পিকাসোর পেইন্টিং

ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে হন্তদন্তভাবে লিকক মিউজিয়ামে ঢুকল অয়ন হোসেন আর জিমি পারকার।
‘দেরি করে ফেলিনি তো?’ উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল জিমি।
কবজিতে বাঁধা হাতঘড়িতে চোখ বোলাল অয়ন। ‘নাহ্, এখনো কয়েক মিনিট বাকি।’
‘থ্যাংক গড!’
মিউজিয়ামের বিশাল গ্যালারিতে ঢুকল ওরা। চারপাশের দেয়ালে ঝুলছে অসংখ্য দামি পেইন্টিং। এক প্রান্তে একটা ফ্রেম ঢেকে রাখা হয়েছে মখমলের কাপড় দিয়ে, সেটার সামনে জমেছে ছোটখাটো একটা ভিড়। দুজন এগিয়ে গেল সেদিকে। কাছাকাছি যেতেই ওদের দেখতে পেয়ে ভিড় থেকে বেরিয়ে এল ওদের বান্ধবী ভিক্টোরিয়া ওয়েস্টমোর ওরফে রিয়া। ভুরু কুঁচকে রয়েছে তার।
‘এতক্ষণে আসার সময় হলো তোমাদের? আমার তো মনে হচ্ছিল আর আসবেই না!’
‘ওভাবে তাকিয়ো না,’ বলল জিমি। ‘সব দোষ অয়নের। সেই কখন থেকে ডাকাডাকি করছি, বেরোল হেলেদুলে। কপাল ভালো যে সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি পেয়েছি।’
‘এর সঙ্গে কপালের কোনো সম্পর্ক নেই,’ ভারিক্কি গলায় বলল অয়ন। ‘পাড়ার মোড়ে সব সময় ট্যাক্সি পাওয়া যায়—সেটা হিসাবে ছিল আমার। ইন ফ্যাক্ট, কখন রওনা হলে ঠিক সময়ে পৌঁছাব, তার চুলচেরা হিসাব করে তবেই বেরিয়েছি। খামোকা আধঘণ্টা আগে এসে বসে থাকার তো কোনো মানে হয় না।’
‘জ্যামে পড়লে বুঝতি! চুলচেরা হিসেব তখন ভুল-চেরা হিসেব হয়ে যেত...’
হি হি করে হেসে ফেলল রিয়া। অয়ন রেগে কিছু বলতে চাইছিল, বাধা পেল ভিড়ের এক পাশ থেকে রিয়ার মা মিসেস ডায়ানা ওয়েস্টমোরের ডাক ভেসে আসায়।
‘রিয়া, অয়ন, জিমি, এদিকে চলে এসো। সময় হয়ে গেছে।’
কথা না বাড়িয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল তিন বন্ধু। মিসেস ওয়েস্টমোরকে অভিবাদন জানাল অয়ন-জিমি। তারপর তাকাল দেয়ালের গায়ে মখমলে ঢাকা আকৃতিটার দিকে।
‘ওটাই সেই পেইন্টিং?’ জানতে চাইল জিমি।
‘হ্যাঁ,’ বললেন ডায়ানা। ‘পাবলো পিকাসোর পেইন্টিং—দ্য লেডি অ্যান্ড দ্য মিরর।’
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, জানা আছে তিন বন্ধুর। বিমূর্ত চিত্রকর্মের মাধ্যমে তিনি রীতিমত বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন শিল্পজগতে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক টাকা খরচ করে তাঁরই একটা পেইন্টিং সংগ্রহ করা হয়েছে লিকক মিউজিয়ামের জন্যে, আজ সেটার পর্দা উন্মোচন করা হবে। পেইন্টিংটা সংগ্রহ করেছেন মি. ম্যাক্স হারকার—মিউজিয়ামের নতুন কিউরেটর...মিসেস ওয়েস্টমোরের পুরোনো বন্ধু, এককালে রিয়ার আর্ট টিচারও ছিলেন তিনি। তারই আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানটায় যোগ দিতে এসেছে ওরা।
‘দ্য লেডি অ্যান্ড দ্য মিরর পিকাসোর সবচেয়ে দুর্লভ চিত্রকর্মগুলোর একটা,’ স্বভাবসুলভ জ্ঞানী জ্ঞানী সুরে বলল অয়ন। কোথাও যাওয়ার আগে বিস্তারিত পড়াশোনা করে নেওয়া ওর অভ্যাস। ‘১৯৪৩ সালে এঁকেছিলেন। আশির দশকের শেষদিকে এক অজ্ঞাতনামা কোটিপতি নিলাম থেকে কিনে নিয়েছিলেন ওটা। ছবিটা এরপর আর কখনো জনসমক্ষে দেখা যায়নি, পড়ে ছিল সেই কোটিপতির ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়...’
‘আবার লেকচার দিতে শুরু করলি?’ বিরক্ত গলায় বলল জিমি।
‘এখানে লেকচারের কী দেখলি?’ আহত গলায় বলল অয়ন। ‘এত বিখ্যাত একটা পেইন্টিং দেখতে এসেছি, সেটার ইতিহাস জানা থাকা ভালো না?’
‘তোর কাছে পেইন্টিংয়ের ইতিহাস কেউ জানতে চেয়েছে? এটা মিউজিয়াম। এখানে পেইন্টিংয়ের পাশে বড় বড় ফলক লাগিয়ে তাতে ইতিহাস লিখে রাখে। যার ইচ্ছা সে পড়ে নেবে। তোর এত বক বক করার দরকার কী?’
‘আমার তো মনে হয় দরকারটা তোমারই,’ ফোড়ন কাটল রিয়া। ‘তোমার কথা ভেবেই বলছে। পিকাসোর নাম শুনেছ কোনো দিন?’
কটমট করে ওর দিকে তাকাল জিমি। ‘আমি পিকাসোর নাম শুনিনি? কী ভাবো তুমি আমাকে?’
‘আরে, এবার দেখি তোরা লেগে গেলি!’ বিস্মিত গলায় বলল অয়ন। ‘ঝগড়াঝাঁটি থামা!’
‘ঝগড়া কোথায় দেখলে?’ বলল রিয়া। ‘ঝগড়া করার সময় নেই আমার। আমি হলাম গিয়ে...যাকে বলে এক্সাইটেড। আমার পুরোনো টিচার পুরোদস্তুর একটা মিউজিয়ামের কিউরেটর হয়ে গেছেন, ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে।’
‘আন্টির নিশ্চয়ই কিছুটা ভূমিকা আছে তাতে?’ জিজ্ঞেস করল অয়ন। ‘আমি শুনেছি আপনি এই মিউজিয়ামের পৃষ্ঠপোষকদের একজন।’
‘আরে নাহ্, আমার কোনো ভূমিকা নেই,’ বললেন ডায়ানা। ‘আমি শুধু নামটা প্রস্তাব করেছিলাম, কাজটা ও নিজের যোগ্যতাতেই পেয়েছে। আর সেটার প্রমাণও দিয়েছে পিকাসোর পেইন্টিংটা সংগ্রহের মাধ্যমে। মিউজিয়ামের সবচেয়ে দামি আর উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মগুলোর একটা হতে চলেছে ওটা।’
‘ঠিক বলেছেন,’ একমত হলো অয়ন। ‘পেইন্টিংটা তো এক হিসেবে হারিয়েই গিয়েছিল। ওটাকে খুঁজে বের করা, তারপর আবার কিনে আনা...চাট্টিখানি কাজ নয়।’
‘তা আর বলতে!’
আশপাশে নজর বোলাল অয়ন। পঁচিশ থেকে ত্রিশজনের মত মানুষ উপস্থিত হয়েছে অনুষ্ঠানে। তাদের ভেতর রয়েছে মিউজিয়ামের পৃষ্ঠপোষক, শিল্পবোদ্ধা আর শিল্পসমালোচকেরা। কিছু সাংবাদিকও রয়েছে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পিকাসোর হারানো পেইন্টিংটা দেখার জন্যে।
অপেক্ষার অবসান ঘটল খানিক পরই। সবার সামনে উপস্থিত হলেন কিউরেটর ম্যাক্স হারকার—সুদর্শন, মাথায় সোনালি চুল, বয়স চল্লিশের কোঠায়। তার সঙ্গে ছোটখাটো গড়নের আরেকজন রয়েছে; ডায়ানা জানালেন, সঙ্গীটির নাম সল বেলামি—মি. হারকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট।
হাততালি দিয়ে কিউরেটরকে স্বাগত জানাল অতিথিরা। মখমলে ঢাকা পেইন্টিংটার সামনে দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে একটা বক্তব্য দিলেন হারকার। শেষে বললেন, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে এবার আপনাদের সামনে আমি পেশ করছি পিকাসোর হারানো মাস্টারপিস...দ্য লেডি অ্যান্ড দ্য মিরর।’
করতালির মধ্যে একটানে মখমলের পর্দাটা সরিয়ে নিলেন তিনি। উদ্ভাসিত হলো চমত্কার একটা বিমূর্ত চিত্রকর্ম—ছোট্ট একটা আয়না ধরে বসে থাকা একটি নারীর ছবি।
ভুরু কোঁচকাল অয়ন। পিকাসোর আঁকা ছবি হিসেবে যতটা সুন্দর হবে ভেবেছিল, ততটা সুন্দর লাগছে না ওটা। দেখা গেল, অনুভূতিটা ওর একার নয়। কপালে ভাঁজ ফেলে মোটাসোটা এক লোক এগিয়ে গেল ছবিটার দিকে। লোকটার মাথায় মস্ত টাক, মুখভর্তি দাড়ি। কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ছবিটা, একটা আঙুল তুলে স্পর্শ করল। পরক্ষণে বদলে গেল তার চেহারা। ঘুরে দাঁড়াল ঝট করে।
দর্শকরা তখনো হাততালি দিচ্ছে। হাত তুলে সে গমগমে গলায় বলল, ‘থামুন আপনারা। হাততালি দেবার কিছু নেই। ছবিটা নকল!’

