পুতুল

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘বাবা, তোমাকে না নতুন একটা পুতুল আনতে বলেছিলাম!’ বাড়িতে ফিরতেই বলল জুলি। সঙ্গে সঙ্গে মুখ শুকিয়ে গেল আমার। বললাম, ‘মা, আজ তো রাত হয়ে গেছে। কাল আনব।’

সামান্য একটা চাকরি করি, প্রাইমারি স্কুলের। বেতন সামান্যই। এই টাকায় তিনজনের সংসার চালানো বেশ কষ্টের। কিন্তু যে করেই হোক, জুলিকে একটা পুতুল কিনে দিতেই হবে। বড় দোকানে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন গেলাম একটা চোরাই মালের দোকানে। সেখানে দাম কম। বললাম, ‘ওই লাল চুলওয়ালা পুতুলটার দাম কত?’

‘একদাম ১০০ টাকা।’

সত্যি বলতে কি, নিজেকে অনেক লাভবান মনে হচ্ছে। কারণ, এই পুতুলের দাম হওয়া উচিত কম করে হলেও ৫০০ টাকা। আমার আবার ক্লাস আছে। ক্লাসে যাওয়া লাগবে। পুতুলের ব্যাগটা টিচার্স রুমে রেখে এলাম। স্কুল শেষ হলো বিকেল চারটায়।

বাড়ি ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেছি। জুলি এসে বলল, ‘বাবা, পুতুল আনোনি?’

‘এই যা, পুতুলটা তো স্কুলে ফেলে এসেছি। তুই চিন্তা করিস না। আমি কালকে গিয়ে নিয়ে আসব।’

পরদিন হেডস্যার মিটিং ডেকেছেন। একটু আগে যাওয়া লাগবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। স্কুলে ঢুকেই দেখি, স্কুলের সামনে একটা জটলা। কাছে গিয়ে দেখি, স্কুলের দারোয়ানের ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে আছে। ব্যাপার কী?

হেডস্যার আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘দেখুন, কী কাণ্ড হয়ে গেল। রফিককে কারা যেন খুন করেছে! এমনকি ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটাও কেটে নিয়ে গেছে। কী বীভৎস অবস্থা!’

আমি টিচার্স রুমে গিয়ে দেখলাম কিছু শিক্ষক রফিকের বিষয়ে আলোচনা করছে। ড্রয়ার থেকে পুতুলের ব্যাগটা বের করে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

জুলি এবার চার বছরে পা দিয়েছে। পুতুলটা দেখে জুলি নিশ্চয়ই খুশি হবে। বাড়ি ফিরেই জুলিকে পুতুলটা দিলাম। যতটা ভেবেছিলাম, পুতুলটা দেখে জুলি তার থেকেও বেশি খুশি হলো। আমার স্ত্রী রিমা বলল, ‘কী দরকার ছিল এত দামি পুতুল আনার?’ আমি নিশ্চুপ রইলাম।

হেডস্যার আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘দেখুন, কী কাণ্ড হয়ে গেল। রফিককে কারা যেন খুন করেছে! এমনকি ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটাও কেটে নিয়ে গেছে। কী বীভৎস অবস্থা!’

জুলি সব সময় পুতুলটা নিয়েই থাকে। আমি ভাবলাম, যাক এত দিনে জুলি একটা ভালো বন্ধু পেল। স্কুল তিন দিন বন্ধ থাকার পর খুলল। ওই দিন বাড়ি আসতে রাত হতে পারে জেনে আগেই বলে এসেছিলাম যে আমার জন্য অপেক্ষা না করে খেয়ে নিয়ো। সন্ধ্যা সাতটার দিকে রিমার ফোন এল। ফোন রিসিভ করতেই রিমা উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, ‘রবিন, তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো, তাড়াতাড়ি।’ আমি কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল। আমি বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

বাড়িতে পৌঁছালাম। বাড়িতে ঢুকেই দেখি রিমা জুলিকে কোলে নিয়ে আতঙ্কিতভাবে বসে আছে।

রিমা আমাকে যা বলল, তার সারসংক্ষেপ হলো এই, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। তখন সে তার ফোন খুঁজছিল আলো জ্বালানোর জন্য। এমন সময় সে দুটি বাচ্চার গলার আওয়াজ পায়। সে ভেবেছিল মনের ভুল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার দুটি বাচ্চার আওয়াজ শুনতে পায় সে। একটি হচ্ছে জুলির, তাহলে আরেকটি কার? এসব কথা ভাবতে ভাবতেই ইলেকট্রিসিটি চলে আসে এবং যা দেখে, তাতে রিমার রক্ত জল হয়ে যায়। জুলি একটা ছুরি হাতে নিয়ে পুতুলটার মাথা কাটার চেষ্টা করছে।

এই কথা শুনে আমি হেসে উঠি। বললাম, ‘আরেকটা বাচ্চার গলা হয়তো বাইরে থেকে আসছিল।

‘কিন্তু জুলির হাতে ছুরি কেমন করে আসবে?’

‘দেখো, জুলি কোথাও থেকে নিয়েছে বোধ হয়। তোমাকে এগুলো সাবধানে রাখতে হবে।’

পরের দিন রিমার ভাই বাড়িতে এল। শুক্রবার, তাই আমার স্কুল ছুটি। বাড়িতে দিলীপের সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় ঘর থেকে পুতুলটা এনে বাইরে বের হলো জুলি। পুতুলটা দেখে কেমন যেন থতমত খেয়ে দিলীপ বলল, ‘এই পুতুল তুই কোথায় পেলি?’

‘মামা, এটা তো বাবা আমাকে কিনে দিয়েছে।’

দিলীপ আমাকে বলল, ‘দাদা, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। চলেন, বাইরে যাই।’

বাইরে এসে চিন্তিত মুখে দিলীপ বলল, ‘এই পুতুল আপনি কোথা থেকে কিনেছেন?’

আমি বললাম, ‘ওই চোরাইপট্টির দোকান থেকে।’

‘ওই যে পেছনের গলির ওইটা?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’

‘দাদা, একটা কথা বলি, পুতুলটা ঠিক সুবিধার না। দোষ আছে।’

‘মানে?’

‘আমাদের বাড়ির পাশে থাকত রহিম। রহিমের একটা ছোট মেয়ে ছিল। নাম ছিল সুলতানা। রহিম একদিন একটা পুতুল কিনে আনে সুলতানার জন্য। দুদিন পর সুলতানা মারা যায়। সুলতানার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটাও ছিল না। এমনকি তার এক সপ্তাহ পর রহিম ও তার স্ত্রী দুজনেই মারা যায়। তাদেরও ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটা পাওয়া যায়নি। পরে বাড়িতে পুলিশ আসে। কিন্তু কিছু পায়নি, তবে পুতুলটা নিয়ে গিয়েছিল। আর সেই পুতুলটা দেখতে ঠিক জুলির পুতুলটার মতো।’

আমি বাইরে বের হলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। একটা রিকশা নিলাম। কিছুক্ষণেই পৌঁছে গেলাম ওই দোকানটায়। দোকানে গিয়ে লোকটাকে বললাম, ‘এই পুতুল আমার চাই না। এটা ফেরত নিন।’

দিলীপের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল রফিকের কথা। রফিকের হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটা ছিল না। আমি বললাম, ‘দিলীপ, তাহলে আমি এখন কী করব?’

দিলীপ বলল, ‘যেখান থেকে কিনেছেন, ওইখানে ফেরত দিয়ে আসেন।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, কিন্তু আজ তো শুক্রবার, দোকানটা মনে হয় বন্ধ আছে। আমি কাল স্কুল শেষে যাব।’

এমন সময় বাইরে এল জুলি। তার হাতে পুতুলটা দেখে খুবই পৈশাচিক বলে মনে হলো আমার। দিলীপ জুলিকে বলল, ‘পুতুলটা আমাকে একটু দেবে?’

জুলি বলল, ‘এই নাও।’

আমি দিলীপকে বললাম, ‘পুতুলটা আপাতত তোমার কাছেই রাখো।’

দিলীপ বলল, ‘হ্যাঁ রাখছি।’

দুপুরে খেয়ে একটা ঘুম দিলাম। দিলীপের কথাগুলো শোনার পর থেকে মন ভালো নেই। রাতে খাবার টেবিলে বসে জুলি তার মামাকে বলল, ‘মামা, আমার পুতুলটা দাও।’

দিলীপ বলল, ‘কাল দেব।’

খাওয়ার পর সবাই যে যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে উঠে বাইরে হাঁটতে যাব, এমন সময় ভাবলাম, দিলীপকে সঙ্গে নিয়ে যাই। দিলীপের ঘরে গিয়ে দেখি, ও ঘরে নেই। আমি ভাবলাম, বোধ হয় বাইরে গেছে। বাড়ির বাইরে বের হওয়ামাত্র যা দেখলাম, তাতে আমার রক্ত শীতল হয়ে গেল। তারপর আমি জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম রিমা চিৎকার করে কাঁদছে। আমাকে সোফার ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে। অনেক লোক জড়ো হয়েছে ঘরে। আমি উঠে দিলীপের লাশের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি দিলিপের ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটা নেই। আমি রিমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। পুলিশ এসে দিলীপের লাশ নিয়ে গেল ময়নাতদন্তের জন্য। আস্তে আস্তে রিমার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলো।

আমি দিলীপের ঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি খাটের ওপরেই পুতুলটা আছে। ওটা হাতে নিয়েই আমি রিমার কাছে গেলাম। রিমার কাছে গিয়ে খুলে বললাম দিলীপের সব কথা। রিমা আতঙ্কিত হয়ে বলল, ‘তুমি এখনই যাও। পুতুলটা ফেরত দিয়ে আসো।’

বাইরে বের হলাম আমি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। একটা রিকশা নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ওই দোকানটায়। দোকানে গিয়ে লোকটাকে বললাম, ‘এই পুতুল আমার চাই না। এটা ফেরত নিন।’

লোকটা বলল, ‘কোনো টাকা ফেরত দিতে পারব না ভাই।’

আমি বললাম, ‘দরকার নেই তোমার টাকার।’

লোকটাকে যখন পুতুলটা ফেরত দিতে যাব, একটা জিনিস লক্ষ করলাম, যা আগে খেয়াল করিনি। পুতুলটারও ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটা নেই।