ভয়ংকর ভূতের গল্প

অলংকরণ: নাবিদুর রহমান

ভূতটা আমার কাছে এসে বলল, ‘স্যার, এবার আপনাকে ভয় দেখাতে চাই। প্লিজ একটু দেখবেন?’

ভয় জিনিসটা ঠিক দেখার না। ওটা অনুভবের। ভয় আমরা দেখি না, ভয় পাই। কিন্তু এই একটা জিনিস কেউ কেউ আমাদের দেখায়, দেয় না। আর আমরাও নিই না, তবু পাই।

ভূতটা বলতে পারত, প্লিজ, একটু ভয় পাবেন? না বলে বলল, দেখবেন!

আমি একবার দেয়ালঘড়িটা দেখলাম। একবার তাকালাম ল্যাপটপের স্ক্রিনে। তারপর ভূতটার দিকে।

হাতে খুব তাড়া। কিশোর আলোর জন্য একটা লেখা লিখছি। মানুষ কী করে মঙ্গলে বসতি গড়বে, এর একটা প্ল্যান দিয়েছে নাসা। খাসা প্ল্যান। সেসব নিয়ে কি-বোর্ড গুঁতোচ্ছি। আর কাউকে না পেয়ে এই লেখা আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে কিশোর আলোর সম্পাদক।

আমি লোকটা মোটেও বিজ্ঞানের না; বরং বিজ্ঞানের নাম শুনলে অজ্ঞান হয়ে যাই।

দুই বছর আগে আমার অপারেশনের সময় অ্যানেসথেসিয়ার বদলে ক্লাস নাইন-টেনের পদার্থবিজ্ঞান বইটার ঘ্রাণ শোঁকানো হয়েছিল আমাকে। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ঠুস—অজ্ঞান।

তার ওপর নাসার লেখাটা ইংরেজিতে। ইংরেজিতেও আমি ভীষণ WEEK। মাথার চুল ছিঁড়ছি, আজকেই লেখাটা দিতে হবে।

এমন সময় যদি একটা ভূত এসে ভয় দেখাবে বলে আবদার জুড়ে দেয়, বিরক্ত হওয়া ছাড়া উপায় কী!

কিন্তু আমি আবার সহজে ‘না’ বলতে পারি না। ভদ্রতা বলে একটা ব্যাপার আছে। বললাম, ‘আচ্ছা দেখাও।’

এত সহজে রাজি হয়ে যাব, ভূতটা হয়তো ভাবেনি। ব্যাগের চেনটা লাগিয়ে দিল। ওদের ব্যাগে চেন লাগালেই ব্যাগের মুখ খোলে। কী একটা যন্ত্রমতোন বের করল। মোবাইল নাকি? এত যন্ত্রের যন্ত্রণা ভূতরাজ্যেও গিয়ে ঠেকেছে দেখছি!

যন্ত্রটা রাখল টেবিলে, আমার ল্যাপটপের পাশে। যন্ত্রটার গায়ে বড় করে লেখা BHOY।

আমি হাই তুললাম। এই কি তবে ‘ভয়’? এতক্ষণে বুঝলাম, কেন ভয় ‘দেখানো’র কথা বলছিল। মনে হলো, এক্ষুনি সে যন্ত্রটার গুণাগুণ প্রচার করতে শুরু করবে। শেষে বলবে, হ্যাঁ ভাই, ৩০০ টাকার একটি ‘ভয়’ পাচ্ছেন মাত্র ১০০ টাকায়। শুধু কোম্পানির প্রচারের জন্য। সঙ্গে ছয় মাসের গ্যারান্টি আছে।

আমি ‘ভয়’ দেখলাম। আমার কাজ তাহলে শেষ। লেখাটার মাঝপথে আছি। নাসার মূল লেখাটায় নিজের নাসা, মানে নাক ডুবিয়ে দিলাম।

স্টিফেন হকিং বলে এক বিজ্ঞানী কী সব থিওরি কপচেছে, বুঝতে পারছি না। আমি আগে ভেবেছিলাম হকিং বোধ হয় কোনো হকি খেলোয়াড়ের নাম। এখন তো দেখছি এই ব্যাটা কসমোলজি-টজি নিয়ে বিশাল কেচ্ছা ফেঁদে বসেছে। মানুষের হাতে আর সময় নেই। ১০০ বছরের মধ্যে মানুষকে অন্য গ্রহে উপনিবেশ গড়তেই হবে।

ভূতটা পাশে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে তখনো। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম (যদিও প্রমাদ ঠিক কীভাবে গোনে আমি জানি না। আমি অঙ্কেও সুবিধার না)।

ভূতদের হাসি মুখ মানে ওদের মন ভীষণ খারাপ। আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল দেখছি।

বললাম, ‘কী, আর কিছু বলবে?’ যাক, এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখ ভার হয়ে গেল। তার মানে খুশি হয়েছে। কারও মনে কষ্ট দিতে নেই। ভূতদের তো আরও নয়। ভূতসংঘের ভূতনেস্কো এ বছর ভয় পাওয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা করেছে। ভূত আর ভূতের ভয় আজ পান্ডার চেয়েও বিপন্ন।

আমার কথা শোনার পর কাজ আরম্ভ করে দিল ভূতটা। টেবিলে রাখা যন্ত্রটার সঙ্গে নানা রকম তার জুড়তে শুরু করল। বিভিন্ন পোর্টে হেডফোনের জ্যাকপিনের মতো দাঁতওয়ালা কীসব ঢোকাচ্ছে।

মাঝে ভূতটাকে একটু নির্ভার মনে হলো। মানে এখন সে চিন্তিত। সামনে একটা ম্যানুয়াল বই। তাতে হিজিবিজি কী সব লেখা। মনে হয় বুঝতে পারছে না, কোন তারটা কোথায় লাগাবে। আমার সন্দেহ হতে থাকল, এই যন্ত্র সেট করতে করতেই সে রাত পার করে দেবে। আমি লেখাটা শেষ করব কখন!

ভূতটাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলাম। এতক্ষণে যন্ত্রটার নামের মাজেজা বোঝা গেল। ম্যানুয়াল বইয়ে লেখা Biggest Horror Optimization Yelding।

মোবাইলের মতো ছোট স্ক্রিন। কী সব মিটারের মতো আঁকিবুঁকি। বুঝলাম, আমাকে ভয় দেখালে মিটারের কাঁটাগুলো নড়বে। তাতে বোঝা যাবে, কী পরিমাণ ভয় পেয়েছি আমি। ৭৯ পর্যন্ত লাল দাগ। ৮০ থেকে ৯০ পর্যন্ত সবুজ। আর ৯১ থেকে ১০০ হলো নীল।

ভয়ে আমরা নীল হয়ে যাই, কবি-সাহিত্যিকেরা লেখে। এ কারণেই হয়তো সবচেয়ে বেশি ভয় পাওয়ার ঘরগুলো নীল রঙের বানিয়েছে ভূতের অ্যাপ নির্মাতারা। ভূতসমাজও বেশ এগিয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে। কী সব আধুনিক প্রযুক্তি!

এই গরমেও ঠান্ডায় কাঁপছে ভূতটা। অর্থাৎ আমাদের হিসাবে ঘেমে যাচ্ছে ও। যন্ত্রটাই যদি চালাতে না পারো বাপু, ভয়টা আর কখন দেখাবা?

ভূতটার দিকে বিরক্তি ভরেই তাকালাম এবার। আমার চাহনিতে একটু কুঁকড়ে গেল ভূতটা। পারলে তখনই ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়। এই একটা অনুভূতিতে ভূত আর মানুষ সমান-সমান।

‘সরি, আমি বুঝি নাই আপনাকে ডিস্টার্ব করছি।’ মুখটা এমন ভঙ্গি করল, অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি।

আসলে ভূতদের জেএসসি পরীক্ষা চলছে। ওদের জেএসসি মানে হলো ‘যত সব চিটিং’। চিটিং মানেই তো নকল। মহা ধুমধামে নকল করে পরীক্ষা দিতে হয়। এটাই নিয়ম। তবে ঠিক কী কারণে বাংলাদেশে এবার ওদের পরীক্ষার সেন্টার পড়ল, বুঝলাম না। বাংলাদেশে তো নকট-টকল হয় না। ঘটে না প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাও। আজই দেখলাম শিক্ষামন্ত্রী এ কথা বলেছেন। এত বড় মানুষ তো আর মিথ্যা বলবেন না।

সে যা-ই হোক। লিখিত পরীক্ষা শেষে এবার প্র্যাকটিক্যাল। এই পরীক্ষায় মানুষকে ভয় দেখাতে হয় ভূতদের। এদের একজনের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা পড়েছে আমাদের বাড়িতে।

বেশ কিছুদিন হলো আমাদের বাড়িতে আছে ভূতটা। খায়দায়, ঘুমায়। আর সারাক্ষণ আমার মেয়ে ঋদ্ধির সঙ্গে টিভি দেখে, নয়তো গেম খেলে মোবাইলে।

ভূতটা প্রথম যখন বাসায় এল, ভীষণ খেপে গিয়েছিল ঋদ্ধির মা। পরে অবশ্য শান্ত হয়েছে। ভূতটার পিঠে চড়ে হাওয়ায় ভেসে রোজ স্কুলে যায় ওরা। রিকশা ভাড়া বেঁচে যাচ্ছে। জ্যামেও পড়তে হয় না।

এই ঢাকা শহরে এই রকম একটা জিনিস আমার বাড়িতে আছে দেখে হিংসেয় গা জ্বলে যাচ্ছে প্রতিবেশীদের। আমাদের পাশের বাসায় থাকে সেঁজুতিরা। ওর বাবা জিয়া সাহেব বড় কোনো অফিসে চাকরি করেন। গাড়ি কেনার কথা ভাবছেন।

সেদিন লিফটে আমাকে পাকড়াও করলেন জিয়া ভাই। বললেন, ‘কত সিসির?’

‘৫০০ এমএল।’ আমার হাতে একটা কোল্ড ড্রিংকসের শিশি। সেটা দেখিয়ে বললাম।

জিয়া ভাই মাথা নাড়লেন, ‘আরে না, কইতেছিলাম ভূতটার কথা। কত সিসি? মাইলেজ কেমন দেয়? রিপেয়ারিং পার্টস অ্যাভেইলেবল? ভালোই করছেন। আমি একটা টয়োটা দেখতেছিলাম...।’

বুঝলাম, তিনি ভূতটার কথা বলছেন। সেটায় তেল লাগে না, এমনকি চার্জও দিতে হয় না শোনার পর ওনার চোখ বড় হয়ে গেল।

স্কুলেও ঋদ্ধি এখন ভীষণ জনপ্রিয়। ভূতের পিঠে চড়ে স্কুলে আসার সৌভাগ্য তো আর সবার হয় না। ভূতটা স্কুলে যেতে চায় না। স্কুল পালানোর দিক দিয়ে তার মধ্যে একটা রবীন্দ্রভাব দেখা যাচ্ছে। স্কুলে অবশ্য ওকে পড়তে হয় না।

কিন্তু ঋদ্ধিদের নামিয়ে দিতে ভূতটা যখন আকাশ থেকে স্কুলের ছাদে এসে নামে, তখন তাকে দেখতে ছোটখাটো ভিড় জমে যায়। এর মধ্যে এসে ভূতটার কান মলে দেয় কিছু দুষ্টু গোছের ছাত্র। ভূতদের ব্যাপারে কবি-সাহিত্যিক বা আঁকিয়েরা অনেক রকম ভুল তথ্য দিয়ে থাকলেও কানের ব্যাপারটা সত্যি। আমিও খেয়াল করে দেখেছি, ভূতটার কান কুলোর মতো। অবশ্য এই প্রজন্মের কুল ছেলেপুলে কুলো চিনবে কি না, আমি জানি না।

এই একটা ঝামেলা ছাড়া ওর জীবনে আর কোনো কষ্ট ছিল না। বাকিটা সময় শুয়ে-বসে দুমসো হয়ে যাচ্ছিল। মুখ সব সময় ভার করে রাখে। প্রথমদিকে বুঝতাম না। সে বুঝিয়ে দেওয়ার পর থেকে বুঝি। ওদের বেশির ভাগ এক্সপ্রেশন ঠিক মানুষের উল্টো।

ঋদ্ধি ওকে ফেসবুক অ্যাকাউন্টও খুলে দিয়েছে। বেশির ভাগ সময় ফেসবুকে পড়ে থাকে ভূতটা। সেখানে নাকি সে তার হারিয়ে যাওয়া অনেক ভূত বন্ধুদের খুঁজে পেয়েছে। ‘আঁধার রাতের সাথি’ নামের একটা অ্যাকাউন্ট থেকে আমার কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে। আমার সন্দেহ, এটা ভূতটারই ফেক আইডি।

কিন্তু সুখের দিন চায়নিজ যন্ত্রপাতির মতো। বেশি দিন টেকে না। আজ সকালে ওর এই যন্ত্রেই বিপবিপ করে মেসেজ এল। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার শেষ দিন আজ। তাতেই ভূতটার মুখে নির্ভার ছায়া। বোঝা গেল বেশ টেনশনে আছে সে।

জেএসসি পরীক্ষায় এফ গ্রেড না পেলে ওকে নাকি সুইসাইড করতে হবে। এফ মানে ওদের কাছে ফেল নয়। এফ ফর ফ্যান্টাসটিক। এ কারণেই ভূতসমাজ ফেল করাটাকে এত উৎসাহের চোখে দেখে।

এফ না পেলে তাই সে ভূতসমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। তখন আত্মহত্যা ছাড়া উপায় কী? আচ্ছা, মানুষ অপঘাতে মরলে ভূত হয়, ভূতেরা আত্মহত্যা করলে কী হয়?

কোনো কোনো ভূত হয়তো মরে গিয়ে মানুষ হয়। আশপাশে এমন অনেক মানুষকে দেখলে আমার কেন জানি সন্দেহ নয়, ওরা আসলে ভূত। মানুষ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিংবা অপঘাতে মরে ভূত থেকে মানুষ হয়ে গেছে।

তবে পরীক্ষায় খারাপ করলে কেউ কেউ এত ভয়ংকর সিদ্ধান্ত কেন নেয়, বুঝি না। আশপাশে অনেকে অপমান করে অবশ্য। খোঁচা দেয়। তখন অভিমান হয়। তবে সেসব গায়ে না মাখলেই হলো। এই যে আমি ইংরেজি আর অঙ্কে এত ভয়াবহ বাজে ছাত্র ছিলাম, তবু তো দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি। ভালোই আছি। যে অঙ্ক শুধু বড় হয়ে বেতন গুনতে শেখায় তা শিখে লাভই বা কী!

ভূতটাকেও কদিন ধরে এসব বোঝাচ্ছিলাম। তবু তার টেনশন কমে না। টেনশনে টেনশনে মুটিয়ে যাচ্ছে। যদিও আমার মনে হয় না, কাউকে ভয়-টয় দেখাতে পারবে।

আগে বাচ্চারা ঘুমোতে না চাইলে ভূতদের ডেকে আনার ভয় দেখাত মা-বাবা। তাতেই কাজ হতো। ভূতদের সেই সুদিন আর নেই। ভূতটার কাছেই শুনেছি, এখন নাকি ভূতের মা-বাবারাই তাদের বাচ্চাদের ভয় দেখায়, না ঘুমালে মানুষ ডেকে আনবে! ভূতদের পত্রপত্রিকায়, টিভিতে মানুষদের যেসব কাণ্ডকীর্তির খবর ছাপা হয়, তাতে ভূতসমাজে মানুষ নিয়ে আতঙ্কের যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি।

সেই মানুষদের ভয় দেখাবে ভূত!

অনেক চেষ্টা চরিত্র করে যন্ত্রটা লাগাতে পেরেছে বলে মনে হলো। এখন সে ভয়টা দেখাবে কাকে? কীভাবেই বা দেখাবে?

‘স্যার, যদি অনুমতি দিতেন...।’

বুঝলাম ও আমাকে ভয় দেখাতে চায়।

আমি কৌতূহল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ভূতটা যন্ত্র থেকে হেডফোনের মতো দেখতে কী যেন কানে গুঁজে দিল। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ায় ফুলে বিকট আকার ধারণ করল। ইয়া বড় হাত বেরিয়ে পড়ল। মুখটা হয়ে গেল দৈত্যের মতো। তারপর দিয়ে উঠল ভয়ংকর এক চিৎকার!

আমার ভয় পাওয়াই উচিত। কিন্তু কিছুতেই কেন জানি ভয় লাগল না। এর চেয়ে ভয়ংকর জিনিস দেখে দেখে আমরা এখন অভ্যস্ত। রোজ পত্রিকায় খুনোখুনি। বোমা হামলা।

এর চেয়েও ভয়ের খবর সেদিন পত্রিকায় পড়েছি। শতবর্ষী এক বাবার কাতর কান্না। তিনি তাঁর পাঁচ গুণধর পুত্রের চারজনের হাতেই মার খেয়েছেন। ছেলেরা কেউ তাকে খেতে দেয় না। দায়িত্ব নিতে চায় না কেউ। শুধু চায় বাবার জমি। এই ছেলেদেরই বাবা নিজ হাতে হাঁটতে শিখিয়েছেন। মুখে তুলে খাইয়েছেন। অসুখ-বিসুখে বিছানার পাশে শুয়ে সেবা করেছেন। সেই বাবা এসেছেন থানার নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বিচার চাইতে। তিনি ছেলেদের কাছে ভাত চান না, হাতের মারও খেতে চান না।

কত দৈত্য এখন ঘুরে বেড়ায় আমাদের চোখের সামনে। রোজ দেখে দেখে আমাদের চোখ সয়ে গেছে। ভূতের ভয় আমরা পাবই বা কেন?

