
আক্কেলপুর গ্রামটা দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু গ্রামের একটা দুর্নাম আছে। গ্রামে ভূতের বড় উত্পাত। সে জন্য আশপাশের কেউ নিতান্ত বাধ্য না হলে এই গ্রামে পা রাখে না।
সুধীর আজ রাতে এই গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে রাজি হয়েছে। তার বাড়ি আরও দুই গ্রাম পরে। আক্কেলপুরের ভেতর দিয়ে গেলে শর্টকাট হয়। তবে কিনা দিনের বেলাতেই এই গ্রামটা এড়িয়ে চলে সে। আজ সে একপ্রকার ফেঁসেই গেছে। মোল্লাগঞ্জের হাটে আড্ডাবাজি করতে গিয়ে আজ সে নিজেকে একটু বেশি জাহির করে ফেলেছিল। বলেছিল, ভূত-প্রেত থাকলে থাকতে পারে। সে ডরায় না।
সেই কথার ফলাফল এই যে এখন সুধীরকে আক্কেলপুর গ্রাম অভিমুখে হাঁটতে হচ্ছে। তার পাশে পাশে হাঁটছে আলতু। সে এই আক্কেলপুর গ্রামেরই ছেলে। তাকে গ্রামের পুলপার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে রমজান শেখের বাড়ির পাশ দিয়ে ডানে মোচড় নিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাবে সুধীর। আলতুকে এগিয়ে দিতে আজ সে রাজি না হয়ে পারেনি। নইলে মুখরক্ষা হয় না। তা ছাড়া দুজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে। মোল্লাগঞ্জ হাটে দুজনের পাশাপাশি দুটি মাছের দোকান।
কাঁটাখালীর বিরান মাঠের মধ্য দিয়ে সরু আঁকাবাঁকা পথ। দুই যুবক হাঁটছে। আকাশে কৃষ্ণ দ্বাদশীর প্রায় গোলাকার চাঁদ। আলতুর হাতে একটা টর্চ। সেটা জ্বালানোর দরকার হচ্ছে না। চাঁদের আলোয় চরাচর যথেষ্ট দৃশ্যমান।
দুজনে গল্প করতে করতে হাঁটছে। মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে সড়াত্ করে বেজি বা শিয়াল ছুটে গেলে ঘনিষ্ঠ হয়ে আসছে দুই বন্ধু।
সুধীর কিছুটা তটস্থ। নাহলে অন্তত তিনটি ব্যাপার সে লক্ষ করতে পারত। প্রথমত, তাদের দুজনার হাঁটার গতি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। দ্বিতীয়ত, অহেতুক উঁচু গলায় কথা বলছে তারা। আর তৃতীয়ত, তারা তাদের কথোপকথনে একটি বিষয় খুব সযত্নে এড়িয়ে চলছে। কিছুতেই সেই প্রসঙ্গটি তারা আনছে না। আর তা হলো আক্কেলপুর গ্রামের এখনকার সংকটের প্রকৃতি। রাতের বেলা কিছু জিনিসের নাম মুখে আনতে নেই।
হাঁটতে হাঁটতে সুধীর জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, তোদের গ্রামটা আর কত দূর?
আলতু: গ্রামে ঢুইকা পড়ছি তো। বটতলার নিচ দিয়া আসলাম, লক্ষ করিস নাই?
সুধীর লক্ষ করেনি বটে। তবে এটা সে লক্ষ না করে পারল না যে সামনে রাস্তার ওপর একটা ছোট কালভার্ট। আর তার সিমেন্টের বেঞ্চের মতো রেলিংটায় কেউ একজন বসে আছে। খালি গা। পরনে লুঙ্গি।
সুধীর চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, ওইটা কে রে?
আলতু: জানি না। তুই কথা বলিস না।
আলতু ও সুধীরের হাঁটার গতি ধীর হয়ে যায়। লোকটার সামনে দিয়ে পুল পার হওয়ার সময় আলতু গলা খাঁকারি দেয়।
আলতু: কে? চেনা চেনা লাগে?
লোকটার মধ্যে কেমন একটা ক্লান্ত ভঙ্গি। ‘আমি কাসেম। হাটে গেছিলি আলতু?’
লোকটার গলা বেশ খ্যাসখেসে।
আলতু বলল, হ, কাসেম মিয়া।
বলল বটে, কিন্তু গলার স্বর বেশ কেঁপে গেল আলতুর।
কাসেম কুঁজো হয়ে বসে রাস্তার সুরকির দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা তুলে দেখছে না। সে নিচু মুখেই বলে, সঙ্গে ওইটা কে?
আলতু: সুধীর। ঈশানপুরের সুধীর। আমরা আসি কাসেম মিয়া, দেরি হইয়া যাইতেছে...। বলেই আলতু হনহন করে হাঁটা দেয়। পেছন পেছন সুধীর।
সুধীর বলে, আরে তুই এমন দৌড়াইতেছিস কেন?
আলতু: জোরে হাঁটা দে সুধীর। জোরে হাঁট।
সুধীর: একটা লোককে দেইখা কেউ এইভাবে ডরায়? তুই তো ছায়া দেখলেও ডরাবি।
আলতু: ওইখানে কে বইসা আছে জানিস, গাধা?
সুধীর: শুনলাম তো। কাসেম মিয়া।
আলতু: কাসেম মিয়া কে জানিস?
সুধীর: না, জানি না।
আলতু: গত শীতে ওলাওঠায় মারা গেছিল কাসেম। আমি নিজে তার কবরে মাটি দিছি।
২.
সাত মহাদেশের নাম কেউ মুখস্থ করে আসেনি। ফলে ইচ্ছা থাকলেও আজ মালভূমি চ্যাপ্টার শুরু করা গেল না। শফিকুল গনি ওরফে ভূগোল শফিক ভেবে দেখলেন, এটা তাঁর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র। গত সপ্তাহেও আয়ন বায়ুর হোমওয়ার্ক কেউ করে আনেনি।
এর একটাই প্রতিকার। শাস্তি দিতে হবে। পুরো ক্লাস।
শাস্তিটা নতুন কিছু নয়। ভূগোল শফিকের রুটিন শাস্তি। ছাত্রছাত্রীরা সবাই নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে হাত পেতে থাকবে। শফিক স্যার বেত্রাঘাত করতে করতে এমনভাবে এগিয়ে যেতে থাকবেন, যেন তিনি টিফিন বিতরণ করছেন।
ছেলেমেয়েরা হাত পেতে রেখেছে। ভূগোল শফিক সপাত্ সপাত্ বেত মারছেন। একেকটি হাতে বেত পড়ছে। হাত সরে যাচ্ছে। শুধু হাতগুলোই দেখতে পাচ্ছেন তিনি, আর কিছু তাঁর নজরে আসছে না।
সারি সারি কোমলমতি হাত সব—কোনোটা চুড়ি পরা, কোনো হাতে মেহেদি, কোনো হাতের তালুতে কলম দিয়ে ছবি আঁকা, কোনো হাত ভিতু, মুঠো করা, কোনো হাতে দ্বিধা। বায়োস্কোপের মতো হাতগুলো একটার পর একটা আসছে আর যাচ্ছে।
এবার একটি হাত আসে গনি স্যারের দৃষ্টিসীমায়, অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে একটি মেয়েলি হাত। রক্তশূন্য। তালুতে কররেখা নেই।
ভূগোল শফিকের বেত থেমে যায়।
যার হাত সেই মেয়েটার মুখটাও একই রকম ফ্যাকাশে আর রক্তশূন্য। টেনে টেনে সুরে বলে ওঠে মেয়েটি, আমাকে মারবেন না, স্যা...র?
ভূগোল শফিক হকচকিয়ে যান, এই! কে তুই? তুই কে?
আমাকে চিনতে পারতেছেন না? আমি শা...প...লা!
স্যারের হাত নেমে যায়। তিনি কেমন অবশ হয়ে যেতে থাকেন।
কোন শাপলা?
শাপলা পারভিন। আনিস প্রামাণিকের মেয়ে। আমার নিউমোনিয়া হইছিল। আমারে তো আপনি দেখতে গেছিলেন স্যার।
ভূগোল শফিক বেত ফেলে একটা বিদঘুটে শব্দ করেন। তারপর এমন একটা কাজ করেন, যা কেউ তাঁকে কখনো করতে দেখেনি। একটা লাফ মেরে ভোঁ-দৌড় মারলেন তিনি। তাঁর মুখ থেকে দুর্বোধ্য কী সব শব্দ ধ্বনিত হতে থাকে। সেটা কিছুটা পাখির কিচিরমিচিরের মতো, কিছুটা মৌমাছির গুঞ্জনের মতো, যদিও তিনি আসলে বলতে চেয়েছিলেন, ‘তোরা সব পালা রে। ক্লাসরুমে ভূত ঢুকেছে!’
মুহূর্তে ক্লাসজুড়ে একটা হুটোপুটি। ছেলেমেয়েরা টেবিলের তলা দিয়ে, কেউ টেবিল উল্টে ছুট লাগায়।
তাদের কণ্ঠে ফুর্তি।
স্কুলের বারান্দা দিয়ে ছুটছেন গনি স্যার। বিভিন্ন ক্লাসরুম থেকে ছাত্রছাত্রীরা স্রোতের মতো পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে।
আক্কেলপুর শহীদ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আজকের ক্লাস ডিসমিস।
৩.
‘আপনি ভূত দেখেছেন কেন বলছেন? সোজা ভাষায় বলুন না, আসলে দেখেছেনটা কী?’
তৃতীয়বারের মতো কথাটা জিজ্ঞেস করলেন শরু মাস্টার, মানে শরদিন্দু দস্তিদার—স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক।
শিক্ষকদের কমনরুমের বড় টেবিলটায় চিত হয়ে শুয়ে ছিলেন ভূগোল শফিক। তাঁর মাথায় পানি ঢালা হচ্ছিল। শরদিন্দু স্যারের কথায় তিনি বিরক্ত হয়ে উঠে বসলেন। বললেন, সোজা ভাষাতেই তো বললাম, ভূত দেখেছি। ভূতটা ক্লাসরুমে ঢুকে হাত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল।
কমনরুমে আরও কয়েকজন শিক্ষক ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছেন। প্রধান শিক্ষক আলি আহমেদ পায়চারি করছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন, ভূত শেষে ক্লাসরুমেও হানা দিল! আর তো কিছু বাকি থাকল না।
অফিসের পিয়ন জয়দেব মগে করে পানি ঢালছিল ভূগোল শফিকের মাথায়। সে বলল, আমাগো শাপলা আসছিল কেলাসে। আহা রে মেয়েটা! খুব মায়া মায়া চেহারা।
শরদিন্দু: কোন শাপলা? ওই যে মাঘ মাসে নিউমোনিয়ায় মারা গেল যে?
ভূগোল শফিক চিঁ-চিঁ করে ওঠেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই শাপলাই। আমার দিকে কেমন করে তাকাল। আমি বোধ হয় বাঁচব না শরদিন্দু বাবু।
শরদিন্দু বলেন, শফিক সাহেব, হয় আপনি ভুল দেখেছেন, নতুবা ছেলেমেয়েরা আপনার সঙ্গে ফাজলামো করেছে।
আমি ভুল দেখিনি।
তাহলে ওরা আপনার সঙ্গে ফাজলামো করেছে।
হেডমাস্টার আলি আহমেদ সামনে এসে দাঁড়ান। বলেন, শফিকের সঙ্গে ফাজলামো করবে কেন?
শরদিন্দু একটু দ্বিধা করেন।
বলুন, শফিকের সঙ্গে স্টুডেন্টরা ফাজলামো করবে কেন?
ছেলেমেয়েরা মাঝেমধ্যে দুষ্টুমি করে। এটা নতুন কিছু না। আমার সঙ্গেও করেছে। আর, এটা তো সবাই স্বীকার করবেন, শফিক সাহেব আমাদের স্কুলের সবচেয়ে রাগী শিক্ষক। আমি বলছি না স্টুডেন্টরা তাঁকে অপছন্দ করে। তবে ওদের মধ্যে কেউ ফাজলামো করলে করতেও পারে।
ভূগোল শফিক অসহায় কণ্ঠে আর্তি করেন, ফাজলামো করেনি। হুবহু শাপলার মতো দেখতে। আমি ভুল দেখব নাকি?
শরদিন্দু একটু জেদি ভঙ্গিতে বলেন, দেখুন, শাপলার মতোই দেখতে ক্লাস ফোরে আরেকটা মেয়ে আছে। বাবুল মিয়ার মেয়ে রত্না। আপনি তাকে শাপলা ভেবে ভুল করতে পারেন।
ভূগোল শফিক উঠে দাঁড়ান। তাঁর শার্টে পানি গড়িয়ে পড়ছে। জয়দেব একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা ঢেকে দেয়, তারই মুছে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। শফিক স্যার তাকে সরিয়ে নিজে মাথা মুছতে থাকেন। বলেন, আপনি কী বলতে চান, শরদিন্দু বাবু?
শরদিন্দু: আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নাই। থাকতে পারে না।
হেডমাস্টার আলি আহমেদ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। আবার পায়চারি শুরু করে বলেন, কেন নাই? ভূত থাকতে কী অসুবিধা?
শরদিন্দু: অসুবিধা এটাই যে ভূত থাকলে বিজ্ঞান থাকে না। ভূত প্রকৃতির নিয়মের লঙ্ঘন। আর আপনারা জানেন, বিজ্ঞান আছে। ফলে ভূত নাই।
ভূগোল শফিক বিরক্ত কণ্ঠে বলেন, এই যে শুরু করে দিলেন ক্লাস লেকচার! শরদিন্দু বাবু, আপনার ওই এক ছটাক বিজ্ঞান তো আমিও জানি। ফিজিকস আমিও পড়েছি। কিন্তু নিজের চোখকে তো আমি অবিশ্বাস করতে পারি না।
তখন কোনায় দাঁড়ানো কামাল স্যারও বললেন, আমিও পারি না। আমি সেদিন পুলপাড়ে চন্দনকে দেখেছি।
ফরিদ স্যার বলেন, আকবরকে দেখলাম আমার সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে আর ঘ্যানঘ্যান করে বলছে, তার বউকে দেখে রাখতে। বিধবা বউটাকে নাকি দেখার কেউ নাই।
৪.
নদীর পাড় ধরে খিলখিল করে হাসতে হাসতে ছুটছে তিন বালক-বালিকা। এদের মধ্যে ক্লাসরুমের সেই মেয়েটিও আছে, যার মুখ ও হাত-পা অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে।
বালক-বালিকারা পানির ধারে এসে থামে। ফ্যাকাশে মুখের মেয়েটি বলে, তোর বুদ্ধিটা খুব কাজে লাগছে রে বাদল। ভূগোল শফিক স্যার দৌড়টা যে দিছে না।
বাদল: তোর অভিনয়ও ভালো হইছে রত্না। গলাটা তো ভূতের মতোই করছিলি। আরেকবার কর তো।
রত্না টেনে টেনে সুর করে বলে, আমাকে চিনতে পারলেন না স্যা...র? আমি শা...প...লা! হি-হি-হি!
সবাই হেসে কুটিকুটি হতে থাকে।
বাদল: নে কেউ দেখে ফেলার আগে পাউডার ধুয়ে ফেল।
মোটা ফজলু সবার বইখাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলে, আচ্ছা, এত পাউডার কই পাইলি?
রত্না নদীর জলে হাত-মুখ ধুতে ধুতে বলে, পাউডার না, পাগল। আটা। চাউলের আটা।
তিনজনেই খিলখিল করে হেসে ওঠে।
ফজলু: ভূগোল শফিক টের পাইলে বারোটা বাজাবে।
রত্না: আরে টের পাবে না। আগামী এক মাস স্যার স্কুলেই আসবে না দেখবি।
বাদল: চল উঠ। বাড়ি যাই। জায়গাটা খুব ফাঁকা ফাঁকা।
তিন বালক-বালিকা বাড়ির পথে পা বাড়ায়। তখন তারা দেখে সামনে একটা ফ্রক পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কেননা সে তাদের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।
ফজলুই প্রথম কথা বলে, এইটা কে রে? এতক্ষণ তো দেখি নাই।
বাদল বলে, আমাদের কথা শুনে ফেলেছে রে। সর্বনাশ। এই, তুই কে?
মেয়েটি কথা বলছে না, উল্টোমুখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ফিরে তাকাচ্ছে না।
রত্না ভয় পেয়ে বাদলের হাত খামচে ধরে।
বাদল: এই কে তুই? কথা বল।
সামনের মেয়েটা আস্তে আস্তে শুধু মাথাটা ঘোরায়। দেখা যায়, মেয়েটা হুবহু রত্নার মতোই দেখতে। তারও হাত-পা-মুখ সাদা, রক্তশূন্য। মেয়েটি কেমন টেনে টেনে কথা বলে, আমি শাপলা। আসল শাপলা। তোমরা আমার সঙ্গে খেলবা? নদীর পারে খুব একা একা লাগে।
৫.
রত্নার গায়ে কাঁথা টানা। কপালে পট্টি। তার গায়ে এক শ চার ডিগ্রি জ্বর এবং সে বিড়বিড় করে প্রলাপ বকছে।
তার মাথার কাছে বসে মা সুলতানা বেগম জলপট্টি বদলে দিচ্ছেন।
টেবিলের ওপর হারিকেন জ্বলছে।
রত্নার বাবা বাবুল মিয়া শার্ট পরছেন, বাইরে যাবেন।
সুলতানা একই কথা বিড়বিড় করে বলছেন, নদীর পারে কী যে দেখল মেয়েটা। তখন থেকে মেয়েটা আমার এমন করতেছে।
বাবুল মিয়া বিরক্ত কণ্ঠে বলেন, শরীরের তাপ কেমন?
