বাঘ শিকার

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

ব্যারন মুনশাউজেন, নামটা শুনলেই ভেসে ওঠে দমফাটা শিকারকাহিনির মজাদার উৎসের কথা। সেই অসামান্য শিকারের গল্পগুলো পড়ে ছোট থেকেই তাঁর তুমুল ভক্ত আমি। যদিও নিন্দুকেরা বলে, ব্যারন মুনশাউজেন আজগুবি চরিত্র; কিন্তু আমার তা মনে হয় না। হরিণের শিংয়ে গাছ জন্মাতেই পারে অথবা নেকড়ে তার চামড়া ছেড়ে যেতেই পারে। এতে সমস্যাটা কী? যত্তসব!

যা–ই হোক, এই কিংবদন্তি শিকারির কথা বইয়ে পড়ে আমারও শিকার করার খায়েশ জেগে উঠল। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরে তো আর বাঘ-ভালুক পাওয়া যায় না। এমনকি নেকড়েরও খুবই অভাব। আশপাশে শুধু কুকুর-বিড়াল আর পাখিদের মধ্যে কাক-চড়ুই। ব্যারন মুনশাউজেনের উত্তরসূরি হিসেবে কুকুর-বিড়াল মারাটা মোটেই আকর্ষণীয় নয়। মারতে যদি হয়ই, তবে বাঘই মারব। সমস্যা হলো, বাঘ মারতে হলে যেতে হবে সুন্দরবন। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যাও তো আমার মতো শিকারির জন্য খুবই কম। তা ছাড়া আমার সুন্দরবন যাত্রার কথা শুনে বাঘেরা সুন্দরবন ছেড়ে দেশের বাইরেও পালিয়ে যেতে পারে। আর যা-ই হোক, দেশের ক্ষতি তো হতে দিতে পারি না। তবে আমি হার মানার পাত্র নই। প্রকৃতির এই বিরুদ্ধাচরণকে পেছনে ঠেলে ভাবতে লাগলাম আর কোথায় বাঘ পাওয়া যায়। হঠাৎই মাথায় ১০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠল, আরে চিড়িয়াখানাতেই তো সহজে আমার শিকার প্রতিভা সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিতে পারি। এতে আমাকে বাঘ খোঁজার কষ্টও করতে হবে না। আমার ভক্তরা আগে থেকেই বাঘকে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছে। এখন শুধু গিয়ে ধুমধাম গুলি ছুড়লেই কেল্লা ফতে।

কথায় আছে শুভস্য শ্রীঘ্রম। তাই এক শুভ দিন মেনে স্কুল বন্ধ দেখে চিড়িয়াখানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই আম্মুর ভিডিও ক্যামেরা হাতিয়ে নিয়েছি। আর নিয়েছি বাবার এয়ারগানটা। এই এয়ারগান দিয়ে বাবা নাকি ছোটবেলায় একটা মেছো বাঘ মেরেছিল। বাবা যদি ছোটবেলায়ই মেছো বাঘ মারতে পারে, তবে আমারও তার ছেলে হিসেবে কিশোরবেলায় বেঙ্গল টাইগার মারতে পারা উচিত। এ ছাড়া ক্যামেরার ব্যাকআপ হিসেবে আমার মোবাইলটাও নিয়েছি আমার শিকার প্রতিভার রেকর্ড রাখার জন্য, কারণ আমার এই প্রতিভা তো আর দশ–পাঁচটা প্রতিভার মতো নয়। এটা হচ্ছে হ্যালির ধূমকেতু। অনেক বছর পরপর আসে। তাই যারা বর্তমানে পৃথিবীতে আছে, তাদের তো এটা দেখার সুযোগ দিতেই হয়। আফটার অল, আমার একটা দায়িত্ব আছে না জাতির প্রতি!

চিড়িয়াখানায় ঢুকেই বিশাল এক ধাক্কা খেলাম। বানরের খাঁচায় বানর প্রজাতির সব প্রাণী অর্থাৎ বানর, শিম্পাঞ্জি, গরিলারা একসঙ্গে তুমুল তর্ক করছে। আমি খাঁচার কাছে যেতেই হঠাৎ সব চুপচাপ হয়ে গেল। এক মুশকো গরিলা তড়িঘড়ি করে খাঁচার তিন-চারটা স্পাইক বাঁকা করে ভেতরে নিয়ে গেল।

আমি চারদিকে বানরের এই অদ্ভুত সম্মেলন অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি ম্যাজিকের মতো খাঁচার ভেতর এক সিংহাসন। আরে খাঁচা কোথায়! আমি তো আমাজনের জঙ্গলে! দুটো গরিলা আমাকে মাথায় তুলে নিয়ে সেই সিংহাসনে বসিয়ে দিল। তারপর সেই সিংহাসনশুদ্ধ আমাকে মাথায় নিয়ে ধুন্ধুমার নাচ লাগিয়ে দিল। ওদিকে চারপাশ থেকে আমার ওপর দানবাকৃতির সূর্যমুখী ফুল পড়তে লাগল। আচমকা বন্ধ হয়ে গেল সবকিছু। গরিলা দুটো আমাকে শুদ্ধ সিংহাসনকে আবার মাটিতে নামিয়ে রাখল। মুখে বিচিত্র রং লাগানো এক বুড়ো বানর সরদার আমার গায়ের ওপর কী যেন ফুল ছিটাতে লাগল আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল কী যেন। কিছুই বুঝতে না পেরে আমি আমার মস্তিষ্ককে বানরের উপযোগী করে ফেললাম। বোঝেনই তো, একজন পৃথিবীসেরা শিকারি হিসেবে সব প্রাণীর ভাষা তো আমার ঠোঁটস্থ-মুখস্থ–কণ্ঠস্থ।

তারপরই বানরদের সরদারের মুখে শুনলাম এক করুণ কাহিনি। এক বাঘ কীভাবে তাদের সব স্বজাতিকে ভোজ করছে। বনে আরও অনেক জন্তু-জানোয়ার থাকতেও বাঘটার নাকি বানরদের মাংসেই লোভ, বানররা আমাকে দেখেই বুঝেছিল যে আমার মধ্যেই রয়েছে বাঘ মারার উপযুক্ত প্রতিভা। তাই তারা সবাই মিলে আমাকে তাদের রাজা বানাতে চাইল। যদিও আমার মতো শিকারির জন্য বানরদের রাজা হওয়া কোনো উপযুক্ত সম্মান নয়। কিন্তু বানরদের তো বাঁচাতে হবে। তাই বানরদের রাজা হওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। রাজা হয়েই বুকের মধ্যে প্রজাদের প্রতি দায়িত্বের ফোয়ারা বয়ে গেল। যেই হাঁক মেরে বাঘ শিকারে নামতে যাব, দেখি আমার এয়ারগানটাই আনতে ভুলে গেছি। নিশ্চয়ই বাসা থেকে চিড়িয়াখানায় আসার সময় কোনো পকেটমার মেরে দিয়েছে। বন্দুক ছাড়া তো বাঘ মারার প্রশ্নই ওঠে না। তাই ভাবলাম কয়েক দিন রেস্ট করে বানরদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসব। কিন্তু রাজা হওয়ার সুখ কপালে সইল না, এক্ষুনি বানরদের হয়ে বাঘ মেরে দিতে হবে।

বানরের খাঁচায় বানর প্রজাতির সব প্রাণী অর্থাৎ বানর, শিম্পাঞ্জি, গরিলারা একসঙ্গে তুমুল তর্ক করছে। আমি খাঁচার কাছে যেতেই হঠাৎ সব চুপচাপ হয়ে গেল। এক মুশকো গরিলা তড়িঘড়ি করে খাঁচার তিন-চারটা স্পাইক বাঁকা করে ভেতরে নিয়ে গেল।

যেই না বললাম আমি অস্ত্রহীনভাবে বাঘ মারতে এসেছি, সঙ্গে সঙ্গেই বানরগুলোর ভোল পাল্টে গেল। বেইমানের মতো ওদের সরদার বলল, তোমাকে বাঘের মুখেই ছেড়ে আসব। হয় বাঘ মরবে, নইলে তুমি। গরিলারা আবার আমাকে চ্যাংদোলা করে তুলে ফেলল। তবে এবার আর রাজা হওয়ার জন্য নয়। রাজা হওয়ার সাজা পাওয়ার জন্য। কোথায় ভেবেছিলাম বাঘ মেরে বীরের বেশে বাসায় ফিরব; সেখানে বাঘের হাত থেকে দেহের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সহি-সালামতে ফিরিয়ে আনতে পারলেই হয়।

কিছুক্ষণ পরই নিজেকে বাঘের সামনে আবিষ্কার করলাম। ভয়ে থরহরিকম্প অবস্থায় দেখি, বাঘটি আমাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল, ‘কী হে! বানরদের রাজা হওয়া কেমন লাগল?’ তোর মতো আরও কয়েকটা বেকুব এ পর্যন্ত বানরদের রাজা হয়েছে। আর সবাই আমার পেটে আরামসে নিদ্রা যাচ্ছে। এখন তোর কোনো শেষ ইচ্ছা আছে কি না বল?’

কথাটা শুনেই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেল। বেশ তো ছিলাম মা-বাবার বকুনি আর তিতকুটে পড়াশোনা নিয়ে। কেন যে ব্যারন মুনশাউজেনের মতো শিকারি হতে গেলাম। শেষমেশ ভাবলাম বাঘের কথামতো শেষ ইচ্ছাটা বলে ফেলাই ভালো, যে–ই না আমার শেষ ইচ্ছাটা বললাম, এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটল, অনেকটা ঘোড়ার ডিম পাড়া আর বাঘের ভেজিটেবল খাওয়ার মতো। কী হলো কে জানে, বাঘটা তুমুল হাসি হাসতে হাসতে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে সেখানেই পটল তুলল। আমিও বুঝতে পারলাম না, কী এমন শুনে বাঘটার এত হাস্যকর মৃত্যু ঘটল। আসলে আমি বলেছিলাম, আমি বাংলাদেশের যানজট দূর করে মরতে চাই। এটা শুনেই বাঘটা মরে গেল! কী আফসোস! যা–ই হোক, বর্তমানে আমিই কথার তিরে বাঘ শিকারকারী প্রথম এবং সর্বশেষ ব্যক্তি। কারণ অন্যদের সঙ্গে বাঘ কথা বলে সময় নষ্ট না করে ডাইরেক্ট অ্যাকশনে যেতে পারে। শীঘ্রই গিনেসে আপনারা আমার নাম দেখবেন। আর যেকোনো শিকারঘটিত ব্যাপারে আমার শরণাপন্ন হবেন। জানেনই তো, নো ফিয়ার, হোয়েন দ্য বস ইজ হিয়ার।