দুই
গুঞ্জন উঠল দর্শকদের মধ্যে।
হারকারের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন পেইন্টিংটার দিকে। ‘না! এ হতে পারে না।’
‘যা বলছি, ঠিকই বলছি,’ জোর গলায় বলল টাকমাথা লোকটা। ‘আমি বাজে কথা বলি না।’
‘কে এই লোক?’ ফিসফিসিয়ে মিসেস ওয়েস্টমোরের কাছে জানতে চাইল অয়ন।
‘জর্জ ন্যাডলার—মিউজিয়াম ওয়ার্ল্ড পত্রিকার সম্পাদক,’ জানালেন ডায়ানা।
উদ্ধত ভঙ্গিতে হারকারের দিকে ফিরে দাঁড়িয়েছে লোকটা। বলল, ‘শুনুন, আমি একজন পিকাসো-বিশেষজ্ঞ। তাঁকে নিয়ে রীতিমত গবেষণা করেছি। একদেখাতেই বলে দিতে পারি, কোনটা পিকাসোর পেইন্টিং আর কোনটা নয়। আপনার এই ছবিটায় না আছে পিকাসোর তুলির শক্তিশালী আঁচড়, না আছে তাঁর সূক্ষ্ম রঙের খেলা। এটা কিছুতেই জেনুইন হতে পারে না।’
হারকার কোনো জবাব দিলেন না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সল বেলামির দিকে তাকাল ন্যাডলার। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী, আপনিও ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না?’
অস্বস্তির সঙ্গে মাথা ঝাঁকাল হারকারের অ্যাসিসটেন্ট। বলল, ‘ইয়ে...হ্যাঁ, আমার কাছেও নকলই মনে হচ্ছে। খুবই কাঁচা হাতের নকল।’
জিব দিয়ে আঙুলের ডগা ভেজাল ন্যাডলার, তারপর আঙুলটা ঘষল ছবির গায়ে। সাদাটে রং উঠে এল আঙুলের ডগায়।
‘এই দেখুন,’ সবাইকে দেখাল সে। ‘ছবিটা গুয়াশ পেইন্ট দিয়ে আঁকা—পানিজাতীয় কোনো তরল লাগলেই মুছে যায়। কিন্তু পিকাসোর হলে এটা অয়েল পেইন্ট দিয়ে আঁকা হতো। এর কোনো ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে, মি. হারকার?’
কিউরেটরকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। বললেন, ‘আ...আমি জানি না। কিন্তু আমি যে পেইন্টিংটা কিনেছি, এটা সেটা নয়। নিশ্চয়ই কেউ বদলে দিয়েছে।’
‘বাহ্‌, ভালোই গল্প ফেঁদেছেন!’ বাঁকা হাসি হাসল ন্যাডলার। ‘নিজের দোষ আরেকজনের ঘাড়ে চাপানোর ফন্দি। বদলেছেন তো আপনি! এ কোনো নতুন ঘটনা নয়—মিউজিয়ামের আসল আর্টওয়ার্ক সরিয়ে নকল ঝোলানো, আর আসলটা গোপনে কোনো প্রাইভেট কালেক্টরের কাছে বিক্রি করে দেওয়া। এভাবে অসৎ কিউরেটররা নিজেদের পকেট ভারী করে।’
আর চুপ করে থাকা সম্ভব হলো না রিয়ার পক্ষে। দুপা এগিয়ে গেল ও। কড়া গলায় বলল, ‘এ অন্যায়! মনগড়া অভিযোগ আনছেন আপনি মি. হারকারের বিরুদ্ধে। কোনো প্রমাণ নেই আপনার হাতে!’
‘প্রমাণ জোগাড় করার দায়িত্ব পুলিশের,’ বলল ন্যাডলার। ‘এখুনি ওদেরকে খবর দিচ্ছি।’
পকেট থেকে সেলফোন বের করে একদিকে চলে গেল সে। বিস্মিত দর্শকদের সামনে একাকী দাঁড়িয়ে রইলেন হারকার।
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল নীরবতায়। তারপর তিনি বললেন, ‘ক্ষমা চাইছি সবার কাছে। বিশ্রী একটা ব্যাপার...আমাদের পেইন্টিংটা নিশ্চয়ই চুরি হয়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে, সেটাই বুঝতে পারছি না।’
‘আপনাদের এখানে সিকিউরিটি সিস্টেম নেই?’ ভিড়ের মাঝ থেকে প্রশ্ন ছুড়ল একজন।
‘আছে,’ এবার জবাব দিল বেলামি। ‘একেবারে প্রথম শ্রেণির সিকিউরিটি সিস্টেম। নিখুঁত। অ্যালার্ম না বাজিয়ে কারও পক্ষেই কোনো জিনিস সরানো সম্ভব নয়।’
‘তা হলে এত বড় একটা অঘটন ঘটল কী করে?’ ক্রুদ্ধ গলায় জানতে চাইলেন পৃষ্ঠপোষকদের একজন। ‘জবাব দিন, মি. হারকার। নইলে আমাদেরকে কঠিন কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে গেলেন ডায়ানা। হাত তুলে বললেন, ‘দয়া করে শান্ত হোন আপনারা। ম্যাক্স হারকারকে আমি বহু বছর থেকে চিনি, ওর সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিছু একটা রহস্য আছে এখানে। পুলিশ আসুক, সব জানা যাবে। ততক্ষণ একটু ধৈর্য ধরুন সবাই।’
‘কী জানা যাবে, তা এখুনি বলে দিতে পারি,’ বেরসিকের মতো বলে উঠল ন্যাডলার, টেলিফোন শেষ করে ফিরে এসেছে সে। ‘দেখবেন, ওই হারকারই নাটের গুরু।’
‘এভাবে বলতে পারেন না আপনি!’ প্রতিবাদ করলেন ডায়ানা।
‘বেশ, আপাতত চুপ করলাম। পুলিশ আসছে। ওরা বলেছে সবার জবানবন্দি নেবে, কেউ যেন চলে না যায়।’
কাঁধ ঝাঁকালেন হারকার। দর্শকদের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনাদের অসুবিধার জন্যে দুঃখিত। দয়া করে যদি গ্যালারির পাশের কামরায় যান, সেখানে সবার জন্যে চা-নাশতার বন্দোবস্ত রয়েছে। আশা করি, সময় কাটাতে সমস্যা হবে না।’
বিরক্তিসূচক বিভিন্ন রকম আওয়াজ করতে করতে রওনা হলো সবাই।
অয়ন নড়েনি। ভুরু কুঁচকে পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে আছে ও, নিচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে।
রিয়া বলল, ‘কিছু একটা করা দরকার! মি. হারকার নির্দোষ। কেউ ওঁকে ফাঁসাবার চেষ্টা করছে।’
‘মি. ন্যাডলারের কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেবার নয়,’ বলল জিমি। ‘কিউরেটরের যোগসাজশে মিউজিয়াম থেকে জিনিস চুরির ঘটনা আমরা আগেও দেখেছি।’
‘অসম্ভব!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রিয়া। ‘মি. হারকারকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। উনি অমন ধরনের মানুষই নন। সন্দেহ যদি করতে হয় তো ওই ন্যাডলার ব্যাটাকেই করা দরকার। আর কেউ কিছু বলল না, সে অমন খেপে উঠল কেন? তাও আবার মি. হারকারের বিপক্ষে?’
অয়নকে একটা খোঁচা মারল জিমি। ‘কী হলো? তুই এভাবে গুম মেরে গেলি কেন?’
বড় করে শ্বাস ফেলল অয়ন। ‘ভাবছি,’ বলল ও। ‘টাইমিংটা গোলমেলে। মি. হারকারই যদি চুরিটার সঙ্গে জড়িত থাকেন, পেইন্টিংটা আজকের অনুষ্ঠানের আগে সরালেন কেন? পরে সরালেই কি আরও নিরাপদ হতো না? এ তো জানা কথা, অনুষ্ঠানে অভিজ্ঞ লোকেরা থাকবেন, তারা এক দেখাতেই ধরে ফেলবেন নকলটা।’
‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা রহস্যজনক,’ একমত হলো জিমি।
‘কী করতে চাও এখন?’ রিয়া জানতে চাইল।
‘কীভাবে কী ঘটেছে, জানতে হবে। এখনো তো কিছুই জানি না। মি. হারকারের সঙ্গে কথা বলা দরকার।’
হারকারকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন ডায়ানা। তিন বন্ধুকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। বললেন, ‘চলো, ম্যাক্সের অফিসে গিয়ে বসি। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।’
পথ দেখিয়ে ওদের মিউজিয়ামের বেজমেন্টে নিয়ে গেলেন হারকার, ওখানেই কিউরেটরের অফিস। পাশেই বড় একটা ওয়ার্করুম, সেখানে রয়েছে ইজেল, ফ্রেমসহ নানা রকম সরঞ্জাম। কিউরেটরের রুমটাও নানা রকম প্যাকিং ক্রেটে বোঝাই, তার মাঝখানে কোনোমতে বসানো হয়েছে তার ডেস্ক। একটা চেয়ারে বসলেন ডায়ানা, ছেলেমেয়েরা বসল কয়েকটা ক্রেটের ওপর।
নিজের চেয়ারে বসে হতাশভাবে মাথা নাড়লেন হারকার। ‘কাজটা নেওয়াই উচিত হয়নি। আমি এর যোগ্য নই।’
‘বাজে কথা বোলো না তো!’ মৃদু ভর্ৎসনা করলেন ডায়ানা। ‘যোগ্যতার কোনো অভাব নেই তোমার। নিজের মেধার জোরেই চাকরিটা পেয়েছ। অন্য কিছু ভাবতে যেয়ো না।’
‘থ্যাংকস,’ মলিন হাসলেন হারকার। ‘কিন্তু পেইন্টিংটা যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, আমার মেধা বা যোগ্যতার কোনো মূল্য থাকবে না। ওপরে কী ঘটল তো দেখলে। সবাই আমাকেই দুষছে।’
‘যদি কিছু মনে না করেন, স্যার,’ বলল অয়ন, ‘আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাই।’
ভ্রূকুটি করলেন হারকার। ‘তোমরা?’
