বুদ্ধিমতী

ছেলেবেলার একটা গল্প বলি, শোনো।  বাংলা ক্যালেন্ডারের একটা মাস, আর বাংলা ব্যাকরণের একটা ‘ক্রিয়া’—এ দুটোতে জুড়ে সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশেরই একটা গ্রাম। বলো তো কী নামটা? পারলে না? এটি হচ্ছে আমাদেরই গাঁয়ের নাম—‘ফাল্গুনকরা’। এ গ্রামেই আমরা থাকি। আমাদের গাঁয়ের পাশেই পার্বত্য ত্রিপুরার ঘন জঙ্গল। ভীষণ বন। একবার বনের ধারে আমরা গিয়েছিলাম পিকনিকে। বন্ধুবান্ধবসহ আমরা প্রায় জনা দশেক। আজকে সে পিকনিকের গল্পটাই তোমাদের বলব।

পিকনিক-অন্তে এক বন্ধু প্রস্তাব করে বসল, ‘এসো, বনের ভেতরে ঢোকা যাক। বেলা তো সবে সাড়ে দশটা। যথেষ্ট সময় আছে এখনো। ভেতরটা একবার দেখা দরকার। দেখি, বাঘ-ভালুকের কী পর্যন্ত দেখা পাই?’

তা-ই হলো। আমাদের ভেতরকার অ্যাডভেঞ্চার চাড়া দিয়ে উঠল। আমরা সবাই মিলে হইহই করে বনের ভেতর ঢুকে পড়লাম। কিন্তু হায়! সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ যারা পড়েছ, তারা জানো, বাঙালির পক্ষে পাহাড় দেখার বিভ্রম কতটা! আমাদের বেলায়ও হলো তা-ই। বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে শেষটায় পথ হারিয়ে ফেললাম। বনে পথ হারানো বড্ড বিপদের কথা। একবার হারিয়েছ কি পথ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মাঝে মাঝে এমন গভীর জঙ্গলও এসে পড়ে যে সূর্যের মুখ পর্যন্ত দেখা যায় না—দিকভ্রম হয়। চাদ্দিকে চড়াই-উতরাই, গভীর-গভীর খাদ। বাঘ-ভালুকের ভয় তো আছেই। আমরা জড়োসড়ো হয়ে গেলাম। কিছুতেই পথ খুঁজে পাই নে। আসলে আমরা যে গভীর বন ছেড়ে একেবারে বনের ধারে এসে পড়েছি, সে কথাটা তখনো কিন্তু টের পাইনি! হঠাত্ বনের মধ্যে সমতলভূমির মতো একটা জায়গা আমাদের নজরে পড়ল। হ্যাঁ, কার যেন একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, না? বাড়ির ধারে একটা মসজিদও। মসজিদের পেছনে আবার একটি পুকুর। পুকুরপাড়ে একটা মেয়ে খেলা করছে। যাক, মেয়েটিকে দেখে আমাদের কিছুটা আশার সঞ্চার হলো।

‘খুকি, একটু পানি দিতে পারো?’

অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আমাদের তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল। মেয়েটিও দেখলাম চটপটে। এক দৌড়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এল। পানি খেয়ে খুব তৃপ্তি পেলাম।

‘এ পানি কোথাকার, ঝরনার?’

‘না, আমাদের পুকুরের।’

‘আহ্! তোমাদের পুকুর এত মিষ্টি! কত পুরোনো এটি?’ পুকুরের দিকে নির্দেশ করে বললাম।

‘শুনেছি আমার দাদার বাবার আমলের এ পুকুর, প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো।’

মেয়েটির কথাগুলো বড় মিষ্টি। ঠিক ওয়ার্ডসওয়ার্থের সেই লুসি গ্রে-এর মতো। ‘আচ্ছা, পুকুরপাড়ে ওই যে উঁচু ঢিবিটা, আর টিবির ওপর ওই যে বটগাছটা দেখা যাচ্ছে—ওটি বুঝি আরো পুরোনো? দেখতে তো ঝুরঝুরে বুড়োর মতো মনে হচ্ছে গাছটাকে।’

‘ছাই বুড়ো।’ মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলল, ‘দেখতে পাচ্ছ না, পুকুরের মাটি থেকেই ওই টিবিটার জন্ম। নইলে এ সমতল জায়গায় হঠাত্ ঢিবি আসবে কোত্থেকে? পাহাড় তো সেই অনেক দূরে। আর বটগাছটা জন্মেছে ঢিবির ওপরেই। কাজেই বটগাছটার জন্ম পুকুরের জন্মের পরে। ওর বয়েস এক শ বছরও হয়নি।’

বনের মেয়ে। অথচ এতখানি সপ্রতিভ, এতখানি হিসেব কষার বুদ্ধি। এখানেই বুঝি তাহলে এ মেয়েটিতে আর লুসি গ্রেতে পার্থক্য। আমাদের কৌতূহল গেল বেড়ে। প্রসঙ্গটা পাল্টে ফের বললাম, আচ্ছা, পানি তো খাওয়ালে। আমাদের কিছু ফল খাওয়াতে পারো? বলেই আর একটি গাছের দিকে নির্দেশ করলাম। তখন জ্যৈষ্ঠ মাস। পাকা পাকা আম ঝুলছিল গাছের ডালে। বনের ভেতর ঘোরাঘুরির দরুন আমাদের জবর খিদে পেয়ে গিয়েছিল। আমগুলো দেখেও বড্ড লোভ হচ্ছিল।

‘কেন, তোমরাই পেড়ে খাও না?’

‘আমরা যে খুকি গাছে চড়তে জানি নে।’

‘তাও জানো না। অপদার্থ। আচ্ছা, আমিই পেড়ে দিচ্ছি।’

বলেই গেছো মেয়েটি এক দৌড়ে গিয়ে গাছে উঠল। তারপর সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ‘কী রকম আম চাও, ঠান্ডা না গরম?’

মেয়েটির কথায় আমাদের তো আক্কেল গুড়ুম। বলে কি রে মেয়েটি—গরম না ঠান্ডা। বেশ রসিকতা তো জানে তাহলে। সুতরাং আমরাও পাল্টা রসিকতা করে বললাম, আচ্ছা আমাদের গরমটাই দাও।

মেয়েটি মগডালে উঠে খুব জোরে একটা ঝাঁকা দিল। আর ঝুরঝুর করে আমগুলো পড়তে লাগল। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভালো ভালো আম পড়ল কিনা গিয়ে এমন এক জায়গায় যেখানে ঘাস নেই। শুধু বালু আর বালু। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছিল। অগত্যা কী আর করি। মাটি থেকে কুড়িয়ে ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝেড়ে ঝেড়ে সেই বালু মিশানো আমগুলো খেতে শুরু করলাম। গাছ থেকে হাততালি দিয়ে মেয়েটি এবার বলল, ‘এই তো সাহেবদের গরম গরম আম খাওয়া হচ্ছে। ফুঁ দিয়ে দিয়ে জুড়িয়ে খাচ্ছে।’

মেয়েটির কথায় আমরা আর না হেসে পারলাম না।

আম খেয়ে যা হোক খিদে কিছুটা কমল। কিন্তু শুধু আমে কি আর পেট ভরে? পিকনিকের খাওয়া খেয়ে বেড়িয়েছি সেই দশটায়। এখন তো বেলা পড়ে গেছে। সারা দিনের ঘোরাঘুরিতে পেটের নাড়িভুঁড়ি অবধি হজম হওয়ার জোগাড়। এখন পেটে কিছু দানাপানি পড়া দরকার। হঠাত্ সেই পুকুরপাড়ে একটা ঘর আমাদের নজরে এল। কাছে গিয়ে দেখি দোকানঘর। দোকান দেখে আমাদের কিছুটা স্বস্তি বোধ হলো। কারণ, দোকানে প্রচুর নারকেল, মুড়ি, গুড় সাজানো রয়েছে দেখলাম। ভাবলাম, একটা নারকেল কিনে কুরিয়ে গুড়-মুড়ি দিয়ে মেখে খেলে মন্দ হবে না। এমন বেমক্কা জায়গায় খিদে নিবারণের এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে? পয়সার অবশ্য অভাব ছিল না। সুতরাং পয়সা দিয়ে মুড়ি-নারকেল একে একে কিনলাম। কিন্তু দুর্ভোগ আর কাকে বলে! এতগুলো মুড়ি কেনার পর দোকানি গুড় মেপে দিতে যাচ্ছে, এমন সময় হঠাত্ দাঁড়িপাল্লার দণ্ডটা ভেঙে দুখান হয়ে গেল। দোকানি হেসে বলল, থাকগে, ঘাবড়াবেন না। আপনারা আমাদের মেহমান। খানিকটা গুড় এমনিই দিচ্ছি, নিন। পয়সা নাইবা দিলেন।

আমরা ভাবি, গরিব বনবাসী মানুষ। এমনিতেই তার আম ধ্বংস করেছি, ফের গুড়ও যদি খাই মুফত্, নেহাত অন্যায় হবে। গুড়টা যে তার পুঁজি। ফের সামান্য দুএক ছটাক গুড়ে নারকেল-মুড়ি মজা হবে না। আমরা দশ-বারোজন। অন্তত এক সের গুড় চাই। এখন কী করি? এদিকে গুড় ছাড়া যে নারকেল-মুড়ির মজাটাই মাটি। পেটে খিদেও চনচন করছে। এমন সময় ওই মেয়েটি দৌড়ে এল আমাদের সাহায্যে, ‘ওমা! সাহেবরা দেখি এবারও হাল ছেড়ে বসে আছেন। আচ্ছা, এসো দেখি, সঠিক গুড় মেপে দিতে পারি কি না।’ বলেই সে তার বাবার কাছ থেকে একটা বড় পাত্র না চেয়ে নিয়ে নামল গিয়ে তাদের পুকুরের ধারে। তারপর পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দিল পাত্রটা। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলাম মেয়েটির কাণ্ড! এদিকে মেয়েটি করল কী, তার বাবার এক সের ওজনের বাটখারাটা চাপাল সেই পাত্রে। বাটখারার ভারে ভাসমান পাত্রের গা যতখানি পানিতে ডুবল, সেখানটায় একটা দাগ দিল। এবার বাটখারাটা তুলে সে জায়গায় অল্প অল্প গুড় পাত্রে ঢালতে লাগল। যতই গুড় ঢালে, ভাসমান বাটিটা ততই পানিতে ডুবতে লাগল। খানিক পরে পাত্রের গায়ের দাগ আর পানি এক বরাবর হয়ে গেল। মেয়েটি এবার গুড় ঢালা বন্ধ করল। তারপর পাত্রের গুড়টা আমাদের হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নাও, তোমাদের এক সের গুড়।—কেমন হলো তো? আর পয়সাগুলো দাও তো চটপট। বাবাকে গিয়ে দিয়ে আসি।’ বলেই আমরা ওকে গুড়-মুড়ির ভাগ সাধবার আগেই পয়সা নিয়ে দিল ছুট।

আমাদের কিন্তু এখনো শিক্ষার সমাপ্ত হয়নি। মেয়েটির হাতে আরও কিছু ভোগান্তি ছিল কপালে। খেয়েদেয়ে খিদে তো নিবল। এবার ফেরার পালা। কিন্তু ফিরি কী করে? বোঝা গেল, লোকালয় যখন এসে পড়েছে, বনের আর বাকি নেই। ভয় সম্পূর্ণ কেটে গেছে। তবু যে আমরা দিক হারিয়ে ফেলেছি। দিকভ্রম শোধরানোর উদ্দেশ্যে মেয়েটিকে বললাম, ‘আচ্ছা, এবার তাহলে আসি। আম গরম না হোক, তোমার কথাগুলো কিন্তু জব্বর গরম। চিরকাল মনে থাকবে। আচ্ছা, একটা কথা বলতে পারো কি? অনেকক্ষণ হয় এ বনের ভেতর দিক হারিয়ে ফেলেছি। আকাশেও মেঘ-মেঘ, সূর্য দেখা যাচ্ছে না। উত্তর দিক কোনটি? সেদিকেই যে আমাদের বাড়ি।’

মেয়েটি আমাদের কথায় ফিক করে হেসে উঠল, ‘ওমা, কী বোকা! উত্তর দিক জানো না! কেন তোমাদের ভেতরেই যেকোনো একজনা উত্তর দিক না?’

মেয়েটির এ প্রশ্নে আমাদের অবস্থা আরও সঙিন হয়ে উঠল। এত্তটুকুন মেয়ে অথচ কথাবার্তায় কী তুখোড়! মেয়েটি কিন্তু কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই আমাদের উপদেশ দিয়ে চলল, তার সেই মুরব্বিয়ানা চালে, ‘সব কাজে বকর বকর করতে নেই, বুঝলে? একটু বুদ্ধি-শুদ্ধি খরচ করতে হয়। এই নাও—।’ বলেই সে আমাদের নিয়ে গেল তাদের পুকুরের পাড়ের সেই মসজিদটায়। দেশ গাঁ-এর মসজিদের পেছনের খানিকটা বাড়িয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে একটা অতিরিক্ত কোঠা, যেখানে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব মুসল্লিদের নিয়ে পশ্চিমমুখো হয়ে নামাজ পড়েন। অতএব, বোঝা গেল, মসজিদের সে অতিরিক্ত কামরার দিকটাই পশ্চিম।

মেয়েটি বলল, ‘তোমরা কি বিলেত থেকে এসেছ? জানো না এ দেশের মসজিদগুলোর পেছন পশ্চিম দিকে ফেরানো থাকে। এখন ও হচ্ছে তোমার পশ্চিম দিক। এ থেকে যার ইচ্ছে উত্তর দিকটাও চিনে নাও, কেমন? না, তাও পারবে না?’

মেয়েটির খোঁচা খোঁচা কথাতে ইতিমধ্যেই আমরা বিব্রত হয়ে উঠেছিলাম। সুতরাং আবার ওর প্রশ্নের ‘উত্তর দিক’-এর দুরাশা ত্যাগ করে সোজা রওনা দিলুম বনের উত্তর দিক অভিমুখে। অর্থাত্ সোজা আমাদের বাড়ির দিকে।

আজকে বড় হয়েছি। মন মাতানো গল্প, উপন্যাস কত পড়েছি। বিশেষ করে ডিটেকটিভ শার্লক হোমসের সেসব চমত্কার বুদ্ধির কাহিনিগুলো। কিন্তু বনের ধারের এ ডিটেকটিভ মেয়েটির বুদ্ধিগুলো আজও আমাদের মনে বেশ নাড়া দেয়। আজও ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘লুসি গ্রে’ কবিতার সেই নির্জন মেয়েটির মতো নির্জন বনের এ বুদ্ধিমতী মেয়েটির স্মৃতি, থেকে থেকে আমাদের মনের কোণে দোলা দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এ বুঝি একেবারে ‘লুসি গ্রে’ আর ‘শার্লক হোমস’-এর যুক্ত সংস্করণ।

অলংকরণ: তারিক সাইফুল্লাহ

[সাজেদুল করিম লিখেছেন খুব অল্প, কিন্তু যা লিখেছেন, বাংলা শিশুসাহিত্যে তা আজও প্রথম সারিতেই অবস্থান করছে। অঙ্কের মজা কিংবা কুইজ নিয়ে যেমন গল্প লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন হাস্যকৌতুক নিয়েও। সবই খুব সহজ ও সাবলীল ভাষায়। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক সাজেদুল করিমের জন্ম ১৯১৭, আর মৃত্যু ১৯৯৫ সালে। চিংড়ি ফড়িংয়ের জন্মদিনে, চেরাপুঞ্জি পলিটিক্স, এপ্রিলস্য প্রথম দিবসে, দস্যি ছেলের দশচক্র, মাসী পিসির অ্যালজেব্রা তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।]