জিনিসটা প্রথম পায়ে লাগে সুমনের। পায়ের সামনে যা পায় তাতেই সুমন একটা লাথি মারে এবং শালা বলে গাল দেয়। আজও লাথি মারল, কিন্তু শালা আর বলতে পারল না। বরং ‘উফ্’ বলে পায়ে হাত দিয়ে বসে পড়ল। বোঝা গেল, এই জিনিসটা কিংবা ‘শালাটা’ খুব সুবিধার নয়।
শোভন একটু এগিয়ে গিয়ে জমে থাকা গাছের পাতা সরিয়ে দেখে সেখানে আস্ত একটা ব্রিফকেস। গলির মোড়ের এই জায়গাটায় একটা আমগাছ আছে, তার নিচে পাতা জমে জমে মাঝেমধ্যে স্তূপ হয়ে যায়। কিন্তু এর নিচে একটা ব্রিফকেস কেউ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে—এমন আহাম্মক কোথা থেকে এল! সেই আহাম্মকের সন্ধানে ওরা এদিক-ওদিক একটু চাওয়াচাওয়িও করল। কাউকে দেখা গেল না অবশ্য।
সুজন বলল, ‘চল চলে যাই। খামোখা ঝামেলা।’
সুমন এখনো পায়ে হাত দিয়ে বসে। চিৎকার করে বলল, ‘চলে যাব মানে...পায়ের ব্যথায় আমি প্রায় মরে যাচ্ছি।’
‘তাহলে কী করবি?’
‘খুলে দেখব কী আছে। দামি কোনো জিনিস থাকলে নিয়ে নেব। আমার কষ্টের বদলা।’
‘চুরি করবি?’
সুমন ভেবে দেখে, চুরি মানে হলো লুকিয়ে কারও ঘরে ঢুকে জিনিস হাতানো। ডাকাতি মানে হচ্ছে দিনের বেলা কারও বাড়িতে ঢুকিয়ে ভয় দেখিয়ে সম্পদ নিয়ে যাওয়া। রাস্তায় অস্ত্র দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ছিনতাই। এখানে এর কোনোটাই ঘটছে না। সেই হিসাবে এই ব্রিফকেস বা এর ভেতরের জিনিস নিয়ে যাওয়া অপরাধের পর্যায়ে পড়বে না।
যে এমন দামি ব্রিফকেস গাছের পাতার নিচে ফেলে যায়, তার নিশ্চয়ই খুব তাড়া ছিল। লকটা তাই ঠিকমতো লাগানো হয়নি। একটু টানাটানি করতেই খুলে গেল আর খুলে গিয়ে যা বেরোল, তা দেখার পর ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে থাকাও মুশকিল। বিস্কুটের আকৃতির সোনার টুকরায় ভর্তি। কয়েকটা ছিটকে পড়ল রাস্তায়। রাস্তায় এটা-ওটা কুড়িয়ে পাওয়া যায় ওরা জানে, ভাগ্য ভালো থাকলে টাকাপয়সা পর্যন্ত কিন্তু তাই বলে এমন সোনায় ভর্তি বাক্স! ওরা এমন থ হয়ে গেল যে কিছুক্ষণ কথা বলল না, জায়গা থেকে নড়ল না, ছিটকে পড়া টুকরাগুলো মাটি থেকে তুলে নেওয়ার কথাও মনে থাকল না।
ওদের মধ্যে শোভন ভাবুক প্রকৃতির। এসব ক্ষেত্রে তাঁকেই পরবর্তী অ্যাকশন সম্পর্কে প্রথম কথা বলতে হয়। জ্ঞানী-জ্ঞানী টাইপ কথা। কিন্তু শোভন খেয়াল করেছে, যখন দরকার হয় তখন ওর মাথায় জ্ঞানের কথা আসে না। আজেবাজে কথা আসতে থাকে শুধু। এখন যেমন ওর মাথায় একটা সিনেমার গান বারবার আসছে। ‘টাকা তুমি সময়মতো আইলা না।’ গানটা টিভিতে শুনে ওর বরং অদ্ভুত লেগেছিল। টাকাকে তুমি করে বলা হবে কেন? এত দামি জিনিসকে তুই বা তুমি করে বলা যায় নাকি! বরং গানের কথাগুলো হওয়া উচিত ছিল, ‘টাকা আপনি সময়মতো আসলেন না!’ কিংবা আরও বিনীত গলায়, ‘টাকা সাহেব আপনি সময়মতো এলেন না!’ অথচ সেই অদ্ভুত গানই তার মাথায় বারবার ঘুরেফিরে আসছে। যেকোনো সময় গেয়ে ফেলতে পারে। গাইলে মান-মর্যাদা সব যাবে।
শোভন খুব কাশতে লাগল। এটা তাঁর নিজস্ব পদ্ধতি। যখন খুব বাজে কথা মাথায় আসে তখন মুখ পর্যন্ত কথাটা না আনার উপায় হচ্ছে কাশতে থাকা।
সুমন খেপে গিয়ে বলল, ‘কী রে, তোর যক্ষ্মা হয়ে গেল নাকি? সোনা দেখলে কারও যক্ষ্মা হয়, এটা তো জানতাম না।’
সুমনের স্বভাবই হচ্ছে কথায় কথায় রেগে যাওয়া। না রেগে সে কোনো কথা বলতে পারে না। কয়েক দিন আগে ইসলামিয়াত স্যার ক্লাসে ওকে পিটিয়েছেন। কারণ, ও আসসালামুআলাইকুম বলেছিল ধমকের ভঙ্গিতে।
ঝগড়ার উপক্রম হলে ঠেকানোর দায়িত্ব আবার শান্তিকামী সুজনের। সুজন ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এখন ঝগড়ার সময় নয়। শান্তির সময়। ঐক্যের সময়।’
সুমন রাগী গলায় বলল, ‘আমি তো সেটাই বোঝাতে চাইছি। শোভন বল।’
শোভন আবার কাশতে শুরু করল। সুমন চিৎকার করে বলল, ‘এই যক্ষ্মা রোগীকে থামা। না হলে এক ঘুষিতে আমি...।’
সুজন শোভনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘শোভন বল না এখন আমরা কী করব?’
শোভন আরও জোরে কাশতে থাকল।
সুজন বলল, ‘কী হয়েছে তোর? গলায় কোনো সমস্যা?’
শোভন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল, ‘আমার না একটা গান মাথায় আসছে।’
‘কী গান?’
শোভন ভয়ে ভয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘টাকা তুমি সময়মতো আইলা না!’
সুমন খেপে গিয়ে বলল, ‘এখানে টাকা কোথায়? এখানে তো সোনা।’
শোভন আরও কাঁচুমাচু করে বলল, ‘ঠিক বলেছিস সোনা! এখন আমার সোনা নিয়ে একটা গান মাথায় আসছে।’
‘সোনা নিয়ে কী গান? আমার সোনার বাংলা...’
শোভন বলে, ‘না। ঐ যে সোনা... সোনা... সোনা যত খাঁটি...’
সুমন হাঁ করে চেয়ে থাকে।
শোভন অসহায় ভঙ্গিতে বলে, ‘আমি কি গানট গাইব?’
সুজন বলে, ‘গেয়ে ফেল। তাহলে তোর কাশিটা চলে যাবে। গলাটাও খুলবে মনে হয়।’
বলার সঙ্গে সঙ্গেই শোভন একেবারে রেকর্ডারে ক্যাসেট বাজার মতো করে গাইতে শুরু করল, ‘সোনা যত খাঁটি তার চেয়েও খাঁটি আমার দেশের মাটি...।’
সুমন থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভুল। ভুল গান।’
‘ভুল!’
‘হ্যাঁ। তোর দেশের মাটি এর চেয়েও খাঁটি হলে লোকে সোনার বদলে বাক্স ভরে দেশের মাটি নিয়ে ঘুরে বেড়াত!’
সুজন বলল, ‘গানটা শেষ করতে দে না। ভালোই তো লাগছে।’
‘তোরা কী সব পাগল হয়ে গেলি নাকি? একটা সোনার বাক্স পেয়েছি আর তার সামনে বসে কিনা একজন গান গাইছে, ওর দেশের মাটি নাকি এর চেয়েও খাঁটি! বৃষ্টির দিনে তোদের এই মাটির কী অবস্থা হয় দেখিসনি! পা পিছলে পড়ে তোরই যে গত বছর ডাক্তারের কাছে যেতে হলো, ভুলে গেছিস?’
