লেখা: রোয়াল্ড ডাল | অনুবাদ: আবুল বাসার
আফ্রিকার ধূসর কাদাময় এক নদীতে দুটি কুমির পাশাপাশি শুয়ে ছিল। পানির ওপরে তাদের মাথা ভাসছিল। এর মধ্যে একটা কুমির ছিল অনেক বড়। আরেকটা বেশ ছোট।
‘জানিস, আজ দুপুরে আমি কী খাব?’ ছোট কুমিরকে জিজ্ঞেস করল বিশালদেহী।
‘না তো।’ ছোট কুমির বলল। ‘কী খাবে?’
বিশালদেহী কুমির ধারালো সাদা দাঁত বের করে হেসে উঠল। ‘দুপুরে মানুষের ছোট্ট সুস্বাদু আর রসাল একটা বাচ্চা খাব।’ সে বলল।
‘আমি কখনো মানুষের বাচ্চা খাইনি,’ পুঁচকে কুমির বলল। ‘শুধু মাছ খাই।’
নদী কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠল বিশালদেহী কুমিরটা। ‘বাজি ধরে বলতে পারি, এখনই যদি তুই কোনো মানুষের নাদুসনুদুস বাচ্চা নদীতে নৌকা চালাতে দেখিস, তাহলে এক কামড়েই তাকে সাবাড় করে ফেলতে পারবি!’
‘না, তা পারব না।’ পুঁচকে কুমির বলল। ‘মানুষের বাচ্চার মাংস খুবই শক্ত। চিবোনো যায় না। স্বাদও জঘন্য, তিতা।’
‘কী বললে! শক্ত! চিবোনো যায় না!’ বিশালদেহী কুমির ভুরু কুঁচকে বলল। ‘জঘন্য তিতা স্বাদ! কী সব আজগুবি কথা বলছিস! মানুষের ছানা খেতে খুবই রসাল আর সুস্বাদু!’
‘ওদের মাংসের স্বাদ তো তিতা।’ পুঁচকে কুমির বলল, ‘খাওয়ার আগে ছানার গায়ে ভালোমতো চিনি মাখিয়ে না নিলে খাওয়াই যায় না।’
‘মানুষের ছানা মাছের চেয়েও বড়।’ বিশালদেহী বলল। ‘এতে অনেক দিকে লাভ হয়।’
‘তুমি খুব লোভী।’ পুঁচকে কুমির বলল ‘আমাদের এই পুরো নদীতে তুমিই সবচেয়ে লোভী কুমির।’
‘যাহ্! এই পুরো নদীতে আমিই সবচেয়ে সাহসী।’ বিশালদেহী বলল। ‘একমাত্র আমিই পানি ছেড়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে শহরে গিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের খাওয়ার সাহস রাখি। বুঝলি!’
‘সেই কাণ্ড তো তুমি মাত্র একবারই করেছিলে।’, ফোঁস করে বলল পুঁচকে কুমির। ‘তারপর কী হয়েছিল তোমার মনে নেই? মানুষেরা তোমাকে দেখে ফেলেছিল। দৌড়ে না পালালে তোমার খবর ছিল সেবার।’
‘ওহ্! কিন্তু আজ আমাকে কেউই দেখতে পাবে না।’
‘অবশ্যই তোমাকে দেখতে পাবে।’, পুঁচকে কুমির বলল। ‘তোমার শরীরটা বিশাল আর কুৎসিত এ কারণেই ওরা তোমাকে কয়েক মাইল দূর থেকেই দেখে ফেলবে।’
বিশালদেহী কুমির আবারও দেঁতো হাসি দিল। তার ভয়ংকর দাঁতে সূর্যের আলো পড়ে ধারাল চাকুর মতো ঝিকমিকিয়ে উঠল। ‘আমাকে কেউই দেখতে পাবে না। কারণ এবার কিছু গোপন পরিকল্পনা করেছি। কিছু চতুর কৌশল খাটাব এবার।’
‘চতুর কৌশল?’, আর্তনাদ করে উঠল পুঁচকে। ‘তুমি জীবনেও কোনো চালাকির কাজ করোনি! এই নদীতে তুমিই সবচেয়ে নির্বোধ!’
