মাদুলি

অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী

মাদুলির কথা কেউ বিশ্বাস করে না।

না করার পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। মাদুলির বয়স এই নয় কি দশ…টানা টানা বড় চোখ, আর মাথায় এক গাছ রুখা রুখা চুল…পরনে একটা প্রায় ছেঁড়া ফ্রক! মানে মাদুলি গরিব। কিন্তু মাদুলি কথা বলে খুবই বড়লোকি। মানে একেবারে হাইফাই বড়লোকি কথা!

যেমন সে বলে, সে নাকি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে প্রায়ই যায়। সেখানে গিয়ে নাকি চিকেন চিবায়, স্যুপ খায়, চিংড়ি খায়। সেখানকার যে ডিম ডিম আলো, তাতে নাকি মাদুলির খুব ঘুমও পায়!

তিন মাস আগে বাবা আমাদের একবার চায়নিজে নিয়ে গিয়েছিল সত্য! মাদুলি তার কদিন আগেই গ্রাম থেকে এসেছিল। বাসায় একা একা রেখে যাওয়া ঠিক না বলে তাকেও মা-বাবা নিয়ে গিয়েছিল এ–ও সত্য! কিন্তু তাই বলে ওই একবার যাওয়াকে মাদুলি প্রতিদিন যায় বলবে?

মাদুলি টিভি দেখে না। একেবারেই না। মা বলে, এমন কাজের মানুষ তো দেখিনি আগে! আগেরগুলো সব তো হাঁ করে টিভি গিলত! এর উত্তরে মাদুলি বলে কী জানো? বলে, টিভিতে যা হয়, যেগুলো হয়, সেগুলো নাকি সে চাইলেই গিয়ে দেখতে পারে! কোন ঘরে খবর পড়ে, কোন ঘরে হয় টক শো, আর কোথায় কোথায় নাটক কীভাবে হয়, সবই নাকি সে দেখেছে! মোশাররফ করিম, মেহ্‌জাবীন, নিশো সবাইকে নাকি সে চেনে! এই এত্ত কাছ থেকে নাকি সবাইকে সে দেখে!

তা আমাদের বাসার পাশেই একটা টিভি চ্যানেল আছে, এটা তো সত্য, কিন্তু ওর ভেতর চাইলে আমরাও কি কোনো দিন যেতে পেরেছি? আর ওই টিভি চ্যানেলের ভেতর কোথায় কী…মানে ওই যে নিউজ রুম আর টক শো রুম…সেগুলো মাদুলি কেন…আমরা কেন…আমাদের বাবারাও তো দেখেনি! কিন্তু মাদুলির একই গোঁ…সে সব দেখেছে!

আমি শিয়াল দেখিনি কোনো দিন। না না, একবার দেখেছিলাম। ওই যে চিড়িয়াখানা গেলাম যেবার… শিয়াল ওখানে ছিল কয়েকটা। দেখতে কেমন অদ্ভুত!

মাদুলিটা এত মিথ্যা বলে যে মাঝে মাঝে মনে হয় ওকে খুব করে বকে দিই। কিন্তু মা যে আবার খুব পছন্দ করে মাদুলিকে। এমন লক্ষ্মী মেয়ে নাকি আর একটাও হয় না! সকালবেলা ঘুম থেকে ডেকে তোলার কোনো হাঙ্গামা নেই—ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে সে ওঠে, একটু ছাতু কি একটু মুড়ি ভাজা, না কী সব হাবিজাবি খেয়ে, একেবারে তৈরি! ঘরটা পরিষ্কার, সোফাটা মোছা, ডিমটা ফেটানো কি রুটিটা বেলে দেওয়া বা ভাত গরম দেওয়া সবই সে করে চোখের নিমেষে! ক্লান্তি নেই কোনো! দুপুরের রান্না থেকে বিকেলের নাশতা, মহল্লার দোকানে বাজার করা থেকে মোবাইলের রিচার্জ সবটাতেই মাদুলি ধুমধাম এগিয়ে! বাবা বলে, এমন মানুষ আগে দেখি নাই রে বাবা! এত শক্তি, এত্ত এনার্জি!

মা–বাবার মুখের এমন প্রশংসা শুনে আমার যে খুব বেশি হিংসা হয়, এ কথাটা এখানেই একটু স্বীকারই করে নিচ্ছি। কিন্তু হিংসা হলেই–বা আর কী করা! মাদুলি তো আমারও অনেক কাজ করে দেয়। ফাইভ না কী পাস করেছে মাদুলি…অথচ সে দেখে দেখে আমার অ্যাসাইনমেন্টের খাতাগুলো কপি করে দিতে পারে দমাদম! দুই পাশের দুই বেণি দুলিয়ে বলে, দেখো তো, ঠিক লিখি নাই?