দেশের মাটির এই অপকীর্তি মনে হওয়াতেই কিনা শোভনের মাথা থেকে গান চলে যায়। মগজ কাজ করতে শুরু করে।
সুজন বলল, ‘আমি বলি কী, আমরা চলে যাই। বাক্সটা যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক।’
শোভন বলে, ‘এখন আর সম্ভব না।’
‘সম্ভব না কেন?’
‘আমরা বাক্সটাতে হাত দিয়েছি। এর মানে এখানে আমাদের হাতের ছাপ লেগে গেছে। আমরা ফেলে গেলে পুলিশ এই বাক্সটা উদ্ধার করবে। তারপর হাতের ছাপ পরীক্ষা করবে। ফিঙ্গারপ্রিন্টের কথা শুনিসনি?’
সুমন রাগী গলায় বলল, ‘আমি তো ওটা আগেই বলেছিলাম। এই ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নেই। এখন মর...।’
শোভন বলল, ‘তুই আগে কখন সেটা বললি। তুই-ই তো বললি বাক্সটার ভেতরে কী আছে দেখা দরকার। যেখানে দেখিবে ছাই, ওড়াইয়া দেখো তাই..বলিস নি?’
সুমন চুপ করে যায়। বাকিরাও। শুরুতে মনে হয়েছিল, এতগুলো সোনা পাওয়া মানে তো ওরা ধনী হয়ে গেল। খেয়াল করে দেখেছে, বড়রা সবাই টাকার কাঙ্গাল। তাদের স্কুলের হেডস্যার সবাইকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন সামান্য কটা টাকার জন্য। তাকে কিছু টাকা দিয়ে দিলে তিনি শান্ত হয়ে যাবেন। সুমনের বাবা সব সময় টাকা-টাকা করেন আর টাকার অভাব দেখা দিলে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেন। মা তখন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন। এই সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে এবার। ওদের কাজের বুয়ার ছেলেটার চাকরি হচ্ছে না বিশ হাজার টাকা ঘুষ দিতে পারছে না দেখে। ওর চাকরিটাও ওরা পাইয়ে দেবে।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এতগুলো সোনা যার, সে নিশ্চয়ই এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না। একটু পর আসবে এখানে খঁুজতে। তারপর ঠিক ঠিক হয়তো ওদের বের করে ফেলবে। এদের নেটওয়ার্ক নাকি অনেক বড় হয় আর খুব নৃশংস হয় ওরা। তা ছাড়া পুলিশও নিশ্চয়ই পিছু নেবে। ভালো একটা ঝামেলা হলো!
বিকেলের দিকে গলিতে মানুষজন খুব কম থাকে। কিন্তু তাহলেও বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। কেউ দেখলে সন্দেহ করে বসবে।
হঠাৎ শোভন বলল, ‘জলদি।’
সুমন-সুজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই শোভন আঙুল দিয়ে একটা গাড়ি দেখায়।
পুলিশের গাড়ি।
সুমনের হাতে ব্রিফকেসটা। বাকি দুজন ছুটতে শুরু করেছে।
সুমন ভেবে পায় না কী করবে? বাক্স হাতে নিয়ে দৌড়ানো না ফেলে যাওয়া—কোনটা নিরাপদ, না বুঝে দাঁড়িয়ে থাকে হাঁ হয়ে।
২.
পুলিশের বড় কর্মকর্তারা সাধারণত দেখতে ছোট হন। ইনি সে রকম নন। দেখতেও যথেষ্ট বড়। পোশাকের ফাঁক দিয়ে শরীরের গঠনটা যতটুকু দেখা যাচ্ছিল, তাতেই বোঝা যায় পেটানো শরীর, চওড়া কাঁধ। মুখটাও বিশাল। সবই বড় বড়। না, বড় কর্তা হিসেবে ইনি ঠিক আছেন।
বড় কর্তার কাজকর্ম অবশ্য ছোট মানুষের মতো। তিনি এখন ব্যস্ত ওদের নাম নিয়ে। কে সুজন, কে সুমন আর কে শোভন—এটা মেলাতে খাবি খাচ্ছেন। দুবার করে তিনজনের নাম শুনে মনে মনে যেন মুখস্থ করার চেষ্টা করলেন, তারপর পরীক্ষা দিতে গিয়ে সুজনকে বললেন সুমন। সুমনকে শোভন। শোভনকে সুজন। বিরক্ত হয়ে শেষে বললেন, ‘তোমাদের নামগুলো তো একজন রাখেনি। আলাদা-আলাদা মানুষ রেখেছে?’
সুমন বলল, ‘জি। আলাদা আলাদা মানুষ। আমারটা আমার বাবা। ওদের দুজনেরটা ওদের বাবা।’
‘মানে, নাম রাখার পর তিনজন এই বাড়িতে এক হয়েছ?’
‘জি।’
‘মজা তো! এখানে এক হলে কী করে?’
রাফি মামা সংক্ষেপে ইতিহাসটা জানাল। ইতিহাসটা সংক্ষিপ্ত হলেও মজাদার। সুমন হচ্ছে রাফি মামার আপন ভাগিনা, ওর অকর্মণ্য বাবার সূত্রে রাফি মামার বাড়িতে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। বাড়ির নিচতলার ভাড়াটে হচ্ছেন আনোয়ার মোল্লা, তার ছেলে হচ্ছে সুজন। আর সুজনের গ্রামে থাকা গরিব চাচার ছেলে হচ্ছে শোভন। এভাবেই তিনজন এখানে। যে নামের কারণে তিনজনকে খুব আলাদা করা যায় না, সেই নাম নিয়েও ওদের মধ্যে গোলমাল আছে কিছু। সুমনের নাম হচ্ছে সুমন চৌধুরী, নামগত একটা বিরাট গৌরব আছে তাঁর। অথচ এই নামের জায়গাটাতে একটু পিছিয়ে সুজন, ওর না সুজন মোল্লা /////। সুমন তাই যেমন কোনো সুযোগ পেলেই চেঁচিয়ে বলে, আমি হচ্ছি চৌধুরী বংশের ছেলে তখন সুজন কোনো সময়েই পুরো নামটা বলতে চায় না। যে স্যার পুরো নাম জিজ্ঞেস করেন, সেই স্যারের ওপর সে ক্ষুব্ধ হয়।
পুলিশ কর্মকর্তা পুরো ইতিহাস শুনে বললেন, ‘লম্বা-বেঁটে-মোটা নিয়ে তোমাদের মধ্যে মারামারি হয় না। একজন দেখছি খুব লম্বা, আরেকজন বাট্টু। আরেকজন মুটু শ্রেণীর।’
রাফি মামা হেসে বলল, ‘না। এই নিয়ে মারামারি হয় না। ওরা বরং আফসোস করে।’
‘কী রকম?’
‘সুমন ভাবে, আমি যদি আরেকটু খাটো হতাম, তাহলে কী মজা হতো! কেউ আর আমাকে লম্বু বলত না।’
পুলিশ কর্মকর্তা হেসে বললেন, ‘তোমাকে বুঝি সবাই লম্বু বলে?’
‘লম্বু বলে আর ঝামেলাও করে। এই তো গত সপ্তাহে স্কুলে কালচারাল কম্পিটিশন হলো। আমাকে সবাই ঠেলে পেছনে বড় ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল। সেখান থেকে আমি সেলিনার নাচটাই দেখতে পারলাম না! খুব সুন্দর নাকি নেচেছিল।’
পুলিশ এমন মনোযোগ দিয়ে কথাটা শুনলেন যেন তিনি অবিলম্বে সেটার সমাধান করে দেবেন। সমাধান হয়ে যাবে ভেবেই কিনা সুজন বলল, ‘আমার খুব বেশি সমস্যা নেই। শুধু পিচ্চি বলে ক্লাসের মেয়েরা...।’
কথাটা শেষ হলো না। পুলিশ কর্মকর্তাটি যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর হঠাৎ কী মনে করে বললেন, ‘বাচ্চারা তোমরা যাও। নিচে গিয়ে খেলাধুলা করো। আজ ইউনিফর্মে এসেছি তো, ঠিক গল্প বেরোচ্ছে না। পুলিশের এই এক সমস্যা, ইউনিফর্ম পরলে হাসি-গল্প এগুলো গলায় আটকে থাকে। বেরোয় না ঠিকঠাক। আরেক দিন ইউনিফর্ম ছাড়া আসব। তখন দেখবে আমি কত গল্প জানি। যাও। নিচে যাও।’
ওরা এক লাফে নিচে চলে এল। আপাতত রক্ষা পাওয়া গেছে। এভাবে যে রক্ষা পাওয়া যাবে ভাবতেই পারেনি।
নিচে পুলিশ কর্তাকে দেখে ওদের জান শুকিয়ে গিয়েছিল। একবার তো ভেবেছিল, ব্রিফকেসটা নিয়ে গিয়ে সোজা তার পায়ের সামনে নিলডাউন হয়ে কান ধরে ফেলবে। প্রস্তাবটা ছিল সুজনের। ওর বিশ্বাস, নিলডাউন হয়ে কান ধরলে পাষাণেরও মন গলে যায়।
খুবই অপমানজনক প্রস্তাব যদিও কিন্তু আরও কিছুক্ষণ সময় পেলে সম্ভবত ওরা সেটা মেনে নিত। রক্ষা করল রাফি মামা। নিচ থেকে শোনা গেল তার চিৎকার, এই সবাই আমার ঘরে আয়।
সুজন বলল, ‘মামার ঘরেই ব্রিফকেসটা নিয়ে যাই। গিয়ে সুন্দরমতো সব স্বীকার করে ফেলব। আমরা তো এখান থেকে কিছু খরচ করিনি। যেমন ছিল তেমনই আছে।’
শোভন একটু ভেবে বলল, ‘মামা যখন ডাকছে, আগে গিয়ে দেখি ব্যাপারটা কী? তারপর না হয়...।’
সুজন বলল, ‘যদি মামার কোনো বিপদ হয়। পুলিশ তো! দেখা গেল মামাকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে বড় মানুষদের না জড়ালে তো পুলিশের লাভ হবে না।’
একটু দমে গেল তিনজনই। সত্যিই তো! মামাকে যদি নিয়ে যায়। যদিও মামাকে নিয়ে নানা রকম দুষ্টামি-ফাজলামি সব সময় চলে, তাকে বিপাকে ফেলতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই মানুষটাকেই পৃথিবীতে ওরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
সুমন বলল, ‘চল। ব্রিফকেসটা নিয়ে যাই।’
শোভনও একই মত দিল।
ব্রিফকেস হাতে নিয়ে বেরোবে এই সময় আবার মামার চিৎকার, ‘এই তোরা আয় না। ইমনের গায়ে পুলিশের পোশাক দেখে ভয় পাস না। ও হচ্ছে আমার ভার্সিটির বন্ধু। এক বিছানায় দেড় বছর ঘুমিয়েছি। আয়।’
এত শান্তির খবর ওদের কানে আজ পর্যন্ত আসেনি বোধ হয়। সুমন ব্রিফকেসটা এক ধাক্কায় নিচের খাটের নিচের গোপন জায়গায় ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চল। নইলে এদিকে চলে আসতে পারে।’
তিনজনই এক দৌড়ে মামার ঘরে। মিনিট পনেরো ওখানে ছিল, গোলমাল হয়নি কোনো। সেই স্বস্তি আছে কিন্তু পুলিশ কর্তাটি না যাওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা পুরো নিশ্চিত হচ্ছে না।
পুলিশের গাড়ি চলে গেলে সুমন বলল, ‘মামা, তোমার এই পুলিশ বন্ধুর কথা তো আগে বলোনি কোনো দিন?’
‘আমার কত বন্ধু কত দিকে! সবার গল্প করতে গেলে তো আর কোনো কাজ করা হবে না।’
‘তা অবশ্য ঠিক। তা উনি কি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?’
‘আরে না। পুলিশ কি আর এমনি এমনি কারও কাছে আসে?’
