মিন্টু ও দাদুর অ-তিথি

noname
noname

‘কররররর...’

কলবেলটা বাজছে। ঘড়িতে সকাল সাড়ে সাতটা।

‘হ্যাঁরে মিন্টু, দুয়ারটা খোল না!’ ইকবাল সাহেব মিন্টুকে তাড়া লাগান।

‘তুমি খোলোগে, দেখছ না আমি ঘুমাচ্ছি।’

‘ঘুমাচ্ছিস, তবে যে কথা বলছিস খুব?’

‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই আমি কথা বলি, এটা আমার বদভ্যাস!’ আর বাক্যব্যয় করে না মন্টু। ঘুমুতে থাকে ফোঁস ফোঁস করে।

‘কে এল এই সাতসকালে?’ গজরাতে গজরাতে ইকবাল সাহেব ওঠেন। হাতড়ে চশমাটা খোঁজার চেষ্টা করেন।

 ‘হ্যাঁরে মিন্টু, আমার চশমা কই রেখেছি বল তো, পাচ্ছি না তো।’

‘কী ঘ্যান ঘ্যান করছ দাদু, আরেকটু হলেই তো আমার ঘুমটা ভেঙে যেত।’ চোখ না খুলেই মিন্টু বিরক্তি প্রকাশ করে। ‘আর তোমার ওই চশমা কস্মিনকালেও আমি খুঁজে পাব না, কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া আমার দ্বারা কখনো হয়নি।’

‘তবে দরজা খুলব কীভাবে হাঁদা, যা যা নিজে খোল। চশমা ছাড়া আমার এক পা-ও চলা সম্ভব না।’

অগত্যা মিন্টুকে উঠে বসতে হয়। চোখ ঘষে তাকাতেই ও চেঁচিয়ে বলে, ‘অ্যা, জ্বলজ্যান্ত চশমাটা ওই টেবিলেই তো পড়ে আছে। দাদু তুমি কী না, তুমি তো ভারি, তুমি তো ভারি...’ বাক্যটা শেষ করার উপযুক্ত শব্দ না পেয়ে ফের কাঁথামুড়ি দেয় মিন্টু।

ইকবাল সাহেব চশমাটা চোখে লাগিয়ে ধীরে ধীরে মূল ফটকের দিকে রওনা দেন। এতক্ষণে কলবেল থেমে গেছে। দরজা খুলেও কাউকে দেখতে পেলেন না।

‘দেখো কাণ্ড, কতক্ষণ আর লোকে কড়া নাড়বে। গেল তো চলে, কে না কে এসেছিল।’ ফিরে এসে গজরাতে গজরাতে বলেন তিনি। ‘তোর মতো অপয়া ছেলের জন্য ঘরের অতিথি এসে চলে গেল!’

‘গেছে যাক, ও নিয়ে ভেবো না দাদু। আপদ বিদেয় হয়েছে!’

‘ছি! এসব বলতে আছে মিন্টু! অতিথি হচ্ছে ঈশ্বরের বর!’

‘উঁহু, অতিথি হচ্ছে বর্বর।’ মিন্টু একটা হাই তুলে বলে।

ইকবাল সাহেব এবার খেপে ওঠেন, ‘তুই কী বুঝিস, এত্তটুকুন ছেলে। অতিথির মর্ম তুই কী জানিস, অ্যা!’

‘দেখো দাদু, আমি যা বলছি ভেবেচিন্তেই বলছি। অতিথি হলো সেসব মানুষ, যারা অসময়ে এসে হাজির হয়!’

‘তার মানে?’ ইকবাল সাহেব যেন থই পান না।

‘মানে তুমি অতিথি শব্দটার দিকে খেয়াল করো না! যারা অ-তিথিতে বা অসময়ে এসে হাজির হয়, ওরাই তো ডিকশনারি অনুযায়ী অতিথি। এই তিথি জ্ঞান নেই বলেই তো অমন ধারা নাম ওদের, তুমি কিচ্ছু জানো না দাদু।’

জবাবে ইকবাল সাহেব কিছু বলেন না, মুখ ভার করে বসে থাকেন। এইটুকুন ছেলে কথার কী মারপ্যাঁচ শিখে গেছে। অথচ এই কদিন আগেই তো তিনিই কথা শিখিয়েছেন ওকে, আর এখন কিনা এই ছেলে ডিকশনারি শেখাচ্ছে!

