বর্ষা প্রজেক্ট

অলংকরণ: শিখা

'বল তো, মাছের প্রিয় খাবার কী?'

'পানি, পানির পোকা, শেওলা।'

'থাপড়ায়ে দাঁত ফালায় দেব! তোর মতো এত বড় গাধা কীভাবে আমার ভাগনে হলো, আমার কল্পনাতেও আসছে না। মাছের প্রিয় খাবার মুরগির বিষ্ঠা, ইংরেজিতে হেন শিট, বুঝলি?'

আমি কিছু বললাম না। ফণী মামা বেশ রেগে আছে। নানাভাই কিছুক্ষণ আগে বকাঝকা করেছেন মামাকে। এখনো চলছে বকাঝকা। মামা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছে বলে কিছু শোনা যাচ্ছে না। মামা আবার বলল, 'দ্য ফেবারিট ফুড অব ফিশ ইজ শিট। তোর নানাভাইকে দেখছিস না, প্রতিদিন পুকুরে বস্তায় বস্তায় মুরগির বিষ্ঠা ফেলছেন। মাছের দল সেই বস্তার মধ্যে খ্যাপাটে ষাঁড়ের মতো কেমন হামলে পড়ে। সব পাগল হয়ে যাচ্ছে, মশা-মাছির মতো সবাই পাগল হয়ে যাচ্ছে। যা পাচ্ছে তা-ই খাচ্ছে। অল আর গোয়িং টু ম্যাড, অল আর গোয়িং টু ম্যাড...বুঝলি?'

আমি আমতা–আমতা করে বললাম, 'নানাভাই এখন তো পুকুরে ফিড দেন। মুরগির বিষ্ঠা আগে দিতেন, এখন দেন না।' ফণী মামা রেগে গিয়ে বলল, 'চুপ কর গাধা। তোকে দেখিয়ে দেখিয়ে দেবেন?'

কত দিন পর মামার সঙ্গে দেখা হলো, অথচ নিজ থেকে কোনো কথা বলতে পারছি না। জমানো প্রশ্নগুলো করতে পারছি না। কারণ, মামা রেগে আছে। রাগান্বিত অবস্থায় মামাকে কোনো রকম প্রশ্ন করা নিষেধ। শুধু শুনে যেতে হবে। ইদানীং রেগে গেলে মামা ইংরেজিতে কথা বলে। গল্প-উপন্যাসে পড়ার সময় ব্যাপারটা বিশ্বাস হয়নি, কিন্তু মামাকে দেখার পর বিশ্বাস হচ্ছে। গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে ফণী মামার পার্থক্য হলো, সেখানে চরিত্রগুলো রেগে গেলে ভুলভাল ইংরেজি বলে আর ফণী মামার ক্ষেত্রে হয় উল্টোটা। রেগে গেলে শুদ্ধ ইংরেজি বলে মামা, আর ঠান্ডা মাথায় বলে ভুলভাল। মামা এবার হুংকার দিয়ে বলল, 'বল তো তোর নানাভাই এত হিংস্র কেন?' আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, 'জা...জা...জানি না!' এবার একটু শান্ত হয়ে কথা বলল মামা। জ্ঞানের কথা বলার সময় মামা সাধারণত শান্ত থাকে। বরফ গলতে শুরু করেছে দেখে আমিও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মামার কথা শুনতে লাগলাম। 'তাহলে বল, বাঘ-সিংহের প্রিয় খাবার কী?'

আমি বললাম, 'মাংস।'

'গুড, এরা কী করে? বনে-বাদাড়ে নিরীহ পশুপাখি ধরে মাংস খায়। যার ফলে দেখ, এরা কত হিংস্র। অথচ একসময় এই বাঘ-সিংহগুলান এত হিংস্র ছিল না। এরা মানুষের বন্ধু ছিল। গরু যেমন মানুষের বন্ধু।'

আমি আঁতকে উঠে বললাম, 'বলো কী মামা! গরু মানুষের বন্ধু?'

মামা, টেবিলের ওপর একটা চাপড় মেরে বলল, 'আলবত গরু মানুষের বন্ধু। গরুর মতো নিরীহ প্রাণী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।'

গতবার ঈদে গরুর গুঁতো খাওয়ার কথা মনে হতেই চুপ মেরে গেলাম। মামা আবার বলল, 'তোর নানাভাইও এ রকম হাঁস-মুরগির মাংস খেতে খেতে দিনকে দিন বাঘ-সিংহের মতো হিংস্র হয়ে উঠছেন। গরুর মতো নিয়মিত শাকসবজি খেলে এ রকমটা হতো না। আমাদের সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন, এভাবে সব সময় হুংকার দিয়ে কথা বলতেন না, বুঝলি?'

আমি মাথা নাড়ালাম, 'বুঝেছি।' এমন সময় মামার জানালার পাশে নানাভাইয়ের গলা শোনা গেল। 'গাধাটা কই? পালিয়েছে! পালিয়ে যাবে কোথায়?' নানাভাইয়ের কথা কানে যেতেই মামা বলল, 'জলদি শুয়ে পড়। সকালে অনেক কাজ আছে।'

দুই

ঝুমবৃষ্টি হচ্ছে। গত রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, এখনো থামার নাম নেই। টিনের চালে একনাগাড়ে ঝনঝন শব্দ শুনতে ভালোই লাগছে। গ্রামে থাকার এই এক মজা—টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাওয়া আর দিনভর ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর হাঁকডাক। সবচেয়ে বেশি আনন্দ আম কুড়ানোতে। ঝড়বৃষ্টি হলেই গাছের পাকা পাকা আম পড়তে থাকে। নানুর বাসায় পুকুরপাড়ে বেশ কয়েকটা আমের গাছ। বেশির ভাগ সময় পুকুরেই পড়ে পাকা আমগুলো। পুকুরে ডুব দিয়ে আম কুড়ানোর আনন্দ অসাধারণ। দল বেঁধে গ্রামের ছেলেপুলেগুলো পুকুরের পানিতে ডুব দিয়ে দিয়ে পানির নিচ থেকে আম তুলে আনে। মাঝেমধ্যে যোগ দেন বড়রাও। তখন প্রতিযোগিতা হয় ডুব দিয়ে কে কত বেশি আম তুলে জমাতে পারে। যে যত বেশি জমাবে, সে-ই প্রথম। আমের সময় নানুর বাসায় এলে আমিও যোগ দেই এদের দলে। তবে নানাভাই যখন বাসায় থাকেন না, তখন। নানাভাই পুকুরে গোসল পছন্দ করেন না।

শহরের বৃষ্টি গ্রামের মতো এতটা সুন্দর না। অস্বাভাবিক দালানকোঠায় এখন পুরো শহর ছেয়ে গেছে। বৃষ্টি এলেই ডুবে যায় শহরের রাস্তাঘাট, তার ওপর যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা...আরও কত কী! এসব বলেছে মিলি, আমার মামাতো বোন। মিলিরা ঢাকায় থাকে। গত ঈদে বড় মামা-মামিসহ নানুর বাসায় বেড়াতে এসেছিল মিলি। বেশ গুছিয়ে কথা বলে মেয়েটা। শুনতে ভালো লাগে। ফণী মামার কাছে শুনেছি, এবার ঈদেও আসবে মিলিরা। কথাটা শোনার পর থেকেই খুব খুশি লাগছে আমার।

বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। ফণী মামা ঘরে নেই। ঝড়–বৃষ্টির মাঝে এত সকালে কোথায় গেছেন কে জানে। মামার যা পাগলামি! ঠান্ডা বাতাস আসছে জানালার ফুটো দিয়ে। বিছানা থেকে কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে নিল রোটন। ফণী মামার গত রাতের কথাটা মনে পড়তেই কিছুটা খারাপ লাগল তার। ফণী মামা বলেছিল, জলদি ঘুমাতে, সকালে নাকি অনেক কাজ আছে। অথচ তাকে একা রেখেই চলে গেল মামা। ফণী মামাকে সে কত ভালোবাসে। মন খারাপ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ব বলে যে-ই না ঠিক করছি, এমন সময় একঝটকায় দরজা খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল ফণী মামা। মামার পুরো শরীর ভেজা, হাতে দুটো বড়শির ছিপ। মামা ছিপ দুটো দরজার পাশে রেখে গামছা নিল আলনা থেকে। মাথা মুছতে মুছতে মামা বলল, 'কী রে রোটন মিয়া, তুই যে গন্ডারের ঘুম দিয়েছিলি, আমি তো ভেবেছিলাম আগামী ছয় মাস তোকে আর জাগানো যাবে না। ছয় মাস পর টের পেয়ে জেগে উঠবি। তোকে জাগাতে না পেরে, শেষমেশ একাই বেরিয়ে পড়লাম।'

নানুর বাসায় কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাসায় সবাই আছেন, কিন্তু যে যাঁর মতো নীরবে কাজ করছেন। বাসার পরিস্থিতি দেখে কেউ বলবে না এ বাসায় কিছুক্ষণ আগে একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।

মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে গেল আমার। আসলে ভুল ভেবেছিলাম মামাকে। ইচ্ছা করে আমাকে ফেলে রেখে যায়নি মামা। খুশি হয়ে বললাম, 'কোথায় গিয়েছিলে মামা?'

মামা মাথা মুছতে মুছতে বলল, 'সিংহের গুহায়। গুহা থেকে বড়শি দুটো উদ্ধার করে আনলাম। দেখলি না গত রাতে বড়শির জন্য কেমন ঝড় তুলেছিল। ভুলেও তোর নানাভাইকে বড়শির ব্যাপারটা বলবি না। বললে চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব, মনে থাকে যেন। বর্ষা প্রজেক্টটা শেষ হলেই আবার জায়গামতো রেখে দেব। এখন রেডি হয়ে নে, মাছের প্রিয় খাবার খুঁজতে বেরোতে হবে। না হলে আজ আর বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে হবে না।'

আমি আঁতকে উঠে বললাম, 'মামা, আমরা এখন মুরগির বিষ্ঠা খুঁজতে বেরোব?'

ফণী মামা রেগে গিয়ে বলল, 'এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব গাধা কোথাকার। মুরগির বিষ্ঠা খুঁজতে বেরোব কোন দুঃখে?'

আমি আমতা-আমতা করে বললাম, 'না, মানে, তুমি না কাল রাতে বললা মাছের প্রিয় খাবার মুরগির বিষ্ঠা।'

ফণী মামা এবার হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, 'দূর গাধা, কাল রাতে আমি তো তোর নানাভাইয়ের ওপর রাগ করে ওসব বলেছি। কথা আর বাড়াস না, জলদি কাঁথার ভেতর থেকে বের হ। বৃষ্টি একটু কমেছে, এখনই বেরোতে হবে। অনেক কাজ পড়ে আছে।'

তিন

নানুর বাসায় কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাসায় সবাই আছেন, কিন্তু নীরবে কাজ করছেন যে যাঁর মতো। বাসার পরিস্থিতি দেখে কেউ বলবে না এ বাসায় কিছুক্ষণ আগে একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। নানুভাই বারান্দায় তাঁর প্রিয় হেলান চেয়ারটায় বসে আছেন, মুখে তৃপ্তির হাসি। নানুভাইয়ের পাশে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছি। নানুভাইকে ভয় পাই আমি। ফণী মামা যেমন ভয় পায়, তার চেয়ে একটু বেশি ভয় পাই। চশমার কাচ পরিষ্কার করতে করতে নানুভাই বললেন, 'গাধাটার উচিত শিক্ষা হয়েছে। কী বলিস?'

আমি চুপ করে রইলাম।

নানাভাই হুংকার দিয়ে বললেন, 'কথা বলছিস না কেন? কথা বল!'

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, 'হু...হু নানাভাই।

কত বড় গাধা! বোলতার চাক পাড়তে গাছে উঠেছে। গাধায় বোলতার চাক দিয়া মাছ ধরবে। হাতের কাছে পাইলে পিটাইয়া মাছ ধরা বাইর করতাম। উচিত হইছে, বোলতায় হুল ফুটাইয়া দিছে। এইবার কয়টা দিন শুইয়া শুইয়া চিঁচিঁ করুক।'

নানাভাইয়ের কথায় খুব খারাপ লাগল আমার। মনে হলো এখনই কেঁদে ফেলব। ফণী মামাকে আমি অনেক ভালোবাসি। মামাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমার খারাপ লাগে। মামার কী দোষ? বোলতার চাকে বোলতার বাচ্চা থাকে। বোলতার বাচ্চা মাছের খুব প্রিয়। বড়শিতে গেঁথে ফেললেই গপাগপ খেয়ে ফেলে মাছ। বাগানে কামরাঙাগাছে একটা বোলতার চাক ছিল। সেটা পাড়তেই গাছে উঠেছিল ফণী মামা। পুরো শরীর মশারি দিয়ে ঢেকে তারপরই উঠেছিল, কিন্তু কে জানত এরপরও বোলতা...‘রোটন দাদা...রোটন দাদা...,’ তাকিয়ে দেখি মতিন ভাই ডাকছে। মতিন ভাইয়ের হাতে টিফিন বক্স। হাসপাতালে ফণী মামার জন্য খাবার নেওয়া হয়েছে। আমি ভাইয়ের সঙ্গে ফণী মামাকে দেখতে যাব এখন। মামার সারা শরীরে বোলতা যেভাবে হুল ফুটিয়েছে, তাতে মনে হয় না হাসপাতাল থেকে এক সপ্তাহের আগে ছাড়া পাবে। নানাভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর মতিন ভাই ফণী মামাকে দেখতে বের হলাম। ফণী মামার এবারের বর্ষা প্রজেক্টটাও হাতছাড়া হয়ে গেল ভেবে একটু বেশিই খারাপ লাগছে!