ভূতটা হয়তো বুঝতে পারল, আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি, কিন্তু আমার কল্পনার চোখে ভেসে আসছে ভীষণ বৃদ্ধ এক বাবাকে পেটাচ্ছে তাঁর চার ছেলে!

কিছুক্ষণ হম্বিতম্বি করে ভূতটা হাল ছেড়ে ছিল। হাতের মিটারে তাকিয়ে ওর খুশি খুশি ভঙ্গি দেখে বুঝলাম, সুবিধে করতে পারেনি। কিন্তু ওকেও তো পাস করতে হবে!

সে এবার গেল ঋদ্ধির কাছে। ঋদ্ধি শোয়ার ঘরে বিছানায় শুয়ে গেম খেলছিল। কচুকাটা করছিল দৈত্যদের। ভূতটা আরও ভয়ংকর চেহারা নিয়ে ওর সামনে হালুমমালুম করল। ঋদ্ধি তো তা দেখে হেসে কুটিকুটি। যেন ওর সামনে সার্কাস দেখাচ্ছে একটা জোকার। যন্ত্রটাই না ফটাস করে ফেটে যায়!

এবার আমার মায়াই লাগল। আমি চোখ ইশারায় রান্নাঘরে যেতে বললাম। ঋদ্ধির মাকে যদি ভয় দেখিয়ে কাজ হয়!

ভূতটার মুখেই এবার ভয়ের ছায়া। এইবেলা তার অনুভূতি প্রকাশ উল্টো হলো না। জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় ভীরু পায়ে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রান্নাঘর থেকে ভূত আর বীথির চিৎকার ভেসে এল! যাক, তাহলে ভূতটা পারল ভয় দেখাতে। খুশিই হলাম। আবার পরক্ষণে মনে হলো, তাহলে তো ভূতটার চিৎকার করার কথা না, ভয় দেখানোর জন্য গর্জন করার কথা। সেও কেন এমন চিৎকার করে উঠল?

দ্রুত রান্নাঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি ভূতটা ভয়ে সেঁধিয়ে গিয়ে একেবারে আগের মতো ছোট্টটি হয়ে গেছে। উঠে বসে আছে বীথির কোলে। বীথির এক হাতে ভূতটা, অন্য হাতে গরম খুন্তি। সেই খুন্তি মেঝের দিকে বাগিয়ে ধরা। আবার কী যে হলো, দুজনে কোরাস চিৎকার করে উঠল। মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা তেলাপোকা! মেয়েরা তেলাপোকায় ভয় পায় জানতাম, ভূতেরাও যে পায় তা জানা ছিল না!

আমার মনে হলো, তেলাপোকাটা যেন শুঁড় কেলিয়ে হেসে চলে গেল।

কিছুটা সয়ে এলে ভূতটা নেমে এল কোল থেকে। বীথি বলল, ‘যা তো, দোকান থেকে এক হালি ডিম নিয়ে আয়। শোন, দেখেশুনে নিবি। চায়নিজ ডিম যেন না হয়।’

নাসাবিষয়ক লেখাটা শেষ হয়েছে। লেখাটা মেইল করে দিয়েছি।

দুজনে বসে চা খাচ্ছি। আমার কাপে কড়া লিকারের রং চা। ওর কাপে গরম বাতাস। এটাই ভূতদের চা। আমি ল্যাপটপ খুলে বসেছি লেখাটা শেষ করার জন্য।

‘স্যার, মানুষ যখন মঙ্গল গ্রহে চলে যাবে, ভূতদের কি সঙ্গে নেবে স্যার?’ এবার সত্যিই কাতর শোনাল ভূতটার গলা। আমার মনে হয় না মানুষ ভূতদের সঙ্গে নেবে। অথচ ভূত সেই শুরু থেকে মানবসমাজের সঙ্গে আছে।

নাসার পরিকল্পনায় কোথাও ভূতদের কথা লেখা নেই।

আমার সত্যিই মন খারাপ হতে থাকল। ইচ্ছে করল, কিশোর আলোর সম্পাদককে ফোন করে বলি, নাসার লেখাটা এবার দিয়ো না। এর বদলে ভূত নিয়ে একটা গল্প লেখব, ওটা দাও। আমার বাসায় একটা ভূত থাকে। মায়াবী চেহারার একটা ভূত। তার নাম ‘ভয়ংকর’।