‘জি, স্যার। আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন। এ ধরনের কেস সামলাবার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের।’
প্রশ্নবোধক চোখে ডায়ানার দিকে তাকালেন হারকার। ‘ওর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী বলতে চায়?’
হাসলেন ডায়ানা। ‘অয়ন আর জিমি শখের গোয়েন্দা। রিয়াও মাঝেমধ্যে সাহায্য করে ওদের। বেশ কিছু রহস্য সমাধান করেছে।’
‘গোয়েন্দা! এই বয়সে!’
‘ভালো গোয়েন্দা হবার সঙ্গে বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই, স্যার,’ ভারিক্কি গলায় বলল অয়ন। ‘প্রয়োজন শুধু মগজের জোর আর পর্যবেক্ষণশক্তি। দুটোই আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে আছে।’
‘বেশ কনফিডেন্ট দেখছি,’ মন্তব্য করলেন হারকার। ‘ঠিক আছে, সাহায্য যদি করতে চাও তো বাধা দেব না। এ মুহূর্তে সাহায্যই দরকার আমার। এখানে যোগ দেবার পর থেকেই একের পর এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছি।’
‘কী ধরনের ঝামেলা?’
‘খুব বড় কিছু নয়। কয়েকটা ডেলিভারি রহস্যজনকভাবে ক্যান্সেল হয়ে গেছে। দুবার মিউজিয়ামের জিনিসপত্র তছনছ করা হয়েছে। আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না আরকি। হুমকিও দেওয়া হয়েছে।’
‘কে হুমকি দিয়েছে?’
‘জানি না। অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল কয়েকবার। নিজের ভালো চাইলে আমাকে লস অ্যাঞ্জেলেস ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। এখানে নাকি আমার ঠাঁই হবে না।’
মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তিন বন্ধু।
‘হঠাৎ এমন হুমকি কেন?’ জিজ্ঞেস করল জিমি।
‘কারণ, লস অ্যাঞ্জেলেসের শিল্পজগতে আমি বহিরাগত। বলার মতো কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই আমার। লিকক মিউজিয়ামের মতো নামকরা জায়গার কিউরেটর হয়ে বসেছি—এটা পছন্দ হচ্ছে না কারও। খানিক আগেই তো দেখলে, ন্যাডলার কীভাবে কথা বলল আমার সঙ্গে।’
‘এটা কোনো কথা হলো?’ রিয়া বিস্মিত। ‘এ তো রীতিমত অন্যায়!’
‘এখানে আমাকে টিকতে দেবে না ওরা,’ হতাশ গলায় বললেন হারকার। ‘বলা যায় না, পেইন্টিং চুরি হয়তো সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।’
‘এমন কোনো ষড়যন্ত্র আমরা সফল হতে দেব না, মি. হারকার,’ দৃঢ় গলায় বলল রিয়া।
‘চেষ্টা যে করতে চাইছ, তাতেই আমি কৃতজ্ঞ, রিয়া,’ বললেন হারকার।
গলা খাঁকারি দিল অয়ন। ‘এবার কয়েকটা প্রশ্ন করি?’
‘শিওর,’ মাথা ঝাঁকালেন হারকার।
‘পেইন্টিংটা শেষ কখন দেখেছেন আপনি?’
‘গতকাল বিকেলে। নিজ হাতে ঝেড়ে-মুছে মখমলের পর্দা দিয়ে ঢেকেছি।’
‘তখন থেকে এখন পর্যন্ত কার কার সুযোগ ছিল ওটার কাছে যাবার?’
‘অনেকেরই ছিল।’
‘একটা লিস্ট পেতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই।’
দরজায় আওয়াজ হলো। সল বেলামি ঢুকল ভেতরে। বলল, ‘পুলিশ এসেছে।’
তার পিছু পিছু কামরায় ঢুকল স্যুট পরা এক ডিটেকটিভ। আইডি কার্ড দেখিয়ে পরিচয় দিল নিজের। ‘আমি ডিটেকটিভ ট্যানার। লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ। কিউরেটর কে?’
‘আমি,’ উঠে দাঁড়ালেন হারকার। ‘ম্যাক্স হারকার।’
‘গ্ল্যাড টু মিট ইউ,’ বলল ট্যানার। ‘কিছু মনে করবেন না, আমরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। আমার লোকেরা এখানকার সিকিউরিটি সিস্টেম চেক করে দেখছে। প্রথম দেখায় মনে হলো, সিস্টেমটা কাজ করছে ঠিকমতোই।’
‘তা হলে ছবিটা বের করে নিল কীভাবে?’
‘হয়তো নেয়নি,’ বলে উঠল অয়ন।
ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল ট্যানার। পরক্ষণে বিস্ময় ফুটল চেহারায়। ‘অয়ন হোসেন না? আরে, জিমি আর রিয়াও আছে দেখছি!’
‘আপনি এদের চেনেন?’ জিজ্ঞেস করলেন হারকার।
‘চিনব না কেন? রিয়া হলো আমাদের কলিগ লেফটেন্যান্ট জন করবিনের ভাগনি। অয়ন-জিমি ওর বন্ধু। এরা গোয়েন্দাগিরি করে, আর সে সূত্রে প্রায়ই দেখা হয় ওদের সঙ্গে।’ ডায়ানার ওপর চোখ পড়ল ট্যানারের। ‘মিসেস ওয়েস্টমোর! আপনাকে আমি খেয়াল করিনি, সরি।’
‘ইটস ওকে, ডিটেকটিভ,’ হাসলেন ডায়ানা।
‘ওরা রহস্যটা তদন্ত করে দেখতে চাইছে,’ বললেন হারকার। ‘আমি রাজি হয়েছি।’
‘ভালো সিদ্ধান্ত,’ বলে আবার অয়নের দিকে ফিরল ট্যানার। বেশ সিরিয়াস দেখাচ্ছে তাকে। ‘হ্যাঁ, এখন বলো...পেইন্টিংটা নেয়নি বলতে কী বোঝালে?’
‘একটা সম্ভাবনার কথা বললাম,’ বলল অয়ন। ‘সিকিউরিটি যদি ঠিকঠাক থাকে, পেইন্টিংটা মিউজিয়াম থেকে বের করে নেওয়া সম্ভব নয়। হয়তো লুকিয়ে রাখা হয়েছে ওটা, যাতে সুযোগ বুঝে আস্তে-ধীরে সরিয়ে ফেলা যায়।’
‘তা হলে ভেতরেই লুকিয়েছে ভাবছ?’
‘সম্ভাবনা তো আছেই।’
চোয়াল চুলকাল ট্যানার। ‘কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। ঠিক আছে, ওপরের সবার ইন্টারভিউ শেষ হলে আমার লোকজনকে দিয়ে পুরো মিউজিয়ামে তল্লাশি চালাব। আরেকটা ব্যাপার...ছবিটা সরাবার মতো সুযোগ কার কার ছিল, সেটা জানা দরকার।’
‘আপনি আসার আগে ওটা নিয়েই কথা হচ্ছিল,’ বলল জিমি। ‘মি. হারকার আমাদেরকে একটা লিস্ট করে দেবেন।’
‘লিস্টের একটা কপি আমাকেও দেবেন,’ বলল ট্যানার। ‘আর হ্যাঁ, শহর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। যেতে হলে আমাদেরকে জানিয়ে যাবেন।’
‘আমাকেও কি সন্দেহ করছেন?’ জানতে চাইলেন হারকার।
‘সবাইকেই করছি,’ ট্যানার নির্বিকার। ‘এখন তা হলে আসি। ওপরে সবাই অপেক্ষা করছে, ইন্টারভিউ শুরু করতে হবে।’
চলে গেল সে।
‘ইয়ে...এখানে আসার আগে মি. বেলোজ আমাকে ডেকেছিলেন,’ ইতস্তত করে বলল বেলামি।
‘ওটা আবার কে?’ জিজ্ঞেস করল রিয়া।
‘মিউজিয়াম পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান,’ জানালেন ডায়ানা।
‘কেন ডেকেছিলেন?’ প্রশ্ন করলেন হারকার।
‘বোর্ড মেম্বাররা সবাই রয়েছেন ওপরে,’ বলল বেলামি। ‘চুরির ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাদের মধ্যে।’ একটু থামল সে। ‘মি. হারকার, ওরা চাইছেন, ব্যাপারটার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আপনি রিজাইন করুন। শেষমেশ যদি আপনার কোনো দোষ পাওয়া না যায়, তা হলে না হয় ফিরে আসবেন।’
‘আজই চলে যেতে বলেছে?’
