ভূতের কবলে হুমায়ূন আহমেদ

অলংকরণ: আসিফুর রহমান

ট্রেনের প্রথম শ্রেণির সংকীর্ণ কামরায় আমি ছাড়া আর যে একটিমাত্র লোক উঠেছেন, তাঁকে শুরু থেকে চেনা চেনা লাগছিল। ট্রেন ঘোড়াশাল পেরোনোর আগেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম।

কিছু মনে করবেন না, আপনি কি হুমায়ূন আহমেদ?

ভদ্রলোক মাথা নাড়েন।

মানে লেখক হুমায়ূন আহমেদ?

ভদ্রলোক লাজুক হেসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। কী যেন চিন্তা করেন। তারপর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে মুখ গম্ভীর করে বলেন, দেখুন, আমি হুমায়ূন আহমেদ বটে, কিন্তু তাই বলে আপনি আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেবেন না, প্লিজ। নিজের লেখালেখি নিয়ে কথা বলতে আমার ততটা ভালো লাগে না। আমি পাঠকদের এড়িয়ে চলি। তা ছাড়া আমি একটা জিনিস নিয়ে ভাবব বলে ঠিক করে রেখেছি। সে জন্য আমার একটু নির্জনতা দরকার। কিছু যদি মনে না করেন, আমি আমার বার্থে শুয়ে পড়ব। ঘুমিয়েও পড়তে পারি।

আমি বিব্রত ভঙ্গিতে ‘অবশ্যই, অবশ্যই’ বলে মুখের সামনে রিডার্স ডাইজেস্টটা মেলে ধরলাম।

ভদ্রলোক নিজের বার্থে শুয়ে পড়ে গায়ের ওপর কম্বল টেনে দিলেন। চশমা খুলে পাশের টেবিলে রেখে চোখের পাতা বুজলেন।

আমি ম্যাগাজিনের পাতায় ডুবে গিয়ে নিজের অপ্রস্তুত ভাব কাটানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছি। বড় লেখকেরা সাধারণত খেয়ালি আর আত্মকেন্দ্রিক হন বলে শুনেছি। অনেকের সৌজন্যবোধেও কিছুটা ঘাটতি থাকে। ইনিও যে ভীষণ খেয়ালি, সে তো স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি।

অনেকটা সময় চোখ বুজে থাকার পর ভদ্রলোক কম্বল সরিয়ে উঠে বসলেন। আমার দিকে তাকালেন। আমি না দেখার ভান করে ম্যাগাজিন পড়তে থাকলাম।

চা খাবেন? আমার ফ্লাস্কে চা আছে, বললেন লেখক।

আমি চা খাই না।

তিনি উঠে সাইড টেবিলে রাখা ফ্লাস্ক থেকে গরম পানি মগে ঢেলে তার মধ্যে একটা টি-ব্যাগ ডুবিয়ে মগ আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন, নিন চা নিন। সিলন টি। আর্ল গ্রে ফ্লেভার।

আমি তো চা খাই না।

আমার হিসাব বলছে, আপনি চা খান। আপনার ব্যাকপ্যাকের কোনা দিয়ে ইস্পাহানির একটা হলুদ প্যাকেট উঁকি দিচ্ছে। নিন। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আমার আসলে ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। হয়েছে কী, একটা গল্পের প্লট কেবল মাথায় উঁকি দিচ্ছিল। সেটা একটু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম মাথার মধ্যে। একটা পর্যায় পর্যন্ত প্লটটা গুছিয়ে না নিলে হারিয়ে যায়। এ রকম সময় আমি একটু স্বার্থপরের মতো আচরণ করি। আর তা ছাড়া লেখকেরা চরিত্রগতভাবেই ভীষণ স্বার্থপর, সেটা জানেন তো?

আমি মগটা নিয়ে কিছু না বলে চুমুক দিতে লাগলাম। চোখ এখনো ম্যাগাজিনের পাতায়।

তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, আপনি কি আমার লেখা পড়েছেন?

না পড়িনি।

ভদ্রলোক এবার ফিক করে হেসে ফেললেন, আপনি দারুণ অভিমানী টাইপ দেখছি।

অভিমানী কেন ভাবছেন? একজন লেখকের লেখা বাংলাদেশের সবাইকে পড়তে হবে, এমনটা প্রত্যাশা করা একটু বাড়াবাড়ি নয় কি?

না, তা তো বটেই। কিন্তু আমার লেখা না পড়লে আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?