ওদিকে মিন্টু কিন্তু তখনো থামেনি। ‘এই যে দেখবে, আজকে, হ্যাঁ আজকের এই অ-তিথিতে একদল অতিথি এসে আমাদের সর্বস্বান্ত করে যাবে। বাসায় কেউ নেই, তোমার আর আমার জন্য মা রেঁধে ফ্রিজে রেখে গেছে। এর চেয়ে অসময় আর হতেই পারে না। দেখবে পাল পাল অতিথি এসে পালা করে আমাদের খাবারে ভাগ বসাবে, টিভির রিমোট ধরে টানাটানি করবে, বয়ামে জমানো চানাচুর খেয়ে নেবে। দূরসম্পর্কের আর দুঃসহ সম্পর্কের সবাই দেখবে একে একে হাজির হবে, দেখবে তোমার ছোটবেলার হারানো ভাইও দরজায় নক করবে।’

‘বাজে কথা বলিস না, আমার ছোটবেলায় কোনো ভাই হারায়নি।’

‘হারালেও সেটা তুমি জানবে কী করে, ছোটবেলার কথা কারও মনে থাকে!’

‘কররররর...’ মিন্টুর কথার ফাঁকে আবার কলবেল বেজে ওঠে।

‘যাও দেখো গিয়ে, তোমার আত্মীয়স্বজন এল কি না। আমি কিন্তু এসব অতিথি আপ্যায়নে নেই, বলে রাখছি।’ বলেই মিন্টু আবার কাঁথামুড়ি দেয়।

ফের ইকবাল সাহেব যান দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই দুজন লোক হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে, তারপর নিজেরাই দরজা লাগিয়ে দেয়।

দুজনের একজন মুশকো, মস্ত গোঁফসমেত। অন্যজন গালভাঙা আর ঢ্যাঙা।

‘তা বাবারা, তোমরা কারা?’ ইকবাল সাহেব ভড়কে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন।

‘জি আমার নাম মজিদ, ইনি আমার ওস্তাদ!’ ঢ্যাঙাটা চট করে জবাব দেয়।

‘ওস্তাদ? কিসের ওস্তাদ?’

মুশকোটা এবার বলল, ‘শোনেন বুড়ামিয়া, লোক মারফত খবর পাইছি আজ এই পুরা বাড়িতে আপনি আর আপনার ছোট এক নাতি শুধু আছেন। তাই চিন্তা করলাম আপনাদের বাড়িটা সাইজ করব। আমার নাম লোকমান, লোকমান ডাকাইত! এবার আমাদের পরিচয় পাইছেন।’

‘জি বাবা, পেয়েছি।’

‘এবার বলেন আপনার নাতি কেমন, ঝামেলাটামেলা করব না তো, করলে আগেই একটা ব্যবস্থা নিয়ে পরবর্তী স্টেপে যাই।’

‘কী ব্যবস্থা নেবে?’

‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা, বেশি ভ্যাজাইল্লা হলে খুনখারাবিও হইয়া যাইতে পারে। এসব বাচ্চাকাচ্চায় আমার ভীষণ অ্যালার্জি!’

‘জি ওস্তাদ, বাচ্চা মানেই মারাত্মক।’

‘হুম, যান বুড়ামিয়া, আপনার নাতিরে আগে নিয়া আসেন।’

ইকবাল সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ‘তার চেয়ে বাবারা, আমার একটা কথা শোনো। তোমরা তো আমার নাতিকে চেনো না, আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ও কিন্তু আসলেই ডেঞ্জারাস। কখন কী করে বসে আমিই ঠাহর করতে পারি না। ও আবার অনেক বেলা করে ঘুমায়। আমি বলি কী, ওকে জাগানোর ঝামেলায় না গিয়ে বরং তোমরা তাড়াতাড়ি ডাকাতি করে চলে যাও ও ওঠার আগেই। আমি আলমারি থেকে টাকাপয়সা, গয়নাগাটি বের করে দিচ্ছি, নিয়ে তোমরা কেটে পড়ো, কী বলো?’

ইকবাল সাহেবের কথায় ওরা ভরসা পায় না চিন্তিত হয়ে পড়ে, বোঝা যায় না। লোকমান ডাকাত শেষমেশ বলে, ‘তা বুড়ামিয়া খারাপ কথা বলে নাই। কী কস মজিদ?’

