বদরুল

অলংকরণ: সাঈফ মাহ্‌মুদ

ঢাস!

কঠিন এক চড়ের শব্দে ঘুম ভাঙল বদরুলের। ওজনদার চড়টা তার কানের নিচেই পড়েছে। এ ধরনের চড় নিয়মিতই খায় বদরুল। এই এলাকার নশু পাগল সুযোগ পেলেই তার কানের নিচে চড়থাপ্পড় দেয়। আগে দুঃখ করলেও বদরুল এখন আর এসব নিয়ে ভাবে না। দার্শনিক বদরুলের চিন্তাচেতনাই আলাদা। সে মনে করে, দুই দিনের দুনিয়ায় মাঝেমধ্যে চড়থাপ্পড় খাওয়া দোষের কিছু নয়।

তিন চাকার সবুজ সিএনজিচালিত অটোরিকশাটার নাম বদরুল। তার মালিকের নাম সদরুল। ছোটবেলায় বাতজ্বরে মারা যায় সদরুলের ছোট ভাই। ছোট ভাইয়ের নামেই অটোরিকশার নাম রেখেছে সে। সদরুল পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। প্রতিদিন রাত ১০টা পর্যন্ত অটোরিকশা চালিয়ে শ্যামলীর এই সুনসান গলিতে বদরুলকে পার্ক করে সে। গলির আশপাশের দু–একজন গার্ডের সঙ্গে খুব খাতির তার। তাদের পাহারায় সকাল অবধি এখানেই থাকে বদরুল। গ্যারেজের ভাড়া বাঁচাতেই এই ব্যবস্থা।

থাপ্পড় খেয়ে বদরুলের ঘুম ভেঙে গেছে। এখন রাত প্রায় দুইটা। এত রাতে নশু পাগল কেন তার কানের নিচে চড় দেয়, এই কারণ সে এত বছরেও খুঁজে পায়নি। কান বলতে, দুই পাশের লুকিং গ্লাস আরকি। চড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গলি থেকে বেরিয়ে যায় নশু পাগল। প্রতিদিনের মতো চড়ের ধকল সামলে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করল বদরুল। কোনোভাবেই ঘুম আসছে না। ইঞ্জিন গরম হয়ে আছে। গরমে ঘুম হয় নাকি? খকখক কাশি দিয়ে নিজেকে স্টার্ট দিল বদরুল। আশপাশ থেকে গায়ে বাতাস লাগানো দরকার।

শ্যামলী থেকে বেরিয়ে মোহাম্মদপুরের দিকে এগোচ্ছে বদরুল। প্রায় ফাঁকা ঢাকায় একা একা চলতে বেশ ভালোই লাগছে। দিনের আলোয় একা চলা বেশ মুশকিল। মালিকের হাত থেকে রেহাই তো পাওয়া যায়-ই না, তা ছাড়া ড্রাইভার ছাড়া অটোরিকশা চলতে দেখলে পাবলিক কেলেঙ্কারি বাধিয়ে ফেলতে পারে। বদরুল যে মানুষের মতো সবই পারে, এটা সহজে কেউ বিশ্বাস করবে বলে তার মনে হয় না। তাই দিনের বেলায় একা বের হওয়ার ঝুঁকি সে নেয় না। বদরুলের জীবনের স্লোগান হচ্ছে, ‘দুই দিনের দুনিয়া, এত গ্যাঞ্জামের দরকার নাই।’

মোহাম্মদপুরের এক গলি থেকে আরেক গলিতে যাচ্ছে বদরুল। আনন্দে ভ্রুমমমমম আওয়াজ বের হচ্ছে তার মুখ দিয়ে। কবরস্থানের পেছনের রাস্তায় ঢুকতেই হঠাৎ ব্রেক কষল সে। অন্ধকার গলির মাঝখানে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দু-তিনজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। ঘটনা সুবিধার মনে হচ্ছে না।

দুই

মাসের প্রথম সপ্তাহটা ঝন্টুর জন্য সেরা সময়। চাকরিজীবীদের পকেটে এ সময় টাকা ঢোকে। ঝন্টুরও তাই এ সময় ডাকাতি করে বিশাল লাভ। প্রতি রাতে দুজন ধরলেই পকেট ভরে যায়। বেশ কিছুক্ষণ হলো কবরস্থানের পেছনের গলিতে ঘাপটি মেরে আছে ঝন্টু। গত দেড় ঘণ্টায় একটা মানুষও এই গলিতে ঢোকেনি।

রাত তখন প্রায় দুইটা। বিশাল ভুঁড়ি দুলিয়ে মোটা একটা খাম হাতে কবরস্থানের পেছনের গলি দিয়ে যাচ্ছেন তারিক সাহেব। মাসের বেতন সঙ্গে করে বাসায় ফিরছেন। ঝন্টুর চোখ পড়ল মোটা খামে। তারিক সাহেব ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় আসতেই ঝন্টু চাপা স্বরে ডাক দিল।

‘ভাইজান, একটু এদিকে আসেন তো। হুদাই দৌড়ঝাঁপ করার চেষ্টা কইরেন না। কাপঝাপ হয়া যাইব।’

জায়গায় আটকে গেলেন তারিক সাহেব। ল্যাম্পপোস্টের পেছন থেকে ছুরি হাতে বেরিয়ে এল ঝন্টু। গোল ভুঁড়িতে আলতো করে ছুরি ছুঁইয়ে কথা চালিয়ে গেল সে।

‘ভাইজানের খাম আর ভুঁড়ির সাইজ তো একই মনে হইতাসে। খামটা দেন, পাতলা কইরা দিই। তা না হইলে ভুঁড়িটা আস্তে কইরা পাতলা কইরা দিমু। চয়েস আপনার হাতে।’

ঝন্টু আর কিছুই শুনছে না। ছোট ছোট দুই ফ্যানের ঠান্ডা বাতাসে ঘুমিয়ে গেছে সে। ঝন্টু ঘুমানোর আগে আস্তে আস্তে শুধু একবার বলল, ‘নাখালপাড়া ঢুইকা আমারে একটা ডাক দিস।’

ঝন্টুর কথা শেষ হতেই গলির মাথা থেকে অটোরিকশার আওয়াজ পাওয়া গেল। দুজনই তাকিয়ে দেখল, হেডলাইট জ্বালানো এক অটোরিকশা ব্রেক কষেছে। ঝন্টু তেমন চিন্তিত নয়। এই এলাকার অটোরিকশাওয়ালাদের নেতা আওলাদ ভায়ের সঙ্গে তার খাতির আছে। ঝন্টুর ডিউটিতে কোনো অটোরিকশা কখনো বাগড়া দেয় না।

‘কী হইল ভাইজান? এদিক–ওদিক তাকান ক্যান? কেউ নাই। খামটা আগায়া দেন, পাতলা করি।’ ধমকের সুরে বলল ঝন্টু।

তারিক সাহেব কাঁপছেন। আস্তে করে খামটা ঝন্টুর হাতে তুলে দিলেন তিনি। মনে হচ্ছে এখনই স্ট্রোক হবে তাঁর।

‘বেশ ভারী আপনের খামটা। পাতলা করার দরকার নাই। পুরাটাই রাইখা দিলাম। বাসার দিকে হাঁটা দেন। কাপঝাপ করলেই ছুরিটা ছুইড়া মারুম। কই যায়া লাগব, কুনু ঠিকঠিকানা নাই।’ খামের ভেতর উঁকি মারতে মারতে বলল ঝন্টু।

তারিক সাহেব বেশ ঘাবড়ে গেছেন। সোজা বাসার দিকে হাঁটা ধরলেন তিনি। এক মাসের বেতনের চেয়ে বউ-বাচ্চার মুখ দেখাটা বেশি জরুরি মনে হচ্ছে তাঁর। দুই কদম হেঁটেই দৌড় দিলেন তিনি। অন্ধকার গলিতে তারিক সাহেবকে আর দেখা যাচ্ছে না। তবে দৌড়ানোর বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে।

তিন

একদানেই অনেকগুলো টাকা পকেটে ঢুকে গেছে ঝন্টুর। আজ আর কারও খাম পাতলা করার দরকার নেই। খামের সঙ্গে তারিক সাহেবের আইডি কার্ডটা চলে এসেছে ঝন্টুর কাছে। জায়গা বুঝে আইডি কার্ড ফালানো হবে। খামভর্তি টাকা আর তারিক সাহেবের আইডি কার্ড নিয়ে আসাদগেটের দিকে এগোচ্ছে ঝন্টু। মেইন রোড দিয়ে যাওয়াই ভালো। গলি দিয়ে গেলে অন্য ডাকাতের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হতে পারে। দেখা হলে ভাগ-বাঁটোয়ারার প্যাঁচে পড়ার আশঙ্কা থাকে। মেইন রোডের ফুটপাতে উঠতেই ঝন্টুর পেছন থেকে বেরিয়ে এল বদরুল। হেডলাইট দুটো ঝন্টুর দিকে তাক করে কথা বলল বদরুল।

‘বস, কই যান? বাসায় যাইবেন? এত রাইতে একা যাওন ঠিক না। উঠেন আপনেরে নামায় দিয়া আসি।’

ঝন্টুর চোখ ড্রাইভারের সিটে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও অন্ধকারে চোখের ভুল ভেবে নিল সে। ডাকাতির পর কোনো প্রকার গ্যাঞ্জামে সে জড়াতে চায় না। হুডির টুপিটা মাথায় তুলে জবাব দিল ঝন্টু—

‘না না। লাগব না। হাঁইটাই যামু। যাও তুমি।’

কথা শেষ করেই হাঁটা ধরল ঝন্টু। একটু পরই টের পেল, অটোরিকশাটা তার পেছন পেছন আসছে। পেছন ফিরতেই শুনতে পেল বদরুলের গলা।

‘বস, টেনশনের কিছু নাই। উঠেন না। ফাঁকা যাইতাসি, আপনেরে লইয়া যাই ওই দিকে।’

অটোরিকশায় বাসা অবধি যেতে পারলে খারাপ হয় না ঝন্টুর। পকেটে হাত দিয়ে ছুরিটা চেক করে অটোরিকশার দিকে এগোল সে। মুঠোফোনের টর্চ জ্বালিয়ে দেখল ড্রাইভারের সিট সত্যিই ফাঁকা। কুলকুল করে ঘামছে ঝন্টু। কোন গলিতে দৌড় দেবে বুঝতে পারছে না সে। এত পরিচিত এলাকাও তার অচেনা লাগছে। লম্বা শ্বাস নিয়ে দৌড়ে হাউজিংয়ের এক বিল্ডিংয়ের চিপায় ঢুকে পড়ল ঝন্টু।

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই সেখানে ঘাপটি মেরে আছে ঝন্টু। খুব ভয় পেয়েছে। অটোরিকশা কথা বলে ড্রাইভার ছাড়া, ব্যাপারটা মাথায়ই ঢুকছে না। চারদিক চুপচাপ। অটোরিকশার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে না। ঝন্টু গলি দিয়ে আসাদগেট পর্যন্ত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। পা টিপে টিপে বেরিয়ে গলি ধরে হাঁটছে সে। দুইটা গলি পার হতেই আবার বদরুলের মুখোমুখি ঝন্টু।

‘এইটা কী করলেন বস? দৌড় দিলেন ক্যান? কতক্ষণ ধইরা খুঁজতাসি। পুরা মোহাম্মদপুর চক্কর দিয়া ফালাইসি। মেইন রোডে ট্রাকের লগে একটা ঘষাও খাইসি। যাউক, আপনারে পায়া গেসি। ঘষা খাওয়ার দুঃখ আর নাই।’

ঘামছে ঝন্টু। দৌড়ে পালিয়ে কোনো লাভ নেই সে বুঝতে পারছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘সিএনজি থেইকা আওয়াজ আহে কেমনে? কেডা তুই? আওলাদ ভায়েরে কিন্তু কয়া দিমু। সিএনজি ভাইঙ্গা দিমু একদম!’

‘আমার নাম হইল বদরুল। শ্যামলীর সদরুল ভাইয়ের গাড়ি আমি। আওলাদ না কার জানি নাম কইলেন ভাই! তারে আমি চিনি নাই ঠিক। আমি তো আপনের প্রোফেশন জানি ভাই। আমার এই সবে সমস্যা নাই। খাম আর পকেট পাতলা করা তো মাইনষের উপকার। ওজন কমায় দিলেন। যাউকগা, আপনে বস ডরাইতাসেন ক্যান? ডরায়েন না।’

‘ডরামু না মানে? মানুষ ছাড়া গাড়ি থেইকা আওয়াজ আইতাসে। পলায়াও শান্তি পাইতাসি না।’

‘বস, আপনে চইড়া বসেন আগে। আপনের বাসার দিকে যাইতে যাইতে আপনেরে সব বিস্তর কইতাসি।’

ঝন্টু আবারও দৌড়ের প্রস্তুতি নিল। আরও নরম হয়ে এল বদরুলের গলা।

‘আর দৌড়ায়েন না বস। খুঁইজা বাইর করতে অনেক কষ্ট হইসে। পরে গ্যাস শ্যাষ হইয়া গেলে মাঝরাস্তায় বইসা থাকা লাগব। আপনেরে ভালো পায়া লয়া যাইতে চাইতাসি। এইবার দৌড় দিলে বেজায় দুঃখ পামু বস।’

ঝন্টুর ভয় কিছুটা কমছে। বদরুলের কথাবার্তা শুনে ভালো বলেই মনে হচ্ছে ঝন্টুর। অটোরিকশায় চড়ার একটু–আধটু ভরসা সে পাচ্ছে। তা ছাড়া এই অটোরিকশাতে চড়া ছাড়া এর হাত থেকে বাঁচারও কোনো উপায় দেখছে না ঝন্টু। কাছে গিয়ে বদরুলের গায়ে হাত বোলাতেই খুলে গেল পেছনের দরজা। দরজা ধরে প্রশ্ন করল ঝন্টু,

‘কোনো কাপঝাপ নাই তো? বাসা কইলাম ম্যালা দূর। পশ্চিম নাখালপাড়া।’

‘আপনার লগে কিয়ের কাপঝাপ বস? আপনে ওঠেন। পূর্ব-পশ্চিম যেইখানে কইবেন, যামু।’

অটোরিকশায় চড়ে বসল ঝন্টু। দুই পাশে দুই ফ্যান চালু হয়ে গেল। বেশ আরাম লাগছে ঝন্টুর। স্টার্ট দিতেই বদরুলের কথা শুরু।

‘বস, ব্যাডাডা যেমনে দৌড় দিল, আমি তো ডরায় গেসিলাম। আমার ওপরে আইসা বাড়ি খাইলে কী উপায়টা হইত কন দেখি? এই এত রাইতে এত ট্যাকা লয়া বাইর হইসে। কেমন বলদ চিন্তা করসেন? ঠিকই আছে। এমন বলদগোর শাস্তির লেইগাই তো আপনেরা আছেন। আচ্ছা বস, আমার পরিচয়টা ভালোভাবে দিয়া লই। আমি হইলাম…’

ঝন্টু আর কিছুই শুনছে না। ছোট ছোট দুই ফ্যানের ঠান্ডা বাতাসে ঘুমিয়ে গেছে সে। ঝন্টু ঘুমানোর আগে আস্তে আস্তে শুধু একবার বলল, ‘নাখালপাড়া ঢুইকা আমারে একটা ডাক দিস।’

চার

ঝন্টুর যখন ঘুম ভাঙল, তখন সকাল ৯টা। চোখ খুলতেই অটোরিকশার গেটের বাইরে নীল শার্টে ঢাকা বিশাল এক ভুঁড়ি দেখতে পেল সে। চোখ পিটপিট করে আশপাশে তাকাচ্ছে ঝন্টু। অটোরিকশার বাইরে সব নীল শার্ট পরা লোকজন। এর মধ্যে রঙিন এক গেঞ্জি গায়ে তারিক সাহেবকে দেখা যাচ্ছে। তারিক সাহেবের মাথার ওপর লেখা ‘মোহাম্মদপুর থানা’।

আইডি কার্ডটাই সর্বনাশ করেছে ঝন্টুর। হাজতে ঢোকানো পর্যন্ত ঝন্টু ‘বদরুল বদরুল’ বলে চেঁচিয়েই যাচ্ছে। ব্যাপারটা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। সদরুল মিয়া অটোরিকশার খবর পেয়ে থানায় এসেছে। তারিক সাহেব তাকে হাসি হাসি মুখে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। সদরুল বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে, সারা রাত সে ঘুমিয়ে ছিল, কোনো হিসাবই ছিল না তার। তবু তারিক সাহেব হাসি হাসি মুখে সদরুলের হাত ধরে হ্যান্ডশেক করেই যাচ্ছেন।

এদিকে থানার পাশের চায়ের দোকানে কাজ করা পিচ্চি বদরুলের মেজাজ খুব খারাপ। মালিকের হাতে মার খাওয়ার ভয় থাকলেও ইতিমধ্যে সে একটা কাপ ভেঙেছে রাগে। একটা ডাকাত তার নাম ধরে ডাকছে, এটা কোনোভাবেই মানতে পারছে না সে। বয়স কম বলে পিচ্চি বদরুলের কি ইজ্জত নেই নাকি?