‘হ্যাঁ,’ মিনমিন করে বলল বেলামি। ‘দেখুন, আমি সত্যিই খুব দুঃখিত...’
তাকে থামিয়ে দিলেন হারকার। ‘থাক, তোমাকে আর ক্ষমা চাইতে হবে না। সিদ্ধান্ত তো তুমি নাওনি। বাই দ্য ওয়ে, আমি চলে গেলে এখানকার দায়িত্ব কে নেবে?’
আরও যেন কুঁকড়ে গেল বেলামি। ‘আ...আপাতত আমাকেই নিতে বলেছেন। তবে প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেব বলে ভাবছি।’
‘কক্ষনো না!’ কড়া গলায় বললেন হারকার। ‘আমার অবর্তমানে তুমি ছাড়া আর কাউকে কিউরেটর হিসেবে ভাবতেই পারছি না আমি।’
‘বেশ,’ সিধে হয়ে দাঁড়াল বেলামি। ‘আপনি যদি তা-ই চান, আমি আপত্তি করব না।’
‘কিন্তু মি. হারকার যদি চলে যান, আমাদের তদন্তের কী হবে?’
‘ও নিয়ে কিচ্ছু ভেবো না,’ আশ্বস্ত করল বেলামি। ‘আমার তরফ থেকে সব রকম সাহায্য পাবে তোমরা। আমিও চাই, মি. হারকার নির্দোষ প্রমাণিত হোন।’

তিন
ঘণ্টাখানেক পর মিউজিয়াম থেকে ছাড়া পেল ওরা। মি. হারকারও বেরোলেন, হাবভাবে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে তাকে। এ-অবস্থায় তাকে একাকী ছাড়তে চাইলেন না মিসেস ওয়েস্টমোর, সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন। আপত্তি করলেন না হারকার, করার মতো অবস্থাতেও নেই। উঠে পড়লেন গাড়িতে। রিয়া অবশ্য গেল না, ও রয়ে গেল অয়ন-জিমির সঙ্গে—কেস নিয়ে আলোচনা করার জন্যে। মাকে বলে দিল, ট্যাক্সি নিয়ে পরে বাসায় ফিরবে।
মিউজিয়ামের খুব কাছেই গ্রিফিথ পার্ক, সেখানে গিয়ে ঢুকল তিন বন্ধু। আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে তিনটা আইসক্রিম কিনে ফাঁকা একটা বেঞ্চি দখল করে বসল। বিকেল গড়িয়ে গেছে ততক্ষণে, সন্ধ্যা নামতে বেশি দেরি নেই। ঠান্ডা বাতাস বইছে।
আইসক্রিম খেতে খেতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে অয়ন। রিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছ? পেইন্টিংটা কি মিউজিয়ামে খুঁজে পাওয়া যাবে?’
‘জানি না,’ বড় করে শ্বাস ফেলল অয়ন। ‘পাওয়া না যাবার সম্ভাবনাই বেশি। নিশ্চয়ই ভালোমতো লুকিয়েছে।’
‘কে করতে পারে কাজটা?’ বলল জিমি। ‘লিস্টটা বের কর। দেখি, কিছু আন্দাজ করা যায় কি না।’
‘ও হ্যাঁ,’ পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করল অয়ন, মি. হারকার দিয়েছেন। চোখ বোলাল ওটায়।
‘কাদের নাম আছে?’ জানতে চাইল রিয়া।
‘মি. হারকার আর মি. বেলামির নাম তো আছেই, আর আছে মিউজিয়ামের কিছু কর্মচারী ও কয়েকজন আর্ট স্টুডেন্ট।’
‘আর্ট স্টুডেন্ট!’
‘মি. বেলামির ছাত্রছাত্রী,’ বলল অয়ন। ‘মিউজিয়ামের বেজমেন্টে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে ক্লাস নেন তিনি, ছবি আঁকা শেখান। কিউরেটরের পাশের ঘরটায়।’
‘ও হ্যাঁ,’ মনে পড়ল জিমির। ‘ওখানে ছবি আঁকার জিনিসপত্র দেখেছি।’
‘কখন হয় ক্লাসটা?’ জানতে চাইল রিয়া।
‘দুপুরে,’ বলল অয়ন, হারকারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে সব। ‘লাঞ্চ ব্রেকের সময়।’
‘তা হলে ছাত্রছাত্রীদের কেউ সরায়নি ছবিটা। মি. হারকার তো বিকেলেও দেখেছেন ওটা।’
জিমি বলল, ‘আমার খটকা লাগছে কোথায়, জানিস? অমন কাঁচা হাতের একটা নকল কেন ঝোলাতে গেল দেয়ালে? ওটা দিয়ে তো কাউকেই বোকা বানানো সম্ভব নয়।’
‘সেটা আমারও প্রশ্ন,’ সুর মেলাল অয়ন। ‘নকলই যদি করবে তো ভালোভাবে করল না কেন? অয়েল পেইন্টের বদলে গুয়াশ ব্যবহার করল কেন? দুটোয় আকাশ-পাতাল ফারাক।’
‘এই গুয়াশটা আসলে কী?’
‘একধরনের ওয়াটার বেইজড পেইন্ট...অনেকটা ওয়াটার কালারের মতো, তবে আরও ঘন,’ বলল রিয়া। ‘অয়েল পেইন্টের চেয়ে হালকা। পাশাপাশি রাখলে পরিষ্কার বোঝা যায়।’
‘হুম, ব্যাপারটা অদ্ভুত,’ মন্তব্য করল জিমি।
‘আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে চলেছে,’ বলল অয়ন। ‘ওই দেখ।’
তাকাল জিমি আর রিয়া। পার্কের ওয়াকওয়ে ধরে হেঁটে যাচ্ছে দুজন মানুষ—একজনের মাথায় টাক, অন্যজন শুকনো-পাতলা।
‘মি. বেলামি না?’ ভুরু কোঁচকাল রিয়া।
‘আর মিউজিয়াল ওয়ার্ল্ড পত্রিকার ন্যাডলার,’ বলল অয়ন।
কিছুদূর গিয়ে থামল দুজন। কথা বলছে সিরিয়াস ভঙ্গিতে।
‘ন্যাডলারের সঙ্গে এত কথা কীসের?’ বলল জিমি।
‘শোনা দরকার,’ উঠে দাঁড়াল অয়ন।
‘আমাদেরকে দেখতে পেলে আর কথা বলবে ভেবেছিস?’
আশপাশে নজর বোলাল অয়ন। একদিকে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ফেরিওয়ালার ওপর দৃষ্টি আটকে গেল, বাচ্চাদের জন্য বেলুন আর মুখোশ বিক্রি করছে।
‘জলদি চল, একটা বুদ্ধি পেয়েছি,’ বলল ও।
তাড়াতাড়ি ফেরিওয়ালার কাছে গেল তিনজনে। তিনটা মুখোশ আর কয়েকটা বেলুন কিনল।
‘দামটা দিয়ে দাও,’ রিয়াকে বলল অয়ন।
‘আমি কেন?’ চোখ কপালে তুলল রিয়া।
‘আমি আর জিমি শুধু ট্যাক্সি-ভাড়া নিয়ে এসেছি। বাড়তি টাকা নেই আমাদের কাছে।’
‘দিয়ে দাও, দিয়ে দাও,’ ফোড়ন কাটল জিমি। ‘বড়লোকের মেয়ে...তোমার তো টাকার অভাব নেই।’
‘খবরদার!’ চোখ রাঙাল রিয়া। ‘খোঁটা দেবে না। আমি কখনো বড়লোকি দেখিয়েছি?’
রাগ দেখালেও পার্স খুলে দাম মিটিয়ে দিল ও। মুখোশ আর বেলুনগুলো ভাগাভাগি করে দিল অয়ন।
‘কী করতে চাইছিস?’ জিমি জানতে চাইল।
‘মুখে মুখোশ পরে আর হাতে বেলুন নিয়ে লোকদুটোর কাছে যাব,’ বলল অয়ন। ‘আমাদেরকে দেখলেও চিনতে পারবে না। পার্কে বেড়াতে আসা আর দশটা বাচ্চার মতো ভাববে।’
কথাটা ও ভুল বলেনি, আশপাশে তাকিয়ে বুঝল জিমি। ওদের বয়েসী অনেক ছেলেমেয়েই ঘুরছে পার্কে, খেলাধুলো করছে।
ঝটপট মুখোশ পরে ফেলল তিনজনে। অয়ন বাঘের মুখোশ পরেছে, রিয়া পরেছে সিংহের মুখোশ, জিমিরটা ক্লাউনের। খিলখিল করে হেসে উঠল রিয়া।
‘হাসছ কেন?’ বিরক্ত গলায় বলল জিমি।
‘তোমাকে দেখে,’ হাসতে হাসতে বলল রিয়া। ‘যা লাগছে না! খাঁটি ক্লাউনের মতো!’
‘আমি ক্লাউন?’ রেগে গেল জিমি। ‘আর তোমাকে কিসের মতো লাগছে, জানো? সিংহের মুখোশ পরা একটা ছাগলের মতো!’
‘কী-ই-ই!’