‘জি ওস্তাদ, এসব বাচ্চাকাচ্চার ঝামেলায় না যাওয়াই ভালো। চলেন ঘুম থেকে ওঠার আগেই জিনিসপত্র নিয়া আমরা কাইটা পড়ি।’

ইকবাল সাহেব এবার ফিসফিস করে ওদের বললেন, ‘শোনো, ও যদি এর মধ্যে জেগেও যায়, তোমরা পরিচয় দেবে ছোটবেলা আমার হারানো ভাই বলে।’

‘অ্যা, কী কন। আপনার মতো বুড়া মানুষ আমার ভাই হইব কেমনে?’

‘আমাদের সময় ওসব হতো, বড় ভাই আর ছোট ভাইয়ের তফাত ৩০ বছরও হতো। এটা কোনো সমস্যা না।’

‘ঠিক আছে!’ বিরস মুখে লোকমান বলে।

‘আর আমি? আমিও কি আপনার ভাই?’ মজিদ জিজ্ঞেস করে।

‘তুমিও ভাই হতে চাও?’

‘জি না, আমার বয়স তো কম! মাত্র দুই বছর আগে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিছি।’

‘ঠিক আছে, তাহলে তুমি ভাতিজা। তুমি তোমার ওস্তাদকে বাবা বলে ডাকতে পারবা?’

‘জি পারব!’

লোকমান অবাক হয়ে মজিদের দিকে তাকায়, ‘তুই আমারে বাপ ডাকবি? মশকরা করছ?’

‘জি ওস্তাদ, পরিস্থিতির প্রয়োজনে সবই করা যায়, কী বলেন চাচা?’

‘হ্যাঁ, এইটা করতে হবে। না হলে আমার নাতি কিন্তু বুঝে যাবে। এবার চলো তোমাদের আলমারির ঘরে নিয়ে যাই!’

এমন সময় চোখ ডলতে ডলতে মিন্টুর প্রবেশ।

‘মিন্টু উঠে গেছিস! দেখছিস, কারা এসেছে?’ ইকবাল সাহেব লোকমানকে দেখিয়ে বলেন, ‘এ আমার ছোট ভাই। ছোটবেলা মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। আর এ হচ্ছে মজিদ। তোর চাচ্চু হয়।’

মজিদ বলে, ‘কেমন আছো ভাতিজা? মাশা আল্লাহ, কত্ত বড় হইয়া গেছো। লাস্ট টাইম যখন দেখছিলাম তখন এইটুকু ছিলা।’

মিন্টু বিরক্ত গলায় বলল, ‘জি ভালো।’ তারপর দাদুর দিকে ফিরে বলল, ‘তোমার হারায় যাওয়া ভাই হলে তার ছেলে ছোটবেলা আমাকে দেখল কীভাবে?’

ইকবাল সাহেব আমতা আমতা করে বলেন, ‘আসলে মজিদ তো হারায়নি। ও ঠিকই আমাদের খুঁজে বের করেছিল। এই লোকমানটাই না নিরুদ্দেশ ছিল।’

মজিদও যোগ করে, ‘হ, আর কইয়ো না ভাতিজা। আব্বায় এত ভুলোমনা, বছরের ১১ মাসই নিরুদ্দেশ থাকে।’

মিন্টু আর কিছু না বলে দাঁত মাজতে চলে যায়।

ওরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

তারপর ইকবাল সাহেব, মজিদ আর লোকমান পাশের ঘরে গিয়ে আলমারি খোলে। আলমারি থেকে বেশ কিছু গয়না আর টাকাপয়সা ইকবাল সাহেব ওদের হাতে তুলে দেন।

মজিদ ইকবাল সাহেবের সহযোগী মনোভাবে কৃতার্থ হয়ে বলে, ‘চাচা, আপনি বিশাল বড় মনের মানুষ। অনেকেই এসব টাকাপয়সা-সোনাদানার লোভ করে, কইরা আমাদের সঙ্গে ঝামেলা করে—বাধ্য হইয়া আমাদের খুনখারাবি, মারামারি নানা কিছু করতে হয়। আপনার মতো লোক থাকলে দুনিয়া হইত শান্তির জায়গা।’

ইকবাল সাহেব ফিসফিস করে বললেন, ‘অত কথা বলো না, এসব নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। আমার নাতি যেন কিচ্ছুটি টের না পায়। যাও যাও!’

‘কররররর...’