আমি অবাক হই, আবার খুশিও হই! পড়াশোনার এই বাজে কাজগুলো যদি মাদুলি করে দেয়, তাহলে তো ভালোই! তা এই সব ভালো মাদুলির কি কোনো দোষ নেই? কোনো ত্রুটি নেই?

আছে। আর তা শুধু আমিই জানি!

মাদুলিটা বড্ড মাংস খায়!

মাংস মানে আবার গরু-খাসির মাংস না। মাদুলির পছন্দ চিকেন…মানে মুরগির মাংস! মাদুলির ভাষায় মুগরির গোশত! তা বাসায় মুরগি হলেই হয়েছে, মাদুলির সেদিন যেন ঈদ! গুনগুন করে সেদিন তার গ্রাম্য গানও গায়। এত খুশি মনে থাকে যে চোখটা পর্যন্ত তার জ্বলজ্বল করে। যেন রাতের বিড়াল! আমি একদিন এ কথা বলতেই মাদুলি হেসে বলে, শিয়ালেরও চোখ জ্বলে! বলো শিয়ালের ন্যায়, তাহলে ঠিক আছে...হুক্কাহুয়া!

আমি শিয়াল দেখিনি কোনো দিন। না না, একবার দেখেছিলাম। ওই যে চিড়িয়াখানা গেলাম যেবার…শিয়াল ওখানে ছিল কয়েকটা। দেখতে কেমন অদ্ভুত! কেমন নোংরা লেজ! চোখ জ্বলে কি না কে জানে…রাতে তো আর দেখিনি!

কিন্তু মাদুলির গোঁ…তার চোখ যদি জ্বলেই, তাহলে তা শিয়ালের মতো জ্বলে। এই সব বলে আর মাদুলি ফিকফিক করে হাসে। ওই যে বললাম, মুরগি হলে মাদুলির খুশির সীমা থাকে না!

কিন্তু যে–ই না বাসায় মুরগি হতে কয়েক দিন দেরি হয়ে যায়, অমনি সে এসে ঘ্যানঘ্যান করে বলে, ও ভাইয়া! খালাম্মাকে বলো না একটু মুরগি করতে…বলো না ভাইয়া চিকা করতে!

বলা বাহুল্য, চিকেনকে মাদুলি আজকাল চিকাও বলে।

এবং বলা বাহুল্য, মাদুলিকে দিয়ে আমি কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য মাকে চিকা করার অনুরোধও করি!

আমি কিছু খেতে চাইছি এটা যেন মা–বাবার সাত জনমের ভাগ্য!

ফলে চিকেন বলা শেষ হয় না আমার, অমনি বাবা ফটাফট চার–পাঁচটা মুরগি নিয়ে চলে আসে ব্যাগভর্তি করে। আর মা–ও লেগে পড়ে...না না মা কেন...আসলে তো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাদুলিই! রান্নাবান্না শেষ করে পেট ভরে খেয়ে তবেই তার শান্তি!

কিন্তু সেবার কোরবানির ঈদে গিয়ে হলো ঝামেলা!

গরু-খাসির মাংসে ফ্রিজ তখন এতই ভরপুর যে ফ্রিজের পাশ দিয়ে তিনবার গেলে একবার যেন মাংস খাওয়া হয়ে যায়। বাসায় সকাল-বিকেল-রাতে চলছে কত রকমভাবে মাংস খাওয়া যায়, তার প্রতিযোগিতা। এরই মধ্যে মাদুলি ঘোরে মুখ শুকিয়ে।

আমি বলি, কী হয়েছে?

মাদুলি বলে, ভাইয়া, একটু যে চিকা খাইতাম!

আমি বলি, ধুর! এখন কেউ চিকেন খায় নাকি...এখন হলো কালা-লাল-হইলদা ভুনার সময়!

মাদুলি বলে, ম্যালা দিন চিকা খাই না ভাইয়া…চায়নিজটাও বন্ধ! খালাম্মারে বলো না ভাইয়া…চিকা খাই…তোমার খাতা লেখার সব কাজ এক রাইতে কইরা দিমু ভাইয়া…কও না…

আমি বলি, ঠিক আছে, ঠিক আছে, দেখছি!

কিন্তু মা আমার কথা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। আরে বাবা, এতগুলো মাংস আছে সেগুলো তো আগে শেষ করতে হবে!

বাবা বলে, বাজারে এখন চিকেনই নেই! আনব কোথা থেকে!

আমি বলি, তাহলে থাক!

আসলে আমারও তো তেমন কোনো অ্যাসাইনমেন্ট বাকি নেই যে মাদুলিকে আমার লাগবেই! কিন্তু মাদুলির যেন মুরগি লাগবেই লাগবে! কেমন তার ছটফটে ভাব। কেমন তার অদ্ভুত উচাটন!