‘এই নদীতে আমিই সবচেয়ে চালাক।’ বিশালদেহী কুমির জবাব দিল। ‘আজ দুপুরে নাদুসনুদুস রসাল মানুষের বাচ্চা দিয়ে ভোজ করব। তুই তখন এই নদীতে ক্ষুধার জ্বালায় নখ কামড়াবি। থাক, যাই। বিদায়।’
বিশালদেহী কুমির সাঁতরে নদীর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে পানি থেকে ওপরে উঠল।
নদীর পাড়ে পিচ্ছিল কাদা। সেখানে দৈত্যাকার দেহ নিয়ে এক জন্তু দাঁড়িয়ে ছিল। তার নাম হাম্পি-রাম্পি। একটা জলহস্তী।
‘কী খবর!’ হাম্পি-রাম্পি বলল। ‘কোথায় চললে এ সময়?’
‘একটা গোপন পরিকল্পনা আর কিছু চতুর বুদ্ধি এঁটেছি।’ কুমির বলল।
‘তাই নাকি!’, হাম্পি-রাম্পি বলল। ‘বাজি ধরে বলতে পারি তুমি ভয়ংকর কিছু করতে যাচ্ছ।’
বিশালদেহী কুমিরটা হাম্পি-রাম্পির দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
‘পেটটা খালি, খাব মজার খাবার সব
গপ গপ গপাগপ!’
‘সুস্বাদু, কী সেটা?’, জিজ্ঞেস করল হাম্পি-রাম্পি।
‘আন্দাজ করো দেখি।’, কুমির বলল। ‘এটা এমন জিনিস যেটা দুই পায়ে হাঁটতে পারে।’
‘তুমি বলতে চাইছ...’ হাম্পি-রাম্পি বলল। ‘নিশ্চয়ই বলতে চাইছ না যে তুমি মানুষের বাচ্চা খেতে যাচ্ছ?’
‘অবশ্যই! সেটাই করতে যাচ্ছি।’ কুমির বলল।
‘ওহ্! তুমি একটা লোভী নিষ্ঠুর জানোয়ার!’ আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠল হাম্পি-রাম্পি। ‘দোয়া করি, তুমি মানুষের হাতে ধরা পড়ো। তোমাকে রান্না করে কুমিরের স্যুপ বানিয়ে খাক ওরা!’
বিশালদেহী কুমির হো হো করে হাসতে লাগল হাম্পি-রাম্পির সামনে। তারপর হেলেদুলে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলতে শুরু করল।
জঙ্গলে তার সঙ্গে টাঙ্কির দেখা হলো। টাঙ্কি এই বনের এক হাতির নাম। টাঙ্কি লম্বা গাছের উঁচু ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছিল। সে কুমিরকে খেয়ালই করল না। এই সুযোগ হাতছাড়া করল না বিশালদেহী। সে টাঙ্কির পায়ে কামড় বসিয়ে দিল।
‘ওহু!’ টাঙ্কি গম্ভীর গলায় চিৎকার করে উঠল। ‘এই কাজ কে করল? ওহ্! তুমি করেছ, পাজি হতচ্ছাড়া জানোয়ার! এখানে কী করছ? তোমার কাদাভরা নদীতে ফিরে যাও?’
‘একটা গোপন পরিকল্পনা আর কিছু চতুর বুদ্ধি এঁটেছি।’ কুমির বলল।
‘বলতে চাইছ, একটা জঘন্য পরিকল্পনা আর নোংরা বুদ্ধি এঁটেছ।’ টাঙ্কি বলল। ‘তুমি জীবনেও কোনো ভালো কাজ করনি।’
‘বিশালদেহী কুমির টাঙ্কির দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
‘একটা যদি নাদুসনুদুস বাচ্চা ধরা যেত
খেতাম আমি, তুই চাবাতি হাড্ডিগুলো যত!’
‘পাজি, নিষ্ঠুর জানোয়ার কোথাকার!’ আর্তনাদ করে উঠল টাঙ্কি। ‘তুমি একটা শয়তান! দোয়া করি, তোমাকে পিষে শরীর থেকে সব রস বের করে সেদ্ধ করে কুমিরের স্টু বানাক!’
বিশালদেহী কুমির জঙ্গলের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠল। তারপর ঘন জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আরও কিছুদূর এগোতেই তার মাগল-ওয়াম্প নামের এক বানরের সঙ্গে দেখা হলো। গাছের ওপর বসে বাদাম খাচ্ছিল মাগল-ওয়াম্প।
‘কী খবর, ক্রোকি।’ মাগল-ওয়াম্প বলল। ‘কোথায় যাচ্ছ এ সময়?’
‘একটা গোপন পরিকল্পনা আর কিছু চতুর বুদ্ধি এঁটেছি।’ কুমির বলল।
‘বাদাম খাবে?’ মাগল-ওয়াম্প জিজ্ঞেস করল।
‘বাদামের চেয়ে ঢের ভালো খাবার আছে আমার।’ নাক সিঁটকে বলল কুমির।
‘আমার ধারণা, বাদামের চেয়ে ভালো কোনো খাবার নেই।’ মাগল-ওয়াম্প বলল।
‘ওহ! তাই নাকি!’ বিশালদেহী কুমির তারপর বলল, ‘যে জিনিসটা এখন যাচ্ছি আমি খেতে
পায়ে তার আছে গোড়ালি, আঙুল আছে হাতে!’
মাগল-ওয়াম্পের মুখ মলিন দেখা গেল। সে আতঙ্কে কাঁপতে লাগল। ‘তুমি নিশ্চয়ই সত্যি সত্যি একটা মানুষের বাচ্চা খেতে যাচ্ছ, না?’ সে বলল।
‘অবশ্যই ওটাই করতে যাচ্ছি।’ কুমির জবাব দিল। ‘এবার একেবারে কাপড়চোপড়সহ খাব। বাচ্চাদের কাপড়সহ খেতেই বেশি স্বাদ।’
‘ওহ্! তুমি একটা স্বার্থপর লোভী কুমির!’ আর্তনাদের সুরে বলল মাগল-ওয়াম্প। ‘নোংরা জানোয়ার! দোয়া করি, গলায় বোতাম আর বেল্ট আটকে মারা যাও তুমি।’
জঙ্গলে তার সঙ্গে টাঙ্কির দেখা হলো। টাঙ্কি এই বনের এক হাতির নাম। টাঙ্কি লম্বা গাছের উঁচু ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছিল। সে কুমিরকে খেয়ালই করল না। এই সুযোগ হাতছাড়া করল না বিশালদেহী। সে টাঙ্কির পায়ে কামড় বসিয়ে দিল।
‘ওহু!’ টাঙ্কি গম্ভীর গলায় চিৎকার করে উঠল। ‘এই কাজ কে করল? ওহ্! তুমি করেছ, পাজি হতচ্ছাড়া জানোয়ার! এখানে কী করছ? তোমার কাদাভরা নদীতে ফিরে যাও?’
‘একটা গোপন পরিকল্পনা আর কিছু চতুর বুদ্ধি এঁটেছি।’ কুমির বলল।
‘বলতে চাইছ, একটা জঘন্য পরিকল্পনা আর নোংরা বুদ্ধি এঁটেছ।’ টাঙ্কি বলল। ‘তুমি জীবনেও কোনো ভালো কাজ করনি।’
‘বিশালদেহী কুমির টাঙ্কির দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
‘একটা যদি নাদুসনুদুস বাচ্চা ধরা যেত
খেতাম আমি, তুই চাবাতি হাড্ডিগুলো যত!’
‘পাজি, নিষ্ঠুর জানোয়ার কোথাকার!’ আর্তনাদ করে উঠল টাঙ্কি। ‘তুমি একটা শয়তান! দোয়া করি, তোমাকে পিষে শরীর থেকে সব রস বের করে সেদ্ধ করে কুমিরের স্টু বানাক!’
বিশালদেহী কুমির জঙ্গলের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠল। তারপর ঘন জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আরও কিছুদূর এগোতেই তার মাগল-ওয়াম্প নামের এক বানরের সঙ্গে দেখা হলো। গাছের ওপর বসে বাদাম খাচ্ছিল মাগল-ওয়াম্প।
‘কী খবর, ক্রোকি।’ মাগল-ওয়াম্প বলল। ‘কোথায় যাচ্ছ এ সময়?’
‘একটা গোপন পরিকল্পনা আর কিছু চতুর বুদ্ধি এঁটেছি।’ কুমির বলল।
‘বাদাম খাবে?’ মাগল-ওয়াম্প জিজ্ঞেস করল।
‘বাদামের চেয়ে ঢের ভালো খাবার আছে আমার।’ নাক সিঁটকে বলল কুমির।
‘আমার ধারণা, বাদামের চেয়ে ভালো কোনো খাবার নেই।’ মাগল-ওয়াম্প বলল।
‘ওহ! তাই নাকি!’ বিশালদেহী কুমির তারপর বলল, ‘যে জিনিসটা এখন যাচ্ছি আমি খেতে
পায়ে তার আছে গোড়ালি, আঙুল আছে হাতে!’
মাগল-ওয়াম্পের মুখ মলিন দেখা গেল। সে আতঙ্কে কাঁপতে লাগল। ‘তুমি নিশ্চয়ই সত্যি সত্যি একটা মানুষের বাচ্চা খেতে যাচ্ছ, না?’ সে বলল।
‘অবশ্যই ওটাই করতে যাচ্ছি।’ কুমির জবাব দিল। ‘এবার একেবারে কাপড়চোপড়সহ খাব। বাচ্চাদের কাপড়সহ খেতেই বেশি স্বাদ।’
‘ওহ্! তুমি একটা স্বার্থপর লোভী কুমির!’ আর্তনাদের সুরে বলল মাগল-ওয়াম্প। ‘নোংরা জানোয়ার! দোয়া করি, গলায় বোতাম আর বেল্ট আটকে মারা যাও তুমি।’
‘আরে, ওদিকে তাকাও!’ খুশি খুশি গলায় টোটো বলল। ‘দেখেছ, এই গাছটা অন্যগুলোর চেয়ে ছোট! অথচ এটাতে নারকেলে ভরা! আমার মনে হয়, আমাকে একটু সাহায্য করলে গাছটিতে সহজেই উঠতে পারব।’
টোটো আর মেরি এক দৌড়ে ছোট্ট নারকেলগাছ ভেবে কুমিরের কাছে এল।
বিশালদেহী কুমির ডালপালার ফাঁক দিয়ে চোখ খুলে দেখল, বাচ্চা দুটো তার কাছেই ছুটে আসছে। তার জিব জলে ভরে গেল। উত্তেজনায় তার সেখান থেকে রস গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আচমকা আশপাশে কোথাও একটা জোরালো গোলমাল শোনা গেল।
আসলে হাম্পি-রাম্পি নামের জলহস্তী আসার শব্দ ছিল সেটা। সে ঝোপঝাড়, জঙ্গল ভেঙে দৌড়ে আসছিল। মাথা নিচু করে হুড়মুড় করে এগিয়ে এল সে।
‘টোটো, সাবধান!’ সে চিত্কার করে বলল। ‘মেরি, সাবধান! ওটা নারকেলগাছ নয়! ওটা বিশালদেহী কুমির। সে তোমাদের খেয়ে ফেলতে চায়!’
হাম্পি-রাম্পি সোজা এসে বিশালদেহী কুমিরকে এক ধাক্কা দিল। বিশাল মাথা দিয়ে কুমিরকে উল্টে ফেলে দিল। এ ধাক্কায় কুমিরটা মাটির ওপর বেশ কিছুদূর পিছলে গেল।
‘ওরে গেলাম!’ হাউমাউ করে উঠল কুমিরটা। ‘বাঁচাও! থামো! আমি কোথায়?’
একরাশ ভয় আর আতঙ্কে টোটো এবং মেরি শহরের দিকে পড়িমরি করে দৌড়াতে লাগল।
কুমিরের গায়ের চামড়া বেশ শক্ত হয়। তাই একটা বিশাল জলহস্তীর পক্ষেও তাকে আঘাত করা কঠিন।
তাই কয়েক টনি ধাক্কা খেয়েও কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল বিশালদেহী কুমির। হামাগুড়ি দিয়ে বাচ্চাদের খেলার মাঠে দিকে যেতে লাগল সে।
‘এবার আমি চালাকি বুদ্ধি নাম্বার দুই কাজে লাগাব!’ বিড়বিড় করল কুমিরটা। ‘এই বুদ্ধিটা নিশ্চয়ই কাজ করবে!’
সে সময় খেলার মাঠে কোনো বাচ্চাই ছিল না। সবাই তখন স্কুলে।
এই সুযোগটা কাজে লাগাতে শুরু করল বিশালদেহী কুমির। সে একটা বড় কাঠের টুকরো খুঁজে পেল। কাঠের টুকরোটা সে মাঠের একেবারে মাঝখানে রাখল। তারপর শরীরটাকে দুপাশে দিয়ে কাঠের টুকরোর ওপর শুয়ে পড়ল। তাকে দেখতে বাচ্চাদের খেলার সি-স দোলনার মতো লাগছিল।
স্কুল ছুটি হলো। ছুটির আনন্দে বাচ্চারা খেলার মাঠে দৌড়ে এল।
‘দেখো!’ তারা উল্লাসে চিৎকার করে বলল। ‘আমাদের মাঠে নতুন একটা সি-স!’
চারদিকে ভিড় জমিয়ে উত্তেজনায় লাফাতে লাগল তারা।
‘আমি সবার আগে এটাতে উঠব!’
‘আমি উল্টো দিকে বসব!’
‘আমিও উঠব!’
‘আমিও! আমিও!’
সবার চেয়ে বড় একটা মেয়ে বলল, ‘এটা দেখে তো ভালো কোনো সি-স মনে হচ্ছে না। তোমাদের কী মনে হয়? এটাতে বসে খেলা কি নিরাপদ?’
‘অবশ্যই নিরাপদ!’ অন্যরা চেঁচিয়ে জবাব দিল। ‘দেখো না এটা অনেক শক্ত!’
বিশালদেহী কুমির আস্তে আস্তে এক চোখ খুলল। চারপাশে জড়ো হওয়া বাচ্চাদের এক পলক দেখল। সে ভাবল, ওদের একজন নিশ্চয়ই আমার মাথার ওপর বসবে। তাহলে একটা গা-ঝাড়া দিয়েই ওকে মুখে পুরব। তারপর গপগপ গপগপ করে গিলে ফেলব।
ঠিক সেই সময় ঘটল আজব কাণ্ডটা। কোথা থেকে যেন একটা বাদামি রঙের কিছু লাফিয়ে খেলার মাঠে নামল। তারপর লাফালাফি করে দুলতে লাগল জন্তুটা।
ওটা আসলে মাগল-ওয়াম্প নামের সেই বানরটা।
‘সবাই এখান থেকে পালাও!’ মাগল-ওয়াম্প উত্তেজিত কণ্ঠে বাচ্চাদের সাবধান করতে লাগল। ‘পালাও, পালাও সবাই! এটা সি-স নয়! এটা বিশালদেহী কুমির। সে তোমাদের খেয়ে ফেলতে চায়!’
বাচ্চারা ভয়ে চিৎকার জুড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে যে যেদিকে পারল পড়িমরি করে পালিয়ে গেল সবাই।
কাজ শেষ হতেই মাগল-ওয়াম্প দ্রুত জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। বিশালদেহী কুমির হতাশ হয়ে খেলার মাঠে একা পড়ে রইল।
দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হয়ে সে প্রথমেই বানরকে শাপশাপান্ত করতে লাগল। তারপর হেলেদুলে হেঁটে গিয়ে স্কুলের পাশের এক ঝোপের মধ্যে লুকাল।
‘আমি এখন আগের চেয়েও বেশি ক্ষুধার্ত!’ সে বিড়বিড় করল। ‘এখন কমসে-কম চারটা বাচ্চা না খেলে পেটই ভরবে না!’
বিশালদেহী কুমির চার পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে শহরের আরও কাছে এগোতে লাগল। এখন সে খুব সাবধান। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে শহরে পৌঁছাতে চায়।
কিছুক্ষণ পর সে একটা জায়গায় পৌঁছাল। সেখানে কিসের যেন মেলা চলছিল। মেলায় সিনেমা, দোলনা, খুদে গাড়িসহ সব রকম খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে অনেকেই পপকর্ন, চকলেট বিক্রি করছিল। বিরাট নাগরদোলার ব্যবস্থাও আছে মেলায়।
নাগরদোলায় কাঠ দিয়ে চমৎকার সব প্রাণী বানানো। এসব প্রাণীর পিঠেই বাচ্চাদের বসতে হয়। সাদা ঘোড়া, সিংহ, বাঘ, জলপরি, ভয়ংকর ড্রাগন আরও নানা সব প্রাণী।
‘এবার তিন নম্বর চালাকি বুদ্ধি কাজে লাগাব আমি!’ ঠোঁট চাটতে চাটতে নিজেকেই শোনাল বিশালদেহী কুমির।
মেলায় কাজ আর হইচই করতেই সবাই ব্যস্ত। এ সুযোগে বিশালদেহী কুমির হামাগুড়ি দিয়ে চুপিচুপি বাচ্চাদের নাগরদোলার ওপর গিয়ে বসে পড়ল। কাঠের তৈরি সিংহ আর ভয়ংকর ড্রাগনের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল সে। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে কাঠের কুমির সেজে বসে রইল। তাকে দেখতে সত্যি সত্যিই নাগরদোলার কাঠের কুমিরের মতোই মনে হচ্ছিল।
মেলায় বাচ্চাদের ভিড় বাড়তে লাগল। তারা রীতিমতো হইচই শুরু করে দিল মেলার ভেতর। অনেকেই চরকির দিকে দৌড়ে এল। এত সুন্দর আর বড় একটা নাগরদোলা দেখে তারা খুবই আনন্দিত।
‘আমি ড্রাগনের পিঠে চড়ব!’ একজন চিৎকার করল।
‘আমি সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ব!’ আরেকজন চিৎকার করল।
‘আমি সিংহের পিঠে চড়ব!’, তৃতীয়জন চিৎকার করে বলল।
ওদের সঙ্গে একটা ছোট মেয়েও এসেছিল মেলায়। নাম তার জিল। সে বায়না ধরল, ‘আমি সুন্দর ওই কাঠের কুমিরের পিঠে চড়ব!’
এ কথা শুনে বিশালদেহী কুমির স্থির হয়ে রইল। কিন্তু চোখের ফাঁক দিয়ে সে ঠিকই দেখল, ছোট্ট মেয়েটি তার দিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। ‘এক কামড়ে সাবাড় করব!’, খুশিমনে সে ভাবল। ‘ওহ্ কী সুস্বাদু!’
হঠাৎ আকাশে কী যেন একটা উড়ে এল। সেখানে হুড়মুড় শব্দ শোনা গেল।
ওটা ছিল রলি-পলি পাখি।
সে নাগরদোলার চারদিকে উড়তে উড়তে সুর করে গাইতে লাগল, ‘জিল, সাবধান! সাবধান! সাবধান! খবরদার কুমিরের পিঠে চড়ো না!’
জিল থেমে গেল। ভালো করে কুমিরের দিকে তাকাল।
‘ওটা কাঠের কুমির নয়!’, সুরে সুরে বলল রলি-পলি। ‘ওটা সত্যি সত্যি কুমির! ওই বিশালদেহী কুমির নদী থেকে এখানে উঠে এসেছে তোমাদের খাবে বলে!’
ভয় পাওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। জিল ঘুরেই এক দৌড় দিল। তার সঙ্গে অন্য বাচ্চারাও। এমনকি যে লোকটি নাগরদোলার দায়িত্বে ছিল সেও পড়িমরি করে দৌড়ে পালাল।
আবারও ব্যর্থ হয়ে বিশালদেহী কুমির কিছুক্ষণ রলি-পলি পাখিকে শাপশাপান্ত করল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে অন্য এক ঝোপের আড়ালে মুখ লুকাল।
‘এখন আমি খুবই ক্ষুধার্ত।’ নিজেকেই শোনাল সে। ‘কমসে কম ছয়টা বাচ্চা না খেলে আমার পেটই ভরবে না!’
শহরের একটু বাইরে গাছগাছালি ভরা সুন্দর একটা মাঠ ছিল। সবাই এটাকে বনভোজনের জায়গা নামেই চেনে। মাঠের চারদিকে অনেক কাঠের টেবিল। তার সঙ্গে লম্বা বেঞ্চ। যখন তখন লোকজন এই মাঠে এসে পিকনিক করে।
বিশালদেহী কুমির স্বভাবসুলভ হামাগুড়ি দিয়ে পিকনিক প্লেসের দিকে এগিয়ে গেল। আশপাশে তখন কেউই ছিল না।
‘এবার চালাকি বুদ্ধি নম্বর চার!’ সে ফিসফিস করে বলল নিজেকে।
গাছ থেকে চমৎকার একগুচ্ছ ফুল তুলে আনল সে। এরপর সেটা একটা টেবিলে সাজিয়ে রাখল।
সেই টেবিল থেকে সে বেঞ্চ সরিয়ে নিল। বেঞ্চটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখল। বেঞ্চের জায়গায় সে নিজেই দাঁড়াল। বুকের নিচে মাথা রেখে আর লেজটা দেহের আড়ালে লুকিয়ে রেখে সে চারপেয়ে একটা বেঞ্চের মতো করে সেখানে দাঁড়াল। তাকে দেখতে সত্যি সত্যিই একটা কাঠের বেঞ্চের মতো লাগছিল।
কিছুক্ষণ পর দুটি ছেলে আর দুটি মেয়ে খাবারের বাক্স হাতে নিয়ে সেখানে এল। তারা একই পরিবারের ছেলেমেয়ে। তাদের মা তাদেরকে এখানে পিকনিক করার অনুমতি দিয়েছে।
‘কোন টেবিলে বসব?’ একজন বলল।
‘চলো চমৎকার ফুলঅলা ওই টেবিলে যাই।’ আরেকজন বলল।
বিশালদেহী কুমির স্থির হয়ে গেল। ‘আমি ওদের সবাইকে খাব।’ সে ভাবল। ‘ওরা আমার পিঠে বসলেই আমি ঝট করে মাথা তুলে চারদিকে নাড়াব। তারপরই গপগপ করে গিলে ফেলব সব কটাকে।’
হঠাৎ জঙ্গলের দিক থেকে গম্ভীর গর্জন শোনা গেল, ‘ছেলেমেয়েরা, তোমরা সবাই পিছিয়ে এসো! পিছিয়ে এসো!’
ছেলেমেয়েগুলো এই কণ্ঠ শুনে থেমে গেল। শব্দের উৎস লক্ষ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
তারপর গাছের ডালপালা ভাঙার মড়াৎ মড়াৎ শব্দের সঙ্গে সেখানে টাঙ্কি নামের হাতিটি জঙ্গল থেকে বের হয়ে এল।
‘তোমরা যেখানে বসতে যাচ্ছিলে সেটা বসার বেঞ্চ নয়!’ সে গর্জন করতে করতে বলল। ‘ওটা হচ্ছে, বিশালদেহী কুমির। সে তোমাদের সবাইকে খেয়ে ফেলতে চাচ্ছিল।’
টাঙ্কি দুলকি চালে বিশালদেহী কুমিরের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর খুব দ্রুত তার শুঁড় দিয়ে সে কুমিরের লেজটা চেপে ধরল। তাকে শূন্যে তুলে ধরল টাঙ্কি।
‘এই! কী করছ! ছেড়ে দাও!’ বিশালদেহী কুমির আর্তচিৎকার করে বলল। তার মাথা তখন নিচের দিকে ঝুলছিল। ‘আমাকে ছেড়ে দাও! আমাকে ছেড়ে দাও!’
‘না।’ টাঙ্কি বলল। ‘তোমাকে এবার ছাড়ছি না। চালাকি বুদ্ধি অনেক দেখিয়েছ। আর না।’
টাঙ্কি তাকে শূন্যে তুলে আবারও চারদিকে ঘোরাতে শুরু করল। প্রথমে টাঙ্কি কুমিরটাকে আস্তে আস্তে ঘোরাচ্ছিল। তারপর সে ঘোরানোর গতি বাড়িয়ে দিল...
আরও জোরে...
আরও জোরে...
আরও জোরে...
এভাবে ক্রমেই গতি বাড়তেই লাগল...
কিছুক্ষণ পর বিশালদেহী কুমিরের দেহ টাঙ্কির মাথার চারদিকে এক বৃত্তে পরিণত হলো।
হঠাৎ টাঙ্কি বিশালদেহী কুমিরের লেজ ছেড়ে দিল। এবার কুমিরটা রকেটের মতো সোজা আকাশের দিকে উঠতে শুরু করল।
ওপর থেকে আরও ওপরে উঠতে লাগল...
আরও ওপরে আর উঁচুতে...
গতিও বাড়তে লাগল ক্রমেই...
কিছুক্ষণ পর সে এতই ওপরে উঠে গেল যে সেখান থেকে পৃথিবীটাকে ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো দেখাচ্ছিল।
সে শোঁ শোঁ শব্দ করে আরও দূরে সরে যেতে লাগল।
মহাশূন্যে চলে গেল সে।
দেখতে দেখতে চাঁদও পার হয়ে গেল।
তারপর নক্ষত্র ও গ্রহগুলো পার হয়ে গেল সে।
অবশেষে....
একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে বিশালদেহী কুমির প্রচণ্ড গরম সূর্যের মধ্যে আছড়ে পড়ল।
চুলায় মাংসের কিমা ভাজার মতো সেও একেবারে ভাজা ভাজা হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।