‘অ্যাই!’ ধমকে উঠল অয়ন। ‘ঝগড়াঝাঁটি পরে। জলদি আয়।’
তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল তিনজনে। বেলামি আর ন্যাডলার এখনো কথা বলছে। তাদের কাছাকাছি একটা গাছের কাছে গিয়ে থামল। ছেলেমেয়েদের দিকে কোনো নজর নেই লোকদুটোর, নিজেদের মতো কথা বলে চলল।
‘...আমার মনে হয় আপনার কথাই ঠিক,’ বেলামিকে বলতে শোনা গেল। ‘বহুবারই মি. হারকারের মুখে চোরাই পেইন্টিংয়ের গল্প শুনেছি আমি। ধনী লোকেরা নাকি বহু টাকা দিয়ে ব্যক্তিগত কালেকশনের জন্যে ওগুলো কেনে।’
‘একটা বাইরের লোক,’ বলল ন্যাডলার। ‘ওকে কখনোই পছন্দ হয়নি আমার। মিউজিয়ামের দায়িত্ব নেবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়েছে কিছু একটা গোলমাল পাকাবে।’
‘আমার তো মনে হয় নকল পিকাসোটাও ওরই আঁকা। ওর ছবি আঁকার হাত অমনই। আবার শুনলাম এককালে নাকি আর্টের টিচার ছিল!’
দাঁত কিড়মিড় করল রিয়া। চাপা গলায় বলল, ‘মিথ্যা কথা বলছে। মি. হারকার খুবই ভালো আর্টিস্ট। আমি নিজে তার সাক্ষী!’
‘শ্শ্শ্,’ ওকে চুপ থাকার ইশারা করল অয়ন। ‘পুরোটা শুনতে দাও।’
হাসাহাসি করছে লোকদুটো। ন্যাডলারের কাঁধে একটা হাত রাখল বেলামি। বলল, ‘আমি যে এসব বলেছি, তা আবার পত্রিকায় লিখে দেবেন না যেন!’
‘আরে নাহ্!’ তাকে আশ্বস্ত করল ন্যাডলার। ‘তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, কোথাও তোমার নাম আসবে না। আমি শুধু লিখব, বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া খবর। কী ঘটে না–ঘটে, আমাকে নিয়মিত জানিয়ো।’
‘তা তো জানাবই।’
‘ঠিক আছে। এখন তা হলে আসি। পরে দেখা হবে।’
‘টাকার ব্যাপারটা ভুলবেন না।’
‘ভুলব না। সংবাদদাতাকে টাকা না দিলে খবর পাব কীভাবে?’
হাত মিলিয়ে দুজন চলে গেল দুদিকে।
টান দিয়ে মুখ থেকে মুখোশ খুলে ফেলল রিয়া। রাগে ওর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। গাল দিয়ে উঠল, ‘শয়তান কোথাকার!’
‘ঠিকই বলেছ,’ একমত হলো জিমি। ‘বেলামি লোকটা মোটেই সুবিধার নয়। আমাদের সামনে ভালো সাজল, আর এদিকে ন্যাডলারের কানে বিষ ঢালছে মি. হারকারের নামে।’
‘পেইন্টিং চুরির পেছনে ওরই হাত নেই তো?’
‘সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না,’ গম্ভীর গলায় বলল অয়ন। ‘মোটিভ রয়েছে তার। মি. হারকার চাকরি হারালে তারই লাভ। অলরেডি তাকে অস্থায়ীভাবে কিউরেটর বানানো হয়েছে।’
‘শুধু মোটিভে হবে না,’ মাথা নাড়ল জিমি। ‘প্রমাণও চাই আমাদের। কীভাবে সেটা পাব?’
‘এখনো বুঝতে পারছি না,’ বলল অয়ন। রিয়ার দিকে তাকাল। ‘চলো, তোমার বাসায় যাব। মি. হারকারের সঙ্গে আরেকবার কথা বলা দরকার।’
‘বেলামির ব্যাপারটা জানাব তাকে?’
‘এখুনি না। প্রমাণ ছাড়া কিছু বলতে যাওয়া ঠিক হবে না।’
ট্যাক্সি নিয়ে আধঘণ্টা পর রিয়ার বাসায় পৌঁছাল তিন বন্ধু। হারকারকে ড্রয়িংরুমে পাওয়া গেল, সোফায় বসে আছেন।
‘ডিটেকটিভ ট্যানার ফোন করেছিলেন,’ ওরা ভেতরে ঢুকতেই জানালেন তিনি। ‘পেইন্টিংটা পাওয়া যায়নি।’
‘ভালোমতো খুঁজেছে?’ জিজ্ঞেস করল রিয়া।
‘হ্যাঁ। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে মিউজিয়ামের সবখানে। পায়নি। তোমার ধারণা ভুল, অয়ন। ওটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে মিউজিয়াম থেকে বের করে নিয়ে গেল, সেটাই আমার মাথায় ঢুকছে না।’
মুখোমুখি একটা সোফায় বসল অয়ন। ‘মিউজিয়ামের সিকিউরিটি সিস্টেমটা সম্পর্কে আমাদেরকে একটু ধারণা দিতে পারেন?’
মাথা ঝাঁকালেন হারকার। ‘প্রতিটা পেইন্টিংয়ের সঙ্গে অ্যালার্মের কানেকশন আছে, কেউ দেয়াল থেকে খুলে নিলেই বেজে উঠবে। অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে লক হয়ে যাবে বিল্ডিংয়ের সমস্ত দরজা আর জানালা। ওগুলো যথেষ্ট মজবুত, ভাঙা সম্ভব নয়। কারসাজি করে খোলা হয়েছিল, এমন কোনো আলামতও পায়নি পুলিশ।’
‘এই অ্যালার্ম সিস্টেমটার কন্ট্রোল কার কাছে থাকে?’
‘আমার কাছে,’ বললেন হারকার। ‘একটা মাস্টার কন্ট্রোল বোর্ড থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় পুরোটা, সেটার একটাই চাবি। আর ওটা আমার কাছে থাকে। গতকাল মিউজিয়াম থেকে বের হবার আগে আমি নিজে চেক করে দেখেছি...সব ঠিকমতোই কাজ করছিল।’
‘চাবিটা এখন কোথায়?’
‘আসার সময় বেলামিকে দিয়ে এসেছি।’
মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তিন বন্ধু।
‘গতকাল কি আপনিই সবার শেষে বেরিয়েছেন মিউজিয়াম থেকে?’ অয়নের পরের প্রশ্ন।
মাথা ঝাঁকালেন হারকার। ‘হ্যাঁ। অফিসে কিছু কাজ ছিল, তাই বেরোতে দেরি হয়েছে বেশ। বেলামির কী যেন কাজ ছিল বাসায়, আগেভাগেই চলে গিয়েছিল ও। আমি বেরিয়েছি আটটায়। বেরোবার আগে পুরো বিল্ডিংয়ে চক্কর দিয়েছি, পিকাসোর পেইন্টিংটা পর্দা দিয়ে ঢেকেছি, অ্যালার্ম সিস্টেম চালু আছে কি না চেক করে দেখেছি, তারপর দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।’
‘ওখানে কোনো নাইটগার্ড থাকে না?’ জানতে চাইল জিমি।
‘না। গার্ড যেন রাখতে না হয়, সে জন্যই তো সিকিউরিটি সিস্টেম বসানো হয়েছে। মেলা টাকা খরচ করেছি সিস্টেমটার পেছনে।’
‘হুম,’ গম্ভীরভাবে মাথা দোলাল অয়ন। ‘ঠিক আছে, স্যার। আর কিছু জানার নেই। এখন তা হলে আসি।’
জিমি আর রিয়াকে ইশারা করে উঠে পড়ল ও। ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে এল তিনজনে।
‘জটিল রহস্য,’ বলল জিমি। ‘রীতিমত অসম্ভব একটা কাণ্ড ঘটেছে বলতে হবে।’
‘হ্যাঁ,’ সায় জানাল রিয়া। ‘সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নকল একটা পেইন্টিং ঢোকানো হয়েছে মিউজিয়ামে, আসলটার সঙ্গে অদলবদল করা হয়েছে, তারপর আবার আসলটা বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে...অ্যালার্ম-ট্যালার্ম না বাজিয়েই! কীভাবে সেটা সম্ভব?’
‘সবচেয়ে বড় প্রশ্নটাই করছ না তোমরা,’ চিন্তিত গলায় বলল অয়ন। ‘পেইন্টিংটা শুধু চুরি করলেই চলত, সেটার জায়গায় কাঁচা হাতে আঁকা একটা নকল ছবি ঝোলানো হলো কেন?’
‘কেন?’
‘জানি না। তবে আমার বিশ্বাস, প্রশ্নটার জবাব পেলেই পুরো রহস্যটা পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
‘কীভাবে জানবে?’
‘আগামীকাল সকালে আবার মিউজিয়ামে যাব আমরা,’ বলল অয়ন। ‘ভালো করে দেখতে হবে ভেতরটা। হয়তো এমন কিছু পাব, যা পুলিশের চোখে পড়েনি।’

চার
পরদিন সকাল দশটায় আবারও লিকক মিউজিয়ামে হাজির হলো তিন বন্ধু।
সদর দরজা বন্ধ। পাল্লার গায়ে একটা নোটিশ ঝুলছে, তাতে বলা হয়েছে, ভেতরে মেইনটেন্যান্স ওয়ার্ক চলছে, তাই অনির্দিষ্টকালের জন্যে মিউজিয়াম বন্ধ থাকবে, খোলার তারিখ পরে জানিয়ে দেওয়া হবে।
বন্ধ দরজায় গায়ে টোকা দিল অয়ন। কয়েক মিনিট পর পাল্লা খুলে উঁকি দিল বেলামি। তিন বন্ধুকে দেখে বিস্ময় ফুটল তার চোখে।
‘আরে, তোমরা! হঠাৎ কী মনে করে?’
