা। বর্তমানে এই সংখ্যা বড়জোর ২০ লাখ, এর একটা বড় অংশই আবার মার্কিনি!

রত্নগর্ভা হয়েও সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে এক রকম অপরিচিতই ছিল ইদিশ। অথচ তার আছে রানির মতো ধনরত্ন, কিন্তু সেগুলোর কোনো খবরই জানত না সাধারণ বিশ্ববাসী। সিঙ্গারের কল্যাণে এখন সেগুলোর সঙ্গেও নতুন করে পরিচিত হয়েছে অ-ইদিশভাষী মানুষ। তোমরা হয়তো বলতে পারো, সিঙ্গারের নামই বা জানল কী করে মানুষ, তিনিও তো ইদিশ ভাষাতেই লিখতেন; অন্য ইদিশভাষী লেখকের যে সমস্যা, তাঁরও তো সেই একই সমস্যা। কিন্তু তাঁর যে সে সমস্যা হয়নি এর পেছনে আছে নোবেল। ১৯৭৮ সালে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল দেয় সুইডেন। কিন্তু নোবেল কমিটিই-বা কেমন করে জানল সিঙ্গারের নাম। সেটা জানার জন্য আমাদের সিঙ্গারের জীবনের একটা অধ্যায় সম্পর্কে একটু জানতে হবে।

জার্মানির পোল্যান্ড দখলের চার বছর আগেই ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান সিঙ্গার। সেখানেই ইদিশ পত্রিকা দ্য ফরোয়ার্ড-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। অচিরেই শুরু হয় গল্প-উপন্যাস লেখালেখি। ব্যাপক ইহুদি নিধনের ফলে তত দিনে আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে ইদিশভাষীর সংখ্যা। তারপরও ইদিশ ভাষাতেই লেখালেখি করতে থাকেন সিঙ্গার। আজীবন অব্যাহত ছিল এই চর্চা। পরে সেগুলোকে আরও আঁটসাঁট করে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন বা করান, এভাবেই অ-ইদিশভাষীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও সখ্য এবং পরিণতিতে নোবেল ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য মানচিত্রে ইদিশ ভাষার স্থান লাভ।

ছোটদের জন্য ১৪টি বই লিখেছেন সিঙ্গার। সব কটিই অতি উপাদেয় কিন্তু কোনোটারই বাংলা আছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে চাইলে ইংরেজিতেই পড়তে পারো, ভাষা খুবই সহজ। এখানে সিঙ্গারের কয়েকটা বইয়ের নাম দেওয়া হলো—জ্লাটে দ্য গোট অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, দ্য ফুলস অব চেলম অ্যান্ড দেয়ার হিস্ট্রি, হোয়েন শ্লেমিল ওয়েন্ট টু ওয়ারশ ইত্যাদি।

অলংকরণ: সারা তৌফিকা

এক ছিল গরিব চাষা, নাম জান স্কিবা। বউ আর তিন মেয়ে নিয়ে গ্রাম থেকে দূরে খড়ের চালার এক ঘরের এক কুঁড়েতে সে থাকত। বাড়িতে একটা বিছানা, একটা বেঞ্চি আর একটা চুলা। কোনো আয়না ছিল না। গরিব চাষার জন্য আয়না তো বিলাসিতা। আর চাষার আয়নার দরকারটাই-বা কী? নিজেদের চেহারা নিয়ে তাদের এত আদিখ্যেতা নেই।

এই চাষার কুঁড়েতেই থাকত একটা কুকুর আর একটা বিড়াল। কুকুরটার নাম বুরেক আর বিড়ালটার নাম কট। দুটিরই জন্ম একই সপ্তাহে। নিজের আর পরিবারের জন্য যত সামান্য খাবারই থাকুক, কুকুর আর বিড়ালটাকে কখনো ভুখা রাখত না চাষা। কুকুরটা কোনো কুকুর দেখেনি, বিড়ালটাও দেখেনি অন্য কোনো বিড়াল, শুধু একে অন্যকে দেখেছে তারা। তাই কুকুরটা মনে করত, সে একটা বিড়াল আর বিড়ালটা নিজেকে মনে করত একটা কুকুর। সত্য বটে, তাদের স্বভাব মোটেও এক রকম না। কুকুর ঘেউ ঘেউ করত আর বিড়াল মিঁউ মিঁউ। কুকুর খরগোশ তাড়া করত আর ইঁদুরের জন্য ওত পেতে বসে থাকত বিড়াল। তবে স্বজাতের সব প্রাণীই কি আর এক রকম হয়? চাষার বাচ্চারাই তো দেখতে সব এক রকম না। ফলে মিলেমিশেই থাকত বুরেক আর কট। প্রায়ই এক থালাতে খেত, চেষ্টা করত একে অন্যকে অনুকরণ করার। বুরেক ঘেউ ঘেউ করলে কটও ঘেউ ঘেউ করার চেষ্টা করত। কট মিঁউ মিঁউ করলে বুরেকও তা-ই করার চেষ্টা করত। মাঝেমধ্যে খরগোশ তাড়া করত কট আর ইঁদুর ধরার চেষ্টা করত বুরেক।

