সেবার হলো কি, আমি আর আমার মেয়ে পদ্য বসে আছি হিথরো এয়ারপোর্টে। পদ্যর বয়স তখন ১৩। আমরা যাব নিউইয়র্ক। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে আমরা লন্ডন পর্যন্ত এসেছি। এরপর আমাদের আমেরিকান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ধরতে হবে। আমার আমেরিকা যাত্রাটা আবার আমেরিকানদের দাওয়াতে, আমেরিকানদের পয়সায় পরিচালিত হচ্ছে। কাজেই যতটা পারা যায়, আমাকে আমেরিকান উড়োজাহাজে উঠতে হবে, যাতে আমেরিকানদের টাকা আমেরিকানদের পকেটেই যায়।
আমাদের পরবর্তী ফ্লাইট প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে। আমেরিকানরা সাধারণত কিপ্টে হয়ে থাকে, তারা ইকোনমি ক্লাসের টিকিট দেয়, কিন্তু এবার তারা আমাকে বিজনেস ক্লাসের টিকিট দিয়েছে। আর মেয়েকে যেহেতু নিয়ে যাচ্ছি, আমি হাসিমুখে ওর জন্য একটা বিজনেস ক্লাস টিকিট কিনে নিয়েছি। বলা বাহুল্য, নিজের টাকায়। বারবার হাসিমুখে মেয়েকে বলছি, কোনো ব্যাপার না! কয়টা টাকার জন্য লোকে যে কেন ইকোনমি ক্লাসে যায়! এই হাসিটা ধরে রাখতে গিয়ে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। এতগুলো টাকা বেরিয়ে গেল! মেয়ে যদি তার মর্মটা বুঝত। সে ধরেই নিয়েছে, বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণই তার প্রাপ্য।
তবে একটা জিনিস খুব ভালো লাগছে। আমাদের ট্রানজিটের ছয় ঘণ্টা খুব আরামে কাটছে। ফাইভ স্টার ফ্যাসিলিটি। আমরা একবার এটা খাচ্ছি, আরেকবার ওটা খাচ্ছি। ডিউটি ফ্রি শপিংয়ের দিকে আমি ভুলেও যাচ্ছি না। গেলেই মেয়ে একটা পিএসপি হাতে নিয়ে বলবে, আগেরটা থ্রিডি ছিল না, এটা থ্রিডি, কিন্তু আমরা এটা কিনব না, তাই না বাবা? আমার টিকিটে তোমার অনেক টাকা গেছে। তখন আমার ফাটা ঠোঁটে হাসি বের করে তাকে ওটা কিনে দিতে হতো। ঠোঁটে অনেক ব্যথা লাগত।
আমরা যেখানটায় বসে আছি, সেই জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। এদের এসি এমন কাজ করছে যে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার অবস্থা। মেয়ে বলল, বাবা, আমি ওই কম্পিউটারটায় একটু বসি। একটু মেইল চেক করব।
আমি বললাম, তোমাকে আবার মেইল করবে কে?
মা করতে পারে।
আমি বললাম, যাও, করো।
একা একা বসে আছি। আমার পাশে একটা তরুণ এসে বসল। হালকা-পাতলা। সবুজ আপেলের মতো ভ্যাদভেদে গায়ের রং। চোখের দৃষ্টি একটু উদ্ভ্রান্ত। তবে পুরো মুখ দেখা যাচ্ছে না। তীব্র ঠান্ডা বলেই হয়তো ছেলেটা মাথাটা হুডি দিয়ে ঢেকে রেখেছে। গলায়ও একটা মাফলার।
তার দিকে তাকিয়ে আছি, চোখে চোখ পড়ল। আমি বললাম, গুড মর্নিং। সে শুধু হাসল।
একটু পরে আমার মেয়ে এসে বলল, না, কম্পিউটারটা নষ্ট। ইন্টারনেট আসে না।
ওই তরুণটা স্প্যানিশ ভাষায় কী যেন বলল।
আমার মেয়ে স্প্যানিশ জানে কিছু কিছু। সে প্রথমে টেলিভিশনে নিক চ্যানেল দেখে স্প্যানিশ শিখে ফেলেছিল। তারপর তাকে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম।
সে পুরো একটা কোর্স সম্পন্ন করেছে। পদ্য তাড়াতাড়ি স্প্যানিশে কী যেন বলল।
আমি বাংলায় জিজ্ঞেস করলাম, পদ্য, কী বলল রে?
বলল, তোমরা কি হিস্পানিক? ও আমাদের লাতিন আমেরিকান ভেবেছে। তোমার গায়ের রং আর তোমার গোঁফটা তো হিস্পানিকদের মতোই। ওর কোনো দোষ দেওয়া যায় না।
আমি বললাম, তুমি কী বললা?
পদ্য বলল, আমি বলেছি, না, আমরা বাংলাদেশের, বাংলাদেশ ভারতের পাশে। আমার বাবা বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখক।
মেয়ে বাবার সম্পর্কে বাড়িয়ে বলেছে। তার বাবা মোটেও বিখ্যাত কেউ নন। তবে তিনি মেয়ের টিকিটের জন্য যে পরিমাণ টাকা খরচ করেছেন, মেয়ের উচিত বাবাকে জগদ্বিখ্যাত বলে অভিহিত করা।
ছেলেটা বলল, বাংলাদেশ। টেগোর।
আমি বললাম, ওকে জিজ্ঞেস করো, ওর বাড়ি কই?
পদ্য বলল, তোমার বাড়ি কই?
সে বলল, আর্জেন্টিনা।
আমি ইংরেজিতে বললাম, ইউ নো রবীন্দ্রনাথ টেগোর, ইউ নো ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো?
সে বলল, ইয়েস। তারপর আবার স্প্যানিশে কী যেন বলল। পদ্যকে জিজ্ঞেস করলাম, ও পদ্য, বেটায় কয় কী!
পদ্য বলল, হ্যাঁ, সব আর্জেন্টাইন শিক্ষিত লোকই টেগোর আর ওকাম্পোর নাম জানে।
আমি বললাম, ওকে বলো, আমাদের দেশের মানুষ আর্জেন্টিনার ফুটবলের বড় ফ্যান। আমরা বিশ্বকাপের সময় সারা দেশ নীল-সাদা পতাকা দিয়ে মুড়ে দিই।
পদ্য বলল। ছেলেটার চোখে হাসি। তারপর সে কিছু একটা বলল, পদ্যর অনুবাদে কথাটা হলো, তোমার বাবার একটা কার্ড দাও। আর আমি তোমার বাবার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাই। আমি লেখকদের পছন্দ করি। আমার গার্লফ্রেন্ডকে যদি দেখাই যে আমি রবীন্দ্রনাথের দেশের একজন লেখকের সঙ্গে ছবি তুলেছি, সে নিশ্চয়ই খুশি হবে।
আমি বললাম, আচ্ছা।
ছেলেটা তার ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে দিল।
আমি ওর পাশে দাঁড়ালাম। ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে একটা ভেটকি মারা হাসি দিলাম। আমার ফাটা ঠোঁটে আবার ব্যথা করল।
ছেলেটা হুড সরিয়ে দিয়েছে। মাফলারটা আছে।
পদ্য ছবি তুলতে গিয়ে কাঁপছে।
কাঁপতে কাঁপতে আমাকে বলল, বাবা, আমি ছবি তুলব। ও তো মেসি!
আমিও কাঁপতে লাগলাম। কী বলিস, ও মেসি! লিওনেল মেসি! হ্যাঁ, তাই তো। এই মেসি, তুমি আগে কইবা না যে তুমি মেসি...
পদ্য দাঁড়িয়েছে। আমি ক্যামেরায় ছবি তুলছি। ততক্ষণে ভিড় হতে শুরু করেছে। কোত্থেকে লোকজন এসে ঘিরে ধরল।
মেসি বলল, আমার ক্যামেরা দাও।
ওকে ওর ক্যামেরা ফেরত দিলাম, ও চলে গেল।
পদ্য বলল, বাবা, ছবি তো আমার ক্যামেরায় তুলি নাই। ওর ক্যামেরায়।
পদ্য ওকে বলল, বাবার কার্ড তোমার কাছে আছে। ছবি পাঠিয়ো। ই-মেইল কোরো। (পুরোটাই স্প্যানিশে)
ও চলে গেলে পদ্য চেঁচামেচি শুরু করল। আমাদের ক্যামেরা বের করতে পারলা না?
আমি বললাম, আমিও তো বোকা হয়ে গেছি। মেসির দেখা পাব এয়ারপোর্টে, এটা কি আমি স্বপ্নেও ভেবেছিলাম নাকি!
আশ্চর্য যে, এক সপ্তাহ পরই আমার ই-মেইলে আমাদের ছবি দুটো অ্যাটাচড ফাইলে চলে এল। মেসির পিএস লিখেছেন, মেসি তোমাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
আমি এখন আমার ল্যাপটপে মেসির পাশে ছবি দুটো দেখছি। হিথরোর বিজনেস ক্লাসের লাউঞ্জে তোলা ছবি।
আষাঢ় মাস। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার জানালা দিয়ে কদম ফুল দেখা যায়।
মেসির জন্য আমার মন কেমন করছে।
বি. দ্র. এটি একটি আষাঢ়ে গল্প। আমি এটা বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি। এটাকে যেন কেউ আবার সত্য বলে ভেবে না বসে। আমার সঙ্গে মেসির কখনো দেখা হয়নি। হয়েছে, দূর থেকে। গ্যালারি থেকে। আমি তাকে দেখেছি। তিনি আমাকে দেখেন নাই।