মুক্তির আনন্দ

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

এটা করোনাকালের গল্প। রাজধানীর শেওড়াপাড়ার শাপলা সরণির একটি গলি। এই গলির ৪৪৫ নম্বর বাসার ছয়তলায় এক ফুফুর বাসায় এসেছে রুদ্র।
এসেছিল করোনা শুরুর আগেই। কিন্তু এসেই আটকে গেছে। লকডাউনের পাল্লায় পড়ে অনেক দিন থেকে যেতে হয় তাকে।
দোকানপাট, রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে কেমন অচেনা হয়ে গেল কদিনের মধ্যেই।
প্রত্যেকেই কেমন করে যেন সেঁধিয়ে যায় নিজের মধ্যেই।
সরকারি নির্দেশমতো বেশ কদিনের প্রয়োজনীয় খাবারদাবার কিনে ঘরে গিয়ে অন্তরীণ হয়েছে শহরের অনেক মানুষ।
হোটেল-রেস্তোরাঁ সব বন্ধ। লোকজনে গমগমে হয়ে থাকা অলিগলি নিমেষেই ভুতুড়ে গলিতে পরিণত হয়েছে। খুব দরকার না পড়লে ঘর থেকে কেউ বের হচ্ছে না। বের হলেও মুখে মাস্ক এঁটে, হাতে গ্লাভস পরে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রয়োজনীয় কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে ঘরে ফিরে জীবাণুনাশক স্প্রে করে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাতে মাখছে। পরিহিত কাপড়চোপড় সাবান–পানিতে ডুবিয়ে নিজেও সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয়ে, গোসল করে তবেই ঘরে ঢুকছে সবাই। এটা নিত্যসময়ের ঘটনা।
এসব দেখে দেখে রুদ্র রীতিমতো বিরক্ত।
তার ওপর অধিক বিরক্ত ঘরের ভেতর কাজহীন বসে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে।
কত আর ঘরের চার দেয়ালে বন্দী থাকা যায়? কিন্তু উপায়ও নেই। এসব না মানলে ভাইরাসটা নিষ্ঠুরভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে যে!
প্রতিদিন বেলা আড়াইটায় টিভিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে গেল ২৪ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্ত এবং নতুন করে হতভাগ্যদের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হচ্ছে। দেখতে দেখতে মৃত্যুর সংখ্যা হাজার অতিক্রম করেছে। তবু মহামারি করোনার বিস্তারের থাবা কমছে না কিছুতেই। এর কোনো প্রতিষেধক নেই। চেষ্টা চলছে আবিষ্কারের। বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী-চিকিৎসক কোভিড–১৯–এর সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ভ্যাকসিনেশন তালাশ করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন।

দুই
আজ তিন দিন। রুদ্র দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না। এই কয় রাত তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। মানবিক দহন তাকে ঘুমাতে দেয়নি। প্রতি রাতই যেন এক একটা দুঃস্বপ্নের রাত। রুদ্রর মনে হচ্ছে এই মহল্লার মানুষ কানে সিসা ঢেলে বধির হয়ে ঘুমাচ্ছে। এই ঘুম যেন সবার শেষ ঘুম। কুম্ভকর্ণের ঘুম।
একটা কুকুর ও তার প্রাণাধিক ছানার করুণ কান্নার আওয়াজ তাকে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্ধ করছে। বিছানাটা অবিকল কাঁটার মতো ফুটছে তার সারা শরীরে।
অথচ প্রতিটি দিন, প্রতিটা রাত আগের মতো না হলেও নিতান্ত বাধ্য হয়ে বাইরে বের হওয়া মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম নয়।
কুকুরের কান্নার পাশাপাশি কমিউনিটির সিকিউরিটি গার্ডের বাঁশির আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। মহল্লায় ঠাসাঠাসি বহুতল ভবন।
এই ভবনগুলোতে অসংখ্য মানুষ বাস করে। কিন্তু কুকুর ও তার ছানার এই সকরুণ আকুতি, বুকফাটা আর্তি কাউকে টলাতে পারেনি।
রুদ্র এখানকার কেউ নয়। ও ভেবেছিল এখানকারই কেউ না কেউ কুকুর ও তার ছানাকে ঠিক সাহায্য করবে।
ঠিক নিচে কী ঘটছে, তা–ও আঁচ করতে পারছে না রুদ্র। কারণ অনেক দিন হলো নিচে নামে না ও। নিচে নামতে ফুফু নিষেধ করেছেন।
তিন–তিনটা দিন পার হলে রুদ্র আর সহ্য করতে পারল না। ও দেখতে চায় কুকুর ও তার ছানাটার আসলে হয়েছেটা কী? কেনইবা দিনের পর দিন এভাবে অনবরত কেঁদে চলেছে? আর কেনইবা তারা এই মহল্লার মানুষগুলোর এত এত হৃদয়ভাঙা কুকুরকান্নার পরও কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না।
আজও এক ফোঁটা ঘুমাতে পারল না রুদ্র। এখন সকাল হওয়ার অপেক্ষামাত্র।
ঠিক তখনো সকাল হয়ে ওঠেনি। রুদ্র আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। দরজাটা একঝটকায় খুলে অতি দ্রুত সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল।
রুদ্রর ফুফু কেবল ফজরের নামাজ শেষ করেছেন। এই ভোর না হতেই রুদ্রর অমন করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখে তিনি হকচকিয়ে গেলেন।
‘রুদ্র, রুদ্র, এত ভোরে কোথায় চললি বাবা?’ বলে তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন।
ফুফুর বলা কোনো কথাই বুঝি কানে ঢুকল না রুদ্রর। ও একেবারে দম বন্ধ করে নিচে নেমে এল বাতাসের গতিতে।
ফজরের আজান হলেই ফ্ল্যাটের মূল গেট খুলে দেওয়া হয়। রুদ্র তা জানে। ও যেন এই সময়েরই অপেক্ষা করছিল রাতভর। তারপর মূল গেট পার হয়ে ছুটল কুকুর ও তার ছানার কাছে। যেখানে ওরা ক্রমাগত আর্তনাদ করে চলেছে।
গিয়ে যা দেখল, তাতে রুদ্রর চোখ ফেটে পানি বের হয়ে এল। মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে এল।
ফুফুদের দুই ফ্ল্যাট পরেই দুই ভবনের মধ্যে গ্রিলের মধ্যে অসহায় এই প্রাণী দুটো আটকা পড়েছে। দুই ফ্ল্যাটের মাঝখানের গ্রিলে তালা ঝুলছে। তার ফাঁক গলে বা লাফিয়ে বের হয়ে আসার কোনো পরিবেশ নেই। আশপাশ দেখে বোঝাই যাচ্ছে সেই চেষ্টাও মা-কুকুর বাদ রাখেনি। সব ব্যর্থ হয়েছে তার।
সব মিলে রুদ্র বুঝলা—
এই করোনাকালে কোথাও কোনো খাবার জুটছে না তাদের। আগে হোটেল-রেস্তোরাঁ খোলা থাকলে মানুষের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট, এঁটোকাঁটা খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই সময় সব হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে চরমভাবে। ফলে কুকুর ও তার ছানা খাবার খুঁজতে খুঁজতে এই দুই ভবনের মধ্যে গ্রিল খোলা পেয়ে ঢুকে পড়ে।
এই ফাঁকে কেউ একজন গ্রিল বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আর এরই সঙ্গে মা-কুকুর ও তার ছানার বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথমে নিজে নিজে বের হওয়ার চেষ্টা করে যখন না পেরেছে, তখন থেকেই মা আর ছানায় ক্ষুধার জ্বালায় প্রাণ কাঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। ছানাটা সম্ভবত দুধ ছাড়া অন্য কিছু খেতে শেখেনি এখনো। কয়েক দিন খেতে না পারায় মায়ের বুকেও আর দুধ নেই। শুকিয়ে গেছে। দুধ না পেয়ে ছানাটা কেবলই কাঁদছে আর কাঁদছে। অন্যদিকে নিজের বুকে দুধ না থাকায় ছানাটার কষ্টে তার বুক ফেটে যেতে চাইছে। আর নিজের ক্ষুধা তো রয়েছেই।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এই এলাকার একজন মানুষেরও হৃদয় গলাতে পারেনি তারা।
কান্নার শক্তি নেই, তবু বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় বিরামহীন কেঁদেই চলেছে দুটো প্রাণী।
রুদ্র যেমন ছুটে এসেছিল, তার অধিক গতিতে ছুটে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগল আবার।
ওই ঘটনাগুলো বুঝতে তেমন সময় নেয়নি রুদ্র। ফলে ও যখন আবার দ্রুতগতিতে ওপরে উঠছিল, তখন তিনতলার ল্যান্ডিংয়ে দেখা হয়ে যায় ফুফু ও ফুফার সঙ্গে। তারা হন্তদন্ত হয়ে তাকেই খুঁজতে বেরোচ্ছিলেন।
রুদ্ধশ্বাসে আবার ওকে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে দেখে তারা আরও বিস্মিত হলেন।
ফুফু আর ফুফাকে দেখে রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ফুফু শিগগিরই কিছু ভাত দাও। কুকুর ও তার ছানাটা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে।
ও আর কাউকে কথা বলার সুযোগ দিল না। দ্রুততার সঙ্গে আবার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগল।
অগত্যা ফুফু আর ফুফা ওর পিছু নিলেন।
রুদ্র ঘরে ঢুকেই স্টোররুমে থাকা শাবল নিল। তারপর এক গামলা ভাত নিয়ে ছুটল নিচে।
এই কাজটুকু করতে ওর খুব বেশি সময় লাগল না।
তখনো মহল্লার মানুষের ঘুম ভাঙেনি। অলিগলি একেবারেই সুনসান।
রুদ্র গিয়ে প্রথমেই শাবল চালিয়ে তালা ভাঙতে শুরু করল। গায়ের সব শক্তি দিয়ে কয়েক ঘা লাগাতেই তালাটা আলগা হয়ে গেল।
কুকুর ও তার ছানা তারস্বরে রুদ্রর আসার আগে সমানে কেঁদে যাচ্ছিল। পরে রুদ্রর শাবল নিয়ে সামনে দাঁড়াতে দেখে ওরা বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিছুটা পেছনের দিকে দৌড়ও দিয়েছিল। অবশ্য দৌড়ানোর মতো তেমন শক্তি তাদের শরীরে অবশিষ্ট ছিল না বললেই চলে। শাবল হাতে দেখে তাদের মারপিঠ করা হবে, এটাই ভেবেছিল ওরা।
রুদ্র তালা আলগা হতেই শাবল ফেলে ভাতের গামলা নিয়ে মুখে ‘চুক চুক’ শব্দ করে ওদের ডাকল। বুঝিয়ে দিল, সে ওদের শত্রু নয়, বন্ধু। কুকুরেরা এই শব্দে অভ্যস্ত। কেউ খাবার বা আদর দিতে চাইলেই কেবল অমন শব্দ করে। ওরাও যেন সাহস ফিরে পেল কিছুটা।
এর মধ্যেই রুদ্র ভাতের গামলাটা মাটিতে নামিয়ে রেখেছে। আর যায় কোথায়? সব সংশয় ঝেড়ে ফেলে কুকুর ও তার ছানা ভাতের গামলায় হামলে পড়ল। আর বুভুক্ষুর মতো খাবলে খাবলে ভাত খেতে লাগল। থেমে গেল তাদের তিন দিনের অনবরত বুকফাটা চিল-চিৎকার।
এই দেখে রুদ্রর চোখ ফেটে আবারও অশ্রু নেমে এল।
তালা ভাঙার সময় বেশ শব্দ হয়েছিল বটে! সেই শব্দে অনেকেই পায়ে পায়ে সেখানে এসে হাজির হলো। একটা অল্প বয়সী ছেলের এই কাণ্ড দেখে কেউ কিছু বলতে পারল না।
বলবে কী? সবার থোঁতা মুখ তখন ভোঁতা হয়ে গেছে। কিছুটা লজ্জা আর অপরাধবোধ কাজ করছে কারও কারও মধ্যে।
এদিকে কুকুর ও তার ছানা কদিন না খেতে পেয়ে হঠাৎ এতগুলো ভাত একসঙ্গে পেয়ে যেন জ্ঞানহারা হয়ে গিয়েছিল। খুব দ্রুত খেতে গিয়ে তাই হাঁপিয়ে উঠল একসময়।
ছানাটা ঠিক তখনো ভাত খাওয়া শিখে ওঠেনি। তবু মায়ের দেখাদেখি সে–ও ভাত খাবার জন্য কসরত করল। কতটা খেতে পারল, কে জানে?
একসময় মা-কুকুরটা খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকল রুদ্রের দিকে করুণ আর মায়াময় চোখ নিয়ে।
অন্য যারা ছিল, তাদের দিকেও ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল মা-কুকুর। কিন্তু তাতে কেমন একটা ভয় আর ঘৃণা জড়ানো ছিল।
পাশাপাশি একটা নিঃশর্ত মুক্তির আনন্দ ওদের চোখেমুখে খেলা করতে দেখল রুদ্র। এ সময় মা-কুকুরটা এসে রুদ্রর পা শুঁকতে লাগল। মায়ের মতো ছানাটাও কুঁইকুঁই শব্দ করে ছোট্ট লেজটা নাড়াতে নাড়াতে এগিয়ে এসে রুদ্রর পায়ে গা ঘষতে শুরু করল।