‘তদন্তের জন্যে এসেছি, স্যার,’ গলায় মধু ঢেলে বলল অয়ন। ‘গতকাল আপনিই তো বলেছিলেন, আমাদেরকে পেইন্টিং চুরির ব্যাপারটা তদন্ত করতে দেবেন।’
‘বলেছিলাম নাকি?’ ভুরু কোঁচকাল বেলামি। ‘ও হ্যাঁ...হ্যাঁ। কিন্তু এখন তো বেশ ঝামেলা চলছে ভেতরে। পরে এলে হয় না?’
‘ক্রাইম সিনটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরীক্ষা করা দরকার, স্যার। দেরি করলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সূত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’
পাল্টা কিছু বলতে পারল না বেলামি। যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় খুলে ধরল দরজা। ‘ঠিক আছে, ভেতরে এসো। কিন্তু বেশি সময় নিয়ো না। ভেতরে কাজ চলছে।’
‘কী ধরনের কাজ?’ ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল রিয়া।
‘রং করাচ্ছি ভেতরটা,’ বলল বেলামি। ‘ডিসপ্লেগুলোও নতুন করে সাজানো হচ্ছে।’
‘মি. হারকার জানেন?’
‘ওনারই আইডিয়া। অনেক দিন আগেই করতে চেয়েছিলেন, সময়ের অভাবে করানো যাচ্ছিল না। ভাবলাম, এই সুযোগে করিয়ে ফেলি। তাতে ভিজিটর আসাও ঠেকানো যাবে। যা একটা ঘটনা ঘটল গতকাল, এখন ভিজিটর ঢুকতে দিলেই হাজারটা প্রশ্ন শোনা লাগবে। তারচেয়ে কয়েক দিন বন্ধ থাকুক মিউজিয়াম। পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক।’
হাঁটতে হাঁটতে গ্যালারিতে পৌঁছাল ওরা। পিকাসোর পেইন্টিংটা যেখানে ঝোলানো ছিল, সে জায়গাটা খালি।
‘ছবিটা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল অয়ন।
‘নিচতলার অফিসে,’ জানাল বেলামি। ‘তালা দিয়ে রেখেছি। পুলিশ আবার দেখতে চাইতে পারে। ওটা তো এভিডেন্স।’
‘হুম। ধন্যবাদ, মি. বেলামি, আমাদেরকে আর সঙ্গ না দিলেও চলবে। আমরা গ্যালারিটা একটু ঘুরে-ফিরে দেখব, কোনো সমস্যা নেই তো?’
‘না, সমস্যা কিসের? দেখো যত খুশি। তবে কোনো কিছুতে হাত দিয়ো না। আমি অফিসে থাকব, কিছু প্রয়োজন হলে জানিয়ো।’
চলে গেল বেলামি। তার গমনপথের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল অয়ন।
‘ব্যাটাকে যত দেখছি, ততই অপছন্দ হচ্ছে,’ বলল রিয়া। ‘মি. হারকার যেতে না–যেতেই মিউজিয়ামে রং করাচ্ছে, সবকিছু নতুন করে সাজাচ্ছে! ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয় মোটেই। নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। চুরির পেছনে ওর হাত থাকলে অবাক হব না।’
আশপাশে তাকাল অয়ন। সত্যিই কাজ চলছে ভেতরে, কয়েকজন রংমিস্ত্রি এক পাশের দেয়ালে নতুন রং চড়াচ্ছে। বেশ কিছু ডিসপ্লে কেস সরিয়ে রাখা হয়েছে এক পাশে।
‘হ্যাঁ, ভদ্রলোকের আচরণ সন্দেহজনক,’ স্বীকার করল ও। ‘তবে ও নিয়ে এখন মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আগে চুরির রহস্য ভেদ করি। এসো।’
পেইন্টিংটা যেখানে ছিল, সেই দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল তিন বন্ধু। ছবিটা সরিয়ে ফেলায় অ্যালার্ম সিস্টেমের তার বেরিয়ে আছে সেখানে।
‘তারটা নিশ্চয়ই ফ্রেমের সঙ্গে লাগানো থাকে,’ জিমি বলল। ‘কানেকশন না কেটে ছবিটা নামানো সম্ভব নয় মোটেই।’
‘সে ক্ষেত্রে অ্যালার্ম বেজে উঠত,’ মাথা নাড়ল অয়ন।
হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়ল রিয়া। খুঁটিয়ে দেখছে মেঝেটা। কিছু একটা চোখে পড়ল ওর।
‘অ্যাই, দেখো!’
ওর পাশে বসে পড়ল অয়ন আর জিমিও। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল মেঝেতে। ফোঁটা ফোঁটা কী যেন লেগে আছে মেঝেতে।
‘রঙের ফোঁটা,’ বলল অয়ন।
‘এতে অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না,’ মন্তব্য করল জিমি। ‘রঙের কাজ চলছে ভেতরে, মেঝেতে রঙের ছিটে পড়বেই।’
‘ভুল বললি। এদিকের দেয়ালে এখনো রং করেনি ওরা, এখানে রং পড়ার কথা নয়।’
‘তা হলে?’
কী মনে হতে জিভ থেকে আঙুলের ডগায় একটু থুতু লাগাল অয়ন, আঙুলটা ঘষল ফোঁটাগুলোর ওপরে। পরক্ষণেই এক লাফে উঠে দাঁড়াল। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে ওর।
‘কী হলো?’ বিস্মিত গলায় জানতে চাইল রিয়া।
‘নকল পেইন্টিংটা দেখতে হবে আমাকে...এক্ষুনি!’
‘চল,’ জিমি উঠে দাঁড়াল। ‘মি. বেলামিকে গিয়ে বলি।’
‘উঁহু। বললে দেখতে দেবে না।’
‘সে কী! কেন?’
‘আগে দেখে নিই, তারপর বলব।’
‘ধ্যাত্তেরি!’ বিরক্ত হলো রিয়া। ‘এত হেঁয়ালি করো কেন? খুলে বললে কী হয়?’
জিমি কিছু বলতে গেল না। বন্ধুটির স্বভাব ও খুব ভালো করেই জানে, এখন বোমা মারলেও অয়নের পেট থেকে কোনো কথা বেরুবে না। ও শুধু বলল, ‘দেখতে দেবে না বললি...তা হলে দেখবি কী করে?’
সংক্ষেপে প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিল অয়ন। খানিক পরেই সিঁড়ি ধরে হাজির হলো তিনজনে। কিউরেটরের অফিসের দরজা বন্ধ, তবে ভেতরে নড়াচড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পাশের কামরাটায় ঢুকে পড়ল অয়ন, কয়েকটা ইজেল টেনে তার পেছনে লুকাল।
এবার দরজায় টোকা দিল জিমি। রিয়া উত্তেজিত গলায় ডাকল, ‘মি. বেলামি! মি. বেলামি!!’
কয়েক সেকেন্ড পর দরজা একটু ফাঁক হলো। দেখা গেল বেলামির বিরক্ত চেহারা।
‘কী ব্যাপার? এত হইচই কীসের?’
‘একটা জিনিস পেয়েছি আমরা!’ হড়বড় করে বলল রিয়া। ‘আপনার দেখা দরকার। জলদি আসুন।’
‘হ্যাঁ, এক্ষুনি!’ জিমি সুর মেলাল।
‘এক মিনিট,’ বলে দরজা বন্ধ করে দিল বেলামি। খানিক পর বেরিয়ে এল। ‘চলো।’
দরজা টেনে দিয়ে জিমি আর রিয়ার পিছু নিল সে। কিছুটা সময় অপেক্ষা করে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল অয়ন। বেলামির কামরার দরজার হাতল ঘোরাল। বন্ধ। লক করে যেতে ভোলেনি লোকটা।
হাতলটা ভালো করে দেখল ও। পুশ লক সিস্টেম। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটল ওর। পকেট থেকে বের করে আনল নিজের লাইব্রেরি কার্ড। দরজার পাল্লা আর চৌকাঠের মাঝখানের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিল কার্ডটা। লকিং মেকানিজমের ওপর একটু চাপ দিতেই খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকে পড়ল ও।
যা খুঁজছে, তা পাওয়া গেল সহজেই। একটা ইজেলের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে নকল পেইন্টিংটা। পাশেই আরেকটা ইজেল, তাতে একই মাপের আরেকটা ফ্রেম কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। এগিয়ে গিয়ে কাপড়টা সরিয়ে ফেলল অয়ন। থমকে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
দ্য লেডি অ্যান্ড দ্য মিররের আরেকটা কপি দেখতে পাচ্ছে ও! আঙুল বোলাল ছবিটার গায়ে। নাহ্, এটাও আসল নয়। নকল। দুটোই নকল ছবি। দেখতে অবিকল একই রকম। এবার পরিষ্কার হয়ে আসছে সব।
মুচকি হাসি ফুটল অয়নের ঠোঁটের কোণে। দুষ্টু একটা বুদ্ধি খেলে গেছে ওর মাথায়।

ওপরতলায় গভীর মনোযোগে রঙের ফোঁটাগুলো দেখছে বেলামি।
‘কী মনে হয় আপনার?’ গলায় আগ্রহ ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল জিমি। ‘ছবি চুরির সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক আছে?’
সোজা হয়ে দাঁড়াল বেলামি। ‘নাহ্। দেখতেই তো পাচ্ছ, এখানে রঙের কাজ চলছে। মিস্ত্রিদের ব্রাশ-ট্রাশ থেকে পড়েছে বোধ হয়।’
‘এটা তো ভাবিনি!’ হতাশ হবার ভান করল রিয়া। ‘ধ্যাত! ভাবলাম কী না কী পেয়েছি!’