গাঁয়ের লোকদের কাছ থেকে ছাগল, মুরগির বাচ্চা, ডিম, মধু ও বাছুর কিনত যেসব ফেরিওয়ালা, তারাও কখনো জান স্কিবার কুঁড়েতে আসত না। তারা জানে, স্কিবা এত গরিব যে বিক্রি করার মতো কিছুই তার নেই। কিন্তু একদিন কীভাবে যেন পথ ভুলে এক ফেরিওয়ালা সেখানে চলে এল। ভেতরে গিয়ে সে যখন তার পসরা মেলে ধরল, মনিহারি বেশভূষার চাকচিক্যে ঝলসে গেল জান স্কিবার বউ আর মেয়ের চোখ। ঝোলা থেকে বেরোল হলুদ পুঁতি, নকল মুক্তা, টিনের দুল, আংটি, ব্রোচ, রঙিলা রুমাল, ফিতাসহ আরও মনিহারি সামগ্রী। তবে বাড়ির মেয়েদের সবচেয়ে মুগ্ধ করল কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা আয়না। ফেরিওয়ালার কাছে ওটার দাম জানতে চাইল তারা। সে বলল, আধা গিল্ডেন। গরিব চাষার জন্য তা-ই অনেক। কিছুক্ষণ পর ফেরিওয়ালাকে একটা প্রস্তাব দিল স্কিবার বউ মারিয়ানা। আয়নাটার জন্য মাসে মাসে পাঁচ গ্রোশেন করে দেবে ও। একটু ইতস্তত করল ফেরিওয়ালা। থলের অনেকটা জায়গা দখল করে আছে আয়নাটা, যেকোনো সময় ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা তো আছেই। ফলে প্রস্তাবটা মেনে নেবে বলেই ঠিক করল। মারিয়ানার কাছ থেকে প্রথম কিস্তির পাঁচ গ্রোশেন নিয়ে তাকে আয়নাটা দিয়ে দিল। এই এলাকায় তার প্রায়ই আসা পড়ে আর স্কিবাদেরও সে ভালো মানুষ বলেই জানে। ক্রমে পুরো টাকাটাই সে ফেরত পাবে লাভসমেত।

কুঁড়েতে অসন্তোষের জন্ম দিল এই আয়না। তখন পর্যন্ত কদাচিৎ নিজেদের দেখতে পেত মারিয়ানা আর তার বাচ্চারা। আয়নাটা হওয়ার আগ পর্যন্ত দরজার পাশের পানির পিপেতেই শুধু নিজেদের ছায়া দেখতে পেত তারা। আর এখন তারা পরিষ্কার নিজেদের দেখতে পায়, ফলে নিজেদের মুখে খুঁত খুঁজে পেতে শুরু করল তারা—এমন সব খুঁত, যা আগে তারা খেয়ালই করেনি। মারিয়ানা সুন্দরই, তবে সামনের পাটির একটা দাঁত নেই তার। তার মনে হতে লাগল, এ জন্য তাকে কুিসত লাগে। এক মেয়ে আবিষ্কার করল, নাকটা তার বড্ড চ্যাপটা আর চওড়া; দ্বিতীয় জনের মনে হলো, তার থুতনিটা বেশি চাপা আর লম্বা; আর তৃতীয়জনের মুখটা যেন তিলে সয়লাব। জান স্কিবাও একঝলক নিজেকে দেখে নিল আয়নায় আর পুরু ঠোঁট আর খরগোশের মতো বেরিয়ে আসা দাঁতগুলো দেখে অসন্তুষ্ট হলো। ওই দিন আয়নাটা নিয়ে এতটাই মশগুল হয়ে রইল বাড়ির মেয়েরা যে রাতের রান্না হলো না, তৈরি হলো না বিছানা, হেলায় পড়ে রইল অন্যান্য গৃহস্থালির কাজকর্ম। বড় শহরের এক দাঁতের চিকিৎসকের কথা শুনেছে মারিয়ানা যে পড়ে যাওয়া দাঁত বাঁধাতে পারে, কিন্তু কাজটা খুব খরচসাপেক্ষ।