এমন সময় আবার কলবেল বেজে ওঠে। কলবেলের শব্দে দাদুসহ ওরা তিনজনই চমকে ওঠে।

‘কে আইল চাচা?’ মজিদ আতঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করে।

‘কী জানি? আজকে তো কারও আসার কথা না।’

‘আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ না তো?’

‘না না, ওরা তো সবাই গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেল গতকালই। এই সকালে তো আর কারও আসার কথা না!’

‘করররর...’ আবারও বেল বেজে ওঠে ওদের কথার ফাঁকে।

‘দাঁড়াও খুলে দেখি। কে আর হবে? বড়জোর পাশের বাসার বদরুল সাহেব, উনি মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে গল্প করতে আসেন।’

‘উনি লোক কেমন?’ লোকমান প্রশ্ন করে।

‘খুবই অমায়িক মানুষ। এত মিষ্টি ব্যবহার। কথাবার্তায় মনেই হয় না লোকটা পকেটে পিস্তল নিয়ে ঘোরে!’

‘অ্যা, পিস্তল নিয়ে ঘোরে!’ লোকমান, মজিদ দুজনেই চমকে ওঠে।

‘হ্যাঁ, উনি তো পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে আছেন। পকেটে একটা-দুটো পিস্তল না হলে চলে না।’

‘শোনেন চাচামিয়া, আপনি দরজা খুলবেন না। কলবেল টিপা বিরক্ত হইয়া চইলা যাক।’

‘দেখো বাবা, সেটা বোধ হয় ঠিক হবে না। যদি দেখে আমি দরজা খুলছি না, কী সন্দেহ করতে কী সন্দেহ করবে, জানো তো ওই গোয়েন্দাদের মন বড় সন্দেহপ্রবণ, পরে দেখবে এক দল পুলিশ নিয়ে হাজির হয়ে যাবে।’

‘ওস্তাদ আমরা শ্যাষ!’ মজিদ ভড়কে গিয়ে বলে।

‘সব তোর গাফিলতির কারণে, এদের প্রতিবেশী যে পুলিশ, এটা তুই খোঁজ নেসনি ক্যান?’

‘ওকে বকাঝকা করছ কেন, গোয়েন্দা পুলিশদের দেখে কখনো বোঝা যায় যে ওরা পুলিশ? ওরা খুব ছদ্মবেশী। তার চেয়ে আমি যা বলি তা শোনো। একটা উপায় আছে না ধরা পড়ার।’

‘কী উপায়?’

‘তোমরা আপাতত লুকিয়ে থাকো। কোনো শব্দটব্দ করো না। বদরুল সাহেব চলে গেলে তারপর যেয়ো।’

‘কই লুকাব?’

‘যেখানে ইচ্ছা, খাটের তলে, বাথরুমে, ওয়ার্ডরোব। যেটা তোমাদের সুবিধা!’

‘খাটের তলে আমি ঢুকতে পারব না, ওটা করে চোরেরা, আমি তো ডাকাত!’ সাফ জানায় লোকমান।

‘আমি ওয়ার্ডরোবে ঢুকতে পারুম না ওস্তাদ, এসব জায়গা নিয়া অনেক ভূতের ছবি দেখছি।’

‘ঠিক আছে, এই যে এই রুমের লাগোয়া বাথরুম আছে, এখানে ঢুকে পড়ো। বদরুল সাহেব বের হলে আমি তোমাদের ডেকে দেব!’

ওরা আর দেরি না করে হন্তদন্ত হয়ে বাথরুমে গিয়ে সেঁধোয়। টাকাপয়সা-গয়না সব নিয়েই ঢোকে।

গেট ততক্ষণে মিন্টু খুলে ফেলেছে। ইকবাল সাহেব কাছে যেতে দেখে, মিন্টুর সামনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে। একজন বেশ বয়স্ক, আরেকজনের বয়স আন্দাজ করা যাচ্ছে না, তবে বিশ-একুশের বেশি হবে না, দুজনের গায়ে চকচকে সাদা পোশাক, পোশাকটা কেমন অদ্ভুত। পা থেকে গলা পর্যন্ত মনে হচ্ছে একই, কিছুটা ডুবুরির সাঁতারের পোশাকের মতো। ইকবাল সাহেবকে দেখেই বৃদ্ধ লোকটা জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘অবশেষে আপনাকে পেলাম, ভাইয়া। আপনি মেলায় হারিয়ে গিয়েছিলেন।’

‘আমার নাম মির কাহার, আমি আপনার ছোট ভাই,’ তারপর পাশের জনকে দেখিয়ে বললেন, ‘এ আমার নাতি, সুব্রান। কত কষ্ট করে যে এই ঠিকানা বের করেছি।’

ইকবাল সাহেব বললেন, ‘বলো কী! আচ্ছা ভেতরে আসো!’

মিন্টু অবাক হয়ে বলল, ‘দাদু সত্যি সত্যি? একই দিনে তোমার দুই ভাই এসে হাজির? দুজনেই মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল?’

ইকবাল সাহেব আমতা আমতা করে বলেন, ‘হ্যাঁ, তাতে অত অবাক হচ্ছিস কেন, আগে মেলায় অমন খুব ভাই হারাত, একসঙ্গে দু-তিনজনও হরহামেশা হারাত!’

ইকবাল সাহেব তারপর মিন্টুকে তাড়া দিয়ে বললেন, ‘যা, তুই বরং পড়তে বস। আমি এদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করি।’

মিন্টু যেতেই ইকবাল সাহেব লোক দুটিকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে বসালেন। লোকগুলো চারপাশে চোখ বুলিয়ে ভালো করে দেখছে, ইকবাল সাহেবের মনে হলো কোথায় কী কী আছে তা দেখে নিচ্ছে—একটু পরেই হয়তো ডাকাতি শুরু করে দেবে।

তিনি তারপর কেশে কড়া করে বললেন, ‘এবার তোমাদের আসল পরিচয় বলো। আমার মেলায় কোনো ভাই হারায়নি, আমি নিজেও হারাইনি। ওসব ফালতু কথা বলবে না। তোমাদের মাথায় কি একটুও বুদ্ধি নেই, আরও বিশ্বাসযোগ্য কিছু বলতে পারলে না? মেলায় হারানো ভাই-ই বলতে হলো, ছি! ছি! মিন্টুটা যদি বুঝে ফেলে!’

বয়স্ক লোকটা যার নাম মির কাহার তিনি জবাবে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘ভাইয়া, আপনি আসলে হয়তো ব্যাপারটা বিশ্বাস করবেন না। আমি আপনার ভাই-ই, আপনার চেয়ে ছয় বছরের ছোট। আর এই সুব্রান, এ আমার নাতি, মানে আপনারও নাতি।’

‘তোমরা কি আমাকে বোকা ভেবেছ? এই গল্প খানিকক্ষণ আগে আমি বানিয়েছি। আর তোমাদের আগেই বলেছি, আমার কোনো ভাই হারায়নি। তোমরা ডাকাত না চোর, সেটা ঠিকঠাক এখনই বলো। টাকাপয়সা যা আছে বের করে এখনই দিয়ে দিচ্ছি। নিয়ে কেটে পড়ো!’

সুব্রান যার নাম সে এবার এগিয়ে এসে ইকবাল সাহেবের পায়ের কাছে বসল, ‘দাদু! আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না। আমাদের জগতে আসলেই আপনি হারিয়ে গেছিলেন।’

‘তোমাদের জগতে মানে?’

মির কাহার বললেন, ‘ভাইয়া, আমরা আসলে এ জগতের না। তবে আপনি বোধ হয় জানেন, পাশাপাশি অনেক জগত্ থাকে। জগত্গুলো বেশ কাছাকাছি, তবে অনেক তফাতও আছে। যেমন ধরেন, এ জগতে যে ভিখিরি, হতে পারে আরেক জগতে সে রাজা-বাদশাহ টাইপ।’

ইকবাল সাহেব বুঝতে পারলেন, তিনি আরও বড় ধরনের ধাপ্পাবাজদের পাল্লায় পড়েছেন। তিনি কোনোমতে নিজেকে শান্ত রেখে ওদের কথা শুনে যেতে থাকেন, ‘তো আমাদের জগতে আপনি আমার বড় ভাই। মানে অবিকল আপনার মতোই একজন বড় ভাই আমার ছিল ঠিক এক সপ্তাহ আগেই। আমাদের জগতে প্রতিবছর একটা মেলা হয়। সে মেলাতে আমাদের পৃথিবীর অনেক অনেক মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয়, হইহল্লা, আনন্দ-ফুর্তি করে। আমরা আমাদের পৃথিবীর বেশ ক্ষমতাধর মানুষ, আমাদের পরিবার পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী আর ক্ষমতাবান পরিবার। তো গত সপ্তাহে সে মেলায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা যে মঞ্চে ছিলাম, সেখানে দুর্বৃত্তরা হামলা করে, তাতে নিহত হন আমার ভাই, মানে আপনারই প্রতিরূপ যিনি তিনি আরকি। যদিও আমাদের পৃথিবীর বাকিরা জানে আপনি বেঁচে আছেন, আমরা মৃত্যুর ঘটনাটাকে চাপা দিতে সক্ষম হই,’

‘চাপা দিতে হলো কেন?’

‘কারণ হলো, আপনি আমাদের পৃথিবীর নবনির্বাচিত নেতা। মাত্র এক মাস আগেই আপনি নির্বাচিত হয়েছেন। এখনই আপনি মারা গেলে আমাদের পরিবারের ক্ষমতা কমে যাবে। তাই আমরা বিশেষ উপায়ে অন্য জগতে আপনাকে খুঁজে বের করেছি। এখন আপনাকে আমরা নিয়ে যাব।’

ইকবাল সাহেব এখনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আজকাল গপ্পোবাজি কী পর্যায়ে চলে গেছে, তা-ই তিনি ভেবে পাচ্ছেন না।

‘তোমাদের কথা সত্যিও যদি হয়, তোমাদের সঙ্গে আমি যাব, সেটা ভাবলে কী করে?’

‘না যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। আমরা খোঁজ নিয়েছি এখানে আপনি নিতান্ত কর্মহীন ক্লান্তিকর জীবন কাটাচ্ছেন। আমাদের জগতে আপনি হবেন প্রবল ক্ষমতাধর, আমাদের উন্নত প্রযুক্তি আপনাকে এমনকি যৌবনের স্বাদও এনে দেবে। এ জগতে বড়জোর আর ১০-২০ বছর বাঁচবেন। আমাদের ওখানে আরও অন্তত ১০০ বছর বেঁচে থাকতে পারবেন।’

‘দাদু, তোমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তা-ই না?’ সুব্রান জিজ্ঞেস করল।

‘মোটেও না! তোমাদের উদ্দেশ্য কী সেটা খুলে বলো, এসব হাবিজাবি কথা রাখো! আগেই বলেছি, টাকাপয়সা যা আছে তা আমি নিজে তোমাদের বের করে দেব!’

সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে সুব্রান ওর পকেট থেকে একটা ক্রিস্টালের মতো বস্তু বের করে। ওটাতে হাত রাখতেই ঘরের ভেতর একটা নীলচে আলোর জানালা তৈরি হলো। সেটা দেখে ইকবাল সাহেব কিছুটা চমকালেন। এমন কিছু তিনি আগে কোথাও দেখেছেন বলে মনে পড়ল না।

‘এটা হচ্ছে একটা পোর্টাল।’ সুব্রান বলল, ‘এমন একটা পোর্টাল দিয়েই আমরা আপনার জগতে এসেছি। এটা দিয়ে আপনি আমাদের জগত্টা দেখতেও পাবেন।’ বলেই সুব্রান হাতের ইশারায় কিছু একটা করল।

noname
noname

সঙ্গে সঙ্গে জানালায় কিছু দৃশ্য ফুটে উঠল। একটা শহরের ছবি দেখা যাচ্ছে। অনেক উঁচু উঁচু ঘরবাড়ি, তবে সেসব চেনা পৃথিবীর মতো নয়, মনে হচ্ছে বাড়িগুলো ঢেউ খেলানো, সবুজ, লালচে আর বাদামি রঙের গাছে ছেয়ে আছে চারপাশ, সাঁই সাঁই করে তার মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছে অচেনা যানবাহন। সুব্রান আরেকটা ইশারা করতেই সে দৃশ্য পাল্টে গেল। এখন দেখা যাচ্ছে সমুদ্রপারের একটা বাড়ি, পুরো বাড়িটা মনে হচ্ছে কাচের তৈরি। এত বড় যে প্রাসাদ বলাই যুক্তিযুক্ত। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বাড়ির চারপাশে। প্রচুর মানুষজন সেটার ভেতরে, তা বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

সুব্রান বলল, ‘দাদু, এটা আমাদের বাড়ি। এ বাড়িতেই তুমি থাকতে, মানে আমাদের ওখানে তোমার যে প্রতিরূপ সে থাকত।’

