বৃষ্টিমানব

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিল রঞ্জু। বেলা সোয়া ১১টা। তাদের স্কুল ছুটি হয় ১১টায়। এমন সময় পেছন থেকে দৌড়ে এল মন্টু।

‘থাম রঞ্জু, থাম।’

থামল রঞ্জু। বেশ অবাক হলো সে। মন্টু তাকে কখনোই এভাবে ডাকেনি। মন্টু কাছে আসতেই সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার?’

‘সাংঘাতিক ব্যাপার।’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মন্টু।

মন্টু সাংঘাতিক ব্যাপার বললে সবাই তা গুরুত্ব দিয়ে শোনে। রঞ্জু একটু গম্ভীর হয়ে ভুরু কুঁচকে বলল,

‘কী সাংঘাতিক ব্যাপার?’

‘বলছি, দাঁড়া।’ মন্টু হাঁপাতে থাকল। বেশ মোটা সে। একটু দেড়োলেই ক্লান্ত হয়ে যায়। হাঁপায় কিছুক্ষণ। তারপর সে আবার শান্ত। এবারও ব্যতিক্রম হলো না। কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে শান্ত হয়ে সে বলল, ‘কাল সন্ধ্যায় বৃষ্টির সময় সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে।’

রঞ্জু কিছু বলল না। মন্টু বলতে থাকল, ‘কাল সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে আমাদের খেলার মাঠে ভূত দেখা গেছে।’

‘কী রকম ভূত?’ নিরস কণ্ঠে বলল রঞ্জু। সে ভূতে বিশ্বাস করে না। কোনো ধরনের ভূতের প্রতিই আগ্রহ নেই তার।

মন্টু বলল, ‘এই ভূত শুধু বৃষ্টির সময় দেখা যায়। যখন প্রচুর বৃষ্টি হয় তখনই।’

‘দেখতে কী রকম?’

‘একেবারে বৃষ্টির পানির মতো। অনেকে বলে এই ভূত বৃষ্টির পানিতে তৈরি। শরীর থেকে নীল রঙের আভা বের হয়। আকার মানুষের মতোই। অনেক বৃষ্টির সময় এই ভূত বের হয়। ভূতটা নাচে, ঘুরে বেড়ায়, মাঝেমধ্যে মানুষ দেখতে পেলে তার গায়ে পানি ছেটায়। এ ছাড়া মানুষের কোনো রকম ক্ষতি করে না।’

‘বুঝলাম,’ বলল রঞ্জু। সে এবারে খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘দ্যাখ্ মন্টু, আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। তুই এই ভূতের কথা বলছিস, কিন্তু আমি তাতেও বিশ্বাস করছি না।’

মন্টুও গম্ভীর হয়ে বলল, ‘জানি তুই বিশ্বাস করিস না। তবু তোকে বলে রাখলাম। সাবধানে থাকিস। নাহলে তুইও একদিন ভিজে যাবি।’

মন্টু চলে গেল। রঞ্জু কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে আবার রওনা দিল বাসার দিকে। সে এই মফস্বল শহরে নতুন এসেছে। তারা ঢাকায় থাকত, কিন্তু বাবার বদলি হওয়ার কারণে এখানে এসেছে তারা। নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সবার সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি মিশে গেছে সে।

আকাশে আবার মেঘ জমেছে। কাল সন্ধ্যার বৃষ্টিতে খেলার মাঠ এমনিই ভিজে গেছে, এখন আর খেলা যাচ্ছে না। আজকেও মনে হয় খুব বৃষ্টি হবে, মাঠ আরও ভিজে যাবে।

বাসায় ফিরে চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলল রঞ্জু। বাবা অফিসে, মা কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি গেছে। তার কাছেই চাবি থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে গোসল করে খেয়ে নিল রঞ্জু। পড়ার টেবিলে বসল স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে। দুপুরের খাবার খাওয়ার আগপর্যন্ত স্কুলের হোমওয়ার্ক করে গেল। দুপুরের খাবার খাওয়ার পর সে একটা গল্পের বই নিল। অনেক বই পড়ে রঞ্জু, তার সবচেয়ে প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

পুরো দিনে আর সূর্যের দেখা মিলল না। মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে থাকল আকাশ, প্রচুর বৃষ্টি হতে থাকল। রঞ্জু গল্পের বই পড়তে পড়তেই শুনল দূরে বাজ পড়ার শব্দ।

রঞ্জু যখন বই থেকে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল, তখন বিকেল প্রায় শেষ। বৃষ্টি তখনো পড়ছে। রঞ্জু বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখল কিছুক্ষণ। হঠাৎ মন্টুর কাছ থেকে শোনা ভূতের কথা মনে পড়ল তার। সেই ভূত আসে বৃষ্টির সময়, প্রচুর বৃষ্টি যখন হয়।

এবারে একটু কাছে বাজ পড়ল। রঞ্জু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, তার ঘরের টিউবলাইট বন্ধ হয়ে গেল। কারেন্ট চলে গেছে। স্কুল ব্যাগ থেকে রেইনকোট বের করল সে। গায়ে পরে নিল রেইনকোটটা। খেলার মাঠে যাবে সে, মন্টুর সেই ভূতকে একটু দেখে আসবে।

তাদের বিল্ডিংয়ের কয়েকটা বিল্ডিং পরই রফিকদের বিল্ডিং। সেটার পাশেই খেলার মাঠ। ঢাকা শহরের বড় বড় অট্টালিকাগুলো দেখে সে অভ্যস্ত, সে হিসেবে এই মফস্বল শহরের অট্টালিকাগুলো ছোট, মাত্র পাঁচ-ছয়তলা।

রফিকদের বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থমকে গেল রঞ্জু। সামনেই খেলার মাঠ। সেই খেলার মাঠে নীল রঙের আলো দেখা যাচ্ছে। সেই আলো স্থির নয়, এদিক-ওদিক ঘুরছে। যেন সত্যিই এটা কোনো ভূতের আলো।

কিছুক্ষণ আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকল রঞ্জু। তারপর ভাবল, আলোটা অন্য কিছুরও হতে পারে। বৃষ্টির ভূতেরই যে হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে এগোল মাঠের। মাঠে এসে বিস্মিত হয়ে গেল সে। মাঠে একজন মানুষ, মনে হলো শরীর পানি দিয়ে তৈরি। নীল রঙের আলো বেরে হচ্ছে শরীর থেকে। রঞ্জু যখন দূর থেকে মানুষটার দিকে তাকিয়েছিল, তখন লোকটা স্থির ছিল না। এখন লোকটি সম্পূর্ণ স্থির, দুই হাত মাথার ওপর তুলে মাথা আকাশের দিকে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। লোকটার মুখ আধখোলা, সেই মুখে টপটপ করে পানি পড়ছে। লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল রঞ্জু। মন্টুর দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। সে এর আগে কোনো ভূতপ্রেত দেখেনি, দেখেনি কোনো অতিপ্রাকৃত কিছু। এগুলোতে বিশ্বাস নেই তার। কিন্তু এখন তার বিশ্বাস হচ্ছে না, অবিশ্বাসও করতে পারছে না। সম্ভবত সে-ই একমাত্র মানুষ যে এই বৃষ্টির ভূতকে এত কাছ থেকে দেখছে।

রঞ্জু বৃষ্টির ভূতের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এই জিনিসটার নাম ভূত দেওয়া উচিত হবে না। সে জিনিসটার নাম দিল বৃষ্টিমানব! হঠাৎ বৃষ্টিমানব চোখ খুলল। ধীরে ধীরে সে নিচে নামাল তার হাত, মাথা সোজা করল। তারপর তাকাল রঞ্জুর দিকে।

রঞ্জু বৃষ্টিমানবের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টিমানবও তাকিয়ে আছে তার দিকে। রঞ্জু লক্ষ করল, বৃষ্টিমানবের চোখের রং নীল, চোখের মণির রং গাঢ় নীল। সে বৃষ্টিমানবের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই চোখে কোনো বিস্ময় নেই, কোনো রাগ নেই, আছে এক আশ্চর্য ঠান্ডা নীরবতা।

হঠাৎ করে কাছেই বেশ জোরে বাজ পড়ল। প্রচণ্ড শব্দে বুক কেঁপে উঠল রঞ্জুর।

রঞ্জুর দিকে হাত নাড়ল বৃষ্টিমানব। পানি বের হলো হাত থেকে। ভিজে গেল রঞ্জুর রেইনকোট। বৃষ্টিমানবের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে রঞ্জু। তার মনে ভয়। হঠাৎ দৌড় দিল সে।

মিনিটখানেকের মধ্যেই সে ফিরে এল বাসায়।

রাতে জ্বর এল রঞ্জুর। তার বাবা রঞ্জুর কপালে হাত দিয়ে খুব অবাক হলেন। প্রচণ্ড জ্বর রঞ্জুর। দ্রুত ডাক্তার ডাকলেন তিনি। ডাক্তার রঞ্জুকে কিছু ওষুধ দিয়ে রাত্রে অস্থায়ীভাবে শরীরের তাপমাত্রা নামিয়ে দিলেন।

রঞ্জুর অসুস্থতার খবর পেয়ে তার মা ফিরে এলেন পরদিন সকালে।

দুদিন পর জ্বরে রঞ্জু মারা গেল।

মৃত্যুর আগে তার মা–বাবা শুনতে পেলেন, রঞ্জু বলছে, বৃষ্টিমানব, বৃষ্টিমানব।

লেখক: নবম শ্রেণি, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা