রাত দুইটার আগন্তুক

অলংকরণ: রাজীব

আজ রাতেও অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল জিনিয়ার। বিছানায় ডান পাশে ফিরে শুয়েছিল সে, দেয়ালের দিকে মুখ করে। ঘুম চটে গেলে সে টের পাচ্ছিল যে বাঁ পাশে, ওর পেছনে, বিছানা থেকে খানিকটা দূরে কার্পেটের ওপর যে ছোট সোফার চেয়ারটা আছে, যেটাতে বসে সে মাঝে মাঝে পা টুলে উঠিয়ে দিয়ে বই পড়ে বা টিভি দেখে, সেটাতে কেউ একজন নিশ্চয় বসে আছে। সেই কেউ একজন যে কে, তা–ও সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিল। আর ঘড়ি না দেখেই সে এটাও বুঝতে পারছিল যে, এখন ঘড়িতে রাত দুইটা বাজে। এই সবকিছু বুঝতে পেরেও সে খানিকটা আতঙ্ক নিয়ে বিছানায় উঠে বসল প্রতিদিনের মতো। বাঁ পাশে ফিরে সোফায় চুপ করে বসে থাকা কুসুমের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মেয়েটা আজ সোফার ওপর ছোট পা দুটো তুলে বসেছে। ফরসা পায়ের গোড়ালি বেরিয়ে আছে গোলাপি রঙের রাত–পোশাকের নিচ থেকে। ঘরের নীলচে ডিমলাইটের মিষ্টি আলোয় মেয়েটাকে দেখাচ্ছে গম্ভীর আর বিষণ্ন। জিনিয়ার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে থাকলেও সে যথাসাধ্য স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করল। একটু হেসে কুসুমের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে? একা একা ভয় লাগছে?

মেয়েটা কিছু না বলে ওপর–নিচে মাথা নাড়ল।

—তুমি আমার কাছে ঘুমাতে চাও?

মেয়েটা চুপ করে রইল। উত্তর দিল না কোনো।

জিনিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল এবার। বিছানার চাদরটা টেনেটুনে ঠিক করে দিয়ে বলল, তুমি এখানে ঘুমাও। আমি চেয়ারে বসে আছি। ভয় নেই।

মেয়েটা চেয়ার ছেড়ে উঠল না। মন খারাপ করে লজ্জিত মুখে বসে রইল একইভাবে।

—তাহলে চলো, আমরা টেলিভিশনে একটা মুভি দেখি।

মেয়েটা এবারও নড়ল না। জিনিয়া প্রাণপণে মাথা ঠান্ডা রাখতে চেষ্টা করল। প্রতিদিন রাতে এসব নাটক কাঁহাতক আর ভালো লাগে? কাল সকালে অফিসে একটা জরুরি মিটিং আছে, সেখানে মূল প্রেজেন্টেশনটা তারই। রাতে ঘুম ভালো না হলে সে প্রেজেন্ট করবে কী করে?

মেয়েটা খালি পায়ে কার্পেটের ওপর দাঁড়াল এবার। মুখ নিচু করে বলল, আমি আমার ঘরে চলে যাচ্ছি।

—ভয় পাবে না তো?

মেয়েটা মাথা নাড়াল দুই দিকে।

—শিওর? জিনিয়া প্রশ্ন করল।

এবার সে মাথা নাড়ল ওপর–নিচে। তারপর নিঃশব্দে বিড়ালের মতো হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। একটু পর শোনা গেল ওর ঘরের দরজা লাগানোর আওয়াজ। জিনিয়ার কি উচিত ছিল ওর পিছু পিছু যাওয়া? ওকে ওর বিছানায় শুইয়ে দিয়ে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে আসা উচিত ছিল কি? কতই বা বয়স ওর? সাত কি আট। এই বয়সে সে–ও একা ঘুমাতে ভয় পেত বইকি। এতে মেয়েটার আর দোষ কী?

পরদিন অফিসে দিনটা খুব খারাপ গেল জিনিয়ার। প্রেজেন্টেশন হয়েছিল ভালোই, কিন্তু এরপর ক্লায়েন্টদের প্রশ্নের উত্তরগুলো সে কিছুই গুছিয়ে বলতে পারেনি। অথচ এমনটা তার কখনো হয় না। দুপুরবেলা মাথাটা ধরে গেল খুব। ডেস্কে ফিরে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে টেবিলে মাথা নামিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল কিছুক্ষণ।

—কফি চলবে? রায়হানের গলা শুনে মাথাটা তুলল সে। কফি? মন্দ হয় না তাহলে। কফির মগটা হাতে দিয়ে পাশের চেয়ার টেনে বসল রায়হান। বলল, তুমি কি কোনো কিছু নিয়ে খুব ডিস্টার্বড জিনিয়া?

জিনিয়া কিছু বলল না। রায়হান তার ক্লাসমেট ছিল বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনে। বর্তমানে সহকর্মী। দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ওর সঙ্গে। বন্ধু হিসেবে এর আগে অনেক কিছুই শেয়ার করেছে ওর সঙ্গে। কিন্তু এই মুহূর্তে জিনিয়া যে সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা কারও সঙ্গেই শেয়ার করা যাচ্ছে না। কেউ ওর কথা বিশ্বাস করবে না। জিনিয়া তাই রায়হানের প্রশ্ন এড়িয়ে গেল। হাই তুলে বলল, কদিন ধরে একদম ঘুম হচ্ছে না। আমার একটা ভালো ঘুম দরকার।

—তুমি তাহলে কয়েক দিনের ছুটি নাও। কোথাও থেকে ঘুরে আসো। পরামর্শ দিল রায়হান।

ছুটি? চিন্তা করতে গিয়েই চমকে উঠল জিনিয়া। ছুটি নেওয়া মানে দিন–রাত সর্বক্ষণ ওই মেয়েটার সঙ্গে থাকা। মেয়েটার চুপচাপ বিষণ্ন চেহারার মুখোমুখি হওয়া। নাহ, ছুটি নেওয়া যাবে না। জিনিয়া বরং আজকাল একটু দেরি করেই অফিস থেকে ফেরে। কখনো ফেরার সময় শপিং মলে বা সুপারশপে অকারণে ঘুরে বেড়ায়। তারপর সন্ধ্যার অনেক পরে বাড়ি ফিরলে মজু বুয়া দরজা খুলে দিলে সে প্রথমে কুসুমের ঘরে উঁকি দেয়। দেখে মেয়েটা গভীর মনোযোগ দিয়ে টেবিলে বসে কী যেন আঁকছে। কোনো কথা না বলে সে বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার নেয়, চুল শুকায়, মজু বুয়ার তৈরি করা এক কাপ চা নিয়ে টিভির সামনে বসে চ্যানেল পাল্টায়। কিন্তু কখনো কুসুমকে কাছে ডাকে না। মেয়েটার মুখোমুখি হতে ভীষণ ভয় করে ওর। সেই ভয়ংকর রাতের কথা মনে পড়ে যায় বারবার। যে রাতে মেয়েটার সঙ্গে প্রথম তার দেখা হয়েছিল।

মজু বুয়া এসে বলল, আফা, টেবিলে ভাত দিমু?

জিনিয়া মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, কুসুম খেয়েছে?

—না। এক লগে দুই জন রে দেই?

—মজু বুয়া, তোমাকে না বলেছি ও ছোট মানুষ, ওকে আগে খাইয়ে দেবে। আমার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই!

—কইছিলাম তো। সে কইল আফনের লগে খাইব।

—ঠিক আছে, খাবার লাগাও। মজু বুয়া চলে যেতে নিলে সে আস্তে করে তাকে ডাকল—মজু বুয়া, একটু শোনো।

বুয়া ফিরে এল আবার। জিনিয়া প্রশ্ন করল, আচ্ছা মজু বুয়া, কুসুমকে কি তোমার একটু অস্বাভাবিক লাগে?

মজু বুয়া একটু চিন্তা করে বলে, হ্যায় একটু বেশি চুপচাপ থাকে। ছুডোগো লাহান না। দুষ্টামি করে না। কথা বেশি কয় না। খুব লক্ষ্মী।

—আর?

—আর কী কমু? আর তো আমি কিছু বেঠিক দেখি না। আফা, এত ছুডোকালে সগলরে হারাইছে। একটু অন্য রকম তো হইবই।

মজু বুয়া চলে গেলে জিনিয়া নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকে। সত্যিই তো। এই ছোট্ট মেয়েটা এই বয়সেই তার পরিবারের সবাইকে হারিয়েছে। চোখের সামনে নিজের মাকে দুর্ঘটনায় রক্তাক্ত অবস্থায় মরতে দেখেছে সে। সে কীভাবে পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকবে বলে জিনিয়া আশা করে? বরং জিনিয়ার উচিত ছিল ওকে আরেকটু কাছে টেনে নেওয়া, আপন করে নেওয়া। আরেকটু বেশি ভালোবাসার চেষ্টা করা।

খাবার টেবিলে দুজন চুপচাপ খাওয়া সারল। জিনিয়া একটু কথা জমাতে চেষ্টা করেছিল—কী খবর, কুসুম? দিন কেমন গেল? কী করলে সারা দিন?

কুসুম এক–দুই শব্দে জবাব সারল—হুম, ভালো, কিছু না—এইসব। ফলে কথা আর জমল না। মজু বুয়া সব গুছিয়ে ধোয়া–পাকলা করে চলে গেলে জিনিয়া কুসুমকে বলল দাঁত মেজে শুয়ে পড়তে। আর নিজে ল্যাপটপ নিয়ে শোবার ঘরের সোফার চেয়ারটাতে বসল। ল্যাপটপে কাজ করল অনেকক্ষণ। তারপর একসময় কোলের ওপর ল্যাপটপ রেখেই ঘুমে চোখ বুজে এল তার। তন্দ্রামতো হতেই আবার সেই অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকল তার। এই ঘরে কেউ ঢুকেছে। কে ঢুকেছে, সে খুব ভালো করেই জানে। নিশ্চয় এখন রাত দুইটা বাজে। হায় আল্লাহ, এ থেকে আমাকে রক্ষা করো!

অফিসের কাজে ঢাকা থেকে যশোর যাচ্ছিল জিনিয়া। বাসে ওর পাশে বসেছিল কুসুম। ওরা দুজন বসেছিল বাসের বাঁ দিকের দুটো সিটে। মাঝখানের আইল পার হয়ে ডান দিকের দুটো সিটে বসেছিল কুসুমের মা আর তার ছোট ভাই। সন্ধ্যাবেলা বাস ছাড়ার পর কুসুমের মা একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, একটু খেয়াল রাখবেন ওর দিকে, প্লিজ। ও কিন্তু বাসে বমি করে। ওর হাতে প্যাকেট দিয়ে রেখেছি।

শুনে জিনিয়া একটু বিরক্ত হয়েছিল। কী মুশকিল! এই মেয়ে যদি এখন বমি করে সব ভাসিয়ে দেয়। মহিলাটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, খারাপ লাগলে আন্টিকে বোলো, কেমন?

জিনিয়া ভদ্রতাবশত পাশে বসা মেয়েটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কী নাম তোমার?

জিনিয়া তার ফোলা চোখ ঘুরিয়ে অনেক কষ্টে দেখতে পেল ওই বেডে পা ঝুলিয়ে বসে আছে কুসুম নামের মেয়েটা।

