বাঘের ভয়ে উঠলাম গাছে

অলংকরণ: রাকিব

রসিকলাল লোকটা যেমন রসিক তেমন গল্পবাজ। একবার গল্প করতে বসলে নড়াচড়ার নাম নেই। হুঁশও থাকে না সময় কতটা কাটল। যেখানে বসে গল্প শুরু করে, ধীরে ধীরে সেখানটায় লোক জমে। এ এক কাপ চা খাওয়ায় ও একটা সিগারেট দেয়। রসিকলাল সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা খায় আর ফুক ফুক করে সিগারেট টানে। অতিরিক্ত সিগারেট টানার ফলে গলাটা ঘ্যারঘ্যারা আর বেদম একটা কাশি আছে। ওই ঘ্যারঘ্যারা গলায় কাশি সামলে গল্প সে চালিয়ে যায়। অদ্ভুত একটা হাসি আছে তার। সেই হাসিটা হাসে। দাঁতগুলো ফাঁক ফাঁক। তার হাসি দেখে লোকেও হাসে।

বাড়ির অবস্থা রসিকলালের মন্দ নয়। জমিজমা আছে ভালোই। ওসব চাষবাস করে ধান, পাট, শর্ষে ইত্যাদি বিক্রি করে সংসার চলে ভালোই। বাড়িতে বেশ কয়েকটা ঘর, বিস্তর গাছপালা, পুকুর, বাঁশঝাড়, ফলফলারির বাগান। গ্রাম–গেরস্ত হিসেবে সচ্ছল লোক।

তবে সংসারকর্ম সে বলতে গেলে করে না। খায়দায়, ঘুমায় আর দুপুরের পর বেরোয় আড্ডা দিতে। সংসার সামলায় ছেলেরা। জমিজমার তদারক করে তারা, বাড়ির কাজ করে ছেলের বউয়েরা।

রসিকলালের স্ত্রীর নাম ছিল কমলা। সে বছর তিনেক আগে এক রাতে হঠাৎ করেই মারা গেল। হাঁপানির রোগ ছিল। বেদম শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। ডাক্তার ডাকার সময়ই পাওয়া গেল না।

কমলা বেঁচে থাকতে সংসার একটু দেখতে হতো। সে মারা গিয়ে রসিকলালকে একেবারেই বেকার করে দিয়ে গেছে। এখন তাকে করতে হয় না কিছুই। ছোট ছেলেটা বাজারে একটা বড় সাইজের মুদিদোকান করেছে। ওই করতে একটা জমি বিক্রি করতে হয়েছে। তবে ব্যবসা ছেলে খারাপ করছে না। মুদিদোকান জমে গেছে। আয়রোজগার বেশ ভালো। নমুনা যা দেখা যাচ্ছে, বছর তিনেকের মাথায় দোকান আরেকটা সে করে ফেলতে পারবে।

নগদ টাকাটা আজকাল ছোট ছেলের কাছ থেকেই নেয় রসিক। আড্ডাবাজিরও তো একটা খরচা আছে! চা–সিগারেট খেতে পয়সা লাগে। মানুষের ওপর দিয়ে কত চালানো যায়!

দেয়। ছোট ছেলেটা বাপকে টাকাপয়সা দেয়।

তবে রসিকের চাহিদা তেমন বেশি কিছু না। এই তো ২০–৫০ টাকা হলেই তার দু–তিনটা দিন চলে যায়। চা আর সিগারেটের খরচাই তো! তা–ও নিজের পয়সায় আর কয়টাই–বা সে খায়! খাওয়ায় তো লোকেই! শুধু বাড়িতে খাওয়ার জন্য আড্ডা দিয়ে ফেরার পথে এক প্যাকেট সিগারেট সে কেনে। তা–ও সস্তা সিগারেট। অনেক সময় ওটাও কিনতে হয় না। তার গল্পে–কথায় মজা পেয়ে কেউ কেউ পুরো এক প্যাকেট সিগারেট কিনেও দেয়।

আজ যেমন দিয়েছে গাঁওপাড়া বাজারের চায়ের দোকানদার মনিরুল।

দেওয়ার অবশ্য কারণও আছে। মনিরুলের দোকানটা কিছুদিন হলো তেমন চলছে না। বিকেলের দিকে কাস্টমার ভিড়ছে না। চলে যায় জালালের চায়ের দোকানে। সেই দোকানের চা নাকি বেশি ভালো। দামও চার আনা কম। অর্থাৎ দোকান জমানোর জন্য চায়ের দাম কাপপ্রতি চার আনা কমিয়ে দিয়েছে জালাল। মনিরুলকে কাত করার জন্য।

তো কাত মনিরুল অনেকখানি হয়ে গেছে। দোকানের বেচা–বিক্রি কমে গেছে। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।

এ অবস্থায় দিন তিনেক আগে রসিকলাল এসে বসল তার দোকানে। বিকেল শুরুর দিকেই এল। এ সময় গ্রামের গৃহস্থলোক কাজকাম শেষ করে, খাওয়াদাওয়া সেরে একটু জিরিয়ে–টিরিয়ে বাজারের দিকটায় আড্ডা দিতে আসে। চা–সিগারেট খায়, গল্প করে। আর এখন তো গ্রামের বাজারের চা–মিষ্টির দোকানে, মুদিদোকানেও টেলিভিশন আছে। কোনো কোনো চ্যানেলে সারা দিনই পুরোনো সাদাকালো সিনেমা দেখায়। সেই সিনেমাই গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখে কাস্টমাররা। ফাঁকে ফাঁকে চা–বিস্কুট খায়। শিঙাড়া, ডালপুরি খায়। এ এলাকায় অবশ্য ইলেকট্রিসিটি আসেনি এখনো। টিভি চলে ব্যাটারিতে। দোকানে দোকানে জ্বলে হ্যাজাক বাতি বা হারিকেন। চার্জার বাতিও জ্বলে কোনো কোনো দোকানে। সেসব দোকান একটু বেশি চালু।

এলাকাটা বনজঙ্গল আর মাঠ–খেতে ভরা। গাঁওপাড়া বাজারে আসতে রসিকলালকে গজারিবনটা পার হতে হয়, তেপান্তরের মাঠের মতো একটা মাঠ পার হতে হয়। সে সাহসী লোক। রাতবিরাতে চলাফেরা করে অভ্যস্ত। ভয় বলতে গেলে পায়ই না। যদিও লোকমুখে শুনেছে, মাঠের মাঝখানকার তেঁতুলগাছটায় তেনাদের একজন বহু বছর ধরে থান গেড়ে আছেন। অমাবস্যার রাতে, ফিনফিনে জ্যোত্স্নারাতে তেঁতুলগাছ থেকে নেমে মাঠে চরে বেড়ান। কেউ কেউ দেখেছেও। রসিকলাল দেখেনি কখনোই। এই মাঠ পাড়ি দিয়ে বহুবার সন্ধ্যায় বা জ্যোত্স্নারাতে, এমনকি অন্ধকার রাতেও সিগারেট টানতে টানতে হেঁটে গেছে। তেঁতুলগাছের তলা দিয়ে গেছে, পথ দিয়ে গেছে, তেনার টিকিটিও দেখেনি।

দেখার শখও ছিল। কোনোরূপে তেনায় রসিককে দেখা দেন, এটা দেখার গোপন একটা লোভ রসিকের ছিল। হয়নি। কী আর করা!

গজারিবনটায় নাকি ইদানীং একটা বাঘ এসে জুটেছে। একটু বুড়ো ধরনের। একটা পা খোঁড়া। তেমন দৌড়াতে পারে না। ল্যাংচে ল্যাংচে চলে। মাঠে গৃহস্থের চরতে আসা দু–একটা গরু–ছাগল সেই বাঘের পেটে গেছে। কেউ কেউ দূর থেকে বাঘটা দেখেছে।

একে বুড়ো বাঘ অন্যদিকে পা খোঁড়া, শিকার ধরতে তার খুবই অসুবিধা হওয়ার কথা। এ কারণে বাঘটা প্রায় অনাহারে থাকে। অনাহারী বাঘ ধীরে ধীরে মানুষখেকো হয়ে ওঠে। সেই কুলাঙ্গারটা নাকি ইদানীং মানুষখেকো হয়ে ওঠার তালে আছে। এই গল্পগাছা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে এলাকায়। এ জন্য দিনে–দুপুরেও একা মাঠ–বনের দিকে আসে না লোকে। আসে দল বেঁধে। হাতে লাঠিসোঁটাও থাকে। কদিন ধরে বাঁশের পাঁচ–ছয় হাত লম্বা একটা লাঠি নিয়ে এই কারণে চলাফেরা করছে রসিক।

তার অবশ্য অন্য একটা সুবিধাও আছে। এই বয়সেও সে দৌড়াতে পারে বেশ ভালোই। ল্যাংড়া বাঘ দৌড়ে তার সঙ্গে পারবে না। বাঘ আসছে দেখতে পেয়ে এয়ছান দৌড় রসিক দেবে, বুড়ো ল্যাংড়া বাঘ সেই দৌড়ের কাছে নস্যি।

তারপরও সাবধানের মার নেই। হঠাৎ সামনে পড়ে গেলে লাঠিটা কাজে লাগবে বলে তার ধারণা।

ধারণা যে কতটা ভুল, তার প্রমাণ রসিক একদিন হাতেনাতে পেল। বাঘ জিনিসটা ছবিতে–সিনেমায় দেখেছে, সামনাসামনি তো আর দেখেনি! সেই অভিজ্ঞতা নেই। জন্তুটা যে আসলে কী ভয়ংকর, বুড়ো হোক আর ল্যাংড়া হোক, তাতে কিছুই যায়–আসে না। বাঘ বাঘই। হুংকার দিয়ে পিছু নিলে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে। কাপড়চোপড় নষ্ট হয়ে যাবে।

রসিকের অবশ্য তা হয়নি। শুধু হাতের লাঠিটা ছিটকে পড়েছিল। তারপর প্রাণপণে সে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দৌড়টা দিতে পেরেছিল। এক দৌড়ে বন পেরিয়ে মাঠে এসে পড়েছিল। বুড়ো ল্যাংড়াও ছুটছে তার পেছন পেছন। এই বুঝি ধরে ফেলল রসিককে। এই বুঝি...

তখন দিকপাশ না ভেবে তরতর করে তেঁতুলগাছটায় উঠে পড়ল রসিক। উঠল একেবারে কাঠবিড়ালের কায়দায়। সে যে গাছে চড়ায় এতটা এক্সপার্ট, সেদিনের আগে রসিক কোনো দিন বোঝেনি।

বুড়ো ল্যাংড়া তখনই তেঁতুলতলায় এসে হাজির। গাছের চারদিকে চক্কর দিচ্ছে আর মুখে ঘ্যাড়ঘ্যাড়, ঘ্যাড়ঘ্যাড় শব্দ। রাগে–ক্রোধে গজরাচ্ছে। কেন রসিককে সে ধরে কচকচ করে তার হাড়মাংস চিবিয়ে খেতে পারল না, এই আফসোস মনে। রাগ–ক্রোধ এ জন্য আরও বেড়েছে।

কিন্তু এ ঘটনা রসিকের জীবনে কেন ঘটল? বুড়ো ল্যাংড়ার কথা জেনেও সন্ধ্যা পার করে কেন সে এই পথে এল! তা–ও একা একা!

গল্পবাজ লোকদের যা হয় আরকি, এক কথাই অনেক রকমভাবে বলে। সঙ্গে সত্যের চেয়ে মিথ্যা থাকে বেশি। সে যে খুবই সাহসী লোক, বুড়ো ল্যাংড়াকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না, বেশ কয়েকবার এসব গল্প সে করেছে। ফলে তার হাতে লাঠি দেখে মনিরুলের চায়ের দোকানের আড্ডাবাজদের একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কী হে রসিক, হাতে যে লাঠি দেখতে পাচ্ছি! ঘটনা কী?’

মনিরুলের সঙ্গে রসিকের ইতিমধ্যে একটা চুক্তি হয়েছে। সে প্রতি বিকেলে তার দোকানে এসে বসবে। গালগল্প করবে। তার চটকদার এবং রসাল সত্য–মিথ্যা গল্প শুনতে লোক জড়ো হবে। মনিরুলের বিক্রিবাট্টা বেড়ে যাবে। জালালের দোকান মার খেয়ে যাবে।

হলোও তা–ই।

কিন্তু এ ঘটনা রসিকের জীবনে কেন ঘটল? বুড়ো ল্যাংড়ার কথা জেনেও সন্ধ্যা পার করে কেন সে এই পথে এল! তা–ও একা একা!

যেদিন থেকে রসিকলাল বিকেলবেলা এসে বসতে শুরু করল, তার গল্পগাছা শুনতে একজন–দুজন করে বাজারের লোক, আশপাশের গ্রামের গৃহস্থলোক জড়ো হতে লাগল। বিক্রি বেড়ে গেল মনিরুলের দোকানে। কয়েক দিনের মধ্যে অবস্থা এমন হলো, দোকানের ভেতর জায়গাই দেওয়া যায় না কাস্টমারকে। বাড়ি থেকে দুখানা লম্বা বেঞ্চ এনে দোকানের সামনে পেতে দিল মনিরুল। তাতেও জায়গা কুলানো মুশকিল। মনিরুল নিজে আর তার ছোকরা কর্মচারীটা চা বানিয়ে কুলাতে পারে না। চায়ের সঙ্গে উজাড় হতে লাগল বিস্কুটের টিন, শিঙাড়া, ডালপুরি আর নিমকি। ওদিকে জালালের দোকানে ব্যাপক মার খেয়ে গেল। ফলে রসিকলালের প্রতি কৃতজ্ঞতা খুবই বেড়ে গেল মনিরুলের। পারলে রসিককে সে কোলে বসিয়ে চা–বিস্কুট খাওয়ায়। সিগারেট টানতে সাহায্য করে।

তো বুড়ো ল্যাংড়ার কথা বেশ চাউর হয়েছে চারদিককার গ্রামে। বনের ভেতর দিয়ে যাদের বাড়ি ফেরার কথা, তারা দল বেঁধে ফেরে। হইচই করতে করতে ফেরে। এই কারণে বুড়ো ল্যাংড়া তাদের দিকে এগোতে সাহস পায় না। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকা ভালো, জীবনটা দিয়ে দেওয়া তো ভালো কথা নয়। তার ওপর মানুষ বলে কথা! দল বেঁধে আক্রমণ চালালে ল্যাংড়া পা নিয়ে দৌড়ে পালানো সম্ভব হবে না। আর অন্যদিকে একা কোনো মানুষ বনের পথে আজকাল যায়ই না। ঘুরপথে চলাফেরা করে।

বুড়ো ল্যাংড়াকে ঘিরে নানা রকম গল্প বানিয়ে বানিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে রসিকলাল। সঙ্গে নিজের বেদম সাহসের প্রচারণাও আছে। এ রকম সাহসী মানুষের হাতে তেল চকচকে বংশদণ্ডখানা দেখে মনিরুলের দোকানের আড্ডাবাজেরা অবাক। ঘটনা কী? রসিকলালও দেখি বুড়ো ল্যাংড়ার ভয়ে কাতর!

এখানে বলে রাখা ভালো, ‘বুড়ো ল্যাংড়া’ নামটাও রসিকলালের দেওয়া। ঠাট্টা করে দিয়েছে।

যাহোক, বংশদণ্ড নিয়ে কথা শুরু হলো। একজন বলল, ‘কী ভায়া? তোমার হাতে লাঠি? কার ভয়ে লাঠি নিয়ে এলে? তোমার ওই বুড়ো ল্যাংড়ার ভয়ে?’

রসিক চায়ে চুমুক দিল। সিগারেটে টান দিল, ‘আরে না। গরমকাল চলছে। বনের পথে আর ওই মাঠে বিস্তর সাপ। সাপগুলো দিনে–দুপুরে আর রাতে যেখানে–সেখানে গা মেলে পড়ে থাকে। বিষধর গোখরা সব। বুড়ো ল্যাংড়ার চেয়ে শতগুণ পাজি। বুড়ো ল্যাংড়ার হাত থেকে বাঁচা যাবে, সাপের হাত থেকে বাঁচা যাবে না। বুড়ো ল্যাংড়া হচ্ছে দেখা শত্রু আর সাপেরা হচ্ছে অদেখা শত্রু। অদেখা শত্রু বেশি ভয়ের।’

আরেকজন বলল, ‘বুড়ো ল্যাংড়া দেখা শত্রু হলো কী করে? তোমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ার আগে কি তোমাকে দেখা দেবে? আমি তো শুনেছি বাঘ বিড়ালজাতীয় প্রাণী। হাঁটাচলায় শব্দ হয় না। নিঃশব্দে পেছন থেকে এসে তোমার ঘেটিটা কামড়ে ধরবে। বিড়াল যেমন করে ইঁদুর ধরে মুখে করে নিয়ে যায়, সেই কায়দায় তোমাকে বনের ভেতর নিয়ে হাড়হাড্ডি মাথামুণ্ডু টোস্ট বিস্কুটের মতো কুড়মুড় করে খাবে।’

রসিক বলল, ‘কথা ঠিক। তবে সেটা সুস্থ–স্বাভাবিক বাঘের ক্ষেত্রে। বুড়ো ল্যাংড়ার ক্ষেত্রে না।’

‘কেন? বুড়ো ল্যাংড়ার সমস্যা কী?’

‘ল্যাংড়া পায়ে চলাফেরার সময় শব্দ হয়। বনে বিস্তর শুকনা পাতা পড়ে আছে। ওসবের ওপর দিয়ে ওই ল্যাংড়া পা ফেললেই শব্দ। আর তোমরা সবাই জানো, আমার দৌড় তো অতুলনীয়। ওই শব্দে আমি এয়ছান দৌড় দেব, বুড়ো ল্যাংড়ার বাপেরও সাধ্যি নেই আমার টিকিটি ছোঁয়।’

আরেকজন বলল, ‘শুনলাম তুমিও আজকাল ঘুরপথে বাড়ি যাচ্ছ? বনপথে যাচ্ছই না।’

চায়ে শেষ চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খেল রসিক। যা বাবা, ধরা খেয়ে গেলাম নাকি! আমি তো ঘুরপথে যাই সবার চোখ এড়িয়ে। তাহলে?

ধরা খাওয়ার ক্ষেত্রে রসিক যা করে, একদম সরাসরি অস্বীকার, ‘না না, মিছে কথা। আমার নামে শত্রুরা এসব রটাচ্ছে। আমি রোজই বনপথে আসা–যাওয়া করি। মিছে কথা, একদম মিছে কথা।’

মনিরুল তার পক্ষ নিল, ‘হ্যাঁ, রসিক দাদার কারণে আমার দোকানের বেচা–বিক্রি ভালো দেখে জালাল শয়তানটা এসব রটাচ্ছে। রসিক দাদা, আপনি ওসব কথায় কান দেবেন না। চা খান, চা খান।’

‘চা তো শেষ।’

‘তাহলে আরেক কাপ দিই!’

‘দাও, দাও। পরপর দুই কাপ চা খাওয়া শরীরের জন্য ভালো।’

আজকের আড্ডায় নতুন তিনজন যুবক এসে জুটেছে। এলাকায় এই তিনজনের বিরাট নামডাক। লোকে তাদের বলে ‘ত্রিরত্ন’। এ রকম নামের কারণও আছে। একজনের নাম হীরা, একজন মানিক, আরেকজন হচ্ছে রতন। তারাই আলোচনাটা ওসব দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। ওরা আসলে জালালের লোক। রসিকলালকে জব্দ করার জন্য জালাল কিছু টাকা খরচা করে ওই তিনটিকে রসিকের পেছনে লাগিয়ে দিয়েছে। মতলব একটাই, রসিককে মনিরুলের দোকান থেকে ভাগিয়ে দেওয়া। সম্ভব হলে এই বাজারে আসাই বন্ধ করা। তাহলে তার দোকানের হারানো গৌরব এবং ব্যবসা—দুটোই ফিরে আসবে।

ত্রিরত্ন নানান কথায় রসিককে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা চালাতে লাগল। আজ পূর্ণিমা। সন্ধ্যা হতে না হতেই বিশাল চাঁদ উঠল আকাশে। ফকফকা জ্যোত্স্নায় চারদিক একেবারে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে গেল। লোকজন যে যার গ্রামের দিকে দল বেঁধে রওনা দিল। রসিকও ঘুরপথ ধরার মতলব করছে।

হীরা বলল, ‘চলুন রসিক দাদা, আপনাকে কিছুদূর এগিয়ে দিই। বনের পথেই তো ফিরবেন! বনের মুখটায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’

রসিক বেকায়দায় পড়ে গেল। কী করা এখন? নিজের ফাঁদে নিজেই আটকেছে! ফাঁদ ভেঙে বেরোনোর উপায় কী?

তারপরও চেষ্টা সে করল, ‘না না, তোমাদের কষ্ট করার দরকার নেই। আমি চলে যেতে পারব। তোমরা ছেলেমানুষ। বনের মুখ পর্যন্ত যাওয়ার দরকার কী? বুড়ো ল্যাংড়া শুনেছি যুবক মানুষের হাড়মাংস, এমনকি মুণ্ডুও বেশি পছন্দ করে। বিপদ তোমাদেরই বেশি। আমার এই বয়সী শরীর বুড়ো ল্যাংড়ার পছন্দ হবে না। আমাকে সে ছুঁয়েও দেখবে না। তোমরা যাও, বাড়ি চলে যাও। আমি ঠিক চলে যেতে পারব।’

মানিক বলল, ‘আরে না। আমরা তিনজন আর আপনি একা। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। জানি আপনি সাহসী লোক। তবু এগিয়ে দিই। আপনাকে একটু সম্মান দেখানো আরকি! চলুন, চলুন।’

রতন ধরল অন্য তরিকা। দয়ালু ও সাবধানী গলায় বলল, ‘তবে বনপথে আপনার না যাওয়াই ভালো দাদা। কখন কী বিপদ হয়!’

এ–ও এক চালাকি। ব্যাপারটা বুঝল রসিক। কিন্তু করবে কী! ওদের কাছে তো ধরা খাওয়া যাবে না! অগত্যা ভগবানের নাম নিয়ে ত্রিরত্নের সঙ্গে বনপথেই রওনা দিল, ‘না না, ঠিক আছে। তোমাদের কথা তো আর ফেলতে পারি না! ভালোবেসে এগিয়ে দিতে চাচ্ছ, দাও।’

ত্রিরত্ন এ–ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে রসিককে বনের মুখে ছেড়ে দিয়ে গেল। রসিক যেন তারপরও ফিরে এসে ঘুরপথ না ধরতে পারে, সে জন্য বনের মুখে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি আর মুচকি হাসি চলছে।

রসিকের তখন বুক ঢিপ ঢিপ করছে। ভগবানের নাম নিচ্ছে দমে দমে। আর যত দ্রুত সম্ভব পা ফেলছে। এ রকম পা ফেলা প্রায় সাধারণ মানুষের দৌড়ের মতো।

এবার বুড়ো ল্যাংড়ার ইতিহাসটা বলতে হয়।

সে হচ্ছে বয়সী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আবাস ছিল সুন্দরবনে। বয়স হয়ে যাওয়ার ফলে শিকার তেমন ধরতে পারছিল না। বনের হরিণগুলো বেজায় চালাক। আর তাদের দোসর হচ্ছে গাছের ডালে ডালে লটকে বেড়ানো বানরগুলো। হরিণ–বানরে বেদম বন্ধুত্ব। গাছের ডাল থেকে কচি কচি পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলে তারা আর হরিণেরা দল বেঁধে তা খায়।

বন্ধুকে সাহায্য করা বন্ধুর দায়িত্ব। বানরেরা জানে হরিণের বড় শত্রু বাঘ। সুযোগ পেলেই হরিণ শিকার করে খাবে বাঘে। সে জন্য গাছের মগডালে বসে তারা গাছতলায় পাতা খেতে থাকা হরিণ বন্ধুদের পাহারা দেয়। বাঘের ছায়া দেখলেই কু কু শব্দে বন্ধুদের সাবধান করে।

হরিণেরা এই ডাকের অর্থ বোঝে। মুহূর্তে দৌড়ে পালায়। এই জন্য বানরদের ওপরও রয়েল বেঙ্গলদের ভীষণ রাগ। এই বদমাশগুলোর জন্য তাদের আহার ছুটে যাচ্ছে।

বুড়ো ল্যাংড়া বুড়ো হলে কী হবে, তার বেজায় রাগ। বানরদের ওপর রাগে–ক্রোধে কয়েকবার সে গাছে চড়ার চেষ্টা করেছে। ভাবটা এমন, দু–একটা বানর ধরেই খাবে।

সেটা অবশ্য পারেনি। তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

একদিন একটা একা হরিণ পেয়ে নিঃশব্দে এগোচ্ছিল সে। বেশ কয়েক দিন না খেয়ে আছে। নানা রকম চেষ্টা করেও শিকার ধরতে পারেনি। খিদেয় চোঁ চোঁ করছে পেট। ইঁদুর–ব্যাঙ ধরে খাওয়ার চেষ্টা করেছে, পারেনি। ইঁদুরগুলো মহা ত্যাঁদড়। বাঘ যে থাবা দিয়ে তাদের ধরবে, সেই থাবা ওঠানোর আগেই সুড়ুৎ করে কোথায় যে উধাও হয়।

ব্যাঙগুলো অবশ্য অত চালাক না। তবে কেমন করে যেন টের পায়, বাঘ আসছে। তারপর এত লম্বা লম্বা লাফ দেয়। লাফ দিয়ে মুহূর্তে গিয়ে পড়ে বনের ধারের সরু খাদে। বুড়ো শরীরে ব্যাঙ ধরাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোয়ান বয়সে রয়েল বেঙ্গল সাধারণত ইঁদুর–ব্যাঙ এসব তুচ্ছ প্রাণীর দিকে ফিরেও তাকায় না। হাতের কাছে হরিণ থাকতে এসব জিনিস কে খায়!

অনাহারী বাঘটা তারপর খালপাড়েও গেছে। খালে বিস্তর মাছ। ব্যাঙের দলও নেমেছে খালে। যদি মাছ কিংবা ব্যাঙ কিছু ধরে উদর পূর্তি করা যায়!

না, কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। খিদের কষ্টে মরো মরো দশা। ওদিকে তাগড়া জোয়ান যুবক বাঘগুলো কী রকম রাজার হালে আছে। হরিণ শিকার করে বাঘিনীকে নিয়ে মজা করে খাচ্ছে আর ঘুমাচ্ছে। এই বুড়োর তো বাঘিনীও নেই। সে একা বাঘ। আর বাঘ সমাজের যা নিয়ম, বুড়ো হয়ে গেলে তাদের কোনো দাম থাকে না। অন্য বাঘেরা পাত্তাও দেয় না। সব মিলিয়ে এই একলা হওয়া বুড়ো বাঘটার সত্যি বড় দুর্দিন যাচ্ছে।

আজ একা হরিণটা পেয়ে সে খুবই উত্তেজিত। যেমন করে হোক ধরতে হবে হরিণ। এই সাইজের একটা হরিণ দু–তিন দিন ধরে খাওয়া যাবে। তারপর দিন দশেক না খেলেও চলবে।

সুন্দরীগাছের ফাঁকফোকর দিয়ে নিঃশব্দে এগোতে লাগল বুড়ো। এই লাফ দিয়ে পড়বে হরিণের ওপর।

লাফটা সে দিল ঠিকই, কিন্তু হরিণটার ওপর গিয়ে পড়ল না। পড়ল কেটে নেওয়া গাছের ধারালো একটা গুঁড়ির ওপর। মুখে–গলায় বড় রকমের আঘাত তো পেলই, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো সামনের একটা পায়ের। সেই পা এমন বেকায়দায় পড়েছিল, থাবার দিককার হাড় ভেতর থেকে দুই টুকরা হয়ে গেল। থাবাটা একেবারে ঝুলে পড়ল। একে খিদের কষ্ট, তার ওপর একটা থাবা গেল ভেঙে, বুড়োর খুবই কান্না পেল। কিন্তু বাঘ বলে কথা। তা–ও রয়েল বেঙ্গল। কান্না তাকে মানায় না। বাঘ কাঁদছে, এটা কি ভাবা যায়?

কিন্তু বাঁচতে হবে, যেমন করে হোক বাঁচতে হবে। এই বন থেকে বেরিয়ে অন্য কোনো বনে গিয়ে নিরিবিলিতে একা একা বাঁচতে হবে। ছোট ছোট আহার ধরে কোনোরকমে হলেও বাঁচতে হবে।

তত দিনে এলাকার লোকজন টের পেয়ে গেছে বনে বাঘ এসেছে। তারা সাবধান হয়ে গেছে। গরু–ছাগল এদিকটায় চরাতে আনে না। নিজেরাও আসে দল বেঁধে। বুড়ো পড়ে গেল ভীষণ বিপদে। কী খেয়ে বাঁচবে এখন? মানুষ খাবে?

তা হলে কী করা যায়?

নদীর ওপারে লোকালয় আছে। একটা গজারিবন আছে। বনের ধারে মাঠ। গেরস্তের গরু–ছাগল চরে। আর বনে আছে খরগোশ, গুই, শজারু। ব্যাঙ আছে, ইঁদুর আছে, বনমোরগ আছে; ওসব খেয়েই বাঁচা যাবে।

রাতের অন্ধকারে নদী পার হয়ে এ পারে চলে এল বুড়ো। গজারিবনে আশ্রয় নিল। ভাঙা একটা থাবা নিয়েই টুকটাক শিকার করে খিদে মেটাতে লাগল।

দিন মন্দ কাটছিল না।

তবে একটা সময়ে যা হয় আরকি। বনের বাসিন্দারা টের পেয়ে গেল, বিরাট বিপদ এসে উপস্থিত হয়েছে তাদের জায়গায়। তারা গেল অতিসাবধান হয়ে। বুড়ো কিছুতেই আর শিকার পায় না। পাঁচ দিন, দশ দিন না খেয়ে থাকতে হয়।

তখন সে বনের ধারের মাঠের কাছে এসে থান গাড়ল। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। একদিন মাঠে চরতে থাকা গেরস্তের একটা ছাগল ধরে খেল। ছাগলগুলো বোকা। ধরা বেশ সহজ। আর তারা তো বোঝেনি যে এই বনে বাঘ আছে! টপাটপ কয়েকটা ছাগল কয়েক দিন ধরে খেল বুড়ো। তারপর খেল দুটো বাছুর। একদিন একটা ষাঁড়ও ধরতে গিয়েছিল। পারেনি। সেটা বেদম শক্তিশালী আর সাহসী। ধারালো শিং বাগিয়ে বুনো মোষের মতো তেড়ে এসেছিল। বুড়ো ভয়ে ল্যাংড়া থাবা উঁচিয়ে কোনোরকমে দৌড়ে বেঁচেছে। নয়তো ষাঁড়টা হয়তো তার ভুঁড়িটাই শিংয়ের গুঁতোয় ফাঁসিয়ে দিত।

তত দিনে এলাকার লোকজন টের পেয়ে গেছে বনে বাঘ এসেছে। তারা সাবধান হয়ে গেছে। গরু–ছাগল এদিকটায় চরাতে আনে না। নিজেরাও আসে দল বেঁধে। বুড়ো পড়ে গেল ভীষণ বিপদে। কী খেয়ে বাঁচবে এখন? মানুষ খাবে?

কয়েক দিন ধরে মানুষ খাওয়ার কথাই ভাবছিল সে। তবে মানুষ ধরা কি এত সহজ? পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ। তারা টেরও পেয়ে গেছে বনে বাঘ এসেছে। বোধ হয় কেউ কেউ দেখেও ফেলেছে। এখন যেকোনো দিন অন্য বিপদও হতে পারে বুড়োর। দল বেঁধে এসে তাকে আক্রমণ করতে পারে। বন্দুক নিয়ে এসে গুলি করে মারতে পারে। বুড়োর তাহলে উপায় কী?

ঝোপের আড়ালে বসে, অনাহারী পেটে কয়েক দিন ধরে এসবই ভাবছিল সে। ভেবে কোনো পথ বের করতে পারছিল না। এ অবস্থায় এক জ্যোত্স্নারাতে বনের পথে একা একজন মানুষকে দেখতে পেল সে। মানুষটার হাতে একটা লাঠি। সে এত জোরে হাঁটছে, হাঁটছে না দৌড়াচ্ছে বোঝা যায় না। একটু চেষ্টা করলে এই মানুষটাকে ধরা যাবে। ল্যাংড়া পায়ের বাঘের সঙ্গেও দৌড়ে সে পারবে না।

এই মানুষটা রসিকলাল। বুড়ো রসিকলালের পিছু নিল। কিন্তু ভাঙা পায়ে মুশকিল যেটা হয়েছে, তা হলো হাঁটলে–দৌড়ালে বনতলে ছড়িয়ে থাকা শুকনা পাতায় ভারী একটা মচমচ শব্দ হয়। শব্দ বাঁচিয়েই এগোচ্ছিল বুড়ো। তারপরও শব্দ অল্পবিস্তর হলো। রসিক টের পেয়ে গেল। ভয়ে পেছন ফিরে তাকাল। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু চাঁদের আলো এসে পড়েছে, সেই আলোয় বুড়োকে সে একঝলক দেখে ফেলল।

তারপর আর কী, মনে মনে বাবা গো, মা গো বলে ডাক ছাড়তে ছাড়তে জীবনের শ্রেষ্ঠ দৌড়টা রসিক দিল। হাতের লাঠি কোথায় ছিটকে পড়ল কে জানে। সে ছুটছে আর তার পেছন পেছন ছুটছে বুড়ো ল্যাংড়া। এই ধরে, এই ধরে অবস্থা। শেষ পর্যন্ত ধরতে পারল না। রসিক দিকপাশ না দেখে তেঁতুলগাছটায় চড়ে বসল। বুড়ো ল্যাংড়াও ততক্ষণে গাছতলায় পৌঁছে গেছে। রসিককে ধরতে না পারার অপমান আর রাগে–ক্রোধে গোঁ গোঁ করছে। একদিকে রাগ অন্যদিকে পেটের খিদে। মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞাও করল সে। এই গাছতলা থেকে সে যাবে না। রসিককে তো কোনো না কোনো সময় গাছ থেকে নামতে হবে। নামলেই তার ঘেটিটা সে মটকাবে।

রসিক তখন গাছের মগডালে বসে হাঁপাচ্ছে আর মনে মনে বলছে, বেদম বাঁচা বেঁচেছি। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ বাঁচতে পারব। বুড়ো ল্যাংড়া তো তেঁতুলতলায় চক্কর কাটছে।

এ সময় রসিকের পাশ থেকে কে একজন গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুই কে রে?’

রসিক থতমত খেয়ে তাকাল। তাকিয়ে ডাল থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। কোনোরকমে সরু আরেকটা ডাল ধরে সেই পতন থেকে বাঁচল। ভূপাতিত হলেই যেতে হবে বাঘের পেটে। সে এখনো তেঁতুলতলায় চক্কর কাটছে।

কিন্তু ইনি কে? রসিকের একেবারে পাশেই পা ঝুলিয়ে বসে আছেন? দেখতে বড় অদ্ভুত। বেশ লম্বা, ঠ্যাঙা। শরীরে মাংস বলতে কিছু নেই। শুধু হাড়। হাড়ের ওপর ঝুলঝুল করছে কালো কুচকুচে চামড়া। হাত–পায়ের নখ বিরাট বিরাট। নাকটা গলা অব্দি লম্বা। একেকটা চোখ গরুর পাঁচখানা চোখের সমান। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। সেই মুখে কয়েকটা দাঁত। একেকটা দাঁত বিঘত পরিমাণ। শরীরের তুলনায় মাথাটা অতিকায়। শরীর এবং মাথায় খেজুরকাঁটার মতো লোম আর চুল। তবে একটা লোম থেকে আরেকটা লোমের দূরত্ব অনেক। চুলেরও একই দশা। যেন ফাঁক ফাঁক করে খেজুরকাঁটা পুঁতে রাখা হয়েছে।

রসিকলাল বুঝে গেল ইনিই তেঁতুলগাছের তিনি। সর্বনাশ। বাঘের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে এ কার খপ্পরে এসে পড়ল রসিক!

কী করা এখন?

রসিক ঘট করে একটা ঢোক গিলল। সে শুনেছে সম্মানিতদের ‘স্যার’ বলতে হয়। তেনাকে স্যার বলে যদি কিছুটা ভজানো যায়। যদি প্রাণটা বাঁচানো যায়।

রসিক অতি বিনীত গলায় বলল, ‘আমি স্যার অতি অধম স্যার, আমার নাম স্যার রসিকলাল। বাঘের ভয়ে স্যার, আপনার কাছে এসেছি স্যার। এখন কি স্যার, আপনি আমাকে খাবেন স্যার, না ওই হারামি বাঘটায় খাবে স্যার, সেই বিবেচনা স্যার আপনার স্যার।’

তেনায় রসিকের দিকে তাকালেন। বিশাল চোখে লাল টকটকে দৃষ্টি। বললেন, ‘কী নাম বললি?’

‘রসিকলাল স্যার, রসিকলাল।’

‘রকিসলাল! আচ্ছা ঠিক আছে।’

রসিক বুঝল তার নামটা বিকৃত করে ফেলেছেন তেনায়। রসিককে বলছেন ‘রকিস’। তাতে অসুবিধা নেই। অক্ষর আগে–পরে হলে কী যায়–আসে! জীবনটা বাঁচলেই হয়।

রসিক হে হে করে কেলানো একখানা হাসি হাসল। এই হাসি দিয়ে আর স্যার স্যার বলে যদি তেনাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়। যদি প্রাণটা বাঁচে।

‘তাহলে তুই ব্যাঘ্রর খপ্পরে পড়েছিস?’

রসিক বুঝল, ‘বাঘ’ শব্দটিকে কঠিন করে ফেলেছে তেনায়। তা করুন। অসুবিধা কী, জিনিস তো একই। বলল, ‘আজ্ঞে স্যার। এ জন্যই স্যার আপনার শরণাপন্ন হয়েছি স্যার।’

‘শরণাপন্ন’ শব্দটি বলেই ভেতরে ভেতরে চমকাল রসিক। এই রকম শব্দ কোত্থেকে এল এ মুহূর্তে? তেনার ‘ব্যাঘ্র’ শব্দ থেকে গোপনে অনুপ্রাণিত হয়েছে রসিক!

‘ব্যাঘ্রটি কোথায়?’

‘ওই তো স্যার আপনার এই তেঁতুলগাছের তলায় স্যার চক্কর কাটছে স্যার।’

একবার নিচের দিকে তাকিয়ে তেনায় তাকালেন রসিকের দিকে। বাঘটাকে পাত্তাই দিলেন না। ওই নিয়ে কথাও বললেন না। বললেন অন্য কথা, ‘তোর স্যার ডাকটা আমার ভারি পছন্দ হয়েছে রে, রকিস। স্যারই তো ছিলাম রে। স্কুলমাস্টারি করতাম। ছাত্ররা স্যার স্যার করত। প্রতাপ মণ্ডল ছিল নাম। নামের মতো প্রতাপও ছিল। ছাত্ররা যমের মতো ভয় পেত। চিরকুমার ছিলাম, বুঝলি রকিস! সংসারধর্ম করিনি। শেষ দিকে মাথাটা গিয়েছিল খারাপ হয়ে। এক রাতে বাড়ির তেঁতুলগাছটার ডালে লটকে পড়লাম। ওসব শ দেড়েক বছর আগের কথা। তারপর থেকে তেঁতুলগাছে তেঁতুলগাছেই জীবনটা কাটছে। এই গাছটায় আছি আজ সত্তর বছর হলো। তোর স্যার ডাকে সব মনে পড়ল। ভালো লাগল রে রকিস, খুব ভালো লাগল। বল তোর জন্য কী করতে পারি?’

রসিক বুঝল কাজ হয়ে গেছে। তেনার হাত থেকে সে বেঁচে গেছে। এখন বাঘের হাত থেকে বাঁচতে হবে। তবে এত ভয়ভীতি আর উত্তেজনার মধ্যেও তেনার গায়ের গন্ধে টিকতে পারছিল না রসিক। বমি ঠেলে উঠছিল গলায়। জোর করে আটকে রাখছিল। সেই অবস্থায় বলল, ‘স্যার, বাঘের হাত থেকে স্যার আমাকে বাঁচান স্যার।’

‘এ আর এমন কী কাজ রে। এক্ষুনি বাঁচাচ্ছি তোকে।’

‘ভরসা দিলে স্যার আরেকখান কথা স্যার জিজ্ঞেস করতে চাই স্যার।’

‘ভরসা দিলাম। বল।’

‘শুনেছি স্যার আপনারা স্যার প্রতিটি শব্দের ওপর স্যার চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে স্যার কথা বলেন স্যার। কিন্তু আপনাকে স্যার সে রকম দেখছি না স্যার।’

‘আমি তো ও রকম তুচ্ছ ভূত না রে রকিস! লেখাপড়া জানা ভূত। মাস্টারি করেছি বহু বছর। সর্বত্র চন্দ্রবিন্দু আমি লাগাই না। আমার ভাষাজ্ঞান প্রখর।’

‘হে হে হে। এবার স্যার বুঝলাম স্যার। এখন স্যার বাঘটাকে স্যার, হে হে।’

‘তুই এখানেই বসে থাক। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। দেখি কথা বলে ওর বৃত্তান্তটা কী?’

রসিকের ভারি লোভ হলো ভূত আর বাঘ কী ভাষায় কথা বলে সেটা শোনা ও বোঝার। তেনায় তো বাঘের সঙ্গে আর মানুষের ভাষায় কথা বলবেন না। বাঘও তার সঙ্গে ভূতভাষায় কথা বলবে না। সে বলবে তার হালুম–হুলুম ভাষায়।

এই আরজিটাও তেনার কাছে পেশ করল রসিক, ‘আরেকখান কথা স্যার।’

‘বল রে, বল।’

‘আপনি কি স্যার বাঘটার সঙ্গে স্যার এই ভাষায় কথা বলবেন স্যার?’

‘আরে না রে মূর্খ। আমি সব জীবেরই ভাষা জানি। ওটির সঙ্গে ওটির ভাষা ব্যবহার করব।’

‘কিন্তু আমি তো স্যার সেই ভাষা স্যার বুঝব না স্যার।’

‘তুই বুঝতে চাস?’

‘আজ্ঞে স্যার।’

‘বুঝতে পারবি। বসে থাক। বসে থাক।’

তেনায় আস্তে করে পা দুখানা নিচের দিকে নামালেন। রসিক দেখতে পেল, সেই পা ধীরে ধীরে লম্বা হয়ে বাঘটার সামনে গিয়ে থামল। তেনায় মস্ত একখানা হাই তুলে বাঘের সামনে দাঁড়ালেন।

এ রকম দৃশ্য বাঘজীবনে দেখেনি বুড়ো ল্যাংড়া। সে একেবারে হকচকিয়ে গেল। রাগ–ক্রোধ বন্ধ হলো তার। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তেনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ভাবল তুচ্ছ কোনো জিনিস হবে। এই মনে করে সামনের ভালো থাবাটি দিয়ে ছোট সাইজের একটা ধাক্কা দিল তেনার পায়ের দিকটায়। গলায় ঘ্যারঘ্যারে মৃদু একটা শব্দ।

কিন্তু সেই ধাক্কা তেনার গায়ে লাগল না। লাগল হাওয়ায়। বুড়ো ল্যাংড়া তাজ্জব। এ কী কাণ্ড! সে তো জিনিসটির পায়েই ধাক্কা দিল। লাগল না কেন?

এবার ধাক্কার সাইজ বড় করল সে। ধাক্কাটা দিল মাঝারি সাইজের। এবারও একই কাণ্ড। বুড়ো ল্যাংড়া মহাবিরক্ত। না, এভাবে তো কাজ হবে না। জিনিসটাকে তো সরাতে হবে। লাফ দিয়ে ধরতে হবে ওটিকে। যদি খাওয়ার উপযুক্ত হয় তাহলে এই জিনিসই চিবিয়ে খাবে। স্বাদ–গন্ধ যা-ই হোক। তবে জিনিসটার গা থেকে এত বদগন্ধ আসছে, এ রকম গন্ধ বাঘজীবনে পায়নি সে।

তেনায় আগের মতোই নির্বিকার। আবার মস্ত একখানা হাই তুললেন। রসিক তেঁতুলডালে বসে কাণ্ডটা দেখছে। চাঁদের আলো আরও প্রখর হয়েছে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব। কোথাও কোনো শব্দ নেই। মাঠের ঝিঁঝিপোকাগুলোও ডাকছে না। বনের দিকেও কোনো শব্দ নেই।

কিন্তু সেই ধাক্কা তেনার গায়ে লাগল না। লাগল হাওয়ায়। বুড়ো ল্যাংড়া তাজ্জব। এ কী কাণ্ড! সে তো জিনিসটির পায়েই ধাক্কা দিল। লাগল না কেন?

বুড়ো ল্যাংড়া ভাঙা থাবা নিয়ে বিশাল একখানা লাফ দিল। তেনাকে ধরতে চাইল। অবাক কাণ্ড। তেনায় জায়গামতোই দাঁড়িয়ে রইলেন। তার দেহের ভেতর দিয়েই লাফ দিয়ে পার হয়ে গেল বুড়ো ল্যাংড়া। ভাঙা থাবায় ভালো রকম ব্যথাও পেল। সেই ব্যথা ভুলে বেকুবের ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল সে। হচ্ছে কী এসব? এ কার পাল্লায় পড়ল সে? খিদের কষ্টে একটা মানুষের পিছু নিয়েছিল। ধরতে পারলে কচকচিয়ে খাবে। সেই ধড়িবাজটা এমন দৌড় দিল, কিছুতেই ধরা গেল না। তারপর এই গাছে এসে উঠল। আর নামল না। গাছ থেকে নামল এই জিনিস! জিনিসটা কী? এত বয়স হলো, জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটল সুন্দরবনে। সেই বনেও তো এই পদের জিনিস সে দেখেনি!

এবার তেনায় মুখ ফেরালেন বুড়ো ল্যাংড়ার দিকে। বিরক্তির গলায় বললেন, ‘আমার ধারণা ছিল ব্যাঘ্র জীবটার বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু আছে। তোকে দেখে সেই ধারণা ভেঙে গেল রে মূর্খ। তুই আমাকে চিনতেই পারছিস না।’

বুড়ো ল্যাংড়া বলল, ‘তুই কে?’

‘চোউপপপপপ। কাকে তুই–তোকারি করছিস, ফাজিল কোথাকার? এই দ্যাখ আমি কে?’

তেঁতুলডালে বসে তাদের কথা শুনতে পাচ্ছে রসিক। আজব ঘটনা। তারা কথা বলছে পরিষ্কার বাংলায়। বাঘ ও ভূত বাংলায় কথা বলে, এ জিনিস শোনা তো দূরের কথা, রসিক কোনো দিন কল্পনাও করেনি। এমন তো হওয়ার কথা নয়! ভূত কথা বলবে ভূতভাষায়, বাঘ বলবে বাঘভাষায়। তা না, তারা কথা বলছে বাংলা ভাষায়।

তারপরই রহস্যটা বুঝল রসিক। এটা স্যারের কাণ্ড। তেনায় এমনটা ঘটিয়েছেন।

ওদিকে স্যার তখন প্রথম ভূতকাণ্ডটা ঘটালেন। বুড়ো ল্যাংড়ার লেজটা ধরে এমন ভঙ্গিতে ওপরে তুললেন যেন একটা নেংটি ইঁদুর দুই আঙুলে ধরে অতি অবহেলায় ওভাবে তুলেছেন। বুড়ো ল্যাংড়া আঁকুপাঁকু করছে। শরীর বাঁকিয়ে, থাবা, ঠ্যাং এদিক–ওদিক করছে হাওয়ায়, তাতে কোনো কাজই হচ্ছে না। এই ফাঁকে সে বুঝে গেছে কার পাল্লায় পড়েছে।

তেনায় নির্বিকার গলায় বললেন, ‘এবার চিনেছিস, আমি কে?’

বুড়ো ল্যাংড়া হাওয়ায় আঁকুপাঁকু করতে করতে বলল, ‘চিনেছি ওস্তাদ, চিনেছি।’

‘“ওস্তাদ” শব্দটা মন্দ না। গুরু বা স্যারের কাছাকাছি। বলতে পারিস। তুই আমাকে ওস্তাদও বলতে পারিস। এখন কী করব বল? এভাবে ঝুলে থাকবি, নাকি তোকে ছুড়ে ফেলব। ছুড়ে ফেললে তুই যে কোথায় গিয়ে পড়বি, তা আমি জানি না। হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘায় গিয়েও পড়তে পারিস। দেব ছুড়ে।’

‘না ওস্তাদ, না। আমাকে ক্ষমা করুন। ইহজনমে আর আপনাকে চিনতে ভুল করব না।’

‘যা। ক্ষমাঘেন্না করে দিলাম।’

বুড়ো ল্যাংড়ার লেজটা অতি তুচ্ছ ভঙ্গিতে ছেড়ে দিলেন তেনায়। ধপ করে মাঠের ঘাসে পড়ল সে। এবারও ভাঙা থাবায় ব্যথা পেল। একটু উঁ–আ করল। ব্যাপারটা খেয়াল করলেন তেনায়।

‘তোর এই দশা কেন রে?’

বৃত্তান্তটা বলল বুড়ো ল্যাংড়া। সুন্দরবন থেকে রাতের অন্ধকারে নদী সাঁতরে এ পারে আসা থেকে শুরু করে রসিকের ঘটনা পর্যন্ত বলল। শুনে তেনার ভারি মায়া হলো।

‘দে দেখি, ভাঙা থাবাটা এদিক পানে দে।’

বুড়ো ল্যাংড়া থাবাটা বাড়িয়ে দিল। তেনায় এক হাতে থাবাটা ধরে অন্য হাতে তিনবার বুলিয়ে দিলেন।

‘দেখ তো, এখন ঠিক আছে কি না!’

বুড়ো ল্যাংড়া থাবা নাড়াতে গিয়ে দেখে, থাবা একদম জোয়ান বয়সের মতো হয়ে গেছে। ভেতরের হাড় জোড়া লেগে সেই আগের জিনিস। ব্যথা–বেদনা বলতে কিচ্ছু নেই।

সে দু–তিনবার থাবা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। মাঠে ভর দিয়ে দাঁড়াল। একদম ঠিক। একদম আগের মতো। ওস্তাদের প্রতি আনন্দে–কৃতজ্ঞতায় তার কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। এ রকম আবেগের মুহূর্তে কথা বলা যায় না। বুড়ো ল্যাংড়া বাক্‌রুদ্ধ হয়ে থাকল।

‘তোর বৃত্তান্ত শুনে আমার ভারি মায়া হয়েছে রে। এ জন্য থাবাটা ঠিক করে দিলাম। হাজার হোক তুই একটা বাঘ। তা–ও যে–সে বাঘ না। কেঁদো বা মেছোবাঘ না। তুই হচ্ছিস রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তোর একটা সম্মান আছে না! তোর কেন ওই হাল হবে! তোকে কেন পেটের দায়ে ইঁদুর–ব্যাঙ ধরে খেতে হবে! আমি নরম মনের জিনিস। তোর দুঃখটা আমার মরমে গিয়া পশিয়াছে। যা, এবার বিদায় হ। এদিক পানে থাকিস না।’

‘তাহলে কোথায় যাব ওস্তাদ?’

‘সুন্দরবনে ফিরে যা।’

‘হেথায় ফিরে কী করব? বুড়ো শরীরে শিকার ধরতে পারব না। না খেয়ে বেঘোরে প্রাণটা যাবে।’

‘সেই সমস্যাও মিটিয়ে দিচ্ছি। আয়, কাছে আয়।’

বুড়ো ল্যাংড়া আদুরে বিড়ালের ভঙ্গিতে তেনার পায়ের সামনে এসে দাঁড়াল। তেনায় তার ডান হাতটা বুড়োর (এখন আর ল্যাংড়া বলা যাবে না) মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত তিনবার বুলিয়ে দিলেন।

‘যা, সব ঠিক করে দিয়েছি।’

বুড়ো অবাক বিস্ময়ে দেখে, আরে, সে তো আর বুড়ো নেই, সে তো ফিরে গেছে তার আগের জীবনে। জোয়ান বয়সে। সে এখন তরুণ যুবক, স্বাস্থ্যবান রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তার ডোরাকাটা শরীর, হাত–পা, চোখ, দাঁত, নখ—সব সেই তরুণ বয়সের। তেল–চকচকে শরীর থেকে চাঁদের আলো যেন পিছলে পড়ছে।

গভীর কৃতজ্ঞতায় এবার সত্যি সত্যি চোখে পানি এল বাঘের।

তেনায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললেন, ‘কাঁদিস না, কাঁদিস না। আমি নরম মনের জিনিস। তোকে কাঁদতে দেখলে আমিও কেঁদে ফেলব।’

শেষ দিকে তেনার গলা ধরে এল।

তেঁতুলডালে বসে রসিক সব দেখছে, সব শুনছে। কাণ্ড দেখে সে এতটাই অবাক, যখন–তখন টুপ করে পড়ে যেতে পারে তেঁতুলতলায়। এ জন্য শক্ত করে ডাল ধরে রেখেছে।

বাঘ (এখন বুড়োও বলা যাবে না) বলল, ‘আপনি আমার এত বড় উপকার করলেন ওস্তাদ, আমাকে আমার বাঘজীবন ফিরিয়ে দিলেন, এই ঋণ আমি কিছুটা শোধ করতে চাই।’

‘কীভাবে?’

‘আপনি যত দূর যেতে চান তত দূর পিঠে করে আপনাকে নিয়ে যেতে চাই। আপনি না করবেন না, ওস্তাদ। ঋণটা আমাকে কিছুটা শোধ করতে দিন। চড়ুন আমার পিঠে। যে নদী পার হয়ে আমি এদিকটায় এসেছিলাম, সেই নদীতীর পর্যন্ত আপনাকে নিয়ে যাই। এ রকম চাঁদনি রাতে একটু হাওয়া খেয়ে এলেন। যদি নদীর ওপারে আমাদের সুন্দরবনটায়ও যেতে চান, সেথায়ও নিয়ে যাব। আপনি শুধু আমার পিঠে বসে থাকবেন। আপনাকে পিঠে নিয়েই নদী সাঁতরে পার হব। আপনার কিছুই করতে হবে না। উঠুন ওস্তাদ, আমার পিঠে উঠুন। না করবেন না।’

‘কী আর করা! তুই যখন এত করে বলছিস! আমি নরম মনের জিনিস। তোর কথা ফেলি কী করে!’

‘আর একটা কাজও ওস্তাদ আপনি করতে পারেন। আমাদের সুন্দরবনটা ভারি সুন্দর জায়গা। হেথায় আমাদের অতিথি হয়ে কিছুকাল থেকে গেলেন। জায়গা খাসা। আপনার পছন্দ হবে।’

‘ওখানে কি তেঁতুলগাছ আছে? আমি তো আবার তেঁতুলগাছ ছাড়া থাকতে পারি না। তেঁতুলগাছে লটকে ছিলাম বলে তেঁতুলগাছেই থাকতে হয় রে!’

‘তেঁতুলগাছ খুঁজে দেব ওস্তাদ। ওই নিয়ে ভাববেন না। উঠুন আমার পিঠে।’

‘কথা মন্দ বলিসনি। এখানে সত্তর বছর ধরে আছি। বড় একঘেয়ে লাগছে। চল তোর সঙ্গেই যাই। তবে আমাকে পিঠে নিতে তোর কোনো ক্লেশ হবে না। আমার ওজন নেই।’

বাঘের পিঠে চড়ার আগে তেনায় তেঁতুলডালে বসা রসিকের দিকে তাকালেন, ‘যাই রে রকিস। তুইও বাড়ি যা। ডর–ভয়ের আর কিছু নেই। যা যা, বাড়ি যা।’

তেনাকে পিঠে নিয়ে বাঘ তখন মাঠে পাথালে ঘোড়ার মতো ছুটছে।

তারপর থেকে এই গল্প সব জায়গায় বলে রসিকলাল। ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে এমন মজাদার ভঙ্গিতে বলে, লোকে যতবার শোনে, ততবারই মুগ্ধ হয়। গল্প জমানোর জন্য একটা ছড়াও বানিয়ে নিয়েছে সে। ছড়াটা বলে গল্পের একেবারে শেষে।

বাঘের ভয়ে উঠলাম গাছে
ভূত বলে পেলাম কাছে।