হাসল বেলামি। ‘এখুনি হাল ছেড়ো না। চেষ্টা চালিয়ে যাও, হয়তো কিছু পেয়ে যাবে। ভালো কথা, তোমাদের আরেক বন্ধু কোথায়?’
‘বাথরুমে,’ বলল জিমি। ‘ওই তো...এসে পড়েছে।’
লম্বা লম্বা পা ফেলে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল অয়ন। জিজ্ঞেস করল, ‘কী, কিছু বোঝা গেল?’
‘মি. হারকার বলছেন, এগুলো রংমিস্ত্রিদের ব্রাশ থেকে পড়েছে।’
‘হ্যাঁ, সেটা একটা সম্ভাবনা,’ মাথা ঝাঁকাল অয়ন। তারপর ঘড়ি দেখল। ‘আরে, অনেকক্ষণ হয়ে গেছে দেখছি। মি. বেলামি, আমাদেরকে এখন বাড়ি ফিরতে হবে।’
‘এখুনি?’ বলল বেলামি। ‘ঠিক আছে, যাও। আরও কিছু যদি দেখার থাকে তো কালকে চলে এসো।’
‘জি, ধন্যবাদ।’
বিদায় নিয়ে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এল তিন বন্ধু। দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই অয়নকে চেপে ধরল রিয়া।
‘বলো, কী পেলে।’
‘ধৈর্য ধরো,’ ওকে বলল অয়ন। ‘রহস্যটা সমাধান করে এনেছি। খুব শিগগির সব জানতে পারবে।’
‘এখনো বলবে না?’
‘অবশ্যই বলব। তবে তার আগে কয়েকটা ফোন করতে হবে আমাকে।’
‘আমার কাছে সেলফোন আছে,’ বলে জিনসের পকেটে হাত ঢোকাল রিয়া।
‘না, এখান থেকে ফোন করা যাবে না। তোমার বাসায় চলো। ডায়ানা আন্টির সঙ্গে কথা বলব। মি. হারকারকেও ডাকা দরকার।’
‘তা হলে অপেক্ষা করছি কেন? এক্ষুনি চলো।’
‘দাঁড়াও। সবাই গেলে চলবে না। একজনকে এখানে থাকতে হবে... নজর রাখতে হবে মিউজিয়ামের ওপর। মি. বেলামি কখন বেরোয়, খেয়াল করতে হবে।’
‘কে থাকবে?’
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিমি। বলল, ‘কে আবার? আমি। অয়ন নিশ্চয়ই থাকতে পারবে না। আর তোমার কথা নাই–বা বললাম...’
‘মানে কী?’ রেগে গেল রিয়া। ‘আমি মিউজিয়ামের ওপর নজর রাখতে পারব না? এটা কি কোনো কঠিন কাজ?’
‘সারাক্ষণ যে রকম ছটফট করো...পারবে গা ঢাকা দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে? আমার তো ধারণা, আধঘণ্টা না যেতেই বেলামির চোখে ধরা পড়ে যাবে।’
‘খবরদার, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!’
‘থামবে তোমরা?’ ধমকে উঠল অয়ন। ‘এত ঝগড়া কিসের? রিয়া, তোমাকে ফেলে এমনিতেও তোমার বাড়িতে যাব না আমি। জিমিকেই থাকতে হবে এখানে।’
‘আমি তো সেটাই বলতে চাইলাম,’ বলল জিমি।
‘থাক, এখন আর সাধু সাজতে হবে না। তুই থাক এখানে। কড়া নজর রাখবি। আমরা গেলাম।’
চলে গেল অয়ন আর রিয়া। রাস্তার ধারের একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকল জিমি। ফ্রাইড চিকেন আর কোক নিয়ে বসল জানালার পাশে। শুরু হলো অপেক্ষার পালা।

পাঁচ
সন্ধ্যা সাতটায় মিসেস ওয়েস্টমোর আর মি. হারকারকে নিয়ে ফিরে এল অয়ন আর রিয়া। এর আগেই ওদেরকে ফোন করে জানিয়েছে জিমি, সোয়া ছটায় মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে গেছে বেলামি।
‘হাতে কিছু ছিল?’ জানতে চেয়েছে অয়ন।
‘হ্যাঁ। খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো একটা জিনিস...কোনো পেইন্টিং বলে মনে হলো।’
‘চমত্কার। ওখানেই অপেক্ষা কর। আমরা একটু পরেই আসছি।’
মিউজিয়ামের সামনের সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করছিল জিমি, ওরা পৌঁছুতেই এগিয়ে এল।
‘এখন কী?’
‘সবাই আসেনি এখনো,’ বলল অয়ন। ‘একটু অপেক্ষা করি।’
পাঁচ মিনিট পরেই ডিটেকটিভ ট্যানারকে পেভমেন্ট ধরে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। সঙ্গে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক।
‘শুভ সন্ধ্যা,’ কাছে এসে বলল ট্যানার। এরপর সঙ্গীকে পরিচয় করিয়ে দিল। ‘ইনি মি. রন বেলোজ—মিউজিয়াম পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান।’
মিসেস ওয়েস্টমোর আর মি. হারকার ভদ্রলোককে চেনেন। কুশল বিনিময় হলো। বেলোজ জিজ্ঞেস করলেন, ‘অয়ন হোসেন কে?’
‘আমি, স্যার,’ বলল অয়ন। ‘ফোনে আমার সঙ্গেই কথা হয়েছে আপনার।’
‘তুমি ঠিক কী করতে চাইছ, তা এখনো আমি বুঝতে পারছি না, ইয়াং ম্যান।’
‘সব পরিষ্কার হয়ে যাবে খুব শিগগির। আমাকে শুধু এটুকু বলুন, মিউজিয়ামের মেইন ডোরের কোডটা কি জানতে পেরেছেন? ভেতরে ঢুকতে হবে আমাদেরকে, অ্যালার্ম বেজে উঠলে বিপদ।’
‘পেরেছি। তবে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। যারা সিস্টেমটা বসিয়েছে, শেষ পর্যন্ত ওদেরকে ধরতে হয়েছে।’
‘গুড। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।’
‘আমরা এখনো দাঁড়িয়ে আছি কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন ট্যানার।
‘আরেকজন বাকি...’
অয়নের কথা শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে ভেসে এল চড়া গলা।
‘আরে, এখানে এত ভিড় কেন?’
ঘুরে তাকাল সবাই। মিউজিয়াম ওয়ার্ল্ড–এর সম্পাদক জর্জ ন্যাডলার এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।
‘স্বাগতম, মি. ন্যাডলার,’ বলল অয়ন।
‘এখানে হচ্ছেটা কী?’ জিজ্ঞেস করল ন্যাডলার। ‘ডিনারের একটা দাওয়াত ছিল, সেটা ফেলে ছুটে আসতে হলো আমাকে।’
‘পিকাসোর পেইন্টিং চুরির রহস্যটা সমাধান হতে চলেছে, স্যার,’ অয়ন বলল। ‘সে জন্যই খবর দিয়েছি আপনাকে।’ এবার ঘুরল চেয়ারম্যানের দিকে। ‘চলুন, মি. বেলোজ। সবাই চলে এসেছে।’
সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠলেন মি. বেলোজ। দরজার পাশের কি-প্যাডে কয়েকটা সংখ্যা চাপলেন। মৃদু আওয়াজ তুলে খুলে গেল পাল্লা। ঝটপট ভেতরে ঢুকল সবাই, তারপর ফের বন্ধ করে দেওয়া হলো দরজা। হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলো গ্যালারিতে।
লাইটের সুইচ টিপতে যাচ্ছিলেন মি. হারকার, তাকে ঠেকাল অয়ন। ‘না, আলো জ্বালবেন না। ভেতরটা অন্ধকার থাকুক।’
ছোট্ট একটা পেনলাইট জ্বালল ও, সবাইকে নিয়ে গেল গ্যালারির শেষ প্রান্তে। নকল পেইন্টিংটা আবার ঝুলিয়ে রেখে গেছে বেলামি। কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, ফ্রেমের সঙ্গে অ্যালার্মের কানেকশন দেয়া হয়নি।
‘এখন?’ জানতে চাইল ন্যাডলার।
‘এখন আমরা অপেক্ষা করব,’ বলল অয়ন।
‘কতক্ষণ?’
‘যতক্ষণ লাগে...’
কথা শেষ হবার আগেই দূর ভেসে এল একটা শব্দ। মিউজিয়ামের মেইন ডোর খুলছে কেউ!
তাড়াতাড়ি পেনলাইট নিভিয়ে দিল অয়ন। চাপা গলায় বলল, ‘সবাই লুকিয়ে পড়ুন। কুইক!’
গ্যালারির পিলার আর ডিসপ্লে কেসগুলোর আড়ালে আশ্রয় নিল সবাই। একটু পরেই একটা ছায়ামূর্তি ঢুকল গ্যালারিতে, হাতে একটা চারকোনা জিনিস। নকল পেইন্টিংটার দিকে সরাসরি এগিয়ে গেল সে। কাছে গিয়ে হাতের জিনিসটা নামিয়ে রাখল মেঝেতে।
লাইটের সুইচের সবচেয়ে কাছে রয়েছে রিয়া। অয়নের ইশারা পেতেই সুইচবোর্ডের পাশে চলে গেল। অচেনা লোকটা যেই না হাত বাড়িয়েছে দেয়ালের ছবিটার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে টিপে দিল সুইচ। উজ্জ্বল আলোয় ভেসে গেল গ্যালারির অভ্যন্তর। চমকে উঠে পাঁই করে ঘুরল লোকটা। সে আর কেউ নয়, সল বেলামি।
আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সবাই।
চোখ পিট পিট করল বেলামি। বিস্মিত গলায় বলল, ‘ব্যাপার কী? আপনারা সবাই এখানে কেন?’
