ভাজা মাছের উল্টো পিঠের রহস্য

অলংকরণ: আসিফ

‘যা-ই করিস, ভাজা মাছটা উল্টে খেতে যাসনে! খুব সাবধান ভাইটি!’

এই বলে দাদু চুপ করে রইল, আমি খুব করে ধরেও ওর পেট থেকে আর কিছু বের করতে না পেরে শেষমেশ রাগ করে বললাম,

‘খাবই তো, খাব না মানে। ভাজা মাছের সোজা পিঠ আমার ভারি না-পছন্দ, পেলে হয় একবার, উল্টোটাই আগে খাব, দেখে নিয়ো বুড়ো।’

শুনে দাদু তড়িঘড়ি চোখ উল্টে মটকা মেরে খুব যাচ্ছেতাই একটা হার্ট অ্যাটাকের ভান করল, যাতে আমি ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনা করি। ন্যাদাটাকে ডেকে একটা ইসিজি করিয়ে নিশ্চিত হলাম, ওটা ভানই। তাই মুচকি হেসে বেরিয়ে পড়লাম জ্যোত্স্না রাত্রিতে, বুড়ো ঠিকই ধবধবে সাদা বিছানায় বসে তখন হাসপাতালের গরম স্যুপ চাখছে, জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম। আসার আগে অবশ্য তাও ওর কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হলো, উল্টো পিঠটা আমি কিছুতেই খাচ্ছি না।

বড় রাস্তার মোড়ে শেওলা পড়া হিজল বনের পাশে একটা ট্রেন থেমে ছিল, ট্রেনের ইঞ্জিনটা নষ্ট পড়ে আছে। রোজ রাতে একদল এসে ইঞ্জিনটা সারানোর নানা টালবাহানা করে, রাতের বখরা গুছিয়ে ভোরের আগে আগেই আবার সরে পড়ে। এই করে চলছে বছর কাল। আজ সারাই কারিগরদের পাশ দিয়ে যেতে শুনি ফিসফাস, চাপা ধমক আর আহাজারি। আরেকটু কাছে গিয়ে দেখি, কারিগরদের গা ঘামে জবজব—অথচ আজকের উত্তরে বাতাসটা খুব মনকাড়া শীত-শীতে।

শুনলাম কাল সকালে নাকি চিফ পরিদর্শক ট্রেনের সার্বিক হালহকিকত দেখতে ঠিকই এই নন্দিকান্দিতে হাজির হবেন, আর এসে যদি দেখেন এত দিনকার সারাই সব অমন বেলেল্লা বেশুমার ফাঁকিবাজি, তাহলে এই সারাই মিস্ত্রিদের ধরে ধরে বয়লারে চালান করে দেবেন, লোকটা খুব দুর্ধর্ষ।

আমি বললাম, বছর ধরে খুব তো বখরা পেলে, আজ রাতে হাত-পায়ের হিস্যা দাও। সবাই ধরলে সারতে কতক্ষণ।

সারাই মিস্ত্রি জেবর মোল্লা বলে, ‘অত সোজা নয়, বত্সর ধরে যে ফাঙ্গাস জমেছে, তা সরাতে না পারলে ইঞ্জিন সারবে না, খোসপাঁচড়ার মলম আনতে পাঠিয়েছি, কয়েক টন ঢালার পর তবে কাজে হাত দেওয়া যাবে—ততক্ষণে ভোর হয়ে পরিদর্শক আঞ্জুমান বখশী এসে আমাদের বয়লারে দেবে।

আমি ব্যাগ থেকে দাদুর তৈরি চর্মসুন্দরের বোতল বের করে জেবর মোল্লার হাতে দিয়ে বললাম, ‘এইটা লাগালে মুহূর্তে সারবে, অল্প একটুতেই, সেল্ফ-রেপ্লিকেটিং আয়ুর্বেদিক সালসা, তবে বিনিময়ে একটা আবদার আছে আমার।’

জেবর মোল্লা হাঁফ ছেড়ে বলল, ‘বাঁচালে খোকা, কী আবদার বলে ফেলো জলদি!’

‘তোমাদের ট্রেনে করে আজ রাত্রিরে আমাকে কোঞ্চাপুরে পৌঁছে দিতে হবে। ওইখানে আমার দাদুর এক দূরসম্পর্কের ভাই থাকে, একটা কাজে যেতে হবে তার কাছে।’

জেবর মোল্লা ভ্রু পাকিয়ে বলল, ‘সালসায় কাজ করলে করা যাবে বৈকি, কোঞ্চাপুর আর কত দূরই বা! ফুল স্পিডে ছেড়ে দিলে পাঁচ ক্রোশ পথ আলো ফুটবার আগেই গিয়ে আবার ফেরত আসা যাবে। তাহলে এবার কাজে লেগে পড়ি।’

ট্রেনে সালসা মেখে ছত্রাক ঝেঁটিয়ে ঠিকঠাক করতে করতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল, তারপর মেইন সুইচ অন করতেই ইঞ্জিন ঘরঘরিয়ে উঠল। আমি গিয়ে ফাসকেলাশে একটা আরাম-চেয়ার বাগিয়ে বসে হাই তুললাম, জেবর মোল্লা দেরি না করে আমার জন্য একটা টিকিট কেটে এনে বয়লারে কয়লা পুরল, কয়লার গা থেকে লাল আভা বের হতেই ট্রেন ছেড়ে দিল কোঞ্চাপুরের পথে।

কোঞ্চাপুর পাহাড়ি এলাকা। নৌকা আর নীল রঙা মহিষের গাড়িতে করে যেতে পাক্কা পৌনে এক দিন আধা রাত লাগে। ঝক্কিও কম না, নৌকার পথটায় জলদস্যু আর সুচালো দাঁতের কুমিরের উত্পাত। সেই তুলনায় ট্রেনটা খুব শর্টকাট আর নির্মল, জানালার পাল্লা লাগিয়ে একটা ভাওয়ালি গানের অ্যালবাম ছেড়ে দিলে একুশ নম্বর গানে এসে ওস্তাদ মীর সুধাকর যেই বড় একটা টান লাগায়, ঠিক তখন বুদ্ধি করে চেইন টেনে নেমে পড়লেই কোঞ্চাপুর।

শেষ রাত্রিরে জেবর মোল্লা আমাকে নামিয়ে দিয়ে ট্রেন নিয়ে আবার উল্টাপথে রওনা হলো। কোঞ্চাপুরে এর আগে এসেছিলাম দাদুর সঙ্গে একবার, তাও বছর কুড়ি আগে। পথঘাট তাই খুব একটা মনে নেই, আর আকাশে পূর্ণচন্দ্র থাকায় সবকিছু আরও কেমন ঘোলাটে লাগছে। স্টেশনে একটা মহিষের গাড়ি পেয়ে গেলাম কপালগুণে।

চালকের নাম অঘোর ব্যাপারী। বলল, আমার জন্যই নাকি তাকে পাঠিয়েছে কবিরাজ ইদরিম খাঁ। এই ইদরিম খাঁ লোকটাই দাদুর দূরসম্পর্কের লতায়-পাতায় কী রকম যেন ভাই হয়।

ইদরিম খাঁর আক্কেল আছে, অঘোর ব্যাপারীকে না পাঠালে এ সময় এ ফকফকা চাঁদের আলোয় খুব মুশকিল হতো, দাদুর তিমির-নেত্র ওষুধটা দশ ফোঁটা সেই কবে দিয়েছি চোখে, এরপর থেকে রাতের অন্ধকারটা খুব মানিয়ে গেছে, কিন্তু পূর্ণিমার আলোতে শুধু ধন্দলাগে।

মহিষ গাড়ি ঝড়ের বেগে ছুটল, খানাখন্দ, চড়াই-উতরাই কিচ্ছুটি ওরা কেয়ার করে না, অঘোর ব্যাপারী বলে দিয়েছে, অ্যায়সা করে সিট বেল্টটা যাতে বেঁধে নিই, নইলে পাহাড়ি রাস্তায় নীল মহিষের টানা গাড়িতে জানালা গলে ছিটকে পড়া ঠেকানো মুশকিল।

ঘড়ির মিনিট কাঁটা আধা পাক ঘুরতেই হাজির হলাম হেকিম ভিলার প্রধান ফটকে। গাড়ির দরজা খুলে নেমে ভিলার সামনে দাঁড়ালাম, পেল্লায় কাঠের ফটক, তাতে কাঠমিস্ত্রিরা মনের খুশিমতো নকশা করে চকচকে বার্নিশ করেছে আর মনে হলো কী যেন লেখা বিচিত্র ভাষায়, পালি ভাষাই হবে হয়তো।

অঘোর ব্যাপারী নেমে ফটকের একটা ঝুল দড়ি ধরে টান দিল, সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে এক হুটোপুটি শুরু হলো মনে হলো। শব্দটা বাড়তে বাড়তে ফটকের দিকে গুড়ি মেরে আসছে সেটা আন্দাজ করতে পারলাম। ঠিক তখনই গা গুলিয়ে পেটের ভেতর কেন যেন পাক দিয়ে উঠল, যেমনটা দিয়েছিল বছর দুই আগে চিম্বা পাহাড়ের চূড়ার তমালগাছে পা ঝুলিয়ে বসার পর।

অঘোর ব্যাপারীর মুখটাও শুকিয়ে কাঠ, আমার চোখে চোখ পড়াতে অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল,

‘ভয় কি! শুধু ভাজা মাছের উল্টো পিঠটা খাবেন না, তাহলেই হলো!’

২.

পা পর্যন্ত সবুজ আলখাল্লায় মোড়া কবিরাজ ইদরিম খাঁ আমার হাতখানা কনুইয়ের ভাঁজে চেপে ধরে খুব আহ্লাদ করে ভেতরে নিয়ে চলল। খোশ মেজাজে বলল,

‘ইদ্রিশ এত দিনে তোকে পাঠিয়েছে আমার কাছে, সেই কবে শুনেছি ওর একটা নাতি হয়েছে, হাতের গড়নে বোঝা যায় কবরেজ হবে, আর আমি কিনা এ্যাদ্দিনে দেখলাম। আয় ভাইটি, আজকে হাতমুখ ধুয়ে নাশতা করে বিশ্রাম নে, কাল থেকে তোর ট্রেনিং শুরু হবে। ইদ্রিশ তোকে কি লবডঙ্কা ট্রেনিং দিয়েছে তাতে আমার ভরসা নেই।

আমি বললাম, ‘দাদুর হার্টের ব্যামো—ওর নিজের ওষুধে আর কাজ হচ্ছে না। দুই দিন পরপরই ইসিজি পেপারে গরমিল হয়, তাই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে হৃৎচন্দনভঞ্জনাসুন্দর ওষুধটার জন্য, ওটা নাকি কেবল আপনার কাছেই আছে!’

ইদরিম খাঁ মুচকি হেসে বলল, ‘আছে বৈকি! বানানো নেই, তবে উপকরণ জোগাড় করে বানাতে কতক্ষণ, ওটার দুই ফোঁটা পড়লেই হৃদপিণ্ডটা ওর হয়ে উঠবে একুশবর্ষী যুবার মতো। সে কাল হবেখন, বন থেকে একটা চমরি গাই ধরে নিয়ে এসে ওর শিংয়ের মজ্জাটা পেলেই বানিয়ে ফেলা যাবে।’

দাদুর মুখে শুনে এসেছি ইদরিম খাঁর বয়স অনেক, তারপরও লোকটা দাদুর মতো বুড়িয়ে যায়নি, চোখের মণি এখনো জ্বলজ্বলে, গায়ে একপোয়া বাড়তি মেদ নেই, ভ্রুগুলো কুচকুচে, একটা লম্বা টুপির ফাঁক দিয়ে যেসব চুল বেরিয়ে এসেছে সেগুলোও ডার্ক অ্যাশ কালারের।

বাড়িটা প্রাসাদের মতো, তবে লোকজন খুব একটা আছে বলে মনে হলো না। সবাই হয়তো মজবুত করে ঘুমাচ্ছে, কয়েকটা মস্ত বড় বিড়াল অবশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেখতে-শুনতে কুকুরের সমান হবে—তিমিরনেত্র ওষুধ চোখে না পড়লে রয়েল বেঙ্গলের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতাম নিশ্চয়ই।

একটা কামরার সামনে আমরা থামলাম, সেখানে ইদরিম খাঁর খানসামা বাকিবিল্লাহ হাতে তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

বলল, ‘হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।’

ইদরিম খাঁ সেখান থেকে বিদায় জানাল, ‘সকালে দেখা হবে ভাইটি, তুই নাশতা সেরে একটা ঘুম দিস মজবুত করে, কালকেই ইদ্রিশের ওষুধটা বানিয়ে দেব।’

বাকিবিল্লাহর আয়োজন বেশ জবরদস্ত, রুটির সঙ্গে সাতান্ন পদের ভর্তা-ভাজি, রোস্ট-কালিয়া, কাবাব-বুটিয়া, মালাইকারি-চচ্চড়ি, ঘিয়ে তাঁতানো জিলিপি, দই-পেস্তাগুজিয়া কত কী!

আমি বললাম, ‘এসবের মানে কি বাকিবিল্লাহ, আমার ইসিজি বিগড়ে দেওয়ার ধান্ধা করছ নাকি!’

বাকিবিল্লাহ হেসে বলল, ‘সব খাঁটি তেল-ঘিয়ে মোড়া, খেলে কিস্যুটি হবে না। তবে খোকা, একটা কথা!’

‘কী?’

‘মানে বলছিলুম, রাতের ডিনারে ভাজা মাছের...’

‘হয়েছে, বলতে হবে না, উল্টো পিঠটা যাতে না খাই তাই তো!’ আমি খেপে গিয়ে বললাম।

বাকিবিল্লাহ জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, খোকা। তুমি আবার কথাটা কর্তাকে বলতে যেয়ো না, তাহলে আমার সর্বনাশ হবে।’

‘কিন্তু কারণটা কী বলো তো?’

কারণ জিজ্ঞেস করতেই বাকিবিল্লাহও কথাটা যেন শুনতে পায়নি ভান করে ঘাড় ডলতে ডলতে উধাও হয়ে গেল।

মুখে আর আমার খাবার রুচল না। গোত্তা মেরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

৩.

নীলমণি পাহাড়ের গোড়ায় স্বর্ণচাপার ঝোপে জড়িয়ে একটা চমরি গাই জাবর কাটছিল মনোযোগ দিয়ে। ইদরিম খাঁ খানসামা বাকিবিল্লাহকে দিয়ে গাইটাকে ডেকে আনলেন আমাদের তাঁবুর কাছে।

তারপর আলখাল্লার নিচ থেকে হাতির খুর চেঁছে ধার করে বানানো একটা বদখত করাত দিয়ে গাইটার একটা শিং কচ করে কেটে নিলেন। এরপর ভেতরের মজ্জাটা গোলাপি কাচের গ্লাসে ঝাঁকি দিয়ে রেখে শিংটা আবার পেঁচিয়ে লাগিয়ে দিলেন মাথায়, তারপর সার্জিক্যাল একটা ব্যান্ডেজ জুড়ে গাইটাকে যেতে বললেন। প্রথমে গাইটা খুব হম্বিতম্বি করছিল, বাকিবিল্লাহ তখন গাইয়ের লোমশ গা খুঁড়ে চামড়া খুঁজে জোরসে এক চিমটি কাটায় শান্ত হয়ে দাঁড়াল।

ইদরিম খাঁ আমার দিকে ফিরে বলল, ‘গাইগুলা খুব পাঁজি হয়েছে, এ্যাদ্দিন পরপর একটু মজ্জা নিই, বিনিময়ে আমার রাজ্যে বিনা ট্যাকসে থাকছে তাও কৃতজ্ঞতাটুকু নেই। দেখলে ভাইটি, কেমন ডাঁট দেখাল! অথচ ইনফেকশন যাতে না হয় তার জন্য অ্যান্টিসেপটিক মলমও মেখে দিলাম শিংয়ে।

আমি বললাম, ‘কোঞ্চাপুরের সবটাই তোমার রাজ্য?’

‌‘না খোকা, অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি, বাকিটা তো দুর্গম সমতল, পাহাড়ি জায়গাটুকু আমার! হেকিম ভিলায় ফিরে ম্যাপ দেখাব, তখন বুঝবি।’

সকাল সকাল বেরিয়েছিলাম আমরা চমরি গাইয়ের খোঁজে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তবে মিলল এসে এই নীলমণি পাহাড়ের গোড়ায়।

আমি কবরেজ ইদরিম খাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার রাজ্যে খুব একটা মানুষ নেই দেখছি, প্রাসাদেও কতগুলো হুলো ছাড়া আর কাউকে দেখলাম না।

কবরেজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ঠিকই ধরেছিস ভাইটি, লোকে শুধু ব্যামো হলেই আমায় মনে আনে, আর দাওয়াই হাতে পেলেই বগলদাবা করে পেছনে না ফিরেই ফিরতি গাড়ি ধরে। সব মিলিয়ে ১০ ঘর বাসিন্দা মিলে পুরো রাজ্য চালাতে হয় আমার! বোঝো ব্যাপারখানা!’

আমি বললাম, ‘খুব প্যাথেটিক, এমন স্বপ্নালু জায়গায় তো কাড়াকাড়ি করে লোকের থাকা উচিত, হাওয়াটাও তরতাজা, ঘাস, লতাপাতাও নির্মল, পানিটা ঝকঝকে, লেকের পাড়টা কাঠের গুড়িতে বাঁধানো, অথচ লোক নেই—দারুণ প্যাথেটিক!’

‘হুম, ঠিক বলেছিস। চল এবার রাতের খাবারের এন্তেজাম করি। বকবক করে দিন কাটালে ওষুধটা আর বানানো লাগবে না। ইদ্রিশটা নিশ্চয়ই তোর পথ চেয়ে আছে।’

আমি বললাম, ‘ঠিক বলেছ কবরেজ। দাদু বলেছে, ওষুধটা নিয়েই যেন ফিরতি গাড়ি ধরি, চলো যাই।’

এরপর ইদরিম খাঁ লেকের পাড়ে বড়শি পেতে বসল, বড়শির আগায় একটা ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি লুচি দিয়ে ছাড়তেই একটা মাছ লাফিয়ে উঠে বড়শি কামড়ে ঝুলে রইল।

‌‘দেখলি কেমন লোভী, লুচি পেলে আর হুঁশ থাকে না।’ কবরেজ মাছটা ছাড়াতে ছাড়াতে আমার দিকে চেয়ে বলল।

আমি দেখলাম মাছটা আশ্চর্য নজরকাড়া রঙের, একপাশটা সোনালি লাল, অন্য পাশ নীলচে হলুদ।

ইদরিম খাঁ বলল,‘খুব সুস্বাদু মাছ, একবার পেটে পড়লে বুঝবি।’

‘কী নাম এ মাছের!’

‘চিনলি না, এ যে ভাজা মাছ!’

‘ভাজা মাছ?’

‘হ্যাঁ, শুঁকে দেখ, কী যে সুবাস!’

আমি বললাম, ‘এটাই তবে ভাজা মাছ। এর উল্টো পিঠ কোনটা কবরেজ?’

আমার প্রশ্ন শুনে ইদরিম খাঁ থমকে গিয়ে চকচকে চোখে তাকাল, তারপর ধাতস্থ হয়ে অমায়িক হেসে বলল, ‘এ আবার কেমন ধারা কথা, মাছের আবার উল্টো-সোজা কী রে? নে নে, মাছটা টুকরিতে নিয়ে রাখ। আরও ধরতে হবে না? আজ রাতে যে ফিস্ট হবে!’

কবরেজের ভাবভঙ্গিতে আমার কেমন গা গুলিয়ে উঠল, পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠল, ঠিক যেমনটা হয়েছিল বছর দুই আগে চিম্বা পাহাড়ের চূড়ার তমালগাছে পা ঝুলিয়ে বসার পর।

আমি বললাম, ‘আমি মাছ ধরায় নেই, এমন জায়গায় যখন এসেছি তখন একটা ল্যান্ডস্কেপ না করে যাচ্ছি না। বলে আমি আমার ব্যাগ থেকে ইজেল, ক্যানভাস আর রং-তুলি বের করে পায়াভারী হয়ে দাঁড়ালাম। কবরেজ আবারও মোলায়েম হেসে বলল, ‘তা বেশ, তা বেশ। তাহলে ইদ্রিশ তোর চৌকস গড়নের হাত পেয়ে ছবি আঁকতে শিখিয়েছে, বেশ তো!’

সন্ধ্যার দিকে যখন আমরা আবার হাকিম ভিলার দিকে ফিরে চললাম, তখন কবরেজের টুকরিতে সাতটা ভাজা মাছ আর আমার হাতে একটা জলরঙা পাহাড়ি লেকের ক্যানভাস।

খেয়াল করলাম গাড়ির কোচোয়ান অঘোর ব্যাপারী আর খানসামা বাকিবিল্লাহ একটু বাদে বাদে কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে, উত্তরে শীত-শীতে বাতাসে না অন্য কোনো কারণে কে জানে!

৪.

হেকিম ভিলায় ফিরেই কবরেজ ইদরিম খাঁ তার দাওয়াখানায় হৃৎচন্দনভঞ্জনাসুন্দর প্রস্তুতে লেগে গেল, প্রথমে গোলাপি গ্লাসে রাখা মজ্জাটা আচ্ছামতো চন্দনরসে ডুবিয়ে সেদ্ধ করে নিল, তার সঙ্গে জাফরান আর অপরাজিতার পাপড়ি মেখে এক ইয়াব্বড় পাচকরসের বয়াম থেকে খানিকটা ঢেলে কড়াইতে চড়িয়ে দিল, তার সঙ্গে আরও অচেনা আর অজানা শিকড়-বাকড়, লতাপাতা জ্বাল দিল, তাতে এক মনকাড়া সৌরভে পুরো বাড়ি ম-ম করতে লাগল।

ওদিকে বাকিবিল্লাহ আর অঘোর ব্যাপারী ভাজা মাছগুলো রাঁধতে লেগে গেল রসুই ঘরে। আমি খানিকক্ষণ দাওয়াখানায় কাটিয়ে এক ছুতোয় বেরিয়ে গেলাম। চুপিচুপি রসুই ঘরে গিয়ে হাজির হলাম।

খানসামা আর কোচোয়ান তখন হাঁড়িতে মসলা চড়াচ্ছে, আমাকে দেখে কেমন ভড়কে গেল। আমি খানসামাকে চেপে ধরে বললাম, ‘এখনই ঠিকঠাক বলো কোনটা মাছের উল্টো পিঠ।’

দুজনাই চমকে উঠে মুখে হাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘খোকা, সোনালি লাল পাশটাই উল্টো পিঠ।’

আমি আর কথা না বাড়িয়ে দাওয়াখানায় হাজির হলাম, দেরি হলে আবার যদি কবরেজ বুঝে ফেলে।

মধ্যরাত্রিরে কবরেজের কাজ শেষ হলো, একটা কাচের বয়ামে জ্বলজ্বলে গোলাপি হৃত্চন্দনভঞ্জনাসুন্দর পুরে আমার চোখের সামনে নাচিয়ে আলখাল্লার পকেটে পুরল।

আমি বললাম, ‘ওটা আবার পকেটে পুরলে কেন কবরেজ, আমাকে দিয়ে দাও। ব্যাগে রেখে দিই মজবুত করে।’

ইদরিম খাঁ চোখ নাচিয়ে বলল, ‘হবে হবে খোকা, অত ভাবছিস কেন। খিদেয় তোর পেটটা চোঁ চোঁ করছে, সেটা তো মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চল আগে ফিস্ট খেয়ে নিই।’

লম্বা ডাইনিং টেবিলটা সাদা ফরাশ পেতে রেডি ততক্ষণে, খানসামা রুপোর থালায় বাসমতী চালের পোলাও সাজিয়েছে, সঙ্গে রোস্ট-কালিয়া, কোর্মাসহ আরও বায়ান্ন পদ, আর পাতে পাতে একটা করে আস্ত ভাজা মাছ।

হাত-মুখ ধুয়ে আমরা বসে পড়ি। টেবিলের একধারে কবরেজ বসল, অন্য ধারের নকশাদার পাতানো চেয়ারে আমি গিয়ে বসি। বাসমতী আর ভাজা মাছের গন্ধে কেমন লালা এসে গেল মুখে। কবরেজ চোখ বুজে কী যেন এক মন্ত্র পড়তে লাগল, টেবিলে সাজানো মোমদানির সলতেগুলো সে মন্ত্রেই হয়তো কেমন কেঁপে কেঁপে একটা শীত-শীতে ভাব এনে দিল। আমাদের দুই পাশে অঘোর ব্যাপারী আর বাকিবিল্লাহও বসেছে কেমন জড়োসড়ো হয়ে। খেয়াল করলাম বাড়ির ধুমসো সাইজের বিড়ালগুলোও দরজার বাইরে জড়ো হয়েছে, ওগুলোর মতলব কী খোদা মালুম!

‘এবার ভাইটি, চলো খাওয়া শুরু করি।’ জ্বলজ্বলে হেসে ইদরিম খাঁ আমন্ত্রণ করল খানিক পর।

খিদেও লেগেছে ঢের, তাই আর দেরি করলাম না। বাসমতী চাল মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে পাহাড়ি খাসির রোস্টে কামড় লাগালাম।

বাকিরাও খাওয়া শুরু করল। খেতে খেতে মাঝেমধ্যে চোখ চলে যাচ্ছিল ইদরিম খাঁয়ের দিকে, বুড়োর খাওয়ায় মন নেই বুঝলাম, নেড়েচেড়ে অল্প করে খাচ্ছে আর বাকি সময় আমার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে। হঠাৎ মনে হলো, ওর ঠোঁটের কোনা দিয়ে একফোঁটা লালা রুপোর থালায় গড়িয়ে পড়ছে, সুড়ুৎ করে সেটা আবার মাঝপথে টেনে নিয়ে কেমন এক বিব্রত হাসি দিল। দেখে আমার গা-টা কেমন ঝমঝমিয়ে উঠল।

খাওয়া শেষে উঠতে যাব এমন সময় বলল, ‘ভাইটি, আগেই উঠলে হবে, ভাজা মাছটি কে খাবে?’

আমার পাতে মাছটা পড়েই ছিল, ছুঁয়েও দেখিনি। আমি বললাম, ‘খাব বৈকি! তবে তোমরা সবাই যদি খাও।’

কবরেজ মুচকি হেসে বলল, ‘আমরাও তো খাব ভাইটি। নে নে শুরু কর।’

উপায় না দেখে মাছের এক টুকরা মুখে পুরতে গেলাম, ঠিক তখনই বাইরের বিড়ালগুলো হঠাৎ চেঁচামেচি শুরু করল।

কবরেজ তাতে কেমন খেপে উঠল, আলখেল্লা থেকে একটা চাবুক বের করে আচ্ছামতো কয়েকটাকে চাবকে শান্ত করে তারপর টেবিলে ফিরল।

‘লোভ দেখ ব্যাটাদের, আমরা খাওয়ার পর যা বাকি থাকে তা তো তোরা পাবিই, আগেই কেন হুল্লোড়।’

তারপর আমার কাছে এসে আমার পাতের মাছটা উল্টে দিল, সোনালি লাল পিঠটা রুপোর থালায় ঝলমলিয়ে উঠল। বলল, ‘ভাজা মাছ সব সময় এ পিঠটা আগে খেতে হয়, কেমন জেল্লাদার দেখেছিস।’

আমি বললাম, ‘যদি এ পিঠটা না খাই?’

কবরেজ অমায়িক চেহারা পাল্টে গাঢ় চোখে আর শক্ত মুখে বলল, ‘তাহলে হৃতচন্দনভঞ্জনাসুন্দরটা পাবি না, এটা ছাড়া আর দুই দিনও ইদ্রিশের আয়ু নেই সেটা জেনে রাখিস।’

অগত্যা আমি ওই পিঠটাই খাওয়া শুরু করি। কবরেজ তাতে সন্তুষ্ট হয়ে নিজ চেয়ারে ফিরে খাওয়ায় মন দিল। আড়চোখে দেখলাম মাছটা ও নিজেও খাচ্ছে, তবে নিলচে হলুদ পিঠ। বাকিবিল্লাহ আর অঘোর ব্যাপারীও কবরেজের মতোই সোজা পিঠটা খাচ্ছে, পাঁজি বুড়োটা আমাকেই কেবল উল্টো পিঠ খাওয়াচ্ছে।

আমাদের তিনজনারই যখন খাওয়া শেষের দিকে, তখন কী যেন এক হয়ে গেল। বন্ধ ঘরেও কেমন একটা শিরশিরে বাতাস খেলে গেল, মোমের আলোরা আবার নেচে উঠল। আর দেখি কি, দেখি যে

ইদরিম খাঁ, অঘোর ব্যাপারী আর বাকিবিল্লাহ তিনজনাই কেমন মুচড়ে উঠল।

তারপর তিনজনাই ঝপ করে তিনটা বিড়াল হয়ে গেল।

একটু বড়সড় বিড়াল, তিমিরনেত্র চোখে না থাকলে রাত্রিবেলা যাদের রয়েল বেঙ্গল বলে চালিয়ে দেওয়া যায়!

এবার আমার পালা। খলবলিয়ে হাসার পালা।

রসুই ঘর থেকে ফেরার পথে চুপিচুপি সব মাছই আমি ব্যাগের কাশ্মীরি টেকসই রঙে পাল্টে দিয়েছিলাম। নীলচে হলুদকে লালচে সোনালি বানানো আমার জন্য এক টানের কাজ। ওরাই আসলে উল্টো পিঠ খেয়েছে।

এই তাহলে ব্যাপার, ইদরিম খাঁর কাছে যারাই আসে তাদের মন্ত্রপূত ভাজা মাছের উল্টো পিঠ খাইয়ে ও মস্ত বিড়াল বানিয়ে রাখে। হাকিম ভিলার সব বিড়ালই তাহলে হতভাগা লোকজন!

‘ছয়টা মাছই আমি পাল্টে দিয়েছি। এবার নিজের ফাঁদে নিজেই পড়েছ ইদরিম খাঁ!’

কথাটা আমি অট্টহাসি দিয়ে বলতে চেয়েছি, কিন্তু গলাটা কেমন কেঁপে ওঠে তীক্ষ্ন স্বরে আমি বলে ফেললাম, ‘মিঁয়াও!’

শিরশিরে হাওয়ায় হঠাৎ আমার মনে পড়ল, মাছ ধরা পড়েছিল সাতটা। একটা মাছ তার মানে রং করা হয়নি ভুলে!