—কুসুম। ছোট্ট করে জবাব দিয়েছিল সে। তারপর আর কোনো কথা হয়নি। বাসে বসে ঢুলুনি এসেছিল জিনিয়ার। ঢাকায় ওর এত ব্যস্ততা যায় যে ঠিকমতো বিশ্রাম নেওয়ারই সময় হয় না। অফিসের কাজে এদিক–ওদিক যাওয়ার সময় সেটা পুষিয়ে নেয় সে। বাস ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল প্লেনের গতিতে। আর একটু পরপর মোবাইল ফোনে কথা বলছিল। দু–একজন যাত্রী এ নিয়ে গজগজও করছিলেন। এসব শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল জিনিয়া। তারপর আর কিছু মনে নেই। একটা প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুমটা যখন ভাঙল, তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করল রাস্তার এক পাশে খাদের মধ্যে আরও কয়েকটি ক্ষতবিক্ষত দেহের সঙ্গে পড়ে আছে। কাদাজলে রক্ত মাখামাখি সব শরীর। বাসটা পড়ে আছে আরও নিচে, একটা ডোবার মধ্যে। আর চারপাশে অনেক লোকজন, অনেক চেঁচামেচি। সাইরেনের আওয়াজ। জিনিয়া ভালো করে চোখ খুলতে পারছিল না। তার চোখ দুটো ফুলে গিয়েছিল অনেক। ডান পায়ে এত ব্যথা করছিল যে মনে হচ্ছিল পা–টা ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এর মধ্যেও সে দুই হাত দিয়ে একটা ছোট শরীর নিজের বুকে আগলে রেখেছিল। শরীরটা থরথর করে কাঁপছিল ওর গায়ের সঙ্গে লেপটে থেকে। কারা যেন এসে ওদের দুজনকেই একসঙ্গে চ্যাংদোলা করে উঠিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিয়েছিল। পোঁ পোঁ আওয়াজ করে অ্যাম্বুলেন্সটা ছুটে চলেছিল হাইওয়ে ধরে। তার অনেক পরে জিনিয়ার জ্ঞান ফিরেছিল এক হাসপাতালের ওয়ার্ডে। তার ডান পা–টা ব্যান্ডেজ করা, উঁচুতে তুলে ধরা। চোখের ওপর বাঁ দিকে ব্যান্ডেজ। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। তাকে চোখ খুলতে দেখে অনেকগুলো কণ্ঠ একসঙ্গে কথা বলে উঠল, জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফিরেছে। সে চোখ খুলে প্রথমেই দেখল সাদা পোশাক পরা নার্সকে। তারপর তার পাশে স্টেথিস্কোপ গলায় ঝোলানো একজন ডাক্তারকে, যিনি কিনা ছুটে এসে তার পালস–ব্লাডপ্রেশার মাপতে শুরু করেছেন ততক্ষণে। জিনিয়া কিছু বলার আগেই মধ্যবয়সী নার্সটা হেসে তাকে জানালেন, চিন্তা করবেন না, ম্যাডাম। আপনার মেয়েও সুস্থ আছে।

মেয়ে? আমার মেয়ে? জিনিয়ার সব তালগোল পাকিয়ে যেতে শুরু করলে একজন হাত তুলে তার পাশের বেডের দিকে নির্দেশ করল। জিনিয়া তার ফোলা চোখ ঘুরিয়ে অনেক কষ্টে দেখতে পেল ওই বেডে পা ঝুলিয়ে বসে আছে কুসুম নামের মেয়েটা। বড় বড় গভীর দুটো বিষণ্ন চোখ মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুহূর্তে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো মনে পড়ে গিয়েছিল জিনিয়ার, জ্ঞান হারানোর আগমুহূর্তে সে ওর মাকে দেখেছে ছেলেসহ ছিন্নভিন্ন শরীরে কাদার মধ্যে পড়ে আছে। আর কুসুম ছিল ওর ঠিক কোলের মধ্যে, বুকের কাছে আগলে রাখা।

তুমি তো তখন মেয়েটার কথা কিছু বলোনি। বলল রায়হান—যখন আমরা তোমাকে ঢাকায় একটা ভালো হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।

জিনিয়া চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। না, সে বলেনি। সরকারি সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকার একটি প্রাইভেট উন্নত মানের হাসপাতালে তাকে নিয়ে এসেছিল বন্ধু ও সহকর্মীরা। কুসুমের কথা তখন কে বলবে? ও যে তার মেয়ে নয় এ কথা শুনে ওখানকার ডাক্তাররাও অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওহ, আপনি যেভাবে ওকে আগলে রেখেছিলেন, আমরা ভেবেছিলাম ও..., থাক, কী আর করা। ওর ফ্যামিলির সবাই ডেড। কেউ ওকে নিতে না এলে আমরা সমাজসেবা অধিদপ্তরে দিয়ে দেব।

ঢাকার হাসপাতালে প্রায় দেড় মাস শুয়েছিল জিনিয়া। সেই সময় একটা রাতও ঘুম হতো না তার। চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পেত মহিলাটির অনুরোধ—একটু খেয়াল রাখবেন ওকে, প্লিজ। মহিলাটির আকুতিমাখা কণ্ঠস্বর যেন পাগল করে দিচ্ছিল ওকে। সুস্থ হয়েই সে ছুটে গিয়েছিল মফস্বলের ওই সরকারি হাসপাতালে। গিয়ে শুনল মেয়েটাকে কেউ নিতে আসেনি। সেও কোনো ঠিকানা বলতে পারেনি। তাকে শহরের এতিমখানায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে তারপর ছুটে গিয়েছিল সেই এতিমখানায়। হোস্টেলের সুপার কুসুমকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি ওনাকে চেনো?’ তখন সে ওপর–নিচে মাথা নেড়েছিল। তারপর আবার যখন জিজ্ঞেস করেছেন, তুমি ওনার সঙ্গে যেতে চাও? তখনো মাথা নেড়েছিল মেয়েটা। ওকে পাওয়ার জন্য বিস্তর হাঙ্গামা পোহাতে হয়েছে জিনিয়াকে। বিভিন্ন অফিসে বিভিন্ন কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছে। এ অফিস–ও অফিস ঘুরতে হয়েছে। তারপর দীর্ঘ চার মাসের প্রচেষ্টায় নিজের কাছে নিয়ে আসতে পেরেছে মেয়েটাকে।

—তুমি কি মেয়েটাকে ভালোবাসো না? রায়হান জিজ্ঞেস করল।

—নিশ্চয় ভালোবাসি। নইলে এত কিছু করব কেন ওর জন্য?

—তাহলে ওকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমোও না কেন? মেয়েটা একা একা ভয় পায়।

জিনিয়া চুপ করে রইল। রায়হান আবার বলল, আচ্ছা, ওকে স্কুলে দিচ্ছ না কেন?

জিনিয়া আস্তে আস্তে বলে, দেব। ফরম এনেছি। রায়হান বলল, আমার মনে হয় তুমি কর্তব্যবোধের তাড়নায় এত ঝামেলা করে মেয়েটাকে অ্যাডাপ্ট করেছ। আসলে ওকে নিয়ে তুমি কিছুটা বিরক্ত। ওকে এখন তোমার ঝামেলা মনে হচ্ছে, তাই না?

জিনিয়া অন্য রকম এক চোখে রায়হানের দিকে তাকায়—তা নয়, রায়হান। মেয়েটা যেন কেমন। তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।

রায়হান একটু হাসে—সেটাই তো স্বাভাবিক। ওর এত বড় একটা ট্রমা গেছে। সে তো একটু কেমন হবেই। জিনিয়া, আমার মনে হয় মেয়েটাকে নিয়ে তোমার সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া উচিত। আমার এক বন্ধু আছে, ঠিকানাটা নাও।

সে রাতে জিনিয়া প্রাণপণে জেগে থাকতে চেষ্টা করল। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বই পড়ল কিছুক্ষণ। সেলফোনে ইয়ার প্লাগ লাগিয়ে গান শুনতে চেষ্টা করল। কিন্তু একসময় ঠিকই তন্দ্রায় পেয়ে বসল ওকে। ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল একটু পর। আর তারপর ঠিক দুইটা বাজতে যথারীতি ভেঙে গেল ঘুম। চোখ খুলেই সে বেশ কল্পনা করে নিতে পারল তার বিছানার পাশের সোফায় কে যেন গুটিসুটি মেরে বসে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ভাবল কালই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হবে।

—আপনি বলছেন প্রতিদিন ঠিক রাত দুইটার সময়ই সে আপনার ঘরে আসে? ডাক্তার জাভেদ প্রশ্ন করলেন।

—জি।

—এর এক মিনিট আগেও না, পরেও না?

—হুম।

—ঠিক ওই সময় ওর কী হয় কখনো জানতে চেয়েছেন?

—না।

—আপনি কি জানেন রাত দুইটার কোনো বিশেষত্ব আছে কি না?

—জানি।

—কী সেটা?

—আমাদের বাসটা ঠিক রাত দুইটার সময় খাদে পড়ে গিয়েছিল। আমার হাতঘড়িটা ভেঙে ওই সময়ে আটকে গিয়েছিল। ভাঙা হাতঘড়িটা আমার হাতে লাগানো ছিল। আমি হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছি।

—কেন নিয়ে এসেছেন?

—জানি না।

—মেয়েটাকে আপনি কেন নিয়ে এসেছেন?

—আমার কেবল ওর মায়ের কথাটা মনে পড়ছিল তাই। আমাকে উনি মেয়েটাকে খেয়াল রাখতে বলেছিলেন। উনি কি জানতেন যে এই যাত্রাতেই উনি মারা যাবেন?

—আচ্ছা মিস জিনিয়া, আমরা আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। রাত দুইটার সময় আপনার ঘরে এসে সে কী বলে?

—কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে।

—আপনি কিছু জানতে চান না?

—জানতে চাই সে ভয় পাচ্ছে কি না। সে এ ঘরে ঘুমাতে চায় কি না। সে প্রতি কথায় মাথা নাড়ে। সে আসলে কিছুই চায় না। এমনিই আসে।

—আপনি কখনো ওকে নিজের কাছে ঘুম পাড়ানোর জন্য ডেকেছেন?

—না।

—কেন? আপনি তো ওকে অ্যাডাপ্ট করেছেন। তবে দূরে দূরে রাখছেন কেন? নিজের কাছে রাখলেই পারেন। যেমনটা একজন মা করে।

জিনিয়া চুপ করে থাকে। ডাক্তার জাভেদ আবার প্রশ্ন করেন, আপনি কি ওকে দেখে বিরক্ত হন?

—না।

—তাহলে?

—আমি, আ আ আমি ভয় পাই।

—ভয় পান? কেন এইটুকু একটা মেয়েকে ভয় পান?

জিনিয়া কোনো কথা বলে না। ডাক্তার জাভেদ তাকে চা অফার করেন। সে সম্মতি জানায়। তার মুখ ফ্যাকাশে দেখায় এখন। ডাক্তার জাভেদ তাকে সময় দেন। তারপর চা শেষ হলে বলেন, এবার বলুন মিস জিনিয়া, আপনি ওকে ভয় পান কেন?

—বললে আপনি আমাকে পাগল ভাববেন।

—আমি কাউকেই পাগল ভাবি না—হেসে উঠলেন ডাক্তার জাভেদ, তাহলে তো আর মনের ডাক্তার হতাম না।

—ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য, ডাক্তার।

—আমি জীবনে এমন অনেক অবিশ্বাস্য বক্তব্য শুনেছি। আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।

—আমি প্রতিদিন ঘরের দরজা লক করে ঘুমাই। ফিসফিস করে বলে জিনিয়া।

—সে নিশ্চয় চাবি জোগাড় করেছে। চাবি দিয়ে খুলে ঢোকে।

—না, ডাক্তার। প্রথমে আমিও তা–ই ভেবেছিলাম। তারপর আমি লক পরিবর্তন করলাম। দরজার ওপরের ছিটকিনিও লাগাতে শুরু করলাম। তারপর মিস্ত্রি ডেকে হ্যাচ বোল্ট লক লাগালাম। কিছুতেই কিছু হলো না।

এবার ডাক্তার জাভেদ চুপ হয়ে গেলেন। জিনিয়া ভয়ে কাঁপতে লাগল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ওর সঙ্গে ভয়ংকর অস্বাভাবিক কিছু আছে। কোনো কিছুই ওকে আটকাতে পারে না। সে ঠিকই এসে হাজির হয়। ঠিক রাত দুইটার সময়। দরজায় যত তালাই দিই না কেন। রাত দুইটায় সে আমার ঘরের ভেতর ঢুকে পড়বেই। ঢুকে বসে থাকবে সোফায়। একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিছু চাইবে না। তারপর আমি বললে ঠিকই হেঁটে নিজের ঘরে চলে যাবে। বাকি রাত আর কোনো ডিস্টার্ব করবে না। কিন্তু একবার তার আমার ঘরে আসা চাই–ই চাই।

জিনিয়া কাঁদতে শুরু করল—ডাক্তার, আমাকে বাঁচান। আমি ভীষণ বিপদে পড়েছি। কাগজপত্রে লেখাপড়া করে সারা জীবনের জন্য ওর দায়িত্ব নিয়েছি। এখন আমি কী করব?

ডাক্তার জাভেদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। একটু ধাতস্থ হতে দিলেন জিনিয়াকে। তারপর বললেন, দেখেন মিস জিনিয়া, আমার মনে হয় রাতের ব্যাপারটা পুরোটাই আপনার কল্পনা। সে কোনো রাতেই আপনার ঘরে আসে না। সে তার নিজের ঘরেই ঘুমায়। আর আপনি কোনো কারণে প্রতিদিন রাত দুইটার সময় এ রকম একটা দুঃস্বপ্ন দেখেন। এটা আপনার হ্যালুসিনেশন। আমি আপনাকে কিছু ওষুধ দিচ্ছি। মনে করে খাবেন। আর প্রতি সপ্তাহে থেরাপির জন্য আসবেন।

আমাদের বাসটা ঠিক রাত দুইটার সময় খাদে পড়ে গিয়েছিল। আমার হাত ঘড়িটা ভেঙে ওই সময়ে আটকে গিয়েছিল।

জিনিয়া ডাক্তারের পরামর্শমতো দুই মাস ওষুধ খেল। আটটা সেশন থেরাপি নিল। কিন্তু যে কে সেই। রাত দুইটার উত্পাত একই রকম রইল। একসময় হতাশ হয়ে পড়ল সে। এই সমস্যা থেকে আর কোনো রেহাই নেই বোধ হয়। আজকাল জিনিয়া অফিসেও অসংলগ্ন আচরণ করে। মাঝে মাঝে সবার সঙ্গে চিত্কার করে ওঠে। তার চোখ দুটো দিনের পর দিন না ঘুমানোর কারণে টকটকে লাল হয়ে থাকে। একদিন এভাবে চিত্কার করতে গিয়ে অফিসেই অজ্ঞান হয়ে পড়লে সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিল শেষ পর্যন্ত। ডাক্তার জাভেদ তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। তারপর রায়হানকে বললেন, আসলেই ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত।

রায়হানও তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। জিনিয়ার সমস্যাটা ব্যাখ্যাতীত। ভীষণ রহস্যময়। ডাক্তার বললেন, ও কিছুদিন হাসপাতালেই থাকুক। তাহলে ভালো ঘুম হবে।

—কিন্তু ওই মেয়েটা যে ঘরে একা আছে!—রায়হান বলে, আমি কি গিয়ে মেয়েটাকে কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায় রেখে আসব? নাকি পুলিশে খবর দেব?

—হুম, সেটাও তো একটা মুশকিল। বেশ, তুমি যাও, দেখো কী করা যায়।

রায়হান চলে গেলে ডাক্তার জাভেদ জিনিয়াকে দেখতে এলেন। তাকে দেখে জিনিয়া অদ্ভুত হাসি হাসতে লাগল—ডাক্তার সাহেব, ও ঠিকই এখানে এসে হাজির হবে। দেখবেন। ঠিক রাত দুইটায়।

ডাক্তার হাসলেন, কখনোই না। সে জানেই না আপনি কোথায়। তা ছাড়া ওকে আমরা অন্য জায়গায় রেখে আসছি।

—তাতে লাভ হবে না কিছু—জিনিয়া বিড়বিড় করতে থাকে, ও আমার পিছু ছাড়বে না। আমৃত্যু আমার পিছু ছাড়বে না।

জিনিয়া ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় ঘুমে ঢলে পড়লে ডাক্তার জাভেদ একজন নার্সকে তার দিকে খেয়াল রাখতে বলে গেলেন। রাত গভীর হতে সেই নার্স ছুটে এল তার রুমে—স্যার, স্যার। পেশেন্ট চিত্কার করছে। কাকে যেন দেখতে পাচ্ছে। পেরিডল ইনজেকশন দিব, স্যার?

ডাক্তার জাভেদ কেবিনের কাছে যেতে যেতে শুনতে পেলেন জিনিয়া চেঁচিয়েই যাচ্ছে, তুমি আবার এসেছ? এখানেও চলে এসেছ? তুমি এখানে কীভাবে এলে? জবাব দাও। আজকে তোমাকে জবাব দিতেই হবে।

হন্তদন্ত হয়ে জিনিয়ার কেবিনে ঢোকার আগেই সেলফোনটা বেজে উঠল ডাক্তার জাভেদের। রায়হানের কল। ফোন ধরতে রায়হান উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল তাকে, মেয়েটা তো এখানে নেই জাভেদ। ঘরে কেউ ছিল না। মেইন দরজা লক করাই ছিল। আমি পুলিশের সাহায্যে ঢুকেছি। ঢুকে দেখি সব ফাঁকা। মেয়েটা কীভাবে বের হলো? কোথায় গেল?

জাভেদের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল যেন। সে কেবিনে ঢুকে দেখল জিনিয়ার মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। কেবিনের ভেতর আর কেউ নেই। নার্স দ্রুত ইনজেকশন পুশ করল তার সামনেই। জিনিয়া ওষুধের কারণে অচেতন হয়ে পড়ল প্রায়। জাভেদ ভারি চিন্তিত আর আশ্চর্য হয়ে বসে রইল রোগীর পাশে। এমন অদ্ভুত কেস সে আর কখনো ডিল করেনি।

শেষ কথা

প্রায় চল্লিশ দিন হাসপাতালে থাকার পর জিনিয়া মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে সে কাউকে দেখতে পায় না। ব্যাপারটা নিয়ে সে কাউকে কোনো প্রশ্নও করে না। মজু বুয়াও নিজের মতো সব কাজ করে রাতে খাবার ঢাকা দিয়ে চলে যায়। জিনিয়া রাতের খাবার খেয়ে কখনো ল্যাপটপে কাজ করে, কখনো বই পড়ে বা গান শোনে। তারপর একসময় নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়লে এখন আর কেউ তাকে রাত দুইটায় ডিস্টার্ব করে না। অফিসের কাজেও তার বেশ মনোযোগ ফিরে এসেছে। মাঝে মাঝে অফিসে রায়হানের সঙ্গে গল্পগুজবে মেতে উঠলেও তারা কখনো কুসুম নামের অদ্ভুত রহস্যময় মেয়েটার প্রসঙ্গ তোলে না। কুসুম সম্পর্কে জিনিয়া কারও কাছে কিছু জানতেও চায় না কখনো। কেবল রায়হান আর তার বন্ধু জাভেদ জানতে পেরেছে যে এক বছর আগে ঢাকা থেকে যশোর যাওয়ার সময় বাস দুর্ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন গুরুতর আহত জিনিয়াকে উদ্ধার করার সময় তার শক্ত করে আগলে রাখা হাত দুটো ছাড়িয়ে একটা ছয়–সাত বছরের মেয়ের মৃতদেহ আলগা করেছিল। মেয়েটার সঙ্গে তার মা আর ছোট ভাইও মারা গিয়েছিল সেদিন সেই দুর্ঘটনায়। বেওয়ারিশ হিসেবে তাদের তিনজনকে কবর দেওয়ার জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের লোকজন এক সপ্তাহ পর মরদেহ তিনটি মর্গ থেকে নিয়ে যায়। আর জিনিয়া প্রায় দেড় মাস চিকিত্সা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে নিজের কাজে ফিরেছিল। জিজ্ঞাসাবাদে মজু বুয়া জানিয়েছে যে ও বাড়িতে রাতে জিনিয়া ছাড়া কখনো আর কাউকে থাকতে দেখেনি সে। কেননা ত্রিভুবনে আসলে জিনিয়া নামের মেয়েটিরও কোথাও কেউ নেই। ছোটবেলায় এক দুর্ঘটনায় সে–ও তার মা–বাবা–ভাই—সবাইকে হারিয়ে একটা এতিমখানায় বড় হয়েছে।