প্যাঁচা কেন এমন করে

প্যাঁচা যখন প্যাঁচা হলো, প্রথমেই সে আবিষ্কার করল যে সে রাতে দেখতে পায়। তার পরপরই সে আবিষ্কার করল যে আর কোনো পাখি রাতে দেখতে পায় না।

তারা শুধু দিনে দেখে। তারা জানে রাতের আঁধারে দেখার চেষ্টা করে কোনো ফায়দা নেই। প্রতিদিন ধূসর গোধূলিতে তারা চোখ বন্ধ করে, আর ভোরতক ঘুমিয়ে পার করে। অনেক দিন ধরেই এমন চলছিল, ফলে অন্ধকার কী জিনিস ভুলেই গিয়েছিল তারা।

এ নিয়ে প্যাঁচা ভাবে। তারপর অন্য পাখিদের কাছে গিয়ে বলে, ‘আমি একটা দেশের খবর জানি, সেখানে অনেক খামার আছে কিন্তু কোনো খামারি নেই। যখন ইচ্ছে, যত ইচ্ছে খাও। বন্দুক, কাকতাড়ুয়া, মানুষ—কিচ্ছু নেই। চাও তো তোমাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারি।’

প্রতিদিন খাবারের খোঁজে মাঠে গিয়ে মানুষের হাতে মারা পড়ে অনেক পাখি। তারা বলে,

‘শুনে তো মনে হয় শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ দেশ; যেন পাখিদের জন্যই বানানো হয়েছে। চলো প্যাঁচার সঙ্গে যাই।’

মনে মনে প্যাঁচা হাসে।

‘ভালো।’ বলে ও। ‘কিন্তু আমাদের তো পাসপোর্ট নেই, তাই রাতেই সীমান্ত পার হতে হবে, কেউ যাতে দেখতে না পায়। গোধূলির সময় রওনা হলে ভোরেই পৌঁছে যাব।’

গোধূলি নামার পর সব পাখিকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ে একটা খরগোশের গর্তে যায় প্যাঁচা।

‘একে অন্যের হাত ধরো। আমি তোমাদের পথ দেখাব।’

পাখিরা আবার নতুন কোন খেলা জুড়েছে, দেখতে ছুটে আসে পাহাড়ের সব খরগোশ। অন্ধকার গর্তে নামার পথ দেখায় প্যাঁচা।

‘এখন কি তবে রাত?’ গর্তের ঘুটঘুটে অন্ধকারে ফিসফিস করে শ্যামা।

‘হুমম,’ কাকেরা বলে। ‘এই তাহলে রাত।’

গর্তের তলাটা এত অন্ধকার যে নিজেদের ঠোঁটটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিল না পাখিরা। প্রত্যেকে সামনের পাখির ডানা ধরে অন্ধের মতো তাকে অনুসরণ করতে থাকে। গর্তের মধ্যেই পাঁচ মিনিট ধরে তাদের ইতস্তত ঘুরপাক খাওয়ায় প্যাঁচা। পাখিরা তো আর হাঁটাহাঁটি করে অভ্যস্ত না, ওইটুকু সময় হাঁটাহাঁটি করেই তাদের মনে হয় বুঝি ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করছে তারা।

‘আর কত দূর?’ হাঁপিয়ে ওঠে আবাবিল। ‘বেচারা পা তো আর পারছে না।’

অবশেষে চিত্কার করে ওঠে প্যাঁচা,

‘থামো। সামনে সব ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিই।’

গর্ত থেকে মাথা বের করে চারদিকে তাকায় প্যাঁচা। কয়েক মিনিট আগে তারা যখন যাত্রা করেছিল, অন্ধকার এখন তার চেয়েও গাঢ়। তবে এখনো পুরোপুরি রাত হয়নি। এখনো পশ্চিমে হালকা আভা রয়ে গেছে।

তখন চিত্কার করে ওঠে প্যাঁচা, ‘আমরা সীমান্ত পার হয়ে গেছি। সকালও হতে শুরু করেছে।’