অলংকরণ: সারা তৌফিকা

পরস্পরকে এই বলে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল মেয়েরা যে, দেখতে তারা যথেষ্টই সুন্দর আর ঠিক ঠিক বরও পেয়ে যাবে। তবে আগের মতো হাসিখুশি আর রইল না তারা। শহুরে মেয়েদের ঘোড়া রোগে ধরল তাদের। নাকটাকে আরও খাড়া করার জন্য আঙুল দিয়ে খালি টানতে লাগল বোঁচা নাক; থুতনিটাকে ছোট করার জন্য কবজি দিয়ে খালি চাপতে লাগল লম্বা থুতনি; আর শহরে তিল দূরীকরণ মলম পাওয়া যায় কি না, তাই ভেবে সারা হলো তিলওয়ালি। কিন্তু কোত্থেকে আসবে শহরে যাওয়ার ভাড়া? মলম কেনার টাকারই বা কী হবে? এই প্রথম নিজেদের গরিবিটা ভালো করে টের পেল স্কিবা পরিবার আর বড়লোকদের হিংসে হলো।

বাড়ির মানব সদস্যরাই শুধু প্রভাবিত হলো না, কুকুর-বিড়ালটাকেও বিচলিত করল আয়নাটা। কুঁড়েটা বেশ নিচু আর একটা বেঞ্চির ঠিক ওপরেই ঝুলত আয়নাটা। প্রথম যখন লাফিয়ে বেঞ্চিতে উঠে আয়নায় নিজের ছবি দেখল বিড়াল, রীতিমতো ধন্দে পড়ে গেল। এমন চিজ তো আগে কখনো দেখিনি। খাড়া হয়ে উঠল কটের গোঁফ, ছায়াকে লক্ষ করে মিঁয়াও মিঁয়াও করতে লাগল, থাবা তুলল। কিন্তু অন্য প্রাণীটাও উল্টো মিঁয়াও করল, থাবা তুলল। অচিরেই কুকুরটাও লাফিয়ে বেঞ্চে উঠল, অন্য কুকুরটাকে দেখে সেও রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ল। অন্য কুকুরের দিকে ঘেউ ঘেউ করে উঠল, তাকে দাঁত খিঁচাল। কিন্তু অন্যটাও তাকে ঘেউ ঘেউ করল, দাঁত দেখাল। তারা এত কষ্ট পেল যে জীবনে এই প্রথম একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বুরেক আর কট। খুবলে কটের গলার মাংস ছিঁড়ে নিল বুরেক; হিস হিস করতে করতে বুরেকের নাকমুখ খামচে ধরল কট। তাদের গা থেকে রক্ত পড়তে লাগল, রক্ত দেখে এত খেপে গেল তারা যে আরেকটু হলেই পরস্পরকে খুন বা পঙ্গু করে দিত। কোনোরকমে তাদের আলাদা করল পরিবারের সদস্যরা। আর কুকুর যেহেতু বিড়ালের চেয়ে শক্তিশালী, তাই বুরেককে বাইরে বেঁধে রাখতে হলো। সারা দিন সারারাত খালি আর্তনাদ করল ও। মনঃকষ্টে কুকুর-বিড়াল দুটোই খাওয়া বন্ধ করে দিল।

তার গৃহস্থালিতে আয়নার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে জান স্কিবা ঠিক করল, তার পরিবারে আয়নার দরকার নেই। সে বলল, ‘দেখার জন্য যখন আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, তারা; বনরাজি, তেপান্তর, নদী, গাছপালাসহ আস্ত দুনিয়াটাই আছে, তখন নিজেকে দেখার দরকারটা কী?’ সে দেয়াল থেকে আয়নাটা নামিয়ে গুদামে রেখে দিল। মাসিক কিস্তি নিতে যখন ফেরিওয়ালা এল, আয়নাটা তাকে ফেরত দিল জান স্কিবা; বদলে মেয়েদের জন্য নিল রুমাল আর চপ্পল। আয়নাটা বিদায় হওয়ার পর আবারও স্বাভাবিক হয়ে গেল বুরেক আর কট। আবারও নিজেকে বিড়াল মনে করল বুরেক আর কট কুকুর। নিজেদের মধ্যে এত খুঁত খুঁজে পাওয়ার পরও মেয়েদের ভালো বিয়ে হয়ে গেল। জান স্কিবার বাড়িতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার কথা শুনে গ্রামের পুরোহিত বলল, ‘কাচের আয়না তো শুধু মানুষের চামড়াটাই দেখাতে পারে, তবে নিজেকে আর পরিবারকে আর যত দূর সম্ভব তার সাহচর্যে আসা মানুষজনদের সাহায্য করার সদিচ্ছার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের প্রকৃত চেহারা। এ ধরনের আয়নাই মেলে ধরে একজন মানুষের প্রকৃত অন্তর।’