সেদিনই গভীর রাতে মাদুলি আমার ঘরে এসে উপস্থিত।

ভাইয়া…ও ভাইয়া!

কী হলো এত রাতে!

একটু চিকার ব্যবস্থা করো ভাইয়া! ওই চায়নিজেও চিকা নেই! টিভি চ্যানেলের ক্যানটিনেও নেই!

যা, এখন ঘুমাতে যা তো! আমাকেও ঘুমাতে দে!

মাদুলি ঘুমায় কি না জানি না। কিন্তু আমি ঘুমাই। কিন্তু ঘুমাতে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। ঘুমের মধ্যেই কী যেন একটা টের পাচ্ছি মনে হয়। আর সেটা বুঝে উঠতেই যেন এবার আমি ঠিকঠাক ঘুম থেকে উঠি। বিছানায় উঠে বসে, মশারিটা খুলে দেখে মাদুলি মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর কেমন একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ তার ভেতর থেকে বের হচ্ছে। এই আওয়াজ আমি কখনো শুনিনি। আমার হাতের লোম দাঁড়িয়ে যায়। কেমন কাঁটা কাঁটা হয়ে যায় গা-টা। মাদুলি গোঙাতে থাকে। চাপা গোঙানিটা একটানা এতই বাড়তে থাকে যে আমার মনে হয়, সেই গোঙানিতে খাটটাও দুলতে শুরু করেছে। আমি বলি, কী হয়েছে…কী হয়েছে?

মুরগি খেতেই সে মাঝে মাঝে পাশের টিভি স্টেশনের ক্যানটিনে ঢুকে পড়ে, মুরগির লোভেই নাকি চলে যায় চায়নিজে! গ্রামে থাকতেও কতজনের মুরগি খেয়েছে সে...ইত্যাদি

মাদুলি তাকায়। জ্বলজ্বলে চোখ। তবে এই চোখ বিড়ালের না। শিয়ালের কি? জানি না। শিয়ালের চোখ আমার কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু মাদুলি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা হুংকারের মতো দেয়। তাতে তার মুখের ভেতর লম্বাটে দুটো দাঁত আমি দেখতে পাই। আর মনে হতে থাকে এমন ডাক কেবল শিয়ালই ডাকতে পারে!

আর এসব ভাবতে ভাবতেই খুব সম্ভবত আমার জ্ঞান হারাই। অথবা আমার চোখের সামনে একটা অদ্ভুত অন্ধকার নেমে আসে। তার ভেতরেই আমি শুনতে পাই গোঙানিটা ধীরে ধীরে কেমন পাশবিক হয়ে উঠছে এবং ঘরের ভেতর কেমন কেউ ভারী শ্বাস নিচ্ছে বারবার! আর হঠাৎ হঠাৎই ঘরের মধ্যে যেন কেউ ধস্তাধস্তি করছে! আমার মনে হয় আমি চোখ খুলতে পারব...কিন্তু চোখ খুলি না আমি। আমার সাহস হয় না। আমার একেবারেই সাহস হয় না!

পরিশিষ্ট:

সেদিনের রাতের বিষয়ে মাদুলি আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলে। বলে যে মুরগির গোশত খেতে না পেলে তার শরীরে কী যেন হয়ে যায়। তার খুবই পিপাসা লাগে আর সবকিছুতে লাগে ছটফটি। আড়াই কি তিন বছর বয়সে মাদুলিকে নাকি একটা শিয়াল ধরে নিয়ে চলে গিয়েছিল! গ্রামের লোকজন তাড়া করে শিয়ালের গর্ত থেকে মাদুলিকে বের করে নিয়ে আসে। প্রায় মরতে বসা মাদুলিকে অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে তোলে। সেই জন্যই হয়তো মাদুলির ভেতর শিয়াল ভাব আছে। সময়–সময় মুরগি খেতে না পেলে সেই শিয়াল ভাব বেরিয়ে আসে। মুরগি খেতেই সে মাঝে মাঝে পাশের টিভি স্টেশনের ক্যানটিনে ঢুকে পড়ে, মুরগির লোভেই নাকি চলে যায় চায়নিজে! গ্রামে থাকতেও কতজনের মুরগি খেয়েছে সে...ইত্যাদি।

মাদুলির এসব কথা আমার বিশ্বাস হয় না। মাদুলি সব সময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে আন্দাজি কথা বলে। তবে মাকে জানিয়ে দিয়েছি ফ্রিজে যেন অন্তত একটা চিকেন থাকে। ফাইনাল এক্সাম চলছে। গভীর রাতে যদি মুরগি খেতে ইচ্ছা করে, তা যেন পাওয়া যায়।

আর হ্যাঁ, মাদুলিকে দিয়ে আমি এখন আর অ্যাসাইনমেন্ট করাই না!