আপনার একটা সাক্ষাত্কার পড়েছি কী একটা ম্যাগাজিনে। সেখানে আপনার ছবি ছিল।

ও। বিচিত্রায়। গত পরশু বেরিয়েছে। কিন্তু আমার কোনো লেখা আপনি সত্যি পড়েননি বলছেন?

সত্যি পড়িনি। দেখুন, গল্প-উপন্যাস আমার ঠিক পড়াটড়া হয়ে ওঠে না। আর বিশেষ করে সেটা যদি হয়...কী বলা যায়...পপুলার ঘরানাটা আমার ঠিক... 

ও, আচ্ছা, তা বটে, তা বটে।

এবার লেখকের বিব্রত হওয়ার পালা। সেটা তিনি খুব একটা লুকাতে পারছেন বলে মনে হলো না। তিনি আবার কম্বল টেনে শুয়ে পড়লেন।

আমি কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে ছুটন্ত মাঠঘাটের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর তাকালাম লেখকের দিকে।

কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

পারেন।

বিচিত্রার ওই সাক্ষাত্কারে আপনি যা বলছেন, তার একটা জায়গায় আমার একটু খটকা লেগেছে।

কোন জায়গাটা?

আপনি বলেছেন, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন না।

না করি না।

কিন্তু ওইখানে আপনার পরিচিতিতে বলা হয়েছে, আপনি প্রচুর ভূত-প্রেতের গল্প লিখেছেন। এমনকি আপনাকে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সফল ভূতের গল্পের লেখক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে ওখানে।

ভূত-প্রেতের গল্প লিখতে হলে ওগুলোয় বিশ্বাস করতে হয় নাকি?

না, তা হয় না। কিন্তু ওইখানে আপনি একটা কথা খুব জোর দিয়ে বলেছেন দেখলাম। আপনি বলেছেন, যুক্তির বাইরে আপনি কোনো কিছু মানতে রাজি নন। বিজ্ঞানের নিয়মের বাইরে জগতে কিছুই ঘটে না।

হুম বলেছি।

আমার মনে হয়েছে, কথাটা আপনি মন থেকে বলেননি।

কেন বলুন তো?

কারণ, সাক্ষাত্কারেরই বিভিন্ন জায়গায় আপনি এমন সব মন্তব্য করেছেন, খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে মনে হতে পারে, প্রকৃতিজগতে যুক্তির একচ্ছত্র আধিপত্য মানতে আপনি রাজি নন। যুক্তির বাইরেও কিছু ব্যাপার থাকে বলে আপনি বিশ্বাস করেন। কথাগুলো নানান প্রসঙ্গে ছেঁড়াছেঁড়াভাবে বলা। কিন্তু মুখ ফসকে পরোক্ষভাবে আপনি সেগুলো বলেই ফেলেছেন। এটা একধরনের স্ববিরোধিতা।

মানুষ তো এ রকম স্ববিরোধীই।

তাহলে আপনি বলছেন, যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, এমন কিছুর মুখোমুখি আপনি জীবনে কখনো হননি?

না হইনি।

উঁহু, তা হয় না। হওয়ার কথা না। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এ রকম কিছু না কিছু ব্যাপার থাকে, কোনো না কোনো অভিজ্ঞতা থাকে, যেগুলো আমাদের চর্মচক্ষে দেখা জগতের বাইরে আরও কিছু জগতের উপস্থিতি জানান দেয়।

আমি একটু জোর দিয়েই বললাম কথাটা। তাতে লেখক কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছু না বলে পাশ ফিরে শুলেন।

বাইরে সন্ধ্যা নামছে। আমিও এলিয়ে পড়ে কম্বল টেনে নিলাম। মোবাইল ফোন খুলে টুইটার ঘাঁটতে লাগলাম।

একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল, লেখকের কথায় সেটার জাল ছিঁড়ে গেল।

কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন।

দেখি লেখক নিজের আসনে কম্বল মুড়ি দিয়ে পদ্মাসনে বসে পড়েছেন।

কোন কথাটা?

ওই যে বললেন না, প্রত্যেকের জীবনে কিছু বিশেষ ঘটনা থাকে। কথাটা ঠিক। আমার জীবনেও এ রকম একটা ব্যাপার ঘটেছে। আমি এ যাবত্ সেটা কাউকে বলিনি। কেননা আমার ধারণা, এটার কোনো ব্যাখ্যা কোথাও লুকিয়ে আছে। আমি ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারছি না বটে, কিন্তু কোনো না কোনো ব্যাখ্যা আছে, থাকতেই হবে।

আমি উঠে বসলাম। বুঝলাম, এবার মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকা নিতে হবে।

আপনি বলবেন ঘটনাটা?

আপনি শুনবেন?

শুনব।

লেখক বলতে শুরু করলেন। লক্ষ করলাম, যে লোক গল্প লিখে এমন সর্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, তিনি মুখে মুখে গল্প বলার ক্ষেত্রে ভীষণ অপটু। গুছিয়ে-জমিয়ে বলা বলতে যেটা বোঝায়, সেটা তিনি করতে পারেন না। তবে কম্বল মুড়ি দিয়ে পা দুলিয়ে দুলিয়ে তিনি যে ভঙ্গিতে গল্পটা বলছিলেন, সেই ভঙ্গিটা আমার ভীষণ চেনা। বারবাড়ির বাংলোঘরে মাচার মধ্যে বসে মুড়ির জামবাটিতে হাত চালাতে চালাতে বহু সন্ধ্যারাতে গ্রামের আড্ডাবাজ লোকেদের এভাবেই গল্প বলতে শুনে এসেছি আমি। এ হলো বাংলার চিরায়ত গল্পকথকের ভঙ্গি।

এটাকে ভূত দেখা বলতে পারেন আপনি, লেখক বলেন। কিংবা বলতে পারেন, প্রেতের অভিজ্ঞতা। দুটোর মধ্যে যে কিছুটা তফাত আছে, বুজুর্গ লোকেরা সেটা বোঝেন। ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার পর আমার মধ্যে একধরনের ভবঘুরে ভাব জেগে উঠেছিল। হোস্টেলে সহপাঠীরা দেশের নানান আনাচে-কানাচে থেকে আসা। তাদের একেক জনের বাড়ি বেড়াতে যাই। একদিন, দুদিন থাকি। তারপর আবার বেরিয়ে পড়ি। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন আদিপুকুর নামের একটা জায়গায় পৌঁছালাম। দক্ষিণাঞ্চলের চুলের মতো ছড়িয়ে থাকা অজস্র নদ-নদীর একটার পাড়ে ক্ষুদ্র একটা মফস্বল টাউন। কয়েকটা দোকানপাট। একটা পোস্ট অফিস। একটা পুলিশ ফাঁড়ি। আর টাউনের এক প্রান্তে নদীর ধারে একটা শ্মশানঘাট। এই শহরে আমার বন্ধু শফিকের বাসা। গিয়ে দেখি, ওদের বাসায় কেউ নেই। বরযাত্রী হয়ে পুরো বাড়ি দূরে কোথায় যেন বিয়ে খেতে গেছে। বাসায় আত্মীয়গোছের এক মাঝবয়সী লোক পাহারায় আছেন বটে, কিন্তু আগাপাছতলা সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। শফিকের বন্ধু পরিচয় দেওয়ার পরও তিনি আমাকে থাকতে দিতে রাজি হলেন না। ভীষণ বিপদে পড়ে গেলাম। একে তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তার ওপর আবহাওয়া সুবিধার না। জোরে বাতাস দিচ্ছে। ঝড় আসবে। শুনেছি, আগের রাতেও এখানে ভীষণ ঝড়ঝাপ্টা বয়ে গেছে।

আশ্রয়ের সন্ধানে বাজারে ঘুরছি। ছোট্ট গঞ্জের বাজার। একটাই রাস্তা। তার দুই পাশে কিছু কাঁচা দোকানপাট। কোনোটার টিনের চাল, কোনোটা খড়ের ঝুপড়ি। এ রকমই একটা চা-বিস্কুটের দোকানে ঠাঁই জুটল। দোকানের ভেতরে দুটো বেঞ্চ পাতা। একটায় দোকানি নিজে শোন। আরেকটায় আমার থাকার ব্যবস্থা। দোকানদারের নাম বলরাম বসাক। মাঝবয়সী। আমি ঢাকা থেকে এসেছি জেনে তিনি কেবল যে দোকানে থাকতে দিতে রাজি হলেন তা-ই না, রাতে আমার খাবারও বন্দোবস্ত করে দিলেন। রাত আটটার মধ্যে দোকান বন্ধ। আমরা দুজন দুই বেঞ্চে শুয়ে পড়লাম। এটা-সেটা নানান গল্প। জানলাম, বলরাম একসময় সন্ন্যাসব্রত নিয়েছিলেন। গেরুয়া বসনে কমণ্ডলু হাতে গোটা উপমহাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। নানান সাধুর আস্তানায় তন্ত্র সাধনাও করেছেন। গল্প শুনতে শুনতে তন্দ্রার মতোন এসেছিল। তখন দুজন লোক এসে বাইরে ডেকে নিয়ে গেল বলরামকে। দোকানের বাইরে অন্ধকারে লোক দুজনের সঙ্গে নিচু স্বরে কিছুক্ষণ কথা বললেন বলরাম। তারপর ভেতরে এসে জানালেন, তিনি দুঃখিত। রাতটা আমাকে দোকানঘরে একাই কাটাতে হবে। কারণ, তিনি রাত কাটাবেন শ্মশানে। শ্মশানে কেন? একটা লাশ পাহারা দিতে। পাশের গ্রামে দীনুকাকার ছোট ছেলে শিপন মল্লিক ওই দিনই দুপুরবেলা ঝড়বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে মারা গেছে। মাঠে গরু চরাচ্ছিল। কড়াত্ করে বাজ পড়ে। একটা গরুও মরেছে সেই বাজে। শ্মশানে চিতা প্রস্তুত। চিতার ওপর লাশও রাখা। তবে কী এক তিথিলগ্নের ফেরে দাহ হবে ভোরবেলা। এই পুরো সময়টা লাশ পাহারা দিয়ে রাখতে হবে।

লাশ পাহারা দেওয়ার পেছনে আরেকটা গূঢ় কারণ আছে। লাশ চুরি হওয়ার ভয় আছে। এই লাশ বজ্রপাতে মারা যাওয়া বালকের। লোকমুখে চালু ধারণা হলো বজ্রপাতে মৃতের শরীর চুম্বকে পরিণত হয়। এই শরীর তখন সোনার চেয়েও দামি। ফলে লোকে লাশ চুরি করে নিয়ে যায়। কথাটা আমি আগেও শুনেছি। তবে এত দিন সেটা গুজব বলেই জানতাম। লোকে যে এটা সিরিয়াসলি নেয়, মানে লাশ চুরির ব্যাপারটা যে একটা বাস্তব সংকট, এটা জানা ছিল না। বললাম, আমিও যাব।

আপনে যাইবেন মানে?

মানে আমিও লাশ পাহারা দেব।

না, আপনে যাইবেন না। এই শ্মশানের দুর্নাম আছে। বিপদ হইতে পারে।

আমি সদ্যকৈশোর পেরোনো তরুণ। বলরাম আমাকে নিবৃত্ত করতে পারলেন না।

শ্মশানের একধারে একটা ভাঙা কালীমন্দিরের বারান্দায় আমরা দুজন বসা। কাছেই একটা উন্মুক্ত স্থানে চিতাকাঠ। তার ওপর সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশটা হালকা জ্যোত্স্নায় আবছা দেখা যাচ্ছে। বলরাম তাঁর গল্পের ঝুলি খুলেছেন। তন্ত্রসাধনার গল্প। কীভাবে মৃতের শরীরে প্রাণসঞ্চার ঘটানো যায়, তারই গূঢ় বিদ্যার গল্প। নিতান্ত গাঁজাখুরি কাহিনি। কিন্তু যে পরিবেশে যে পরিস্থিতিতে সেগুলো শুনছিলাম, তাতে সবই সম্ভব মনে হচ্ছিল।

গল্প শুনতে শুনতে দেখি জ্যোত্স্নার আলো নিভে গেল। আকাশে ঘন মেঘ করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি। সেই সঙ্গে ঝড়। এ রকম ঝড়ের তাণ্ডব আমি কোনো দিন দেখিনি। উড়িয়ে নিয়ে যাবে মনে হলো। পাশেই একটা জঙ্গল মতোন জায়গা। সেগুলোর গাছপালা নুয়ে পড়ছে মাটিতে। এই প্রলয়কাণ্ডের মধ্যেও আমি একমনে তাকিয়ে আছি চিতার দিকে। বিদ্যুত্ চমকালে এক একবার আলোকিত হয়ে উঠছে চিতা। সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশের শরীর দেখা যাচ্ছে। পাশে বিড়বিড় করে কী যেন মন্ত্র পড়ছেন বলরাম। মাঝে মাঝে হুংকার দিয়ে উঠছেন। খুবই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।

এই সময় একটা ঘটনা ঘটল। সেটা এমন এক ঘটনা, যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। শ্মশানের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যতই গা ছমছম করুক, আমার বোধবুদ্ধি লোপ পায়নি। ফলে যা দেখেছি, সেটা যে চোখে দেখার ভুল না, এটা হলপ করে বলতে পারি।

