মাদক পাচার!

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

বাইরে প্রবল তুষারঝড়। ঘর থেকে বেরোনো দায়। স্কুল ছুটি। হাতে কোনো কাজ নেই। কিশোরদের বসার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে তিন গোয়েন্দা। আড্ডা মানে, যার যার মতো কাজ করছে। মুসা মোবাইলে গেম খেলছে। রবিন একটা বই পড়ছে। আর কিশোর একা একা দাবা খেলার চেষ্টা করছে। একসময় ‘ধ্যাত্তোর’ বলে দাবার ঘুঁটিগুলো টেবিলের ওপর ঠেলে ফেলে দিল সে। হাই তুলতে তুলতে রবিনও ঠাস করে বইটা বন্ধ করে কোলের ওপর রেখে দিল। ‘নাহ্, পড়তে আর ভালো লাগছে না এখন!’ আর গেম খেলতে খেলতে এতই রাগ হলো মুসার, ফোনটাই বন্ধ করে দিল। বিড়বিড় করে বলল, ‘এই ঘোড়ার ডিম নিয়ে কী করে যে বুঁদ হয়ে থাকে পোলাপানগুলো, আমার মাথায় ঢোকে না! এর চেয়ে বাগানে গিয়ে মাটি কোপানোও ভালো।’

‘ভালো তো বটেই,’ কিশোর বলল। ‘কিন্তু বাগানে যাবে কী করে? ঘর থেকে বেরোতে পারলে কি আর এখানে বসে থাকতাম?’

‘দেখি, আমি চকলেট বানিয়ে আনি,’ মুসা বলল। ‘বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। মুখটা অন্তত একটু নড়ানো দরকার।’

ইলেকট্রিক হিটার দিয়ে গরম গরম তিন মগ চকলেট বানিয়ে আনল সে।

আর ঠিক এই সময় বেশ বড় সাইজের একটা ফ্রুট কেক নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন মেরিচাচি।

দেখে এত খুশি হলো তিনজনে, সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘থ্রি চিয়ার্স ফর মেরিচাচি!’

হেসে চাচি জানালেন, ‘এটা খা এখন। লাঞ্চে বাংলাদেশি খাবার হবে। পোলাও আর আস্ত মুরগির রোস্ট। ডিমের কোরমা। সালাদ।’

খুশিতে হট্টগোল শুরু করে দিল তিন গোয়েন্দা। মুসা তো খাবারের বর্ণনা শুনে পাগল হয়ে গেল। হাসতে হাসতে চলে গেলেন মেরিচাচি।

‘যাক, মনটা ভালো করে দিয়ে গেলেন আন্টি,’ মুসা বলল।

‘কিন্তু সময় কাটানোর জন্য একটা কিছু করা দরকার,’ কিশোর বলল। ‘এক কাজ করি চলো, ধাঁধার আসর জমাই।’

‘ভালো প্রস্তাব,’ সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল রবিন। ‘তার চেয়ে গল্পধাঁধা খেলি না কেন আমরা?’

তিনজনেই একমত। ঠিক হলো, একজন একজন করে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে গল্প শোনাবে ওরা। শেষ দিকে প্রশ্ন রেখে দেবে। জবাব দিতে হবে অন্য দুজনকে।

‘কে আগে শুরু করবে?’ ভুরু নাচাল কিশোর।

মুসা বলল, ‘তুমি আমাদের নেতা। তুমিই শুরু করো।’

নড়েচড়ে বসল কিশোর। ‘বেশ।’ এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে বলল, ‘একদিন একটা কাজে থানায় গিয়েছিলাম। ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের অফিসে বসে আছি। হঠাৎ ছুটে ঘরে ঢুকল অফিসার রিকি জারসি।’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘চিফ, আমাদের সোর্স ওরিয়ন এইমাত্র ফোন করেছে। জানিয়েছে, কয়েক মিনিট আগে রকি বিচ রেলস্টেশনে পৌঁছেছে লুথার, একজন লোকের হাতে একটা ব্রিফকেস তুলে দিয়েছে। ওরিয়ন লোকটাকে চেনে না। ব্রিফকেসটা নিয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেছে অপরিচিত লোকটা, একটা বাসে উঠে চলে গেছে।’

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন। ‘তার পিছু নেওয়া হয়েছে!’

‘হ্যাঁ। পুলিশের একটা গাড়ি বাসটার পিছু নিয়েছে। কোনো ঘটনা ঘটলে সরাসরি ফোন করে আপনাকে জানাতে বলে দিয়েছি ড্রাইভারকে।’

মাথা ঝাঁকালেন ফ্লেচার। ‘আর লুথার?’

‘তার পিছু নিয়েছে ওয়ারনার।’

ঠিক এই সময় ফোন বাজল। থাবা দিয়ে রিসিভার তুলে নিলেন ক্যাপ্টেন। দীর্ঘ একটা মিনিট মন দিয়ে শুনলেন ওপাশে কথা। তারপর আদেশ দিলেন, ‘দুটোকেই অ্যারেস্ট করো! লুথারকেও করো, বাসে করে যে যাচ্ছে তাকেও করো।’

এই ঘটনার পঁয়ত্রিশ মিনিট পর উইলিয়াম হ্যারিসন নামে একটা লোককে নিয়ে অফিসে ঢুকল দুজন পুলিশ। ক্যাপ্টেনের মুখোমুখি বসানো হলো লোকটাকে। যে ব্রিফকেসটা সে নিয়ে যাচ্ছিল বাসে করে, সেটা রাখা হলো টেবিলের ওপর, দুজনের মাঝখানে। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ মনে হচ্ছে হ্যারিসনকে। বারবার সে উকিলের সঙ্গে দেখা করার কথা বলতে লাগল। প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, সে নিরপরাধ। পুলিশ ভুল করে তাকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ যাকে খুঁজছে সে-লোক সে নয়।

নিরীহ ভঙ্গিতে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আপনি আমার অফিসারদের কাছে বলছেন, অপরিচিত একজন লোক রকি বিচ স্টেশনে আপনার সাথে দেখা করে আপনাকে ব্রিফকেসটা স্টোনহিলে পৌঁছে দিতে বলেছে। আর এই কাজটা করে দেওয়ার জন্য আপনাকে দুশ ডলার দিতে চেয়েছে। তাই তো?’

‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল হ্যারিসন।

‘আপনি আরও বলছেন, লোকটার নাম আপনি জানেন না, এই ব্রিফকেসটার ভেতর কী আছে সে-সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই আপনার?’

‘না, নেই। বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।’

‘আর আপনি আমাকে এ রকম একটা গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করতে বলেন, মি. হ্যারিসন?’

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল হ্যারিসন। ‘হ্যাঁ, বলছি। এ ছাড়া আর কিছু করারও নেই আপনার। কারণ, আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন না আপনি। একজনের কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে আরেকজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া কোনো অন্যায় নয়।’

‘হাসালেন আপনি, মি. হ্যারিসন।’ কঠোর পুলিশি কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন। ‘হাসালেন’ বললেও হাসির লেশমাত্র নেই তাঁর চেহারায়।

‘এত সহজ একটা কাজের জন্য দুশ ডলার পেলে যে কেউ বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যেত,’ হ্যারিসন বলল।

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

‘বিনা বাক্যে রাজি হওয়াটাই বোকামির লক্ষণ।’ চোখের পাতা সরু করে হ্যারিসনের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। ‘কোনটা আপনি, হ্যারিসন? বোকা? লোভী? না নিজেই অপরাধী দলের সদস্য?’

এতই অপমানিত বোধ করল হ্যারিসন, ভাষা হারিয়ে ফেলল।

বলে গেলেন ক্যাপ্টেন, ‘আপনি ব্রিফকেসটা নিলেন, স্টোনভিলের বাসে চাপলেন। গন্তব্যে পৌঁছে বাস থেকে নামলেন, ফোর্ড নামে একটা লোকের হাতে ব্যাগটা তুলে দিলেন। তারপরেই আপনার কাজ শেষ। এই তো?’

‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল হ্যারিসন। ‘সবই তো আপনি জানেন। ফোর্ডকেও ধরেছেন, এখন তাকেই জেরা করুন, সব জানতে পারবেন। আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করবে সে। বলবে, এর আগে জীবনে কখনো দেখেনি আমাকে।’

‘বলবে যে সেটা আমিও জানি। আরও বলবে, লুথারকে আপনি চেনেন না, যার কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়েছেন। লুথার যে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মাদক চোরাচালানি, সেটাও নিশ্চয় আপনি জানেন না, তাই না?’

‘বুঝলাম,’ ফুঁসতে লাগল হ্যারিসন, ‘ব্যাগে যে হেরোইন আছে, সেটা না জেনেই স্টোনভিলে পৌঁছে দিতে রাজি হয়ে আমি ভুল করেছি, ভুল করেছি, বিনা খাটনিতে টাকা রোজগারের লোভ করে। কিন্তু আদালত ঠিকই বুঝবে, একটা “বোকা” লোক কিছু মূল্যবান কাগজপত্র একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য এতগুলো টাকা দিয়েছে আমাকে।’

‘আপনি কি একবারও খুলে দেখেছেন, ব্যাগে কী আছে?’

‘না!’

‘তাহলে মাই ডিয়ার মি. হ্যারিসন, এত সহজে পার পাচ্ছেন না আপনি।’

‘মাত্র দুই ডলার দিয়েই যেখানে কাজটা করা যায়,’ ক্যাপ্টেন বললেন। ‘সেখানে দুশ ডলার দিল, আর কোনোরকম সন্দেহ জাগল না আপনার, এটাই বা কী করে হয়?’

সামনের টেবিলটায় সজোরে এক কিল মারল হ্যারিসন। আপেলের মতো লাল হয়ে গেছে মুখ। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাগে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বলছি তো, ভুল করেছি।’ তারপর সামান্য নরম হয়ে ধীরে ধীরে বসে পড়ল আবার। ‘বেশ, আবারও স্বীকার করছি, দুটো ভুল আমি করেছি। এক. টাকার লোভ করে। দুই. অপরিচিত লোকের কাছ থেকে কোনো কিছুই যাচাই না করে তার কথামতো ব্যাগটা পৌঁছে দিয়ে। তবে এই ভুলের জন্য আপনি আমাকে জেল খাটাতে পারবেন না।’

‘পারি। আপনি আরেকটা ভুল করে ফেলেছেন। যাতে আমি বুঝে গেছি, আপনি মোটেও নিরপরাধ নন, মাদক চোরাচালানিদের লোক।’

এ পর্যন্ত বলে থামল কিশোর। দুই সহকারী মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল। ‘এখন বলো তো, ক্যাপ্টেন কী করে বুঝলেন, লোকটা অপরাধী?’

‘আন্দাজে,’ জবাব দিয়ে দিল মুসা।

‘আন্দাজে কাউকে অপরাধী করে জেলে ভরা যায় না,’ কিশোর বলল।

দুই হাত নেড়ে মুসা বলল, ‘অকারণ মাথা খাটিয়ে অ্যাসিডিটি বাড়িয়ে এত সুন্দর লাঞ্চটা মাটি করতে চাই না।’

খানিকক্ষণ চিন্তা করে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ‘আমি পারব!’

* হ্যারিসন যে অপরাধী ক্যাপ্টেন কীভাবে বুঝলেন?