তারপর পাখিদের বাইরে খোলা জায়গায় নিয়ে যায় ও। আবার খরগোশরা ছুটে আসে, এক কান খাড়া আর এক কান নামিয়ে বসে পাখিদের দেখে তারা, মুখে তাজ্জব ভাব।

‘এই কি সেই নতুন দেশ?’ জানতে চায় পাখিরা, প্রায়-আঁধার হয়ে আসা চারপাশে তাকায় তারা, চুপিসারে কাছাকাছি আসে।

‘এই সেই দেশ,’ বলে প্যাঁচা। ‘আর ওই দেখ পুবে প্রভাত হচ্ছে।’

অন্ধকার ভূগর্ভে পুরোদস্তুর নিজেদের নিশানা হারিয়ে ফেলেছিল পাখিরা আর বাইরেও এত অন্ধকার যে দিনের আলোয় চেনা দৃশ্যও এখন আর চিনতে পারে না তারা। ফলে প্যাঁচা যা বলে সবই তারা বিশ্বাস করে।

পাহাড় থেকে তাদের একটা খামারে নিয়ে যায় প্যাঁচা।

হঠাত্ পায়রা বলে, ‘কিন্তু অন্ধকার তো মনে হচ্ছে আরও বাড়ছে।’

‘ব্যাপারটা খেয়াল করেছ তাহলে,’ বলে ওঠে প্যাঁচা। ‘এই একটা কথা তোমাদের বলতে একদম ভুলে গেছি। এ দেশের দিন আমাদের ভোরের চেয়েও অন্ধকার।’

মনে মনে সে হাসে। ভয়ে একে অপরের দিকে তাকায় পাখিরা।

‘দিনই যদি ভোরের চেয়ে অন্ধকার, তাহলে রাতের অবস্থা কী?’ চিত্কার করে ওঠে তারা। ‘রাত কত অন্ধকার?’

থমকে পাখিদের দিকে তাকায় প্যাঁচা। তার মুখ দেখতে পারছে না তারা, তবে বুঝতে পারছে, প্যাঁচা আন্তরিক।

‘এখানে রাত এত কালো, এত নিকষ যে তার দিকে পলকমাত্র ফেলেও কোনো পাখির পক্ষে টেকা অসম্ভব। বাঁচতে চাইলে একটাই করণীয়। দিনের আঁধার ধূসর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যত ভালো করে সম্ভব চোখজোড়া বন্ধ করে রাখতে হবে। ধূসর ভোরে আমি না জাগানো পর্যন্ত তোমরা ওগুলো অবশ্যই বন্ধ করে রাখবে। অন্ধকারে একবার নজর দিয়েছ কী মরেছ।’

তারপর আর একটিও শব্দ না-করে তাদের খামারের খড়গাদায় নিয়ে যায় প্যাঁচা।

খামারের বাতি সব নেভানো, চাষি ঘুমাচ্ছে। খামারটাও সুনসান।

‘তোমরা পৌঁছে গেছ, যেমনটা কথা দিয়েছিলাম,’ বলল প্যাঁচা। ‘এখন যত ইচ্ছা খাওদাও।’

পাখিরা ঠোঁট দিয়ে খুঁটাখুঁটি করে কিন্তু ততক্ষণে এত অন্ধকার হয়ে গেছে যে কোনো কিছুই দেখা যায় না। শেষে পা দিয়ে খুঁজে খুঁজে শস্যদানা বের করে। কিন্তু সেটা তো খুবই ধীর প্রক্রিয়া।

গোলাঘরের এক কোণে জুত করে বসেছে প্যাঁচা, জায়গাটা থেকে খড়গাদা দেখা যায়। যখনই ইচ্ছা করে ছোঁ মেরে একটা বুলবুলি বা মাছরাঙা ধরে নিয়ে আসে। নিকষ অন্ধকারে বাকি পাখিরা টেরও পায় না। ‘ইঁদুর-গুবরের চেয়ে এটা বেশি মজা,’ ঠোঁট থেকে রক্ত মুছতে মুছতে ভাবে প্যাঁচা। আকাশে প্রথম ধূসর আলো ফুটে উঠতে উঠতে এত ভরপেট খায় প্যাঁচা, যেমনটা জীবনে আর কখনো খায়নি।

একটা হুংকার দেয় সে,

‘ওই ধেয়ে আসছে সন্ধ্যার ধূসর আলো। জলদি! জলদি! ভয়ংকর অন্ধকার নামার আগেই আমাদের বিছানায় ফিরে যেতে হবে, চোখ বন্ধ করতে হবে।’

হুড়মুড় করে একে অপরের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে প্যাঁচার গলা লক্ষ করে ছুটে আসে পাখিরা। তারা সব একত্র হলে কাছেই একটা কাঁটা ঝোপের বনে তাদের নিয়ে যায়।

‘ঘুমানোর দারুণ জায়গা,’ বলে প্যাঁচা। ‘সকালে তোমাদের ডেকে দেব।’

আর এভাবেই সকালের ধূসর আলোকে প্যাঁচার কথামতো সন্ধ্যার অন্ধকার মনে করে চোখ বুজে পাখিরা। ঝলমলে সারাটা দিন দলবলে কাঁটা ঝোপের নিচে চোখ বন্ধ করে কাটিয়ে দেয় তারা। ভয়ে কয়েকজন তো ঘুমাতে পর্যন্ত পারে না। একটা চোখের পাতা পর্যন্ত খোলারও সাহস হয় না কারও। ওই অন্ধকারে একবার তাকিয়েছ কী মরেছ—আগেই তাদের সাবধান করে দিয়েছে প্যাঁচা।

একটা গাছের অন্ধকার ফোকরে আরামে ঝিমায় প্যাঁচা। ভালোই কাজে দিয়েছে তার ফন্দি। নিজের ওপর সে বেজায় খুশি। আর ইঁদুর-গুবরে খেতে হবে না।

সন্ধ্যায় হাঁক পাড়ে প্যাঁচা,

‘ভোর হলো,’ পাখিদের বলে। ‘চলো খেতে যাই।’

আবার তাদের খামারে নিয়ে যায় প্যাঁচা। সেখানে সবকিছুই আগের মতো ঘটে।

এভাবে মোটাতাজা হয় প্যাঁচা আর অন্য পাখিদের দশা হয় করুণ।

অন্ধকার খড়ের গাদায় খুঁটাখুঁটি করে করে তারা ক্লান্ত। কালেভদ্রে একদানা শস্যকণা মেলে, অধিকাংশ সময়ই জোটে কাঠকুটো। খামারের হাঁস-মুরগি দিনভর খড়গাদার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত খুঁটে খুঁটে খায়, তারপর পাখিদের জন্য খুব বেশি আর কিছু থাকে না। ঘুমিয়েও আতঙ্কে থাকে তারা—যদি স্বপ্ন দেখে, যদি না-বুঝে চোখ খুলে ফেলে আর দেখে ফেলে ভয়ংকর অন্ধকারের এক ঝলক। এটা তো একটা বিরাট চাপ। বিপদ সম্পর্কে অনবরত তাদের সতর্ক করে প্যাঁচা।

‘ওই অন্ধকারে একবার তাকিয়েছ,’ অবিরাম জপে চলে প্যাঁচা, ‘কী মরেছ।’

অথচ ছোট্ট একটা পাখি একটা মাত্র চোখে এক সেকেন্ডের জন্যও যদি বাইরে তাকাত, তাহলেই সে দেখতে পেত ভয়ংকর অন্ধকার বলে আসলে কিছুই নেই। বদলে দেখত তার অতি চেনা গ্রাম আর সূর্য। কেউ যেন কখনো অমনটি না করে, তা নিশ্চিত করত প্যাঁচা।

পাখিরা রোগাপাতলা হতে থাকে। খসে পড়তে থাকে তাদের পালক। অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে তাদের পা ব্যথা করে। ব্যবহার না করতে করতে ডানাগুলো আড়ষ্ট হয়ে যায়। নয়া দেশ তাদের একটুও ভালো লাগে না।

নিজেদের মধ্যে নালিশ করতে থাকে তারা।

অবশেষে এক সন্ধ্যায় নিয়মমতো প্যাঁচা যখন হাঁক ছাড়ে ‘সকাল!’ তারা সব তাকে গিয়ে ধরে; বলে তারা আর পারছে না।

