রানি কমলা ও কমলাসাগর দিঘি

ময়মনসিংহ গীতিকার গল্প | অনেক দিন আগে বাংলাদেশের আনাচকানাচে, দূরের গ্রামে যখন ছিল না শিক্ষার আলো তখনো ছিলেন অনেক কবি। তাঁরা গান বানাতেন মুখে মুখে। সুরে সুরে গাইতেন মানুষের দুঃখের কাহিনি। অনেকে সেগুলো রাখতেন মুখস্থ করে। এগুলোর নাম পালাগান, আরেক নাম হচ্ছে গীতিকা। সেকালের মানুষের কাছে এই গান ছিল পরম আদরের। সবাই গোল হয়ে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনত গায়েনদের দরদি কণ্ঠের গান। দীনেশ চন্দ্র সেন ছিলেন এক বিরাট পণ্ডিত। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেছিলেন তিনি। ইতিহাস রচনার কাজ ছাড়াও বাংলার হারানো গীতিকা বা পালাগান সংগ্রহ করে সেগুলো প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্যের অনেক সোনালি সম্পদকে আধুনিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। ময়মনসিংহ গীতিকা নামের বইটি এ রকমই অনেকগুলো পালাগান বা গীতিকার সংকলন। সেই বই থেকে নেওয়া হয়েছে এই গল্প।
অলংকরণ: তুলি

অনেক অনেক আগের কথা। এক ছিলেন রাজা। নাম তাঁর জানকীনাথ। যেখানে রাজার বাড়ি তার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে সোমাই নদী। অপূর্ব সুন্দর ছিল রাজার বাড়ি। জানকীনাথের রাজ্যে শুধু সুখ আর আনন্দ।

প্রজারা ভালোবাসত রাজাকে।

রাজার ছিল এক রানি। পরমাসুন্দরী রানির খ্যাতি ছিল রাজ্যজোড়া। রাজা ভীষণ ভালোবাসতেন রানিকে। রানিও ভালোবাসতেন রাজাকে। রাজার ছিল অপরূপ দুটি ঘর। একটা ঘরের নাম জলটুঙ্গী; আর একটা ঘরের নাম কামটুঙ্গী। গরমকালে রাজা আর রানি বাস করতেন জলটুঙ্গী ঘরে।

সারা দিন রাজ্যের কাজ করতেন রাজা। আর রানি করতেন অন্দরমহলের কাজ। রাতে রাজা আসতেন রানির কাছে। দুজনে কত যে গল্প করতেন তা আর বলে শেষ করা যাবে না। কথা বলতে বলতে পার করে দিতেন অনেক রাত। গল্প করতে করতে না ঘুমালে কী হবে? দুজনেরই চোখেই ছিল রাশি রাশি স্বপ্ন।

এমনি এক রাতে রানি রাজাকে বললেন,

‘রাজা, তুমি তো আমাকে খুব ভালোবাস। সেই ভালোবাসার একটা চিহ্ন চাই আমি। তুমি রাজপ্রাসাদের কাছে একটা বিরাট দিঘি খনন করো। তার নাম হবে কমলাসাগর। যতকাল এই দিঘিটা থাকবে ততকাল এই রাজ্যের মানুষ মনে রাখবে আমার কথা।’

রাজা ভেবেছিলেন কি-না-কি চাইবেন রানি। কিন্তু দিঘির কথা শুনে বললেন,

‘এ আর এমন কী কথা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দিঘি খনন করার ব্যবস্থা করব।’

রাজা যখন এ কথা বলছিলেন ঠিক সেই সময় এক শকুন আকাশফাটা এক চিৎকার করে উড়ে গেল ঘরের ওপর দিয়ে। রাজা-রানির স্বপ্ন আর কল্পনাকে চমকে দিল শকুনের এই চিৎকার।

রাজা জানকীনাথের যেই কথা সেই কাজ। শত শত মজুর লেগে গেল কাজে। দিঘি খননের কাজ চলতে লাগল দ্রুত। ধীরে ধীরে দিঘির গর্ত হলো বেশ গভীর। এত গভীর হয়েছে দিঘি কিন্তু জলের দেখা নেই এক ফোঁটাও।

রাজার কপালে দেখা দিল দুশ্চিন্তার ভাঁজ।

গণ্যমান্য মানুষেরা বললেন, যদি দিঘিতে জল না ওঠে তাহলে রাজার চৌদ্দপুরুষের জায়গা হবে নরকে।

রাজা জানকীনাথ চেয়েছিলেন রানির ইচ্ছে মেটাতে। তিনি ভেবেছিলেন দিঘি খনন করলে রানির ইচ্ছেও মিটবে আর রাজ্যের মানুষেরও উপকার হবে। অথচ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে উল্টো দিকে। একে তো দিঘিতে জল উঠছে না, অন্যদিকে তাঁর চৌদ্দপুরুষের স্থান হবে নরকে।

রাজা তখন চঞ্চল হয়ে উঠলেন। দিঘিতে জল না ওঠা পর্যন্ত দিঘি খনন করতে হবে—হুকুম দিলেন তিনি। কিছুতেই খনন বন্ধ রাখা চলবে না। কাজ বন্ধ রাখবে যে মৃত্যুদণ্ড হবে তার। আরও কিছুদিন কাজ চলল পুরোদমে। তারপর রাতের অন্ধকারে একে একে কাজ ছেড়ে পালাতে শুরু করল শ্রমিকেরা।

রাজার মনে শান্তি নেই। আধা ঘুম আধা জাগরণে দিনরাত্রি পার হয় তাঁর। রাজার মনে হলো স্বপ্নের মধ্যে যেন কেউ তাঁকে বলছে—এই দিঘিতে যদি রানি একবার নামেন তাহলে চারদিক থেকে কুলকুল করে জল উঠবে। কিন্তু সেই জলে ডুবে যাবেন রানি।

আতঙ্কে কেঁপে উঠল রাজার মন। তিনি সে রাতেই জলটুঙ্গী ঘরে শুয়ে ছিলেন। রাজার তন্দ্রা গেল ছুটে। তিনি ছুটলেন কামটুঙ্গী ঘরের দিকে। সেখানে শুয়ে আছেন রানি।

রানি কমলারও মন ভালো নেই। তিনি যদি জানতেন তাঁর এই একটা শখ মেটাতে গিয়ে রাজার চৌদ্দপুরুষকে নরকে যেতে হবে তাহলে এমন একটা সর্বনাশা আবদার রাজার কাছে করতেন না কিছুতেই।

দিঘির মালিক নিজের জীবন দিঘির নামে উৎসর্গ করলে জল উঠবে। এ কথা যখন রানি কমলা ভাবছেন, ঠিক তখনই উতলা হয়ে রাজা এলেন রানির ঘরে। তারপর স্বপ্নে যা যা দেখেছেন সব খুলে বললেন। রাজার ভয়, স্বপ্ন সত্যি হলে তিনি রানিকে হারাবেন। রাজা বললেন, ‘দরকার নেই আমার রাজত্বের। ধন, সম্পদ, খ্যাতি এসব কিছুই চাই না। তোমাকে নিয়ে পাতার কুটিরে বাস করব। দরকার নেই আমার দিঘির জল। তোমাকে ছাড়া আমি স্বর্গও চাই না। চলো রাজ্য ছেড়ে চলে যাই দূরে কোথাও।’ রাজার কথা শুনলেন রানি কমলা। তার পরও ঠিক করলেন এই দিঘির জন্য উৎসর্গ করবেন নিজের জীবন। তাঁর একটা শখের জন্য রাজার চৌদ্দপুরুষকে নরকে যেতে হবে? কিছুতেই হতে পারে না তা।

মাঝরাতে রাজার চোখ এড়িয়ে অন্দরমহলে গেলেন রানি। দাসীদের বললেন, ‘আমি স্নান করার জন্য সোমাই নদীতে যাব। তোরা সব চল আমার সঙ্গে।’ দাসীরা তখন ঝাঁক বেঁধে চলল রানির সঙ্গে। কারও কাঁখে সোনার কলস, কারও হাতে কারুকাজ করা গামছা, কারও হাতে রানির জন্য সুগন্ধি তেলের বাটি, কারও হাতে রয়েছে নানা রঙের ফুলের সাজি। সেই অন্ধকার রাতে রানি কমলা দাসীদের নিয়ে চললেন সোমাই নদীতে স্নান করতে। রাতের আকাশটা অন্ধকারে কালো চাদরে ঢাকা। সেই কালো চাদর ভেদ করে যেন চাঁপাফুলের মতো ফুটে আছে তারাগুলো। আর তখন সোমাই নদী বয়ে চলেছে কুলকুল শব্দে। নদীর তীরে এসে এক দাসী রানির গা মেজে দিল কারুকাজ করা রঙিন গামছা দিয়ে, এক দাসী সুগন্ধি তেল মেখে দিল ঘনকালো চুলের মধ্যে। তারপর রানি কমলা নামলেন সোমাই নদীর জলে স্নান করতে।

স্নান শেষে দাসীরা রানির শরীর যত্ন করে মুছিয়ে দিল নরম গামছা দিয়ে। এক দাসী ভেজা শাড়ি বদলে পরিয়ে দিল আগুন পাটের শাড়ি। তারপর রানি বললেন নদীকে,

‘হে নদী—তুমি সাক্ষী থেকো, তীরের শ্যামল গাছপালা—সাক্ষী থেকো তোমরা, সাক্ষী থেকো আসমানের তারা। জীবন বিসর্জন দেব আমি। আমার স্বামীর পূর্বপুরুষেরা যেন নরকে যাওয়া থেকে মুক্তি পান।’

তারপর মণিমাণিক্যে ঝিকমিক করা সোনার কলসিতে সোমাই নদীর জল ভরলেন রানি। সেই সোনার কলসি কাঁখে নিয়ে হেঁটে চললেন পথ দিয়ে। তখন পুবাকাশে উঁকি দিচ্ছিল ভোরের মায়াবী লাল আলো। সকালের আকাশের মেঘ যেন আলতা মাখাচ্ছিল পায়ে। দূর থেকে ভেসে আসছিল গাঁয়ের মানুষের জেগে ওঠার শব্দ।

রানি ফিরে এলেন ঘরে।

রাজা আর রানির ছিল সুন্দর ছোট্ট একটা ফুটফুটে ছেলে। রানি এসে দেখলেন ছেলেটা চাঁদের মতো মুখ নিয়ে ঘুমিয়ে আছে সোনার পালঙ্কে। রানি কমলা কোলে তুলে নিলেন তাকে। তারপর দুই গাল ভরিয়ে ফেললেন চুমুতে চুমুতে। আর কোনো দিন রানি দেখতে পাবেন না ছেলেকে। দুই চোখ থেকে তাঁর অঝোরে গড়িয়ে পড়ছিল জল। চোখের জলের একেকটা ফোঁটা পড়ছিল আর যেন মনে হচ্ছিল গড়িয়ে পড়ছে মুক্তার দানা।

অলংকরণ: তুলি

তারপর রানি এলেন রাজার কাছে। বললেন,

‘আমার মন কেমন করে। আমি যদি মরে যাই তাহলে আমাদের ছেলেকে কাছে কাছে রেখো সব সময়।’ রাজারও মন খারাপ হলো। বললেন,

‘তুমি যদি মরে যাও তাহলে আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কী? আমিও বাঁচব না।’ রাজা বুঝতে পারলেন না রানি নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন তাঁরই পূর্বপুরুষদের নরক থেকে মুক্ত করার জন্য।

তারপর রানি ডাকলেন সেই দাসীকে যে দাসী তাঁর ছেলেকে দেখাশোনা করে। রানি তাকে বললেন,

‘আমার ছেলেকে দিয়ে যাচ্ছি তোমার হাতে। সব সময় যত্নে রেখো। তাকে মা ডাক শিখিয়ো। খিদে পেলে সে যখন মা বলে কেঁদে উঠবে, তখন আদর করে মিষ্টি সুরে শিস বাজিয়ে সান্ত্বনা দিয়ো।’ দাসীর বুক কেঁপে উঠল কিসের যেন শঙ্কায়। তার চোখের কোণ থেকেও নেমে এল কান্নার জল।

তারপর।

রানি সোমাই নদীর জলে ভরা সেই সোনার কলসি নিলেন কাঁখে। আকাশের ছেঁড়া মেঘগুলো তখন যেন আবছা সিঁদুরের রঙে রাঙা হয়ে উঠেছে। দিঘির পাড়ে এক-দুই করে বাড়ছিল মানুষের ভিড়। সবাই দেখল তাদের রানিমা খালি পায়ে সোনার কলসি কাঁখে নিয়ে দিঘির দিকে যাচ্ছেন। সবার বুকের মধ্যে হাহাকার উঠল। কেউ বলল,

‘রানিমা এ কোথায় যাচ্ছেন আপনি। রাজবাড়িতে ফিরে যান। নাইবা উঠল দিঘিতে জল।’

কোনো কথা শুনলেন না রানি কমলা। সেই শুকনো দিঘির তলায় নামলেন। সোনার কলসি থেকে এক আঁজলা জল ছিটালেন দিঘির তলায়। তখন শঙ্কায় দিঘির পাড়ে দাঁড়ানো লোকজন সব হায় হায় করতে লাগল রানির জন্য। রানি সেখানে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করলেন ঈশ্বরের কাছে,

‘আমি যদি ধর্ম রক্ষা করে থাকি তাহলে পুকুরে উঠুক জল। রাজার পূর্বপুরুষদের ওপর থেকে অভিশাপ যাক কেটে। পাতাল ভেদ করে জল উঠে আসুক। নিয়ে যাক আমাকে ভাসিয়ে।’

হাত উঁচু করে কলসি থেকে জল ঢালতে লাগলেন রানি। এ যেন জাদুর কলসি। কিছুতেই ফুরায় না। রানি যত ঢালেন কলসি থাকে আগের মতোই ভরা। আস্তে আস্তে তিরতির করে জল উঠতে লাগল দিঘির তলা থেকে। ভিজে গেল রানির পায়ের পাতা। আরও জল ঢালতে লাগলেন রানি। জল উঠল হাঁটু পর্যন্ত। আরও জল ঢাললেন রানি।

দেখতে দেখতে গলা পর্যন্ত ডুবে গেল রানির। তারপর একসময় পুরো শরীর গেল তলিয়ে। জলের তোড় উঠল বেড়ে। শুধু রানির বেণিটা ভাসতে দেখা গেল কিছুক্ষণ। আরও জোরে উঠতে লাগল জলের তোড়।

কিছুক্ষণ পর রানির আগুন পাটের শাড়ির আঁচলটা আচমকা ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল অতলে। আর কিছুই দেখা গেল না।

খবর শুনে রাজা ছুটে গেলেন পাগলের মতো। তাঁর মুখে একটাই কথা,

‘হায় রানি। হায় রানি।’ রাজার দুঃখে ব্যথিত সব মানুষের কণ্ঠে কান্নার ধ্বনি,

‘হায় রানি। হায় রানি’ বনের পাখিও তখন শোকে-দুঃখে আকাশে উড়ে উড়ে কেঁদে বেড়াচ্ছিল। ‘হায় রানি হায় রানি’ বলে। রাজার হাতির চোখ বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছিল দুঃখের অশ্রু। পিঞ্জরের পাখিগুলো যেন কী হারিয়ে ছটফট করছে খাঁচার ভেতর। রাজার সভাসদগণও যেন স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন। কথা নেই কারও মুখে। মাতম উঠল সারা রাজ্যে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? সবাই যে রানির শোকে উন্মাদ।

রাজসিংহাসন শূন্য। রাজা তাতে বসেন না।

শূন্য আকাশের শোভা যেমন পাখি, আকাশের গৌরব যেমন চন্দ্র-সূর্য, বাগানের সৌন্দর্য যেমন নানা রঙের ফুল তেমনি রাজপ্রাসাদ পূর্ণ হয় সেখানে রানি থাকলে। রানি নেই, যেন কিছুই নেই। রানি হারিয়ে রাজা যেন বাউল হয়ে গেছেন। চুলগুলো উসকোখুসকো। পরনের কাপড় এলোমেলো। মাথার শোভা যে রাজমুকুট তা গড়াচ্ছে ধুলায়। রাজা কেবল দিঘির চারপাশে ঘুরে বেড়ান। সভাসদ আর পাত্রমিত্রগণ সান্ত্বনা দেন রাজাকে, সিংহাসনের কথা বলেন, বলেন রাজ্যশাসনের কথা। কিন্তু কোনো দিকে মন নেই রাজা জানকীনাথের।

দুঃখ আর বিষাদে ভরা দিন কাটে রাজার। এবার রাজা বললেন, ‘দিঘি সেঁচে রানিকে উদ্ধার করতে হবে।’

শত শত লোক লেগে গেল দিঘি সেঁচার কাজে। নয় দিন নয় রাত ধরে দিঘির জল সেঁচা হলো। কিন্তু তাতে চুল পরিমাণ জলও কমেনি। উল্টো সোমাই নদীর চর ডুবে গেল দিঘির সেঁচা জলের বন্যায়। অনেক ঘর আর বাগান গেল জলের তলে।

দুঃখে দুঃখে দিন যায় রাজা জানকীনাথের।

একদিন।

রাজা শুয়ে আছেন তাঁর কামটুঙ্গী ঘরের বারান্দায়। চোখে ঘুম নেই। তবু চোখ বুজে শুয়ে আছেন তিনি। এমন সময় দেখলেন এক অদ্ভুত স্বপ্ন। রানি এসে হাত রেখেছেন রাজার মাথায়। বলছেন,

‘রাজা, তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। ছেলের জন্য শোকে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। আমার জন্য তুমি আরেকটা কাজ করো।’

স্বপ্নের মধ্যেই রাজা জিজ্ঞাসা করলেন,

‘কী কাজ, রানি।’ রানি বললেন,

‘দিঘির পাড়ে একটা ঘর তৈরি করো। আমার ছেলেকে দেখাশোনা করে যে দাসী ছেলেকে তার কোলে দিয়ে রাতে সেই ঘরে পাঠিয়ে দেবে। আমি আদর করে সেখানে দুধ খাওয়াব ছেলেকে। আর সাবধান। এ কথা যেন

কীটপতঙ্গও জানতে না পারে। এক বছর যদি এভাবে দুধ খাওয়াতে পারি, তাহলে সে হবে দেবরাজ ইন্দ্রের সমান। এক বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা হবে আমার।

রাজা দেখলেন রানি আছেন ঠিক আগের মতোই। পরনের কাপড় পরিপাটি। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রংও আগের মতোই। পরনে তার সেই আগুনপাটের শাড়ি। বাতাসে উড়ছে শাড়ির আঁচল। উড়ছে মাথার ঘনকালো কেশরাশিও।

পরদিন রাজা পাত্রমিত্র সবাইকে ডাকলেন। চোখে তাঁর জল। অনেক দিন পর রাজকার্য শুরু করলেন রাজা। হুকুম দিলেন,

‘দিঘির পাড়ে একটা সুন্দর ঘর তৈরি করতে হবে এক দিনের মধ্যে।’

সেই ঘর নির্মাণের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। ডাকা হলো অনেক নামকরা কারিগরকে। বলা হলো যেন কোথাও কোনো ছিদ্র না থাকে। চাঁদ-সূর্যের আলো আর বাতাস যেন একটুও ঢুকতে না পারে সেই ঘরে।

কারিগরেরা গজারির কাঠ দিয়ে তৈরি করল থাম। সেই থামের গায়ে আঁকল নানান কারুকার্য। এমন সুন্দর করে শণ দিয়ে চাল ছাওয়া হলো যে ঘরটা যেমন মজবুত হয়েছে তেমনি হয়েছে সুন্দরও। কারিগরেরা অপরূপ কারুকাজ করা শীতলপাটি টাঙিয়ে দিয়েছে বেড়ার চারদিকে। সেই ঘরের সৌন্দর্য যেন তাই ফুটে বেরিয়েছে আরও। ঘরের কোথাও কোনো ছিদ্র নেই, একটা পিঁপড়েও ঢুকতে পারবে না সেই ঘরে।

ঘরের মধ্যে বসানো হয়েছে সোনার পালঙ্ক। রেশমি কাপড়ের চাদর বিছানো হয়েছে বিছানায়। মাথায় দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে মখমলের কাপড়ের ঢাকনা দেওয়া বালিশ। পালঙ্কের মাথার কাছে বাতিদানে রাখা হয়েছে একটা ঘিয়ের প্রদীপ। এই পালঙ্কের পাশেই ছোট্ট আর একটা বিছানা। সেটা এত নরম আর শুভ্র যে দুধের সাদাকেও হার মানাবে।

প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা দাসী রাজা-রানির আদরের ধন ছেলেটাকে কোলে নিয়ে যায় সেই ঘরে। আর রাত শেষ হওয়ার আগেই চলে আসে।

এভাবে এক-দুই-তিন করে দিন যায়। এক বছর শেষ হতে আর মাত্র এক দিন বাকি। রাজা জানকীনাথ জিজ্ঞাসা করলেন দাসীকে,

‘তুমি তো প্রতিদিন আমার ছেলেকে নিয়ে ওই ঘরে রাত্রিযাপন করো। কী দেখ সেখানে।’

দাসী বলল,

‘রানিকে দেখি সেই আগের মতোই। পরনে তাঁর আগুনপাটের শাড়ি। আগের মতো সোনার বরণ গা তাঁর। সারা শরীরে যেন রত্ন চমকায়। ঘরে একটুও ছিদ্র নেই। দরজার কপাট থাকে বন্ধ। তবু রানি কোন পথ দিয়ে আসেন আর কোন পথ দিয়ে যান কিছুই বুঝতে পারি না।’

রানির কথা দাসীর মুখে শুনে আবার বুঝি পাগল হলেন রাজা জানকীনাথ।

বললেন,

‘আজই তো শেষ রাত্রি। তুমি সেই ঘরে ছেলেকে নিয়ে তাড়াতাড়ি যেয়ো। আমি আজ দেখব রানি কমলাকে। কথা বলব তার সঙ্গে।’

অন্য দিনের মতো দাসী রাজার ছেলেকে নিয়ে গেল সেই ঘরে। পালঙ্কে শুইয়ে দিল ছেলেকে।

এদিকে মধ্যরাতে রাজা গেলেন সেই ঘরে। রানিকে আজ দেখবেনই তিনি। ভাবতে ভাবতে রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। একটু পরই পুবের আকাশ উঠবে রাঙা হয়ে। রাজা যেন উন্মাদ হয়ে উঠলেন। সেই ঘরের দরজায় আঘাত করতে লাগলেন জোরে জোরে,

‘ওরে দাসী দুয়ার খোলো, রানির সঙ্গে কথা বলব আমি। আমার আর ধৈর্য নেই। শিগগিরই দরজা খোলো তুমি।’

রাজার কণ্ঠ শুনে রানি কমলা নিজে হাতে খুলে দিলেন দরজা। খুলতেই রাজা জড়িয়ে ধরলেন রানিকে। রানি বললেন,

‘আমাকে ছেড়ে দাও রাজা। আজ আমার অভিশাপ দূর হবে। আমি দেবলোকে যাব।’ বলেই শূন্যে উড়ে মিলিয়ে গেলেন রানি।

আর তখন রাজার হাতে আটকে রইল কেবল রানির পরনের আগুনপাটের শাড়ির আঁচলের কারুকাজ করা এক টুকরো কাপড়।

(কিশোর আলোর আগস্ট ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)