পিস্তল বের করে তার দিকে তাক করলেন ট্যানার। ‘হ্যান্ডস আপ, মি. বেলামি। আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো।’
‘গ্রেপ্তার! কিসের জন্যে?’ আচমকা রেগে গেল বেলামি। ‘অপরাধ তো করেছেন আপনারা! অবৈধভাবে ঢুকে পড়েছেন মিউজিয়ামে।’
‘কেউ অবৈধভাবে ঢোকেনি, সল,’ বললেন মি. বেলোজ। ‘আমি ঢুকতে দিয়েছি ওদের।’
‘কিন্তু কেন?’
‘আপনাকে হাতেনাতে ধরবার জন্যে,’ বলল অয়ন। এগিয়ে গেল সামনে। দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিংটার দিকে ইশারা করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, এটাই সেই হারানো পিকাসো।’
‘অসম্ভব!’ প্রতিবাদ করল ন্যাডলার। ‘ওটা তো সেই নকলটা! ভালো করে তাকাও।’
‘আপনিই তাকান,’ মুচকি হাসল অয়ন, ‘তবে ছবির ওপরে নয়, তলায়।’
‘কী বলছ এসব?’
প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে অয়ন। প্যান্টের পকেট থেকে ছোট একটা পানির বোতল আর রুমাল বের করল। রুমালটা একটু ভিজিয়ে এগিয়ে গেল ছবিটার দিকে। একটা কোনা মুছতে শুরু করল। গুয়াশ পেইন্ট সরে গিয়ে বেরিয়ে এল একই ধরনের আরেকটা রং, তবে সেটা অয়েল পেইন্টে করা।
‘মাই গড!’ চোয়াল ঝুলে পড়ল ন্যাডলারের। ‘আমি বিশ্বাস করি না!’
‘অ্যালার্ম না বাজার কারণ হলো, ছবিটা দেয়াল থেকে সরানোই হয়নি,’ ব্যাখ্যা করল রিয়া। ‘দুরাত আগে আসলটার ওপরেই নকলটা এঁকেছেন মি. বেলামি।’
‘তা কী করে হয়?’ হারকারের কণ্ঠে অবিশ্বাস। ‘সেদিন সবার শেষে আমি বেরিয়েছি মিউজিয়াম থেকে, আর বেরোবার আগে নিজে দেখেছি পেইন্টিংটা।’
‘ঠিক,’ জোর গলায় বলল বেলামি। ‘মিথ্যে অভিযোগ আনা হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে, এর জন্যে মানহানির মামলা ঠুকতে পারি। ক্ষমা চেয়ে এখুনি বেরিয়ে যান সবাই!’
তার কথায় কান দিল না অয়ন। হারকারকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি দেখেছেন মি. বেলামিকে বেরিয়ে যেতে?’
‘ইয়ে...না,’ মাথা নাড়লেন হারকার। ‘চলে যাচ্ছে বলেছিল তো, তাই ভেবেছি...’
‘কোনো প্রমাণ নেই আপনাদের হাতে,’ কড়া গলায় বলল বেলামি। ‘মুখের কথায় কিছুই যায়-আসে না...’
‘প্রমাণ আছে,’ তাকে থামিয়ে দিল অয়ন। ‘এই যে প্রমাণ।’
নিচু হয়ে খবরের কাগজে মোড়ানো জিনিসটা তুলে নিল ও।
‘না!’ চেঁচাল বেলামি। ‘ওটা আমার!’
টান দিয়ে কাগজের আবরণ ছিঁড়ে ফেলল অয়ন। দেখা গেল দ্য লেডি অ্যান্ড দ্য মিররের আরেকটা কপি।
‘আরেকটা নকল!’ বিস্মিত গলায় বললেন ডায়ানা। ‘এর মানে কী?’
‘এখুনি জানতে পারবেন,’ বলল অয়ন। ‘আগে কীভাবে কাজটা করা হলো, সেটা বলি। মি. হারকারের কাছ থেকে বিদায় নিলেও সেদিন রাতে বাড়ি যাননি বেলামি। ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে ছিলেন। হারকার বেরিয়ে যাবার পর সারা রাত সময় পেয়েছেন, তখন গুয়াশ পেইন্ট দিয়ে আসলটার ওপরে এঁকেছেন নকলটা। সকালে যখন মিউজিয়াম খুলল, ভালো মানুষের মতো দেখা দিয়েছেন অফিসে, যেন রাতটা বাড়িতেই কাটিয়ে ফিরেছেন। কেউ কিছু সন্দেহ করেনি। জানতেন, বিকেলে পর্দা উন্মোচনের সময় ধরা পড়বে নকলটা... চাকরি চলে যাবে মি. হারকারের, আর কিউরেটরের দায়িত্বটা দেওয়া হবে তাকে। আমার তো মনে হয়, এত দিন মিউজিয়ামে যত গোলমাল হয়েছে, সবই মি. বেলামির কীর্তি। যতভাবে পেরেছেন, উত্ত্যক্ত করেছেন মি. হারকারকে। উনি হাল ছাড়েননি দেখে শেষমেশ পেইন্টিং চুরির দায়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছেন।’
‘তাহলে মি. হারকারকে সরাবার জন্যেই এত কিছু?’
‘ঠিক তা-ও না। আমার ধারণা, এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলেন মি. বেলামি। কিউরেটর তো হবেনই, একই সঙ্গে পিকাসোর আসল পেইন্টিংটা বিক্রি করে মোটা টাকা কামাবেন। সমস্যা হলো, ওটার ওপরে নকলটা আঁকা হয়েছে; কাজেই আগে হোক পরে হোক, এভিডেন্স হিসেবে ওটা পুলিশ বা আদালতের কাছে জমা দিতে হবে। তাই গতকাল রাতে দ্বিতীয়টা এঁকেছেন। প্ল্যান করেছিলেন, সেটা দেয়ালে ঝুলিয়ে আসলটা বাড়ি নিয়ে যাবেন, গুয়াশ পেইন্টটা মুছে ফেলে বিক্রি করে দেবেন কোনো ধনী কালেক্টরের কাছে।’
‘কিন্তু দেয়ালে তো আসলটাই ঝোলানো দেখছি,’ ভুরু কুঁচকে বললেন বেলোজ। ‘আসলটা ঝুলিয়ে নকলটা নিয়ে গেল কেন? এখন আবার ফিরে এসেছে কেন?’
‘ওটা অয়নের কৃতিত্ব,’ বলল জিমি। সকালে ওর বন্ধুটি কী করেছে, তা বুঝে ফেলেছে। ‘নিশ্চয়ই ছবিদুটো অদল-বদল করে দিয়েছিস, তাই না? ওই যে, সকালে যখন ওঁর অফিসে ঢুকেছিলি?’
‘তু...তুমি আমার অফিসে ঢুকেছিলে?’ কথা আটকে যাচ্ছে বেলামির।
‘জি,’ দাঁত কেলাল অয়ন। ‘খুব বোকামি করেছেন, ছবি দুটো ওভাবে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা একদম উচিত হয়নি।’
হেসে উঠলেন ট্যানার। ‘ভালোই শিক্ষা দিয়েছ। এবার বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। আসল ভেবে নকলটা নিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে, রং মুছতে গিয়ে ভুলটা ধরতে পেরেছে। সে জন্যই আবার ছুটে এসেছে মিউজিয়ামে, ছবিটা বদলে নিতে।’
‘ঠিক ধরেছেন,’ বলল অয়ন। ‘আসলে...ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছিল না। ছবি বদলাবার সময় হাতেনাতে ধরা গেলেই শুধু কিছু করা সম্ভব। সে জন্যই ফাঁদটা পেতেছি।’
‘কিছু বলার আছে আপনার?’ বেলামিকে জিজ্ঞেস করলেন ট্যানার।
মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল বেলামি। কোনো কথা ফুটছে না। তাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেলেন ট্যানার।
‘না বুঝে আপনাকে সন্দেহ করেছিলাম,’ হারকারকে বলল ন্যাডলার। ‘ক্ষমা চাইছি।’
‘না, না, ক্ষমা চাইবার কী আছে?’ বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন হারকার। ‘আপনার পত্রিকায় ঘটনাটা ক্লিয়ার করে দেবেন, তাহলেই চলবে। বিশেষভাবে উল্লেখ করবেন এই ছেলেমেয়েদের ভূমিকা।’ অয়ন, জিমি আর রিয়ার দিকে ইশারা করলেন তিনি।
‘তা তো বটেই। এদের তুলনা হয় না।’
‘কিন্তু অয়ন,’ বললেন ডায়ানা। ‘তুমি ব্যাপারটা বুঝলে কী করে? লোকটা তো দারুণ প্ল্যান এঁটেছিল।’
‘মেঝেতে পড়ে থাকা পেইন্টের ফোঁটা দেখে,’ বলল অয়ন। ‘বেলামি বলেছিলেন, ওগুলো রংমিস্ত্রিদের ব্রাশ থেকে পড়েছে। কিন্তু দেখলাম, দেয়ালে সাদা রং করছে মিস্ত্রিরা; আর মেঝেতে পড়ে আছে নীল আর ধূসর রঙের ফোঁটা।’
‘ধন্যবাদ...অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাদের,’ কৃতজ্ঞ গলায় বললেন হারকার। ‘তোমাদের জন্যেই আমার হারানো সম্মান ফিরে পেলাম। সেই সঙ্গে ফিরে পেলাম হারানো পিকাসোটাও।’