পোর্ট্রেট

অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী

ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। অভ্যাসমতো ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। সাইড টেবিলে মোনার রাখা সবুজ বোতলটা নেই। এবার পুরোপুরি কাটল ঘুমটা। মনে পড়ল, এটা আমার ধানমন্ডির বাসা নয়, আমি এখন কুয়ালালামপুরের এক হোটেলে।

পানি খেয়ে এসে মুঠোফোনে সময় দেখলাম। তিনটা কুড়ি, মানে দেশের সময় একটা কুড়ি। এখন আর বাড়িতে ফোন করার কোনো মানে হয় না। একা  আমার বিদেশভ্রমণ এই প্রথম। অফিস থেকে পাঠাল, তাই বাধ্য হয়ে আসা। ‘ইনক্লুসিভিটি’র ওপর একটা ট্রেনিং এখানকার হেড অফিসে। প্রায় ছয় বছর ধরে এ বিষয়টা নিয়েই কাজ করছি দেশে। তবু কেন যেন আসতে আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। আসার আগে খাবার টেবিলে এ নিয়ে বেশ একটা আলোচনাও হয়ে গেল। নাকের ওপর চশমাটা ঠিক করতে করতে বড় মেয়ে দিশা স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘বাবা আসলে রুটিনে ঢুকে গিয়েছে। ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে সাতটায় খবরের কাগজ, আটটায় পরোটা-সবজি, সাড়ে ছটায় বিকেলের চা না পেলে বাবা আর কোনোভাবেই শান্তি পায় না।’ আজকাল বড় বোন যা বলে, তাতে সায় দেওয়া স্বভাব হয়ে গিয়েছে ছোটটার। দীপাও মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘ঠিক ঠিক! মনে আছে, পরশু হকার আংকেল আসতে দশ মিনিট দেরি করল আর বাবা কেমন অস্থির হয়ে গেল?’

মোনার ধারণা, চার দিন একা গুছিয়ে চলতে হবে, এটাই আমার ভয়। এ কথাটা আংশিক সত্যি। আংশিক বলছি, কারণ, গুছিয়ে চলা নিয়ে আমার ভাবনা নেই। আমার সবচেয়ে বড় ভয় একাকিত্ব। অথচ এমন নয় যে আমি মানুষের সঙ্গে প্রচুর কথা বলি। বাড়িতে, অফিসে, আড্ডায় কিংবা যেকোনো জায়গায় আমি মনোযোগী শ্রোতা। প্রয়োজনের বাইরে কথা বলা আমার ধাতে নেই। আশপাশে পরিচিত মানুষ থাকতে হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। একরাশ অপরিচিত মানুষের মধ্যেও আমি বোধ হয় স্বচ্ছন্দে থাকতে পারব। শুধু একা এক ঘরে বসে থাকার সঙ্গে আমি কোনো দিনই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। প্রথম কিছুক্ষণ আমার মাথার মধ্যে ঘুরতেই থাকে যে এখানে আমি একা, আর মিনিট দশেক পর শুরু হয় অস্থিরতা আর শ্বাসকষ্ট। মিনিট পাঁচেক ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু অস্থিরতাটা বাড়ছে।

কে বলবে এটা গভীর রাত! দেখে মনে হয় যেন কোনো উৎসব চলছে! রাস্তায় রীতিমতো মানুষের ঢল। বেশির ভাগই ট্যুরিস্ট আর বয়সে তরুণ। দোকান-রাস্তাঘাট আলোতে আলোতে ঝকমক করছে। হোটেলের ঠিক সামনেই গিটার হাতে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে গান গাইছে দুটো ছেলে–মেয়ে। তাদের ঘিরে আনন্দিত জনতার ভিড়। ভাষা বুঝছি না কিন্তু গানের সুরে প্রবল আনন্দের ছোঁয়া, শুনতে বেশ লাগে।

হেঁটে একটু সামনে এগোই আমি। ফুটপাতজুড়ে নানা জিনিসের পসরা। স্যুভেনিরই বেশি বিক্রি হচ্ছে বোধ হয়। এ ছাড়া আছে ট্যাটু আর্টিস্টের দল আর পোর্ট্রেট আঁকিয়েরা। এক জায়গায় গোল হয়ে বসেছে তারা। কেউ সামনে দিয়ে গেলেই আন্তরিক সুরে ডাকছে। এরা সবাই বয়সে তরুণ। কারও গায়ে রঙিন টি–শার্ট, কারও মাথায় অদ্ভুতদর্শন টুপি। কারও আবার চুলের রংটা বেগুনি-গোলাপির মিশ্রণে বড় বিচিত্র। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে এদের আঁকাআঁকি দেখলাম। আমার ধারণা ছিল পোর্ট্রেট করার পুরো সময়টা শিল্পীর সামনে বসে থাকতে হয়। এখানে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। শিল্পী আপনার ছবি তুলে রাখবে নিজের মুঠোফোনে, এরপর অর্ধেক সম্মানী দিয়ে আরেকটা টোকেন নিয়ে আপনি পনেরো মিনিটের জন্য ঘুরতে চলে যাবেন। এর মধ্যেই মুঠোফোনে ধরে রাখা ছবি দেখে আঁকা হয়ে যাবে আপনার ছবি। ব্যাপারটা নিশ্চয় প্রযুক্তির একটা দারুণ সুবিধা কিন্তু আমার পঞ্চাশোর্ধ্ব মনে বা মস্তিষ্কে একটা খচখচানি থেকে গেল। দিশা জানলে বলত, ‘উফ বাবা! তুমি এত রিগ্রেসিভ!’ কী করব! সারা জীবন ভেবে এসেছি শিল্পীরা সামনে বসা মানুষকে দেখে পোর্ট্রেট করেন।

হোটেলে ফিরব বলে পা বাড়ানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একজনকে দেখে থমকে গেলাম। আর্টিস্টদের জটলা থেকে খানিকটা দূরে বসা লোকটা। তবে তাদের মতোই ক্যানভাসে দ্রুত হাতে তুলি চালাচ্ছে সে। জীর্ণ পোশাক আর বিশেষত্বহীন চেহারা। বয়স বোধ হয় চল্লিশের কোটায়, যা অন্য আর্টিস্টদের তুলনায় খানিকটা বেশি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বুঝলাম আসলে বয়স, চেহারা বা বেশভূষার কারণে তাকে লক্ষ করিনি আমি। লক্ষ করেছি, কারণ, তার হাতে মুঠোফোন নেই। ক্যানভাসের ওপর খানিকটা ঝুঁকে পড়ে আঁকছে সে। আশপাশেও তাকাচ্ছে না। সমস্ত ভঙ্গিতে কোথায় যেন একটা ধ্যানী ব্যাপার আছে।

লোকটা ঠিক কী আঁকছে, তা দেখার প্রবল কৌতূহল থেকেই বোধ হয় তার দিকে এগোলাম আমি। না, আহামরি কোনো ব্যাপার নেই, অন্যদের মতো পোর্ট্রেটই আঁকছে। শুধু কী দেখে আঁকছে, সেটা বুঝতে পারলাম না। কল্পনা থেকেই আঁকছে হয়তো। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে লোকটা ঘুরে তাকাল। ভাবলাম অন্যদের মতো আন্তরিক সুরে টেনে টেনে বলবে, ‘ইউ ওয়ান্ট আ পোর্ট্রেট?’ কিন্তু দীর্ঘক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শুধু। তারপর মাথা নেড়ে নিজের কাজে মন দিল সে।  

আজ কুয়ালালামপুরে শেষ রাত আমার। কাল সকাল আটটায় ফ্লাইট। কনফারেন্সটা তেমন ভালো লাগেনি। বক্তারা বেশির ভাগই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফাঁকা মুখস্থ বুলি আওড়েছেন। কিন্তু সন্ধ্যার পর শহর ঘুরে বেড়ানোটা বেশ ভালো লাগছে। কখনো পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি, কখনো গাড়িতে। নিজেকে বেশ তরুণ তরুণ লাগছে। মোনাকেও ফোনে তাই বললাম। উত্তর এল, ‘তবে একাই ঘোরো! আমাদের আর কোনো দিন কোথাও নিতে হবে না।’ কেউ শুনলে ভাববে আমি ইচ্ছা করে ওদের আনিনি। অথচ সে নিজেই আমাকে জোর করে ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছে। ছোট মেয়েটার এসএসসি চলছে, এ অবস্থায় যে তার নড়ার উপায় নেই, এটাও মোনারই যুক্তি।

অবশ্য মোনা এমনই, অকারণ অভিমানী এক মেয়ে। মেয়ে বলছি কেন, গত ডিসেম্বরে ওর একচল্লিশ হলো, এখন বোধ হয় নারী বলা উচিত। আচার-আচরণে অবশ্য একচল্লিশের কোনো লক্ষণ দেখি না। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ মেয়েদের সঙ্গে হইহুল্লোড় করছে, এধার–ওধার ছুটে বেড়াচ্ছে। এই তো গত সপ্তাহের কথা। পুরোনো বাক্স-পেটরা ঘেঁটে তিথিডোর–এর একটা কপি বের করল বোধ হয় বড় মেয়ে। অমনি ছোট মেয়ে আর মা দুজন মিলে তাকে সারা বাড়ি তাড়া করে বেড়াল। ‘কে আগে পড়বে’, তা নিয়ে বিষম যুদ্ধ। অথচ একই বইয়ের আরেক কপি কিন্তু বুকশেলফে আগেও ছিল, এখনো আছে। বড় মেয়ে, মানে আমাদের দিশা আজকাল ইউনিভার্সিটিতে যায়, বেশ গুছিয়ে কথা বলা শিখেছে। ও নিয়মিত বলে, ‘মা, তোমার মধ্যে বালিকা স্বভাব প্রবল! সতেরোতে আটকে আছ।’

অবশ্য বালিকা স্বভাবের হলেও মোনা ভীষণ গোছানো। আমার রুটিন নিয়ে বাড়াবাড়িটাও সম্ভব হয় ওর কারণেই। ঘুম থেকে ওঠামাত্র ঝকঝকে বালতিতে গরম পানি, গোসল থেকে বের হওয়ামাত্র বিছানায় ইস্তিরি করা শার্ট, নাশতার টেবিলে ঠিক আধা চামচ চিনির চা আর ভাঁজ করে রাখা পত্রিকা পেলে রুটিন মানাটা খুব সহজ হয়ে যায়।

মোনার কথা ভাবছিলাম বলেই হয়তো হোটেলে ফেরার পথে পোর্ট্রেট আঁকিয়েদের দেখেও মোনার কথাই মনে হলো। ওর একটা পোর্ট্রেট করিয়ে নিলে হয়! বেশ চমকে দেওয়া যাবে। মাত্র বিকেল বলে আজ আর্টিস্টরা সংখ্যায় কম। তবে মুঠোফোনবিহীন সেই ধ্যানী আর্টিস্টম্যান আগের জায়গাতেই আছে। আজ তার সামনের ক্যানভাস অবশ্য খালি।

‘আপনি কী দেখে পোর্ট্রেট করেন?’ জিজ্ঞেস করলাম লোকটাকে। সেই একই রকম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, যেন কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করছে। তবে বাড়াবাড়ি রকম অস্বস্তি হওয়ার আগেই ভাঙা ইংরেজিতে উত্তর এল, ‘ইউ ওয়ান্ট আ পোর্ট্রেট অব ইওর ওয়াইফ?’

আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। তবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল লোকটা। ব্যস্ত হাতে ক্লিপবোর্ডে কাগজ লাগাল। একটার পর একটা রং খুলে ঢালতে লাগল হাতের প্লেটে। কিন্তু এবার আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছে। ছবি না দেখলে কী আঁকবে লোকটা! আর টাকাপয়সার ব্যাপারটাও তো আগে ঠিক করে নেওয়া উচিত। আমি তাই থামিয়ে দিয়ে আগে টাকার ব্যাপারটাই জিজ্ঞেস করলাম। আবার সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, তারপর উত্তর এল, ‘আই ডোন্ট চার্জ এনিথিং ফিক্সড। আই উইল এক্সেপ্ট হোয়াটএভার ইউ ফিল অ্যাপ্রোপ্রিয়েট।’ কী বিপদে পড়লাম, ঠিক বুঝতে পারছি না। আঁকা শেষ হলে কী হাতি–ঘোড়া চেয়ে বসবে কে জানে!

পানিতে রং গোলাতে শুরু করেছে অদ্ভুত লোকটা। আমি ওয়ালেট থেকে মোনার ছবি বের করে প্রবল আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রং গোলানো শেষ হলে নিশ্চয় মোনার ছবি দেখতে চাইবে সে। কিন্তু না, কাগজে পেনসিল ধরে এলোমেলো দাগ কাটা শুরু করল লোকটা। আর থাকতে না পেরে বলেই বসলাম, ‘আই ওয়ান্ট আ পোর্ট্রেট অব মাই ওয়াইফ অ্যান্ড হিয়ার ইজ শি।’ ছবিটা হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড দেখল সে। কিন্তু ওই কয়েক সেকেন্ডই মাত্র, এরপর ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘কাম হিয়ার আফটার অ্যান আওয়ার।’

সামনে থেকে সরে এলাম আমি। হোটেলে ফিরে লাগেজটা একটু গুছিয়ে ফেলা দরকার। এখানে সময় দেওয়ার মানে হয় না। তা ছাড়া এবার লোকটাকে আমার একটা পুরোপুরি ঠকবাজ মনে হতে লাগল। ভালো করে না দেখেই, কোনো রকম ছবি ছাড়া পোর্ট্রেট এঁকে ফেলা নিশ্চয় সম্ভব নয়।

প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে লাগেজ গোছাচ্ছি। দীপার জন্য কেনা একটা পুতুল আর মোনার পোর্সেলিন সেট কোনোভাবেই লাগেজে ঢোকাতে পারছি না। ইন্টারকম বেজে উঠল। রিসেপশন থেকে কল, কেউ একজন আমার জন্য পার্সেল রেখে গেছেন, রুমে পাঠিয়ে দেবে কি না, জানতে চাইছে। পার্সেল দেওয়ার কেউ কুয়ালালামপুরে নেই বলেই সন্দেহ হলো। তবু পাঠিয়ে দিতে বললাম, ব্যাপারটা দেখা যাক।

একটা চার কোনা জিনিস খবরের কাগজে মোড়ানো। খবরের কাগজ সরানোর আগেই বুঝতে পারলাম এটা পোর্ট্রেট। ‘পার্সেল’ শব্দটা শুনে আসলে চট করে এটার কথা মাথায় আসেনি।

পোর্ট্রেটটা দেখার পর অন্তত দশ মিনিট হলো শুধু ভাবছি। মুগ্ধ হয়েছি নাকি অবাক হয়েছি, সেটা অবশ্য বুঝতে পারছি না। অপূর্ব সুন্দর হাতের কাজ লোকটার! নিখুঁত ছবি এঁকেছে। মোনার থুতনির কাটা দাগ, গালের তিল, এমনকি চোখেমুখে কিশোরীসুলভ হাসিটাও এক্কেবারে নিখুঁত।

তবে অনেকগুলো খটকা আর প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। ওয়ালেটে রাখা যে ছবি আমি লোকটাকে দেখিয়েছিলাম, সেটা বহু আগের ছবি। বোধ হয় ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় স্টুডিওতে গিয়ে তোলা। অর্থাৎ তরুণী বয়সের ছবি। কিন্তু আমার হাতের পোর্ট্রেটে যে মোনা, তার চেহারায় বয়সের ছাপ আছে, কানের পাশের চুলে রুপালি আভা স্পষ্ট। ঠিক যেমনটা মোনার বর্তমান চেহারা! তরুণ বয়সের ছবি দেখে কি বর্তমান চেহারা এতটা নিখুঁতভাবে আঁকা সম্ভব? বলার আগেই লোকটা কীভাবে জানল আমি আমার স্ত্রীর পোর্ট্রেট চাই? আঁকা শুরু করার আগে লোকটা নিজে থেকে মোনার ছবি দেখতে চাইল না কেন? এত অল্প সময় কাউকে দেখে কি তাকে এঁকে ফেলা যায়? ছবি আঁকার খুঁটিনাটি আমি কিচ্ছু জানি না। তবে যতটুকু সাধারণ বুদ্ধি আমার আছে, তাতে এই প্রশ্নগুলোর কোনো স্বস্তিদায়ক উত্তর আমি পাচ্ছি না।

যত সময় যাচ্ছে, তত নতুন নতুন প্রশ্ন আসছে মাথায়। এ এলাকায় পাশাপাশি অনেকগুলো হোটেল। আমি যে ঠিক এ হোটেলেই আছি, সেটা কীভাবে জানল লোকটা? এমনকি আমার রুম নম্বরটাও...না! আর ভাবতে পারছি না! একবার নিচে নেমে ব্যাপারটা বোঝা দরকার।

একরকম ছুটতে ছুটতেই হোটেল থেকে বের হলাম আমি।

লোকটা নেই। সন্ধ্যা পেরিয়েছে। মানুষের ভিড় বিকেলের তুলনায় বেশি। ফুটপাতজুড়ে অন্যান্য দিনের মতো আর্টিস্ট আর হকারদের জটলা। কিন্তু আমি যাকে খুঁজছি, তাকে কোথাও দেখছি না। অন্য আর্টিস্টদের জিজ্ঞেস করতে লাগলাম লোকটার কথা, কেউই সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুধু গালে ট্যাটুওয়ালা এক মেয়ে আঁকা থামিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়াট ডিড হি ড্র? ইওর পোর্ট্রেট?’ আমি মাথা নেড়ে ‘না’ বলামাত্র যেন মেয়েটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। মিষ্টি হেসে বলল, ‘দেন ইউ আর সেফ অ্যান্ড হ্যাপি!’

অদ্ভুতদর্শন এই মানুষগুলোকে কেমন অসহ্য বোধ হতে লাগল। তা ছাড়া খেয়াল হলো লোকটা টাকা নেয়নি এখনো। নিশ্চয় হোটেলে টাকা চাইতে আসবেই। তখনই পাওয়া যাবে সব কটি প্রশ্নের উত্তর।

রিসেপশনে এক তরুণী বসা। মুখে অভিবাদনের হাসি। ওকেই জিজ্ঞেস করলাম আমার জন্য রেখে যাওয়া পোর্ট্রেটটা যে দিয়ে গেল, সে আবার এসেছে কি না। প্রশ্ন শোনামাত্র মেয়েটার মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। শুধু ফিসফিস করে বলল, ‘পোর্ট্রেট…ডিড ইউ সে…পোর্ট্রেট?’

অতিপ্রাকৃত বিষয়ে আমার বিশ্বাস কোনো দিনই ছিল না। তবু এইমাত্র মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে। মোনাকে একবার ফোন করব ভেবে পকেটে হাত দিলাম। না, তাড়াহুড়াতে ফোনটা বোধ হয় রুমেই ফেলে এসেছি।

রুমে ফিরতে ফিরতে মেয়েটার বলা কথাগুলোই ভাবতে লাগলাম। তার ভাষ্যমতে, মোনার পোর্ট্রেটটা যে এঁকেছে, তার নাম জিকরি আশরাফ। কিশোর বয়স থেকেই পোর্ট্রেট আঁকায় বেশ সুনাম অর্জন করেছিল সে। কোনো মানুষকে অল্প কিছুক্ষণ দেখেই হুবহু এঁকে ফেলতে পারত আশরাফ। কিন্তু বছর দুয়েক আগে এক বিখ্যাত প্রবীণ আর্টিস্ট পত্রিকার কলামে দাবি করেন, আশরাফ যাদের পোর্ট্রেট আঁকেন, তারা পোর্ট্রেট আঁকা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান। এই অদ্ভুত দাবি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় খানিকটা হইচই হয়। আর এক টিভি চ্যানেল আশরাফের এক্সিবিশনের ছবি দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে, যাদের পোর্ট্রেট আশরাফ এঁকেছেন, অতি সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

রুমে ঢুকতেই টেবিলের ওপর রাখা পোর্ট্রেটটায় চোখ পড়ে আমার। ঠিক যেন দূর থেকে মোনা হাসছে!

ফোন হাতে নিতেই দেখি অসংখ্য মিসকল। দিশা, দীপা দুজনের নম্বর থেকেই তিনবার করে কল এসেছে। আম্মাও কল করেছে চারবার। কল ব্যাক করার আগেই দিশার একটা টেক্সট চোখে পড়ল, ‘বাবা, প্লিজ কল ব্যাক সুন। মা ইজ নট ওয়েল।’