ইকবাল সাহেব মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে দেখতে বুঝলেন, ব্যাপারটা তিনি যতটা সহজ ভেবেছেন আসলে তা নয়। এরা হয়তো সত্যি সত্যিই অন্য জগতের বাসিন্দা এবং এদের ক্ষমতাও অনেক।

সুব্রান বলে চলছে, ‘তা ছাড়া আমাদের পৃথিবী অনেক প্রাচুর্যময়, তোমাদের এখানে যেসব মূল্যবান রত্ন হিসেবে লোকে জানে, সেসব আমাদের পথেঘাটে ছড়ানো থাকে।’ বলতে বলতে সুব্রান একটা পার্কের দৃশ্য দেখায়, ‘দেখো এই পার্কের প্রতিটা বেঞ্চি সোনায় মোড়ানো, হীরা-চুনি গোঁজা। আমাদের ওই পৃথিবীতে অভাব বলে কিছু নেই। সবচেয়ে গরিব লোকটিও তোমাদের জগতের শ্রেষ্ঠ ধনীর চেয়ে ধনবান।’

 আজ সত্যি সত্যিই ওরা তাকে ওদের জগতে নিয়ে যাবে, তা ইকবাল সাহেব বুঝে ফেললেন। তিনি শেষ চেষ্টা করলেন, ‘দেখো, আমি বুঝতে পারছি তোমরা জরুরি প্রয়োজনেই আমাকে নিতে এসেছ। কিন্তু দেখো, আমার জগতে আমি আনন্দেই আছি, অন্য জগতে আমি সম্রাট হয়ে থাকতে রাজি নই। আরও ১০০ বছর বাঁচার চেয়ে আমার নাতি মিন্টুকে নিয়ে আর ১০ বছর বাঁচতে পারলেই আমি খুশি।’

সুব্রান বলল, ‘দাদু, তোমার থেকে এটা শুনব, সেটা আমি জানতাম, আমাদের জগতে তুমি আমাকেও অতি স্নেহ করতে। তবে সে জগতে গিয়ে যাতে তোমার কষ্ট না হয়, সে জন্য তুমি আমাদের সঙ্গে আরও একজনকে চাইলে নিয়ে যেতে পারবে। সে ব্যবস্থা আমরা করেছি। এক জগত্ থেকে আরেক জগতে যাওয়াটা বেশ কঠিন। এর জন্য যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন হয়, তা জোগান দিতে আমাদের প্রায় মোট সম্পদের অর্ধেকটা খরচ করতে হয়েছে। তারপরও আমরা তুমিসহ আরও একজন যাতে যেতে পারো সে ব্যবস্থা করেছি। তুমি মিন্টুকে নিয়ে আসো। এই জানালা দিয়ে আমরা এখনই চলে যাব।’

ইকবাল সাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘দেখো ছেলে, তুমি বুঝতে পারছ না। আমি এখানে শুধু মিন্টুকে নিয়ে থাকি না, মিন্টুকে নিয়ে আমি যদি চলে যাই, মিন্টুর বাবা-মা শোকে-দুঃখে পাগল হয়ে যাবে। আমিও ওদের ছেড়ে কোথাও যাব না।’

এবার মির কাহার বলল, ‘আসলে ভাইয়া, আপনার হাতে আর কোনো উপায় নেই। আপনি যেতে না চাইলেও আমরা আপনাকে জোর করে নিয়ে যাব।’

‘কী বলতে চাইছ তুমি?’

‘আসলে আমরা বেশ বড় বিপদে পড়েছি। তা ছাড়া ও জগতে কয়েক দিন থাকলে আপনিও বুঝে যাবেন, কত দারুণ একটা জায়গায় আপনি চলে এসেছেন। আপনি এখন যেতে না চাইলে আমরা আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপনাকে আমাদের ইচ্ছাধীন বানিয়ে নিয়ে যাব। এমনকি মিন্টুকেও। আমরা হিসাব করে দেখেছি, প্রাথমিক সময়টা আপনাকে ধাতস্থ রাখতে এ জগতের একজন পরিচিত মানুষও আমাদের নিতে হবে।’

এখনই পোর্টালটা তৈরি হবে। আপনি দয়া করে মিন্টুকে নিয়ে আসুন।

বয়স্ক লোকটির কথা শেষ হওয়ামাত্রই ঘরের আলোর জানালাটা বড় হয়ে একটা দরজার সমান হয়ে গেল।

ঠিক সে সময়ে এমন একটা ঘটনা ঘটল যে ওরা কেউই সেটার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

এতক্ষণ ওদের সব কথাই বাথরুম থেকে বের হয়ে পর্দার আড়ালে বসে শুনেছে মজিদ ও লোকমান। সব শুনে ওরা বুঝেছে, ওই জগতে ওদের যাওয়া চাই। যেখানে পথেঘাটে সোনা-হীরা পড়ে থাকে, সেই দেশে যে করেই হোক ওদের যেতে হবে। তাই পোর্টালটা তৈরি হওয়ামাত্রই ওরা পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে দুজনেই একযোগে তাতে ঝাঁপ দিল। একটা তীব্র আলোর ঝলক দিয়ে ওরা মিলিয়ে গেল।

ব্যাপারটা কী হলো সেটা বুঝতে ওদের খানিকটা সময় লাগল। মির কাহার এবং সুব্রানের মুখেও দেখা গেল ভীতি।

‘এরা কে ছিল? কেনই বা ওরা পোর্টালটা ব্যবহার করল?’

ইকবাল সাহেব বললেন, ‘ওরা এ বাড়িতে ডাকাতি করতে ঢুকেছিল। নিশ্চয়ই এতক্ষণ আমাদের কথা লুকিয়ে শুনেছে। প্রাচুর্যের লোভেই হয়তো ওরা তোমাদের জগতে চলে গেছে। ওদের কোনো ক্ষতি করো না, ওরা বোকা ধরনের।’

মির কাহার ও সুব্রান খানিকক্ষণ নিজেদের মধ্যে অন্য কোনো ভাষায় কথা বলল। ইকবাল সাহেব বুঝলেন, ওদের ভাষাও ভিন্ন। এতক্ষণ নিশ্চয়ই কোনো অনুবাদ যন্ত্রের মাধ্যমে কথা বলেছে।

মির কাহার খানিক পর ইকবাল সাহেবের দিকে ফিরে বললেন, ‘আসলে ওরা আমাদের বেশ বড় ধরনের ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। আমাদের পোর্টালের শক্তি অনুযায়ী আমরা ছাড়া আর দুজন লোকই নেওয়া যেত, ওরা দুজন চলে যাওয়ায় আপনাকে বা মিন্টুকে আর নেওয়া যাবে না এখন। আবার নতুন করে পোর্টাল তৈরি করে তবে আসতে হবে।’

ইকবাল সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, ‘ওদের কী হবে?’

‘ওরা শিগগিরই আমাদের নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে ধরা পড়বে। তবে বড় কোনো ঝামেলা যেন না হয়, সেটা আমরা নিশ্চিত করব।’

‘তার মানে তোমরা কি আবার আমাকে নিতে আসবে?’

সুব্রান মুখ কালো করে বলল, ‘সে সম্ভাবনা খুব কম দাদু। পুনরায় এই পোর্টাল তৈরি করতে যে সম্পদ প্রয়োজন, সেটা আমাদের নেই। তুমি ওখানে না থাকলে সেটা জোগাড় করা আরও কঠিন হবে। ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন না হলে হয়তো আর আসা হবে না।’

কথা শেষ করে ওরা আর দাঁড়ায় না। পোর্টালটা দিয়ে একসঙ্গে দুজনেই চলে যায়। আলোর দরজাটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।

****

মিন্টু খানিক পর এসে দেখে দাদু একা রুমে বসে কী যেন ভাবছে।

‘কী দাদু, তোমার অতিথিরা কই? কাউকেই যে আর দেখছি না।’

ইকবাল সাহেব  মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘সব অন্য তিথিতে চলে গেছে! চল আমরা আজ বাইরে থেকে ঘুরে আসি। বাসায় থেকে আর ভালো লাগছে না।’

‘সত্যি বলছ? আমি যেন পড়ায় ফাঁকি না দিই সে জন্য তুমি বাসায় রয়ে গেলে, তুমি বলছ ঘুরে আসতে?’ মিন্টু সন্দেহ প্রকাশ করে।

‘এক দিন না পড়লে কিছু হয় না। পরিচিত পৃথিবীতে এক বেলা ঘুরে বেড়ানোর জন্য, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য সম্রাট হওয়ার অনুরোধও ছাড়া যায়, আর আছিস তুই পরীক্ষা নিয়ে। চল চল!’

মিন্টুর দাদুকে আজ কেন যেন অচেনা মনে হয়!

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী