ভুলে ভরা গুড্ডুবুড়ার একদিন

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

ক্লাস ফোরে পড়া গুড্ডুবুড়ার এমন একটা দিন গেল, যেদিন একটার পর একটা ভুল করতেই থাকল সে। একটা দিনে সবই ভুল হতে থাকবে, এটা কীভাবে সম্ভব?

প্রথমে সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে সে গেল বাথরুমে। দাঁত মাজতে গিয়ে গুড্ডু বুঝতে পারল যে সে টুথব্রাশে টুথপেস্টের বদলে অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম লাগিয়ে ফেলেছে। এটা তার বাবা শেভ করার পর গালে আফটার শেভ ক্রিম হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। থু থু করতে লাগল গুড্ডু।

যখন সে থু থু করছে, তখন তার মা বাথরুমে এসে ঢুকলেন। বললেন, ‘কী হয়েছে?’

‘সামান্য ভুল। আমি টুথপেস্টের বদলে আফটার শেভ ক্রিম ব্রাশে নিয়েছি।’

মা বললেন, ‘কোন ব্রাশ? এটা তোর ব্রাশ নাকি? তোর ব্রাশ তো এই নীল রঙেরটা। লাল রঙের এই ব্রাশ দিয়ে তো আমি আমার চিরুনি পরিষ্কার করি।’

এইবার গুড্ডুর বমি পেয়ে গেল। মায়ের চিরুনি পরিষ্কার করার ব্রাশ দিয়ে সে দাঁত মাজছিল!

সে গোসল করতে গেল। মাথায় শ্যাম্পু দিচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, শ্যাম্পুটা বেশি কড়া। চোখও বন্ধ। কোনোরকমে চোখ খুলে সে দেখতে পেল, সে বাসন মাজার লিকুইড সোপ দিয়েছে মাথায়। তাড়াতাড়ি মাথার চুল ধুতে গেল সে। অমনি কলের পানি শেষ হয়ে গেল। সে চিৎকার করতে লাগল, ‘মা, কলে পানি নেই। নিচের পানির পাম্পটা ছাড়তে বলো তো।’

সেই পাম্প ছাড়া হলো। তারপর সে মাথা থেকে বাসন মাজা সাবান পরিষ্কার করতে পারল।

এরপর সে শাওয়ারের নিচ থেকে সরে এসে দেখল, তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকতেই সে ভুলে গেছে। এখন ভেজা গা সে মুছবে কী করে। সে তার গেঞ্জি দিয়ে গা-মাথা মুছে প্যান্ট পরে বাথরুম থেকে বের হলো।

দেখল, ডাইনিং টেবিলে কতগুলো শসা আর দই। সে দইয়ে শসা ডুবিয়ে শসা খেতে শুরু করল। তখন তার ছোট খালা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এই, কী করিস।’

‘শসা খাই।’

ক্লাসের ছেলেমেয়েরা হো হো করে হাসতে লাগল। তখন গুড্ডু বুঝল, সে জুম মিটিংয়ের ভুল লিংকে চাপ দিয়েছে। এখন মিস শামীম ইংলিশ ক্লাস নেবেন। এটা মোটেও তাদের বন্ধুদের ফাজলামো আড্ডার লিংক নয়

ছোট খালা বললেন, ‘গাধা। এই শসা দিয়ে আমি আমার মুখের ময়লা তুলেছি। এই দই আমি মুখে মেখে তারপর এই বাটিতে রেখেছি।’

এইবার গুড্ডু বমি করবে নাকি কাঁদবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বলল, ‘শসা কেন গালে মাখতে হবে, দই কেন মাখতে হবে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

এরপর সে বসল জুম মিটিংয়ে। তাদের বন্ধুরা মিলে একটা গ্রুপ চ্যাট করবে।

সে মিটিংয়ে ঢুকল বাসার গেঞ্জি পরে। আর তারপর গেঞ্জিটা খুলে একটা শার্ট পরতে পরতে বলল, ‘কী রে ইবলিশের দল, ক্যামন আছিস তোরা!’

অমনি ওপাশ থেকে ইংলিশ টিচার মিস শামীম বলে উঠলেন, ‘এই গুড্ডু, মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ! হাউ রিডিকুলাস। তুমি খালি গা হচ্ছ কেন?’

ক্লাসের ছেলেমেয়েরা হো হো করে হাসতে লাগল। তখন গুড্ডু বুঝল, সে জুম মিটিংয়ের ভুল লিংকে চাপ দিয়েছে। এখন মিস শামীম ইংলিশ ক্লাস নেবেন। এটা মোটেও তাদের বন্ধুদের ফাজলামো আড্ডার লিংক নয়।

তাড়াতাড়ি করে ল্যাপটপ শাটডাউন করে সে উঠল। খালা ওই ঘরে ছবি আঁকছেন। একটু ছবি আঁকা দেখা যাক।

ওই ঘরে গিয়ে গুড্ডু দেখল, বাহ্‌, খুব সুন্দর একটা পারফিউমের স্প্রে। সে তার গায়ে পারফিউম স্প্রে করতে লাগল। আসলে সেটা ছিল একটা রঙের স্প্রে। তার গায়ে একটা উৎকট নীল রং স্প্রে হয়ে গেল। শার্ট, গলা, ঘাড়—সবখানে নীল রং। সে অবশ্য টের পেল না যে তার এই অবস্থা হয়েছে।

এরপর সে দেখল একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল। সেটা থেকে সে এক ঢোঁক কোল্ড ড্রিঙ্কস মুখে দিয়ে বুঝল যে আসলে কেরোসিন খাচ্ছে। তখন তার বমিটা হয়েই গেল। আর বমি করল সে খালার আঁকা একটা ছবির ওপরে। পাশের ঘর থেকে খালা ছুটে এলেন। ‘এই, তোর এ কী অবস্থা? সারা গায়ে রং মেখে ভূত সেজেছিস কেন? আর আমার ছবি নষ্ট করলি কেন?’

গুড্ডু কী বলবে? আজকে তো ভুলেরই দিন। ভুল হতেই থাকবে।

তার শরীর থেকে সেই রং তুলতে বহুত কষ্ট করতে হলো। শার্টটা ফেলেই দিতে হলো।

তবে ভুল করতে করতে সে একটা ভালো কাজও করে ফেলল।

তাদের বাসাটা নিচতলায়। দোতলায়। দোতলার গেটটা খোলাই থাকে।

তাদের বাসার গেট খোলা পেয়ে একটা চোর এসে তাদের ঘরের মধ্যে ঢুকে খাটের নিচে লুকিয়ে রইল।

আর গুড্ডু ভাবল, চারদিকে করোনা। কাজেই ঘরগুলোকে ভাইরাসমুক্ত করা দরকার। কিছুদিন আগে তারা একটা কোম্পানি থেকে উপহার হিসেবে কতগুলো স্যানিটাইজার, মাস্কের সঙ্গে দুইটা এয়ার ফ্রেশনার পেয়েছে। বলা হচ্ছে, এই এয়ার ফ্রেশনার বাতাসে ছড়িয়ে দিলে পুরা ঘর ভাইরাসমুক্ত থাকবে সাত দিন।

কিন্তু গুড্ডু এয়ার পিউরিফায়ার স্প্রেটা খুঁজে পেল না। পরে দেখল, এটা ছোট খালা তার ছবি আঁকার টেবিলে রেখেছেন। আসলে সেটা এয়ার ফ্রেশনার ছিল না। ছিল পিপার স্প্রে। মানে মরিচের স্প্রে। এটা অনেকেই সঙ্গে রাখে হঠাৎ করে কোনো ছিনতাইকারী বা আততায়ী এলে তার মুখে–চোখে মারার জন্য। তাহলে আক্রমণকারী চোখ বন্ধ করে ফেলবে। অন্তত পাঁচ মিনিট আর চোখে দেখতে পারবে না। হাঁচি–কাশি দিতে দিতে ধপাস করে পড়ে যাবে। মেয়েরা এটি বেশি করে সঙ্গে রাখে, যাতে দুষ্টু লোকের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।

সেই পিপার স্প্রে নিয়ে গুড্ডু স্প্রে করতে লাগল তার মা–বাবার বেডের নিচে।

অমনি ওরে বাবারে ওরে মারে বলে এক লোক বেরিয়ে এল খাটের নিচ থেকে। সে–ও ধপাস করে পড়ে গেল মেঝেতে।

বাবা দৌড়ে এলেন। মা দৌড়ে এলেন। এ কে? সে কেন তাদের খাটের নিচে?

আর গুড্ডু ভাবল, চারদিকে করোনা। কাজেই ঘরগুলোকে ভাইরাসমুক্ত করা দরকার। কিছুদিন আগে তারা একটা কোম্পানি থেকে উপহার হিসেবে কতগুলো স্যানিটাইজার, মাস্কের সঙ্গে দুইটা এয়ার ফ্রেশনার পেয়েছে।

বাবা ৯৯৯–এ কল করলেন। পুলিশ এল পাঁচ মিনিটের মধ্যেই।

‘কী ব্যাপার?’

বাবা বললেন, ‘কী ব্যাপার তা জানার জন্যই তো আপনাদের কল করেছি।’

‘ব্যাপার জানার জন্য আমাদের কল করবেন কেন? ব্যাপার জানার জন্য প্রথম আলো অনলাইন দেখুন।’

‘না মানে, আমাদের খাটের নিচ থেকে এই রকম একটা লোক বের হয়েছে। আর সে মেঝেতে শুয়ে চোখ রগড়াচ্ছে।’

পুলিশ দেখল লোকটাকে। ‘আরে, এ তো কুখ্যাত চোর ছ্যাঁচড়া মানিক। একেই তো আমরা খুঁজছিলাম।’

বাবা বললেন, ‘তো পেয়ে গেলেন। নিয়ে যান।’

‘ওর এ অবস্থা হলো কেন?’

গুড্ডু বলল, ‘একটু স্যানিটাইজার স্প্রে করেছি। এই যে।’

খালা বললেন, ‘আরে, এটা তো পিপার স্প্রে। তাই তো লোকটা এই রকম করছে। ওর চোখে জ্বালা করছে।’

পুলিশ বলল, ‘ওর চোখে পানি দিতে হবে।’

খালা বললেন, ‘না, পানি দিলে বাড়বে। আগুনের সেঁক দিতে হবে।’

একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে লোকটাকে তার ওপরে চোখ মেলতে বলা হলো। কী সমস্যা। শেষে লোকটার চোখ ভালো হলো। ছ্যাঁচড়া মানিককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল থানায়। গুড্ডুবুড়াও সবার বাহবা পেয়ে ভাবল, যাক, ভুল করতে করতেই একটা ভালো কাজ করে ফেলেছি!