যমজ

অলংকরণ: তুলি

বিষয়টা নিজের ভেতরেই রেখেছিল রাবাত। আর পারল কই। রোববার দিন মাকে সে বলেই ফেলল কথাটা।

রাবাত যখন একা কোনো ঘরে থাকে, কে যেন তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। পেছন দিকে ঘুরে তাকালেই আবার সে নেই হয়ে যায়। প্রায়ই হয় এমন। বেশির ভাগ রাতে হয়। শুধু তা-ই নয়, দিনের বেলাতেও এমন হয়েছে কয়েকবার। সেদিন স্কুলে যাওয়ার সময়ও হলো। কে যেন তার পেছন পেছন হাঁটছিল।

মা শুনে বললেন, ‘তোর মনের ভুল, বাবা।’

‘আমিও তো সেটাই ভাবছিলাম, আম্মু। অনেক দিন বিষয়টা নিজের মধ্যেই রাখছিলাম। আজ আর তোমাকে না বলে পারলাম না।’

মা রাবাতের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিন্তু বাইরে বলতে থাকলেন, ‘ওসব হতেই পারে। মনের ভুল, আস্তে আস্তে কেটে যাবে।’

রাবাত পড়ে নবাবগঞ্জ পাইলট স্কুলে। ক্লাস এইটে। পড়াশোনায় খুব ভালো। ক্লাসের সেকেন্ড বয়। তাদের বাড়ির পাশে পুকুর। পুকুরের পাশ দিয়ে এখন বড় রাস্তা হয়েছে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টাই গাড়ি চলে। এক ঘণ্টায় ঢাকা শহরে পৌঁছে যাওয়া যায়। রাবাত একদিন ভেবেছিল, বাবার সাইকেল চালিয়ে ঢাকা শহরে চলে যাবে। যাওয়া হয়নি। সে শুনেছে, ঢাকার অর্ধেক পথ পৌঁছালে একটি গা ছমছম করা জায়গা আছে। দুদিকে বড় বড় তালগাছ। আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা। বাবা একবার সাইকেলে যাচ্ছিলেন শহরে। ঠিক গা ছমছম করা জায়গাতেই সাইকেলের চেইন নষ্ট হয়ে যায়। বাবা খুব ভয় পেয়েছিলেন। তার পর থেকে তিনি আর যাননি সাইকেলে। এখন ঢাকা যেতে হলে বাসেই যান। এসব কথা ভেবে তাই আর যাওয়া হয়নি রাবাতের।

সন্ধ্যাবেলা রাবাত পড়ছিল তার ঘরে। মা এসে তার চেয়ারের পাশে দাঁড়ালেন। রাবাতের মনে হলো কেউ এসে তার পেছনে দাঁড়াল। এমন সময়গুলোয় রাবাতের বুকে একটু ভয় দেখা দেয়। বুকের ধুকপুকানিটা একটু বাড়ে।

‘আজ থেকে আমি তোর ঘরে থাকব।’ রাবাত পেছন ফিরে দেখে, মা।

‘ও, তুমি। আমি ভেবেছিলাম...।’

‘কী ভেবেছিলি, তুই?’

‘না, কিছু না।’

রাবাত মায়ের কাছ থেকে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছে।

কিন্তু মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। মা বুঝে ফেললেন রাবাতের মনের কথা।

রাতের খাবারের পর রাবাত বলে, ‘আম্মু, আমি আমার ঘরে একাই শোব। তোমাকে থাকতে হবে না।’

মা তা-ই করলেন। খুব একটা জোরাজুরি করলেন না।

রাবাতের পড়ার ঘরই শোয়ার ঘর। ঘর থেকে তাদের পুকুরটা দেখা যায়। তার মনে হলো, পুকুরটায় কেউ ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। ঝাঁপ দেওয়াতে পুকুরে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

‘এত রাতে কে গোসল করে?’ মনে মনে ভাবে রাবাত। ঘরের কাছে একটা ল্যাম্পপোস্ট। তাতে মিটমিট করে একটা বাতি জ্বলছে। তার ইচ্ছে করে, একবার দেখে আসতে, কে গোসল করে। ড্রয়ার থেকে টর্চলাইটটা বের করে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সেদিকে। দূর থেকে মনে হয়, পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে কেউ গা মুছছে। গোসলের পর লোকজন যেভাবে গা মোছে। রাবাত সেদিকে টর্চ ধরল। কিন্তু না, কেউ নেই। দু-একবার পুকুরের পানি ফুলে উঠল যেন। পুকুরের দিকে সে তাকিয়ে আছে। হঠাত্ তার মনে হলো, পেছনে এসে কেউ দাঁড়াল। রাবাত বুকে সাহস সঞ্চয় করে। আজ তাকে দেখতেই হবে কে তার পেছনে দাঁড়ায়।

কে?

ঘুরে দাঁড়াল রাবাত। টর্চটা উঁচু করে ধরল।

হুবহু তার চেহারার মতো একটি ছেলে। তার বয়সীই হবে। গায়ের রং, চোখ, মুখ, নাক—সব তার মতো।

রাবাত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘তুমি কে?’

প্রশ্ন শুনে ছেলেটা হাসে। কোনো কথা বলে না।

রাবাত আবার জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি কে। আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছ কেন?’

ছেলেটি আবার হাসে। খুব মিষ্টি চেহারা। বড্ড মায়া মায়া মুখ তার। তবে রাবাতের ধীরে ধীরে ভয় বাড়ে।

আবার পুকুরে যেন কেউ ঝাঁপ দেয়। ঝুপ করে শব্দ হয়। মনে হয় পুকুরের পানি ছিটকে এসে তার গায়ে পড়ে। রাবাত ঘুরে তাকায়। হ্যাঁ, পুকুরের পানিতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। পুকুরে ঝাঁপ দিলে যেমনটি হয়।

পুকুরে পাকা ঘাট। পাকা সিঁড়িটি পুকুরের পানি পর্যন্ত নেমে গেছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে দেখে একটি শাড়ি ভাঁজ করা। তাহলে কি সত্যি সত্যিই কেউ গোসল করছে! কিন্তু কারও পক্ষে কি এতক্ষণ ডুব দিয়ে থাকা সম্ভব!

‘সম্ভব?’

দেখতে তার মতো ছেলেটি এসে পাশে দাঁড়ায়।

‘তুমি তাহলে কথা বলছ?’

ছেলেটি হাসে।

দূরে লোকজনের কথার আওয়াজ পাওয়া যায়। হ্যাঁ, কারা যেন রাবাতের দিকেই এগিয়ে আসছে। হাতে মনে হচ্ছে হ্যারিকেন। দ্রুত তারা খুব কাছে চলে আসে।

রাবাতের মা-বাবা। সঙ্গে পাশের বাড়ির সুলাইমান চাচা ও ছোট মামা। বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘রাত একটা বাজে, তা জানিস। এত রাতে এখানে কী করছিস?’

‘পুকুরে কে যেন গোসল করছে। তাই দেখতে এসেছি বাবা।’

‘বলিস কী! তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। এটা তো খারাপ পুকুর!’

ছোট মামা বলেন, ‘পুকুর খারাপ হতে যাবে কেন। একজন মৃগী রোগী পুকুরে পড়ে মারা গিয়েছিল। তাতে পুকুরটা খারাপ হয়ে গেল?’

কথা শুনে বাবা রেগে যান।

‘পণ্ডিতি করিস না, আসলাম। যা বুঝিস না, তা নিয়ে কথা বলিস না।’

মা বলেন, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি চল, বাবা।’

‘দাঁড়াও। শাড়িটা আছে কিনা দেখি।’

রাবাত টর্চ ধরে সিঁড়ির দিকে। শাড়িটা নেই।

‘কার শাড়ি?’

‘না, কারও না।’

মা রাবাতের বাবার কানে কানে বলেন, ‘ওকে তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে চলো। আবোলতাবোল কথা বলছে।’

ছোট মামা বলেন, ‘দাঁড়াও। আমার স্যান্ডেলে ধুলাবালু লেগেছে। পুকুর থেকে পা’টা ধুয়ে আসি।’

বাবা বলেন, ‘তুই কি পাগল হয়েছিস। এই পুকুরে তুই পা ধুবি?’

‘দুলাভাই, আমি পাগল হইনি। পাগল হয়েছ তুমি।’ ছোট মামা বলেন।

তিনি চটাং চটাং স্যান্ডেলের আওয়াজ তুলে সিঁড়ি দিয়ে পুকুরে নামতে থাকেন। পুকুরে যেই এক পা দিয়েছেন, অমনি ধপাস করে নিচে পড়ে গেলেন। সম্ভবত ভয়ে তিনি চিত্কার দিয়ে ওঠেন। সোলায়মান চাচা দৌড়ে যান সেদিকে। তাঁকে টেনে তোলেন।

ছোট মামা কাঁপছেন।

বাবা বলেন, ‘কী রে, এখন কাঁপছিস কেন?’

‘মনে হলো, কেউ যেন আমার পা টান দিয়ে পুকুরে ফেলে দিল।’

সোলায়মান চাচা বলেন, ‘এই পুকুরটাতে কিন্তু অনেক দিনের পুরোনো রুই-কাতলা মাছ আছে। একটা নাকি আছে, প্রায় ঢেঁকির সমান।’

বাবা বলেন, ‘রুই-কাতলার কি হাত আছে নাকি! আসলাম তো বলল, ওকে যেন কেউ টান দিয়ে ফেলে দিল।’

গভীর রাত। এক পাশে মা শুয়ে আছেন। কিন্তু রাবাতের মনে হচ্ছে অন্য পাশে তার পিঠের কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। রাবাত সেদিকে ঘোরে। না, কেউ নেই। মাঝেমধ্যেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। এপাশ-ওপাশ করছে সে। রাবাতের একবার মনে হয়, ‘ওঘর থেকে বাবাকে ডেকে আনলে কেমন হয়। বাবাও একই খাটে ঘুমাক। এক পাশে মা, আরেক পাশে বাবা। মাঝখানে রাবাত ঘুমাবে। তাতে আর রাবাতের কোনো অসুবিধা হবে না। তাই হলো। রাবাত মা-বাবার সঙ্গে ঘুমাল।

সকালবেলা মা বললেন, ‘একজন মনোরোগ চিকিত্সকের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো তো।’

বাবা বললেন, ‘দেখি। যাক, আর কয়েকটা দিন।’

মা রেগে বলেন, ‘কবে যে তোমার আর কয়টা দিন শেষ হবে?’

রাবাতের ক্লাস শুরু হয় সকাল সাড়ে দশটায়। ক্লাসে ঢুকে তো রাবাতের চক্ষু ছানাবড়া। তার মতো দেখতে গত রাতের সেই ছেলেটি, তার পাশের সিটে বসে আছে। ক্লাসের অন্যরাও অবাক।

‘রাবাত, তোরা কি যমজ নাকি রে?’ ক্লাসের কয়েকজন রাবাতের কাছে জানতে চায়।

রাবাতের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। সে ধীরে ধীরে ছেলেটির পাশে গিয়ে বসে। ছেলেটি বলে।

‘হাই।’

হুবহু সেই হাসি। পুকুরপাড়ে যাকে সে রাতে দেখেছে।

‘তুমি?’ রাবাত জানতে চায়।

‘আমরা খুলনায় ছিলাম। বাবা বদলি হয়েছেন এখানে। তাই এখানে ভর্তি হতে হলো। আমি রাবাত।’ ছেলেটি বলে।

‘রাবাত। তোমার নামও রাবাত?’

‘কেন। তোমার নামও রাবাত নাকি। ইন্টারেস্টিং তো?’

স্কুল ছুটির পর রাবাত নতুন রাবাতকে বলে, ‘তোমার সঙ্গে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’ ওরা দুজন গেটের বাইরে এসে দাঁড়ায়।

‘রাবাত বলে, ‘তুমি কাল রাতে পুকুরপাড়ে এসেছিলে কেন?’

‘পুকুরপাড়ে। কোন পুকুরপাড়ে?’

রাবাত রেগে যায় যেন।

‘ভণিতা কোরো না। কেন এসেছিলে বলো?’

‘আশ্চর্য। কোন পুকুর। আমি তো তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’

রাস্তার পাশেই তারা দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। তাদের পাশে একটি রিকশা এসে দাঁড়ায়। রিকশায় একজন মহিলা বসে আছেন।

নতুন রাবাত এগিয়ে যায় রিকশার দিকে।

‘আম্মু। ওর নামও রাবাত। ভেরি ইন্টারেস্টিং।’

রাবাতের মা একদৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন রাবাতের দিকে।

‘তোমাদের দুজনের চেহারায় এত মিল, ভাবাই যাচ্ছে না।’

রাবাত রিকশায় মায়ের পাশে গিয়ে বসে।

রিকশা চলতে শুরু করে।

রাবাত রিকশার পেছন পেছন যায়।

‘রাবাত। তোমার সঙ্গে কিন্তু আমার কথা শেষ হয়নি।’

নতুন রাবাত রিকশা থেকে বলে, ‘কাল কথা হবে, দোস্ত।’