তাপ কমতেছে না। সেন্টু ডাক্তার নিয়ে আসেন।
আচ্ছা দেখি।
বাবুল মিয়া বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসেন। তিনি কাদের চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে পা বাড়ান। চেয়ারম্যান সাহেব মিটিং ডেকেছেন। জরুরি। গণ্যমান্য সবাই থাকবেন। ওইখানে সেন্টু ডাক্তারকেও পাওয়া যাবে। মিটিং শেষে তাকে নিয়ে আসা যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি।
গজ দশেক সামনে আরেকটা লোক রাস্তায় হাঁটছে। অন্য সময় হলে বাবুল মিয়া সঙ্গ পেয়ে আশ্বস্ত হতেন। একত্রে যেতেন। আজ তিনি চট করে ডানে অন্য একটি রাস্তা ধরেন।
সবাই এখন সঙ্গ এড়াতে চায়।
৬.
কাদের চেয়ারম্যানের গলা ভারী, জলদগম্ভীর। তিনি বলেন, খুব জরুরি একটা ব্যাপারে আমি গ্রামের সবাইরে ডাকছি। সমস্যাটা এমন, কিছু কয়াও যায় না, সওয়াও যায় না। আপনারা সবাই জানেন, সমস্যাটা কী। জানেন না?
উঠানের দুপাশে দুটি বাঁশের খুঁটিতে হ্যাজাক জ্বালানো হয়েছে। মাটিতে মাদুর পাতা। তাতে গ্রামের সাধারণ লোকজন বসেছে। গণ্যমান্য যারা তাদের বসতে দেওয়া হয়েছে চেয়ার আর মোড়ায়।
সবার মাঝখানে হাতলঅলা একটা কাঠের চেয়ারে কাদের চেয়ারম্যান বসা। তিনি বলেন, আমাদের হেডমাস্টার আলি আহমেদ স্যার আপনাদের বিষয়টা বুঝায় বলবেন। বলেন স্যার, আপনি গণ্যমান্য ব্যক্তি। আপনি বলেন।
চেয়ারে বসা ছিলেন আলি আহমেদ স্যার। তিনি উঠে দাঁড়ান। গলা খাঁকারি দেন। তারপর একটু হাত কচলে শুদ্ধ ভাষায় শুরু করেন, বছর খানেক ধরে আমাদের আক্কেলপুর গ্রামে এমন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে, যেটার কথা আমি জীবনে কোনো দিন কোথাও শুনি নাই। রাতের বেলা এগুলার নাম নেওয়া ঠিক না। তবু প্রয়োজনের খাতিরে বলতে হচ্ছে। দেখেন, ভূত-প্রেত সব গ্রামেই কমবেশি আছে। এরা থাকবে। কিন্তু অন্য কোথাও ভূতের এ রকম উত্পাত নাই।
উপস্থিত লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।
কাদের চেয়ারম্যান ধমক দেন, আপনারা এত কথা বলতেছেন কেন? স্যারের কথা শোনেন।
গুঞ্জন থেমে যায়।
আলি আহমেদ আবার বলতে শুরু করেন, আমি লক্ষ করেছি, এই গ্রামে কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু বা অপমৃত্যু ঘটলেই সে ভূত হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর পরও সে গ্রামের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাছে উঠে বসে থাকছে।
ভূগোল শফিক পাশেই বসে ছিলেন। তিনি ফোড়ন কাটেন, এ রকম হতে থাকলে তো একদিন গ্রামে মানুষের চেয়ে ভূতের সংখ্যা বেশি হয়ে যাবে।
আবার একটা গুঞ্জন শুরু হতে যাচ্ছিল। চেয়ারম্যান সাহেব হাত তুলতেই সেটা থেমে যায়।
আলি স্যার বলে চলেন, কেন এ রকম হচ্ছে আমরা জানি না। কিন্তু হচ্ছে। এই যেমন আমাদের বসন্তবাবু, তিনি অকালে মরে গেলেন, কীভাবে যেন মারা গিয়েছিলেন...?
ভিড়ের মধ্যে একজন বলে ওঠে, গলায় শিং মাছের কাঁটা ফুটে।
আলি আহমেদ: হ্যাঁ। আমরা সবাই তাঁকে চিতায় তুললাম। দাহ হলো। কিন্তু তারপর থেকে বসন্তবাবুকে দেখেনি এ রকম লোক কম আছে। সারা গ্রামে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যাকে রাস্তায় পাচ্ছেন, তাকেই বলছেন, গলার কাঁটাটা খুলে দিতে। খুব নাকি খচখচ করে।
পাটকাঠির মতো শুকনো চেহারার মদন জোলা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যায়। বলে, আর রহমত শেখ। দুই বউয়ের মারামারি থামাইতে গিয়া সে যে বেকায়দা বঁটির কোপে মইরা গেল, তারে তো পুলপাড়ে দেখা যাইতেছে।
আরেকজন দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, কালু মিস্ত্রি। ডাব পাড়তে গিয়া সে পড়ল গাছ থেকে। তারেও তো দেখি আমি ওই গাছে বইসা থাকতে।
অপর একজন বলে, দিনের বেলাতেও।
ভূগোল শফিক আবার ফোড়ন কাটেন, এখন ভূতের ভিড়ে গ্রামে রাস্তায় হাঁটা দায়। ঠোকাঠুকি লাগে।
আবার গুঞ্জন। এবার গুঞ্জন সহজে থামছে না।
কাদের চেয়ারম্যান গলা চড়িয়ে বলেন, অথচ এই ভূত তাড়ানোর জন্য আমি কী করি নাই? আপনারা বলেন, কী করি নাই আমি? ওঝা দিয়া গ্রামের প্রতিটা বাড়ি বাইন্ধা দিছি। পীর সাহেবরে দিয়া প্রতিটি রাস্তার প্রতিটা গাছের গায়ে তাবিজ পরাইছি। কী হইছে? কিছু হয় নাই। আমি টিএনও সাহেবরে চিঠি লিখছি। থানায় দারোগা সাহেবরে গিয়া বলছি। বলছি, কিছু একটা করেন। পুলিশ কী করবে? ভূতের বিরুদ্ধে পুলিশ কী করবে? তবু ওসি আবদুল বাতেন আমার বন্ধু মানুষ। আমাকে বলছে, সামনের মাস থেকে গ্রামে একটা ফাঁড়ি বসাবে। আপাতত গ্রামে দুজন কনস্টেবল টহল দেবে। হবে? এতে কিছু হবে মনে করেন আপনারা?
গুঞ্জন।
কাদের চেয়ারম্যান গলা নামিয়ে বলেন, আমি আর কী করতে পারি, আপনারা পরামর্শ দেন।
শরদিন্দু মাস্টার এক কোনায় একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। এবার তিনি দাঁড়িয়ে যান। বলেন, এখানে আমি দুটো কথা বলতে চাই।
ভূগোল শফিক নিচু স্বরে গজগজ করে ওঠেন, এই যে লেকচার শুরু হবে এখন।
কাদের চেয়ারম্যান বলেন, শরদিন্দু বাবু বলবেন? কিন্তু আপনি তো ভাই ভূতেই বিশ্বাস করেন না। আপনি আর কী বলবেন?
শরদিন্দু বলনে, দেখুন, আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না, এটা ঠিক। কিন্তু আপনাদের সবার মতো আমিও স্বীকার করি, এ মুহূর্তে গ্রামে যেটা চলছে, সেটা একটা বড় সমস্যা। একটা ক্রাইসিস। ভয়ে মানুষ কাজে যেতে পারছে না। দোকানি দোকান খুলতে পারছে না। আজ স্কুলেও একটা হুলুস্থুল হয়েছে। কাল থেকে বাচ্চারা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে পারে। বাবুল মিয়ার মেয়েটা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। আমি মানি, গ্রামে এখন একটা বিরাট সংকট। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আপনারা সংকটের সঠিক কারণটা ধরতে পারছেন না। আর সে কারণেই সমাধানের উপায় পাচ্ছেন না।
ভূগোল শফিক পাশ থেকে বলেন, তা বলেন, আপনার কাছেই তো সব সমস্যার সমাধান আছে। বলেন সমাধানটা কী?
শরদিন্দু বলেন, আপনারা আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেন। এই আক্কেলপুর গ্রামেই কেন শুধু ভূত-প্রেতের উত্পাত? আশপাশে আরও তো অনেক গ্রাম আছে, সেগুলায় কোনো উত্পাত নেই কেন?
সভার সবাই এ-ওর দিকে তাকায়। একটা গুঞ্জন।
শরদিন্দু: আমি বলি। এর জন্য আমাদের এ এলাকার এমপি ফজলুল পাশা দায়ী।
আবার গুঞ্জন।
শরদিন্দু: কেন দায়ী? কারণ আশপাশে সব গ্রামে পল্লী বিদ্যুত্ এসেছে। একমাত্র আমাদের আক্কেলপুর গ্রামে নেই। যে গ্রামে কারেন্ট আছে, সেই গ্রামে ভূত থাকতে পারে না।
কাদের চেয়ারম্যান আঁতকে ওঠেন, আপনি তো রাজনৈতিক বক্তব্য দিতেছেন, শরদিন্দু বাবু।
শরদিন্দু: আমি সত্যি কথা বলছি।
কাদের চেয়ারম্যান: এই গ্রামে কারেন্ট ছিল কিন্তু একসময়।
শরদিন্দু: হ্যাঁ। ছিল। অনেকের বাড়িতে এখনো বিদ্যুতের তার আছে, সুইচ বোর্ড লাগানো আছে।
কাদের চেয়ারম্যান অসহায় গলায় বলেন, এক বছর আগে পল্লী বিদ্যুত্অলারা এখানে কারেন্ট কেটে দিছে। এখানে এমপি সাহেবের কী করার আছে?
শরদিন্দু: এমপি সাহেব এ কাজ করিয়েছেন। দেখেন, ফজলুল পাশা এমপি ইলেকশনে আশপাশের সব গ্রামে জিতেছে। শুধু এই গ্রামে জিততে পারে নাই। গ্রামবাসী তাঁকে ভোট দেয় নাই। এ জন্য এই গ্রামের লোকজনের ওপরে তাঁর ক্ষোভ।
সবার মধ্যে আবার গুঞ্জন। কাদের চেয়ারম্যান ধমকে ওঠেন, আপনারা সবাই চুপ করেন।
ভিড়ের একজন বলে ওঠে, শরু মাস্টার ঠিক কথা বলছে। কারেন্ট থাকলে ভূত নাই।
তখন ভিড়ের সামনের সারিতে বসা একজন নাকি সুরে বলে ওঠে, ঠিক কথা বলছে। ঠিক কথা।
হঠাত্ সবাই চুপ করে লোকটার দিকে তাকায়। এতক্ষণ লোকটা এখানে মাদুরে বসে ছিল, কেউ তেমন লক্ষটক্ষ করেনি। লোকটার চামড়া অস্বাভাবিক রকম ফ্যাকাশে-সাদা। চোখগুলোর নিচে কাজলের মতো কালি।
কাদের চেয়ারম্যান চেয়ারের ওপর পা তুলে বসে খেঁকিয়ে ওঠেন, এই! তুই কে রে?
লোকটা আবার নাকি সুরে বলে, আমি কালু মিস্ত্রি। ডাবগাছ থেকে যে পইড়া গেছিলাম। আমারে চিনতে পারতেছেন না চেয়ারম্যান সাব? একটু আগে তো বৈঠকে আমার কথাই আলাপ করা হইল।
কাদের চেয়ারম্যান: এই তুই এইখানেও আসছিস?
কালু মিস্ত্রি মিহি গলায় বলে, আমি একা না, চেয়ারম্যান সাব। আরও অনেকে আসছে। তাকায় দেখেন এইখানে ভিড়ের মধ্যে বইসা আছে...
হঠাত্ হুলুস্থুল পড়ে যায়। মানুষজনের কোলাহল। ছোটাছুটিতে হ্যাজাক দুটো মাটিতে আছড়ে পড়ে নিভে যায়। অন্ধকারে কার যেন ধাক্কায় চেয়ার থেকে পড়ে যান কাদের চেয়ারম্যান। কিছুটা পদদলিতও হতে হয় তাঁকে।
৭.
আজ একটু রাত করে খেতে বসলেন শরদিন্দু দস্তিদার। মেঝেতে মাদুর পেতে বসেছেন তিনি। পিয়ন জয়দেব ভাত বেড়ে দিচ্ছে। সে শরুবাবুর সঙ্গেই থাকে।
বেড়ার ঘর। বাইরের উঠানে চাঁদের আলো ঘরের ভেতর থেকেও দেখা যাচ্ছে। উঠানে একটা শিউলিগাছ।
শরদিন্দু বলেন, জয়দেব, তুইও খেয়ে নে আমার সঙ্গে।
জয়দেব: আমি পরে খাব, স্যার।
শরদিন্দু: আজ রান্না ভালো হয়েছে।
জয়দেব: থ্যাংক ইউ স্যার।
শরদিন্দু: বা-বা। ইংলিশ শিখেছিস। আচ্ছা, একটা প্রশ্নের জবাব দে দেখি। শহরে ভূত থাকে না কেন?
জয়দেব: শহরে ইলেকট্রিসিটি আছে, সে জন্য।
শরদিন্দু খুব সন্তুষ্ট হলেন, ঠিক বলেছিস। ব্যাপারটা আসলে ইলেকট্রিসিটির না, বুঝলি। ব্যাপারটা হচ্ছে অন্ধকারের। মানুষকে নানা রকম অন্ধকার ঘিরে থাকে। অজ্ঞানতার অন্ধকার, কুসংস্কারের অন্ধকার। এইগুলা দূর করতে পারলে ভূত-প্রেত থাকে না।
জয়দেব: ঠিক কথা স্যার।
শরদিন্দু খাওয়ায় মনোযোগ দেন। জয়দেবের কথা শুনে খাবারের স্বাদ আরও বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, আচ্ছা জয়দেব, তুই কি ভূত বিশ্বাস করিস?
জয়দেব: করি স্যার।
শরদিন্দু ডাল দিয়ে মেখে একটা বড় লোকমা মুখে তুলতে যাচ্ছিলেন। হাতটা থেমে গেল।
জয়দেব: করি না স্যার। একেবারে করি না।
শরদিন্দু বিরক্ত চোখে তাকান জয়দেবের দিকে।
৮.
খালের পাড়ে একটা শিমুলগাছের ছায়ায় বসে আছে আব্বাস। সামনে মাঠের মধ্যে গরু চরছে। একটু দূরে সাদেক বসা। সাদেক কাদের চেয়ারম্যানের ছেলে। ক্লাস এইটে পড়ে।
আব্বাস বলে, চেয়ারম্যান সাহেবের খবর কী রে?
—আব্বার পা মচকায় গেছে। ওই দিন যে হুড়াহুড়ি। হাতের ডানাও ভাঙছে।
—আহা বেচারা। তোর বাপজানকে দেখলে আমার খুব মায়া হয়, সাদেক।
—মায়া হয় কেন?
—তোর বাবা এই গ্রামের অধীশ্বর। সবাই এত দিন তাঁর ভয়ে তটস্থ ছিল। কিন্তু এখন ভূত-প্রেতের উত্পাত। সবাই এখন ভূতের ভয়ে অস্থির।
—তো?
—তাতে তোর বাবার স্ট্যাটাস পড়ে গেল না? ভূতেরও নিচে নেমে গেল স্ট্যাটাস। সেই দিন বক্তৃতা দেওয়ার সময় দেখলি না কেমন অসহায় গলা তাঁর।
—তোমার যতসব উল্টাপাল্টা কথা, আব্বাস ভাই।
—তুই কি ভূতে বিশ্বাস করিস সাদেক?
—করব না কেন?
—দ্যাখ, এইসব ভূত-টুত বলে কিছু নাই। খামোখা ভূতের ভয় পাস ক্যান?
—ভূত নাই, তাহলে রাস্তাঘাটে সবাই এইগুলা কী দেখতেছে?
—একে বলে হ্যালুসিনেশন। চোখের ভুল।
—শহরের কলেজে গিয়া দুই পাতা ইংরেজি পইড়া আসছ বলে তুমি খুব পণ্ডিত হয়ে গেছ আব্বাস ভাই। ভূত যেদিন ঘাড় মটকায় দিবে, সেই দিন টের পাবা।
—আমি শরদিন্দু স্যারের সঙ্গে একমত। পুরা গ্রামে একটাই মাত্র মুক্ত মনের মানুষ আছে। শোন, স্যারের সঙ্গে আমার কথা হইছে। স্যার পণ করছে, গ্রামের মানুষের ভূতের ভয় তাড়ায় ছাড়বে। স্যার জনে জনে বোঝানোর মিশন শুরু করবে। হাটে লেকচার ক্লাস দিবে। মানুষকে বিজ্ঞান বোঝাবে। এটাকে বলে ক্যাম্পেন। আমি তাকে এই কাজে সহায়তা করব। ভূত বলে যে কিছু নাই, আমরা দুইজনে গ্রামের মানুষকে বোঝায় ছাড়ব। তুই আমার সঙ্গে থাকিস। তোর মতো ছেলেদের নিয়ে একটা টিম করা দরকার।
৯.
আক্কেলপুরের এক কোনায় একটা ছোট্ট বাজার আছে, নাম বিন্নি বাজার। গড়ের পাশে অল্প কয়েকটা দোকান, সেটাই বাজার। সেখানে দুপুরবেলা একটা প্রায় পত্রশূন্য বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে শরদিন্দু দস্তিদার। তাঁর হাতে চক। সামনে সওদা করতে আসা গ্রাম্য লোকজন।
শরদিন্দু স্যারের পেছনে একটা ব্ল্যাকবোর্ড। তাতে চক দিয়ে লেখা, ‘ভূত বলে কিছু নাই’।
নিচে নানা রকম ডায়াগ্রাম, আর বিভিন্ন শব্দ এলোমেলো লেখা। যেমন: বল = ভর গুণন ত্বরণ; মাধ্যাকর্ষণ, পৃথিবী, চাঁদ, চন্দ্রগ্রহণ, কক্ষপথ, ইত্যাদি। শরদিন্দুর দুপাশে আব্বাস ও জয়দেব দাঁড়ানো। জয়দেবের হাতে ডাস্টার।
শরদিন্দু বলেন, উপস্থিত সুধী, এতক্ষণ আমি পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে প্রাথমিক ধারণাগুলো আপনাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম। আগামী পরশু আমি মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেব, তাহলে আপনারা বুঝতে পারবেন, মানুষ কেন ভুল দেখে। একটা জিনিস নাই, তারপরও কেমন করে আছে বলে মনে হয়...
খটখটে রোদে বটগাছের তলায় বসা নানা বয়সী লোকজন। বেশির ভাগই বয়োবৃদ্ধ। তোবড়ানো গালে তারা বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাচ্ছে। একটু পেছনে তন্দ্রায় ঢুলছিল মাছের দোকানদার আলতু। তার সাদা লুঙ্গিতে হঠাত্ পানের পিক পড়ে। কোথা থেকে এল এ পিক? আলতু অনুসন্ধানী চোখে আশপাশে তাকায়। তার চোখ যায় ওপর দিকে। ওপরে বটগাছের শুকনো ডালে একটা কেউ বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে। খালি গা ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য। চোখের নিচে কালি। পান খেয়ে লোকটা মুখ লাল করেছে। আলতুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে পান খাওয়া দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসে।
আলতু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, গাছের বিভিন্ন ডালে এ রকম আরও বহু শ্রোতা পা দুলিয়ে শরদিন্দু স্যারের লেকচার শুনছে
১০.
শরদিন্দু থমকে দাঁড়ান।
কে? কে ওখানে?
রাস্তার এক ধার থেকে উঠে আসে একটা যুবক। খালি গা, লুঙ্গি পরা।
শরদিন্দুর হাতে লণ্ঠন। সেটা তিনি উঁচু করে ধরেন।
কে তুমি?
আমি সুধাংশু।
তুমি এইখানে কী করো?
এই একটু হাওয়া খাইতে বাইর হইছি।
ভালো। হাওয়া খাও।
শরদিন্দু আবার হাঁটতে শুরু করেন। গ্রামের কাঁচা রাস্তা। দুপাশে ধানখেতে ঝিঁঝি ডাকছে। তার পাশে একটু দূরত্ব রেখে সুধাংশুও হাঁটছে।
সুধাংশু বলে, আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন আছে স্যার। আমিন, সদরুল, ফজলু।
শরদিন্দু এতক্ষণ খেয়াল করেননি। এবার বুঝলেন, দুপাশে অন্ধকারে আরও কয়েকজন তাকে অনুসরণ করছে। এরা তাকে একপ্রকার ঘিরে ধরে হাঁটছে।
শরদিন্দু হাঁটা থামান না। বলেন, তোমরা কি কিছু বলবা?
বলব।
বলে ফেলো।
সুধাংশু ইতস্তত করতে থাকে, আমরা স্যার আপনার ওপর খুব মাইন্ড করছি।
কেন? মাইন্ড করেছ কেন?
পাশ থেকে একজন বলে ওঠে, স্যার নাকি বলে বেড়াচ্ছেন আমরা আসলে নাই।
হ্যাঁ। গ্রামের লোকজনকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করছি, তোমাদের আসলে কোনো অস্তিত্ব নাই।
যুবকদের একজন বলে, আমরা যদি না থাকি স্যার, তাইলে এই মুহূর্তে আপনি কাদের সঙ্গে কথা বলতেছেন?
শরদিন্দু থামেন। কথাটা যে বলেছে তার দিকে তাকান। তারপর আবার হাঁটতে থাকেন। বলেন, তোমরা আমার মনের কল্পনা। হ্যালুসিনেশন।
বাঁ পাশ থেকে আরেকজন বলে, বুঝি নাই স্যার।
না বুঝলে পরশু বিন্নি বাজারে আসো। আমি ক্লাস নিচ্ছি। পরশু অপটিক্যাল ইলিউশন বিষয়ে লেকচার দেব। খুব সরলভাবে বুঝিয়ে দেব বিষয়গুলা। ভূত হলেও তোমাদের বুঝতে অসুবিধা হবে না।
সুধাংশু বলে, স্যার, জীবিতকালেই মাথায় গোবর ছিল। মরার পরে মনে করেন সেইগুলা শুকায় ঘুঁটে হয়ে গেছে। আমাদের আর কী বুঝাইবেন। আমারে আপনি নিজ হাতে শ্মশানে পুড়াইলেন, সদরুলরে মাটি দেওয়া হইল গ্রামের গোরস্থানে, এখন আমরা রাস্তার মধ্যে ঘুইরা বেড়াইতেছি, তারপরও স্যার বলতেছেন আমরা নাই। কী করলে আপনি স্যার নিশ্চিত হবেন, আমরা আছি?
পাশের যুবক বলে, বলেন স্যার, কোন পরীক্ষা দিতে হবে?
শরদিন্দু বলেন, আপাতত তোমরা আমার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাও। একেবারে হাওয়া।
সুধাংশু বলে, ঠিক আছে।
সবাই একযোগে হাওয়া হয়ে যায়।
অদৃশ্য অবস্থা থেকে সুধাংশুর কণ্ঠস্বর শোনা যেতে থাকে, এইবার কী বিশ্বাস করলেন স্যার?
শরদিন্দু হাঁটতে হাঁটতে বলেন, তোমরা পরশুর ক্লাসে এসো। খুব ইমপরটেন্ট।
১১.
বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেছে।
একদিন সন্ধ্যার আগে আগে ফাঁকা স্কুলের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেন শরদিন্দু দস্তিদার। পাশে একটা মোড়া টেনে বসেছে আব্বাস।
চুপচাপ সামনে স্কুলের মাঠের দিকে তাকিয়ে দুজনে। মাঠে ছেলেরা ধুলা উড়িয়ে বল খেলছে।
শিরীষগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কমলা রোদ এসে পড়েছে বারান্দায়।
শরদিন্দু মাস্টার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আব্বাস সেটা লক্ষ করে।
আপনার মন খারাপ, স্যার?
আমি বোধ হয় হেরে যাচ্ছি, আব্বাস।
হাল ছাড়বেন না স্যার। আমি আছি।
আমি মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও হাল ছাড়ব না। এমনকি মৃত্যুর পরেও না।
মুখ ফসকে মৃত্যুর কথা বলে ফেলায় একটু সচকিত হন শরদিন্দু মাস্টার।
বয়স হচ্ছে, এ জন্য মৃত্যুর কথা মুখে আসে, বুঝলা।
১২.
ওই দিনের পর শরদিন্দু দস্তিদারের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে। তিনি বিছানায় শুয়ে থাকেন। গলা পর্যন্ত কাঁথায় ঢাকা। শিয়রে আব্বাস বসে জলপট্টি দেয়। মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করে রিডিং নেয়।
একদিন রাতে থার্মোমিটারের পারদের দিকে তাকিয়ে আব্বাসের মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। এক শ ছয়। আব্বাস জয়দেবকে ডাকে, দ্রুত সেন্টু ডাক্তারকে ধরে আনতে বলে।
শরদিন্দু বলেন, ঝামেলা কোরো না, আব্বাস। আমার সময় হয়ে গেছে।
আব্বাস জয়দেবকে ধমক লাগায়, দাঁড়ায় আছিস ক্যান, গর্দভ। দৌড় দে।
জয়দেব অন্ধকারে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে সে টের পায়, আশপাশে আরও অনেকে ছুটছে। তারাও কি শরু মাস্টারকে বাঁচাতে উদ্গ্রীব?
সেন্টু ডাক্তারকে বাসায় পাওয়া গেল না। কামারপাড়ায় রোগী দেখতে গেছেন। সেখানে গিয়ে জানা গেল রইসুদ্দিনের হালের বলদের কী এক রোগ, সেখানে গেছেন। শেষে তাকে পাওয়া গেল জেলেপাড়ায়।
এক সাইকেলেই দুজনে ছুটল।
উঠানে লণ্ঠনের আলো জ্বলছে। বারান্দার একটা বেঞ্চে বসে আব্বাস। জয়দেব এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। বলে, ডাক্তার আনছি আব্বাস ভাই।
দরকার হবে না।
ভোররাতে শ্মশানে চিতা জ্বলল। আব্বাস কাজের ছেলে। জয়দেবও অনেক খাটাখাটুনি করেছে। শরদিন্দু বাবুর আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ নেই। ফলে তেমন ঝক্কি পোহাতে হলো না।
১৩.
বিকেলবেলা স্কুল প্রাঙ্গণে শোকসভা বসেছে। শামিয়ানা টাঙানো ছোট্ট মঞ্চে একটা টেবিলের ওপারে চেয়ার পেতে বসা স্কুলের সিনিয়র শিক্ষকেরা। কাদের চেয়ারম্যানও আছেন। তাঁর হাত ও পায়ের ব্যান্ডেজ গতকাল মাত্র খোলা হয়েছে। পেছনের ব্যানারে লেখা, ‘শরদিন্দু দস্তিদার স্মরণসভা’।
সামনে চেয়ার ও মাদুর পাতা। তাতে স্কুলের ছাত্রছাত্রী, গ্রামের লোকজন।
হেডমাস্টার আলি আহমেদ মাইক্রোফোনে বক্তব্য দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘শরদিন্দু দস্তিদার আমাদের সবার মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন এই গ্রামের উন্নতি। তাঁর মতো পণ্ডিত ব্যক্তি আমি আর দেখিনি। আমাদের দুর্ভাগ্য, জীবদ্দশায় আমরা তাঁর পূর্ণ সমাদর করতে পারি নাই। তিনি আমাদের মধ্যে থেকে ভূতের ভয় দূর করতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে...’
শোকসভার সবাই এত নিবিষ্টমনে বক্তব্য শুনছে যে তারা লক্ষই করল না একটা লোক একটু দেরি করে শোকসভায় যোগ দিতে আসছে। যতীনদের উঠান ডিঙিয়ে, সিদ্দিকদের পুকুরপাড় আর স্কুলের খেলার মাঠের মাঝ বরাবর ধীর পায়ে আসছে লোকটা। দেরি হয়েছে, তবু কোনো তাড়া নেই লোকটার। সভার খুব কাছে এসে পড়লে দু-একজন এবার তাকে দেখতে পেল।
লোকটা একেবারে মঞ্চে উঠে যায়, আলি আহমেদ স্যারের সামনে গিয়ে থামে। আলি স্যার বক্তব্য দিচ্ছিলেন। সেটা থামিয়ে লোকটার দিকে তাকান। ভয়ার্ত চোখ তার। লোকটা বলল, স্যার, আমি কিছু বলতে চাই।
হেডমাস্টার সরে দাঁড়ান। লোকটা মাইক্রোফোন হাতে নেয়। বক্তৃতা শুরু করে।
লোকটা বলে, প্রিয় গ্রামবাসী...আপনাদের সবাইকে শুভেচ্ছা। একজন মানুষের জীবনে অনেক রকম লক্ষ্য থাকে। আমার লক্ষ্য ছিল কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করে মানুষকে আলোকিত করা। জীবিত অবস্থায় আমি সেটা পারিনি। তবে আমি হাল ছাড়িনি। মৃত্যুর পর এখন অনেক শারীরিক সীমাবদ্ধতা থেকে আমি মুক্ত। এখন আমি, শরদিন্দু দস্তিদার, নতুন উদ্যমে আমার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার চেষ্টা করব। ভূত বলে যে কিছু নেই, সেটা আমি আপনাদের বুঝিয়েই ছাড়ব...
চারদিকে হট্টগোল। হুটোপুটি।
একটা কারও ধাক্কায় মঞ্চে কাঠের চেয়ার থেকে উল্টে পড়ে যান কাদের চেয়ারম্যান। গতকালই তাঁর প্লাস্টার কাটা হয়েছে।
অলংকরণ: তুলি