বাবুর সাইকেল

অলংকরণ: শিখা

বাবু ক্লাস সিক্সে পড়া এক দুরন্ত কিশোর। তার অনেক বন্ধুই সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে। অনেক দিন থেকেই বাবু ভাবছে, নিজের একটা নতুন সাইকেল হলে বেশ হতো। যদিও তাদের সংসারে সব সময়ই টানাটানি। তবু একদিন সাহস করে বলেই ফেলল বাবাকে—

বাবা, আমার একটা সাইকেল চাই।

সাইকেল, কেন?

আমার সব বন্ধু সাইকেলে স্কুলে যায়। খেলার মাঠে যায়। আমিও যাব।

না-না ওসব ফুটানি হবে না। মন দিয়ে লেখাপড়া করো।

প্লিজ বাবা, আমি দোকানে দেখে এসেছি। বেশি দাম না। চাইলে কিস্তিতেও দেবে।

বাবা চোখ বড় করে বলল, বাবু একদম আজেবাজে চিন্তা করবে না। হাত-মুখ ধুয়ে স্কুলে যাও।

বাবুর মন খারাপ হয়ে গেল। ছুটির পর স্কুল থেকে বাসায় না গিয়ে লাল দিঘির পাড়ের পুরোনো বটগাছতলায় বসে রইল সে। দুপুর বেলা। চারদিক সুনসান। দিঘির জলে একটার পর একটা ঢিল মেরে চলেছে বাবু। হঠাৎ দেখল তার পাশে লম্বা সাদা চুল আর দাড়িওয়ালা এক বুড়ো এসে বসেছে। তার জামায় রংবেরঙের তালি মারা। বাবু বুড়োর দিকে তাকাতেই সে মিষ্টি করে হেসে বলল, খোকা তোমার নাম কী?

বাবু।

এই দুপুর বেলা মন খারাপ করে বসে আছ কেন?

বাবা আমাকে সাইকেল কিনে দেবে না।

হি-হি-হি। তোমার সাইকেল চাই।

হ্যাঁ, চাই তো। আমার সব বন্ধুর সাইকেল আছে।

আমার একটা সাইকেল আছে। আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি। তাই চালাতে পারি না। ওটা বাড়িতে পড়ে আছে। তুমি যদি চাও তো...।

আমায় দেবে?

হা হা হা। দেব, তবে যে আমার বাড়ি যেতে হবে।

আমি যাব।

বাবু আর বুড়ো হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকল। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখল এক পাহাড়। তারা পাহাড়ে উঠতে লাগল। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কোনো বাড়ি দেখতে পেল না বাবু। খুব ভয় করতে লাগল ওর। ভয়ে ভয়ে ও বলল, কোথায় তোমার সাইকেল? বুড়ো দুদিকে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, সাইকেল চাই তো তোমার? দাঁড়াও। এই বলে জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধুলোর মতো কী যেন বের করে বাবুর গায়ে ছিটিয়ে দিল। আর অমনি বাবু একটা সাইকেল হয়ে গেল। বুড়ো লোকটিও হাওয়া!

নিজের ভুল বুঝতে পারল বাবু। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। এখন বাবু নিজেই একটি সাইকেল। যে সাইকেল একা একা চলতে পারে আস্তে-জোরে, ডানে-বাঁয়ে।

সাইকেল বাবু সারা বিকেল-সন্ধ্যা পাহাড় আর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াল। রাত হয়ে এলে চিন্তা করতে লাগল বাবু। তাকে তো বাবা-মা-বন্ধুরা কেউ চিনতে পারবে না। এখন কী হবে? সে পাহাড়ে ফিরে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল! একসময় ঘুমিয়েও পড়ল কাঁদতে কাঁদতে।

সকালে পাখির ডাকে ঘুম থেকে উঠে দেখে সামনে বসে আছে সেই বুড়ো। দেখতে দেখতে বুড়ো পরিণত হলো একটা সবুজ ভূতে। খিকখিক গলায় সে বলল, আমি হলাম ভূতের রাজা জিংগালা! দুষ্টু ছেলেদের এভাবেই মজা দেখাই। খুবই রাগ হলো বাবুর। সে তার চাকা দিয়ে মাড়িয়ে দিল বুড়োর দুই পা। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল বুড়ো।

ওরে বাবা। থাম...থাম। সরি...সরি।

তবে আমাকে মানুষ করে দাও।

আগে বলো, আর কখনো অযথা জেদ করবে না?

না-না। করব না।

মা-বাবার ওপর রাগ করে পালিয়ে বেড়াবে না।

কখ্খনো না।

জিংগালা ভূত এবারও পকেট থেকে ধুলো নিয়ে ছিটিয়ে দিল সাইকেলের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে আবার মানুষে পরিণত হলো বাবু।

ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি কে?

আমি জিংগালা। ভূত। অবাধ্য ছেলেদের শিক্ষা দিই।

বাই...বাই, জিংগালা।

আবার দেখা হবে খোকা।

এদিকে বাবুর বাবা অফিস থেকে দোকানে গিয়ে বাবুর জন্য একটা টুকটুকে লাল সাইকেল নিয়ে এসেছে। বাড়িতে ঢুকতেই মা এসে বলল, বাবু এখনো স্কুল থেকে ফেরেনি। বাবা বলল, চলে আসবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। তবু বাবু এল না। বাবা এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। খেলার মাঠ, বন্ধুদের বাড়ি গেল। কোথাও বাবু নেই। রাতে বাবা থানায় গিয়ে পুলিশকে জানাল। মা কাঁদল সারা রাত। বাবা বসে রইল নতুন সাইকেলটা ধরে।

ভোরে চুপি চুপি বাড়ি ফিরল বাবু। সারা রাস্তা ভেবেছে বাড়ি ফিরে কী বলবে। তার কথা তো কেউ বিশ্বাস করবে না। ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকল বাবু। ওকে দেখামাত্র ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল মা। বাবু বহু কষ্টে মাকে ছাড়িয়ে লাজুক চোখে তাকিয়ে দেখল, বাবা একটা লাল সাইকেল ধরে বসে আছে। বাবু ধীরে ধীরে গেল বাবার কাছে।

কোনোমতে বলল, সরি বাবা। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর কখনো এমন করব না।

ভুলটা আমারই। একটা সাইকেলই তো চেয়েছ। এই নাও তোমার নতুন সাইকেল।

বাবা, আমার সাইকেল চাই না। কিছুই চাই না।

এটা তোমার জন্মদিনের উপহার। পছন্দ হয়েছে?

ধন্যবাদ বাবা।

বাবাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল বাবু। বাবার চোখ গড়িয়েও পানি পড়তে লাগল।