‘দয়া করে আমাদের নিজের দেশে নিয়ে চলো,’ তারা বলে।

প্যাঁচা চিন্তিত হয়ে পড়ে। পাখিদের নিজের কুক্ষিগত করে রাখতে চায় সে। আর সে ইঁদুর-গুবরে খেতে চায় না।

তার মাথায় একটা নতুন ফন্দি আসে।

‘হ্যাঁ, তোমরা ঠিকই বলেছ,’ সে বলে। ‘এটা চমত্কার একটা দেশ, কোনো বিপদও নেই। তবে তোমরা যেমনটা বলেছ, টিকে থাকাটা বড্ড কঠিন। চলো যে গর্ত দিয়ে আমরা এসেছি সেটা খুঁজে বের করি, তারপর নিজের দেশে ফিরে যাই।’

সে তাদের খরগোশের গর্তে ভরা পাহাড়ে নিয়ে যায়। তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে।

‘পাখিরা আবারও ওই খেলাটা খেলছে,’ খরগোশরা বলাবলি করে, দেখার জন্য ছুটে আসে তারা।

‘এই গর্তগুলোরই কোনো একটা হবে,’ পাখিদের বলে প্যাঁচা। ‘কিন্তু ঠিক কোনটা মনে করতে পারছি না। তোমাদের কারও মনে আছে?’

‘আমার মনে হয় এটাই সেই গর্ত হবে,’ বলে কোকিল।

‘কিংবা এটা,’ বলে শালিক।

‘চলো সবগুলোই পরীক্ষা করি,’ বলে প্যাঁচা।

বেশির ভাগ পাখি গর্তে ঢুকতেই সাহস করে না, যদি হারিয়ে যায়। যারা ঢোকে তারাও শিগগিরই বেরিয়ে আসে, বলে:

‘এটা দেখি এখানেই বেরিয়ে এসেছে।’

প্যাঁচা ভান করে যেন, কী ঝামেলাতেই না সে পড়েছে।

‘আমরা ফিরে যাওয়ার পথ হারিয়েছি। সবই আমার দোষ,’ কেঁদে ফেলে প্যাঁচা, তারপর গলায় সাহসের ভাব এনে বলে:

‘চিরটা কাল আমাদের যেহেতু এখানেই থাকতে হবে, এটার সর্বোত্তম ব্যবহার করাটাই ভালো।’

তারপর রাতের খাওয়ার জন্য তাদের খড়গাদায় নিয়ে যায়।

এ রকমই চলতে থাকে প্রায় এক বছর।

অবশেষে পাখিরা ঠিক করে, অনেক হয়েছে। এভাবে অসুখী হয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না।

‘এটা কোনো জীবন না,’ তারা বলাবলি করে।

‘তিলে তিলে ধুঁকে মরার চেয়ে চলো সবাই মিলে এখনই একযোগে বীরের মতো মরি,’ বলে একটা চড়ুই।

‘আমরা তাই করব,’ বলে কাঠঠোকরা। ‘এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে চলো সবাই বীরের মতো একযোগে মরি।’

‘কিন্তু কীভাবে?’ জানতে চায় ছোট্ট ডাহুক। ‘কীভাবে মরতে পারি আমরা?’

‘চলো, সবাই আমরা মারাত্মক অন্ধকারে তাকাই। প্যাঁচাই তো বলেছে, তাহলেই আমরা সবাই মারা যাব।’

সে রাতে শেষবারের মতো প্যাঁচার সঙ্গে বাইরে যায় অসুখী পাখিরা। যথারীতি সে তাদের খড়গাদায় নিয়ে যায়, তারপর নিজের জায়গায় গিয়ে বসে। কিন্তু খাবার খোঁজার বদলে তারা উঠানের মাঝখানে একত্রে জটলা করে বসে থাকে। করণীয় তো তারা ঠিকই করে ফেলেছে। কিন্তু প্যাঁচা তো তার কিছুই জানে না। তাই সে তাকিয়ে থাকে। নরম ক্ষীণ গলায় পুরোনো গান ধরে তারা।

‘তোমাদের হলোটা কী?’ জানতে চায় প্যাঁচা। ‘না খেলে যে মারা পড়বে।’

কিন্তু তাকে কোনো পাত্তাই দেয় না পাখিরা। ক্ষুধার্ত, ক্ষীণ গলায় গান চালিয়ে যায় তারা। অনেক দিন তারা গান করে না। বড় চাপা, বড় করুণ সুরে গান গায় তারা।

সেটা ছিল উজ্জ্বল এক রাত, আকাশে পূর্ণ চাঁদ। কিন্তু পাখিদের একটাকেও ধরতে পারে না প্যাঁচা। একে অন্যের সঙ্গে বড় কাছাকাছি ঠাসাঠাসি বসে আছে যে ওরা। জটলার ধার থেকেও প্যাঁচা একটা পাখি ধরতে পারে না। রাতভর তারা গান করে।

সকাল হতে হতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে প্যাঁচা।

‘গোধূলি!’ খেঁকিয়ে ওঠে ও। ‘কাঁটা ঝোপে ফিরে চলো। ওই ধেয়ে আসছে ভয়াল অন্ধকার।’

সে ভীষণ ক্ষুধার্ত। তবে কী করতে হবে, জানা আছে তার। কাঁটা ঝোপের মধ্যে ওরা যখন চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকবে, ঠিক তখনই, দিনের ভরা আলোয়, চুপিচুপি তাদের মাঝে সে নেমে পড়বে। তারপর পেট পুরে খাবে। একটা বুলবুলি, একটা ছাতারে, একটা সবুজ টিয়ে আর পাঁচটা চড়ুই—

‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’ খেঁকিয়ে ওঠে প্যাঁচা।

তার পিছুপিছু কাঁটা ঝোপে ফিরে যাওয়ার বদলে ওরা তখন পাহাড়ের পথ ধরেছে। চড়াই ধরে ধরে তারা একসময় চূড়ায় গিয়ে ওঠে। তাদের চারপাশ তখন অন্ধকারে ঢাকা। তিনটা দেবদারুগাছের তলায় জড়ো হয় তারা, দাঁড়ায় পুবে ফুটে ওঠা প্রথম ধূসর রেখার দিকে মুখ করে। তারপর আরও একবার তাদের সেই পুরোনো গান ধরে।

শিগগিরই আকাশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করবে সেই ভয়াল আঁধার। অথবা অমনটাই তারা ভাবে। ক্রমশ উজ্জ্বল হতে থাকা সকালের দিকে তাকিয়ে তারা গান গায়, চোখগুলো যতদূর সম্ভব বস্ফািরিত করে রাখে যাতে ভয়াল আঁধারের প্রথম আলোটা ধরতে পারে।

ওহ্, এই জীবন নিয়ে তারা বড় ক্লান্ত, অবসন্ন।

প্যাঁচার দেখানো পথ ছাড়া যাওয়ার জায়গা নেই, সদা অন্ধকারে বাস, সামান্য কয়েকটা খাদ্যকণার জন্য ঝগড়াঝাঁটি—এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে এই মৃত্যু ঢের ভালো।

গান গাইতে গাইতে সকালটার দিকে তাকিয়ে থাকে তারা। প্রতিটা মুহূর্তে তাদের প্রত্যাশা, উজ্জ্বল পুব থেকে এই বুঝি তাদের দিকে ছুটে আসে ঘাতক কালো রশ্মি।

মাঠের এক প্রান্তে নিজের ডানা দিয়ে মাথা ঠুকছে প্যাঁচা। ফলাফলটা কী হবে ভালোই জানা আছে তার। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সূর্য উঠবে, পাখিরাও তাদের চারপাশের দৃশ্য চিনতে পারবে।

‘ফিরে আয়,’ চিত্কার করে অনুনয়-বিনয় করে প্যাঁচা। ‘বোকার দল! তোরা সব মরে পাথর হয়ে যাবি। ঘরে ফিরে জলদি চোখ বন্ধ কর।’

কিন্তু প্যাঁচার কথায় তাদের কোনো আগ্রহই নেই আর। তারা শুধু মরতে চায়।

ধীরে ধীরে আকাশে তার জ্বলন্ত লাল প্রান্ত তুলে ধরে সূর্য।

চিত্কার করে ওঠে ভরতপাখি। বাতাসে ডানা মেলে ও।

‘এ যে সূর্য!’ চিত্কার করে ওঠে ও। ‘এ যে সত্যি দিন!’