অলংকরণ: আসিফুর রহমান

দেখি আকাশ কাঁপিয়ে কড়াত্ করে একটা বজ্রপাত হলো। আর সেই বজ্র সোজা এসে পড়ল চিতার ওপর। শুধু চিতার ওপর না, চিতায় শোয়া লাশের ওপর। দপ করে আগুন ধরে গেল কাপড়ে। তারপর যা দেখলাম, এটার বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। দেখি পুরো চিতা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। আর তার মধ্যে একটা মনুষ্য শরীর ধীরে ধীরে উঠে বসছে। ধীর আলস্যে সেটা চিতা থেকে নেমে গেল। নেমে হেঁটে হেঁটে সেটা ঢুকে গেল বনের মধ্যে।

এই দৃশ্য আমি দেখেছি। বলরাম দেখেছেন কি না আমি জানি না। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করিনি। লোকে জেনেছে, মাঝরাতে প্রকৃতিই মৃতের অন্ত্যেষ্টি সম্পাদন করেছে।

এটুকু বলে লেখক থামলেন। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

আমি বললাম, আপনি বলতে চান এক শরীরে দুবার বজ্রপাত? প্রথম বজ্রপাতে যদি মৃত্যু ঘটে, সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বজ্রপাতে কী হবে?

আমার কোনো ধারণা নেই।

বলরাম তন্ত্রসাধক ছিলেন বলছেন। তার মন্ত্রের কোনো ব্যাপার থাকতে পারে?

আমি সেটা বলব না। আমি শুধু যেটুকু দেখেছি, সেটুকু বললাম।

আমরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। দুমদুম শব্দে একটা ব্রিজ পার হলো ট্রেনটা।

ছেলেটার বয়স কত ছিল?

কোন ছেলেটার?

শিপন মল্লিক।

ক্লাস ফোর কি ফাইভের বালক হবে।

আমরা আরও কিছুক্ষণ এ নিয়ে কথা বলতাম হয়তো, কিন্তু চেকার এসে টিকিট দেখে গেল। এরপর অ্যাটেনডেন্ট এসে জানতে চাইল আমরা রাতের খাবারের অর্ডার দেব কি না। গল্পে ছেদ পড়ে গেল এবং এই প্রসঙ্গটা আর ফিরে এল না। আমরা আরও নানা বিষয় নিয়ে কথা বললাম।

ভোরবেলা ট্রেন মোহনগঞ্জ স্টেশনে এসে থামল। ভদ্রলোক আগেই দেখি ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে রেখেছেন।

আপনি কি এখানেই নামবেন?

হ্যাঁ।

কোনো সংবর্ধনা অনুষ্ঠান?

না। এখানে নেমে ধুন্দুলপাড়া নামের একটা অজ পাড়াগাঁয়ে যাব। সেখানে একটা শ্মশানে কালু নামের এক সন্ন্যাসী শুনলাম ডেরা পেতেছেন। কিছু অলৌকিক ক্ষমতাটমতা নাকি আছে। আর শুনেছি, তাঁর শরীর থেকে কাঁঠালচাঁপা ফুলের গন্ধ বের হয়। কালুর কথা ভাবতে ভাবতেই গতকাল একটা গল্পের প্লট মাথায় এসেছে। গল্পের নাম দিয়েছি ‘জ্বিন কফিল’।

বেশ নাম। আপনি কি এভাবেই শ্মশানে শ্মশানে সন্ন্যাসী খুঁজে বেড়ান?

ভদ্রলোক কোনো জবাব দিলেন না। তাঁর মধ্যে আবার লেখকসুলভ উন্নাসিকতা জেগে উঠছে। ট্রেন স্টেশনে থামলে আমি সম্মান দেখিয়ে তাঁর স্যুটকেসটা হাতে তুলে নিলাম। তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। তিনি প্ল্যাটফর্মে নামলে আমি নেমে এগিয়ে দিলাম স্যুটকেস। আমার শার্টের হাতা অর্ধেক গোটানো। হাত থেকে স্যুটকেসটা নেওয়ার সময় ভদ্রলোক চমকে গেলেন।

আপনার হাত পুড়ে গিয়েছিল নাকি?

পুরো শরীর পুড়ে গিয়েছিল।

কীভাবে?

বজ্রপাতে।

ভদ্রলোক এবার ভালো করে আমার দিকে তাকালেন।

এতক্ষণ একসঙ্গে কাটালাম। আপনার নামটা তো জানা হলো না।

আমার নাম শিপন মল্লিক। এটা নিছক একটা কোইনসিডেন্স। অন্য কিছু ভাববেন না প্লিজ।

হুইসেল দিয়ে দিয়েছে। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। আমি টুপ করে উঠে পড়লাম।

‘জ্বিন কফিল’ লেখা হলে গল্পটা আমি পড়ব। ভূতের গল্প আমার প্রিয় না হলেও পড়ব। দেখা হবে। ভালো থাকবেন।

(কিশোর আলো নভেম্বর ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত)