
রৌদ্রোজ্জ্বল ঝলমলে সকাল। একটু আগেই সূর্যটা ঘুম ভেঙে হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছে। সাদা খণ্ড খণ্ড মেঘও একে একে আকাশে জড়ো হচ্ছে। নতুন এক কর্মব্যস্ত দিন শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই।
বাগানের ভেতর পাতার ঘরে প্রজাপতির বাস। এটাই তার বাড়ি। যে প্রজাপতির কথা বলছি, ওর রংটা রংধনুর মতো। এ বাগানের একমাত্র রংধনু প্রজাপতি ও। এ নামেই ওর পরিচিতি। রংধনু প্রজাপতিটাও নতুন দিনটা শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর কাজ বলতে তো ওই ফুলের বাড়ি গিয়ে আড্ডা, গল্প আর বাগানের সবার খোঁজখবর নেওয়া। সে জন্যই তৈরি হচ্ছে ও। পাতার ওপরে জমে থাকা শিশিরের টুকরাকে আয়না বানিয়েছে প্রজাপতি। সেই আয়নাতেই নিজেকে দেখে দেখে সাজগোজ করছে ও। রঙিন ডানা দুটো সুন্দর করে সাজিয়ে চোখ দুটোও হালকা সাজিয়ে নিল প্রজাপতি। তারপর উড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এল।
বাইরে এসে এত সুন্দর ঝলমলে দিন দেখে তার মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। মনের আনন্দে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সে উড়ে চলল গোলাপ ফুলের কাছে। পথে ফড়িং, টুনটুনি, দোয়েল, কয়েকটা প্রজাপতি আর মৌমাছির সঙ্গে দেখা হলো তার। সবাইকে শুভ সকাল জানিয়ে প্রজাপতি চলল গোলাপগাছের দিকে।
গোলাপগাছের কাছাকাছি যখন সে পৌঁছে গেছে প্রায়, তখন হঠাত্ ডানা দুটোতে খুব ব্যথা লাগল। ব্যথায় চিত্কার করে উঠল প্রজাপতি। তাকিয়ে দেখল, একটা ছোট মেয়ে তার ডানা দুটো ধরে রেখেছে। প্রজাপতি কাতর স্বরে বলল, ‘আমায় ছেড়ে দাও না ছোট্ট মেয়ে। আমি খুব ব্যথা পাচ্ছি।’
‘কেন তোমায় ছাড়ব আমি? আমি তোমার মতো এত সুন্দর প্রজাপতি কখনো দেখিনি। তোমাকে নিয়ে যাব আমি। তোমাকে আমি অনেক সুন্দর জায়গায় থাকতে দেব।’ বলল মেয়েটি।
‘দোহাই তোমার, তুমি এমনটা কোরো না। আমাকে ছেড়ে দাও। দ্যাখো, তোমার হাতের ছোঁয়ায় আমার ডানার রং উঠে যাচ্ছে, আরেকটু পর ডানাগুলো ভেঙেই যাবে।’ কেঁদে কেঁদে বলল প্রজাপতি।
‘ওহ্! দুঃখিত।’ বলল মেয়েটি। প্রজাপতির ডানা ছেড়ে দিয়ে তাকে হাতের ওপরে বসাল সে। তারপর বলল, ‘কিন্তু তুমি উড়ে যেয়ো না প্রজাপতি। তুমি আমার কাছে থাকো।’
‘না না, আমার তো বাসা আছে। পাতার ভেতরে আমার বাসা। আমি সেখানেই থাকব। সেটাই ভালো লাগে আমার।’ বলল প্রজাপতি।
‘ইশ্! তুমি এত সুন্দর একটা প্রজাপতি আর তুমি পাতার ঘরে থাকো? আমি তোমাকে এর চেয়ে অনেক সুন্দর বাসা দেব। তুমি এসি লাগানো ঘরে থাকবে। সেখানে নরম বিছানা আছে, অনেক খেলনা আছে আর গেম খেলার জন্য একটা কম্পিউটারও আছে। সেখানে অনেক ভালো থাকবে তুমি। তোমাকে অনেক ভালো খাবার দেব আমি। রুটির সঙ্গে মাখন, মধু আর মিষ্টি সব চকলেট।’ বলল মেয়েটা।
প্রজাপতি হেসে উঠল। তারপর সে বলল, ‘কিন্তু মেয়ে, তুমি যে ঘর, যে খাবারকে অনেক ভালো বলছ, সেই ঘর তো আমার কাছে মৃত্যুপুরী, সে খাবার আমার কাছে অর্থহীন।’
‘কেন? তুমি আরও ভালো কিছু চাও বুঝি? তাহলে তোমাকে আমি আরও ভালো ঘর আর খাবার দেব।’ বলল মেয়েটি।
‘না গো মেয়ে। তোমার অত ভালো ঘর বা খাবার কিছুই আমার চাই না। আমার পাতার ঘরই ভালো, আর আমার এই খাবারই ভালো। শোনো, আমাকে তোমার ওখানে নিয়ে গেলে আমি বাঁচব না। আমি তো তোমার মতো এসি লাগানো নরম বিছানা আর অনেক খেলনা রাখা ঘরে থাকতে পারি না। তুমি যেমন বনবাদাড়ে রাত কাটাতে পারবে না, আমিও তেমন তোমার ঘরে থাকতে পারব না। তুমি যেমন পোকামাকড় খেতে পারবে না, আমিও তেমন রুটি আর মাখন খেতে পারব না। সবাই কি আর এক হয় বলো? প্রতিটি প্রাণীরই বাঁচার জন্য তার উপযোগী পরিবেশ লাগে। তোমার পরিবেশটা তো আমার উপযোগী নয়। আমার তো এই প্রকৃতির মাঝে, ফুলের দেশে, পাতার দেশেই ঘর। এটাই আমার জগত্। এ ছেড়ে অন্য কোথাও গেলে আমি বাঁচব না।’ বলল প্রজাপতি।
খুব মন খারাপ হলো ছোট্ট মেয়েটির। তবু সে বলল, ‘কিন্তু আমি তো তোমার বন্ধু হতে চেয়েছিলাম। এমন হলে আমি তো তোমার বন্ধু হতে পারব না। আমি তো কখনো তোমাকে দেখবই না।’
প্রজাপতি তখন খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, ‘এই আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম। তুমি আমাকে সব সময় দেখবে। এ বাগানেই তো আমি থাকি। প্রতিদিন আমাদের দেখা হবে। শুধু কথা দাও, তোমরা আর গাছপালা-বাগান-বন ধ্বংস করবে না। যদি তা করো, তাহলে আমার জগত্ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমিও ধ্বংস হয়ে যাব। তখন তুমি সত্যিই আমাকে আর দেখবে না।’
ছোট মেয়েটা প্রজাপতির শেষ কথাগুলো শুনে খুব কষ্ট পেল। সে প্রজাপতিকে কথা দিল সব মানুষ মিলে এই পৃথিবীকে সবুজ করে তুলবে, গড়ে তুলবে প্রজাপতি, পাখি আর ফুলদের রঙিন জগত্।
অলংকরণ: তুলি