ধীরে ধীরে সূর্য ওঠে।

সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাখিরা উড়ে গিয়ে দেবদারুর ডালে বসে, শাখায় শাখায় নাচানাচি করে। মাথা ঝনঝন না করা পর্যন্ত গান করে।

‘এ যে সূর্য!’ তারা গান করে। ‘এ যে সত্যি দিন!’

মাঠের ধারে একটা কাঁটা ঝোপের তলায় দাঁড়িয়ে রাগে কটমট করে তাকিয়ে থাকে প্যাঁচা। তারপর ঝোপ থেকে মাথা নিচু করে জমির কাছ দিয়ে উড়ে যায়। তারপরও পাখিরা তাকে দেখে ফেলে।

‘আমাদের ধোঁকা দিয়েছে ও,’ চিত্কার করে ওঠে ওরা। ‘ওই যে যাচ্ছে! ওই যাচ্ছে ধোঁকাবাজ।’

চিত্কার-চেঁচামেচি করতে করতে দল বেঁধে সব পাখি প্যাঁচাকে ধাওয়া করে। গাছে না পৌঁছা পর্যন্ত ডানা দিয়ে তাকে মারে তারা, তার পালক টেনে তোলে। গাছের গভীর কোটরে নিজেকে লুকায় প্যাঁচা।

পাখিরা উড়ে উড়ে গাছের ওপরে উঠে যায়, গান করে।

আর এখনো তা-ই আছে।

প্রতি ভোরে পাখিরা গান গায়, প্যাঁচারা অন্ধকার গর্তে ফিরে যায়। তাকে দেখলেই তার ধোঁকাবাজির কথা মনে পড়ে যায়, দল বেঁধে পাখিরা তাকে ধাওয়া করে। তাই রাতেই শুধু বেরোনোর সাহস পায় তারা, ইঁদুর, চিকা আর গুবরে খেয়ে কোনো রকমে কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকে।

[টেড হিউজ : ব্রিটেনের যেমন রাজা বা রানি আছে, আছে প্রধানমন্ত্রী আর প্রধান ধর্মযাজক, তেমনি আছে একজন পোয়েট লরিয়েট বা রাজকবি। সরকারিভাবে তিনিই প্রধান কবি। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে এই নিয়োগ দেন রাজা বা রানি। আগে আমরণ স্থায়ী হলেও বর্তমানে এই পদের মেয়াদ ১০ বছর। এ বাবদে তিনি সরকারের কাছ থেকে বছরে পান ৫ হাজার ৭৫০ (কিছুদিন আগে ছিল শুধুই ৭০!) পাউন্ড, বিনিময়ে তাঁর প্রধান কাজ রাজপরিবারের সদস্যদের জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উপলক্ষে কবিতা লেখা। টেড হিউজ তেমনই একজন রাজকবি। ১৯৮৪ থেকে আমৃত্যু তিনিই ছিলেন যুক্তরাজ্যের রাজকবি।

বড়দের কবি হলেও তোমাদের জন্যও চমত্কার কিছু বই লিখেছেন টেড হিউজ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি     রূপকথার বই—হাউ দ্য হোয়েল বিকাম অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, দ্য আয়রন ম্যান আর দ্য আয়রন ওম্যান। প্রথমটির নাম দেখেই বুঝতে পারছ গল্পগ্রন্থ, পরের দুটো উপন্যাস।

এশীয় কবিতা উত্সবে যোগ দিতে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশেও এসেছিলেন টেড হিউজ, ছিলেন নয় দিন, লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা, ঘুরেছেন সুন্দরবন।]

অলংকরণ: শিখা