‘তাহলে...।’
‘এসেছিল একটা কেসে। এই এলাকায় আজ দুপুরে ওদের একটা দল একজন সোনা চোরাকারবারিকে ধাওয়া করেছে। লোকটা পালিয়েছে। কিন্তু ওদের কাছে ইনফরমেশন আমাদের গলিতে নেমে নাকি একবার সে একটা ব্রিফকেস হাতে নেমেছিল। দেখতে এসেছে সেই ব্রিফকেসটা আদৌ এখানে ফেলে গেছে কি না?’
তিনজনের মুখে মুহূর্তেই কেউ যেন কালো কালি মাখিয়ে দিল। এমন অন্ধকার হয়ে গেল ওদের চেহারা!
শোভন তাড়াতাড়ি করে বলল, ‘ব্রিফকেসটা কি পাওয়া গেল?’
‘আরে না। ওসব জিনিস কি পাওয়া যায় নাকি?’
‘তোমার কাছে এল কেন?’
‘এখানে এসে ওর মনে পড়ল আমার বাসা এই গলিতে। ফোন করল।’
‘ও।’
সুমন বলল, ‘আচ্ছা মামা, উনি পুলিশ হিসেবে কেমন?’
‘খুব ভালো। দেখিসনি ওর পকেট মেডেলের ভারে নুয়ে পড়ছে। কিছুদিন পরপরই তো শোনা যায়, এই মেডেল, ওই মেডেল জিতেছে।’
‘তাহলে তো বের করে ফেলবে মনে হয়!’ সুমন চেষ্টা করেও গলার দুশ্চিন্তাটা লুকাতে পারে না।
‘আরে দূর। কোথা থেকে বের করবে। ভার্সিটিতে থাকার সময় একবার এক শ টাকা হারিয়েছিল, এক মাস চেষ্টা করে সেটাই খঁুজে বের করতে পারেনি। আর ও বের করবে সোনার বাক্স!’
‘পারবে না বলছ!’
‘প্রশ্নই ওঠে না। তবে...।’
‘তবে...’
‘তবে আমি বের করে ফেলব।’
‘কী? তুমি...তুমি কি জানো নাকি?’
‘পুরোপুরি জানি না কিন্তু আমার ধারণা, এর মধ্যে তোদের কোনো একটা যোগসূত্র আছে।’
‘কী বলছ তুমি... পাগল হয়ে গেলে নাকি...।’
‘চল। তোর ঘর পরীক্ষা করা হবে। খাটের নিচেই জিনিসটা লুকানো বলে আমার ধারণা। চল।’
মামা দ্রুত পায়ে সুমনের ঘরের দিকে আগায়।
ওরা ঠিক বুঝতে পারে না, কী থেকে কী হচ্ছে।
৩.
রাফি মামার সামনে ব্রিফকেসটা। আর ওরা তিনজন।
মামা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার খুব রাগ করা উচিত। তাই না?’
তিনজন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
‘উচিত তোদের তিনটাকে ধরে নদীতে নিয়ে ফেলা আর রাফি কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া।’
ওরা এবার আরও জোরে মাথা নাড়ে।
‘উচিত সব প্রজেক্ট বাতিল করে দেওয়া। আর দেশ-বিদেশ ঘোরার কোনো কাহিনি নেই। সব বাদ।’
এবারও ওরা মাথা নাড়ে। ঠিকই তো! মামাকে লুকানোর চেষ্টা করা রাফি কোম্পানি বা থ্রি এসের নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
‘কিন্তু আমি রাগ করছি না। কিচ্ছু বাতিল করছি না। কারণ কি জানিস?’
তিনজন না সূচক মাথা নাড়ে।
‘তা তো জানবি না। আমাকে বাদ দিয়ে কি আর তোরা কিছু করতে পারিস? কিন্তু তার পরও ফাউল করিস।’
ওরা অপরাধ মেনে আবার মাথা নাড়ে।
‘বাতিল করছি না, কারণ আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।’
‘নিশ্চয়ই দারুণ কোনো আইডিয়া।’ সুমন তৈলাক্ত গলায় বলে।
মামা বলল, ‘দারুণ মানে! শুনলে একেবারে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি।’
‘বলো না মামা। বলো। তাড়াতাড়ি বলো।’
শোভন বলল, ‘মামা, তার আগে যদি বলতে তুমি কীভাবে টের পেলে...। তাহলে আমরা একটু শিখতে পারতাম। কীভাবে লুকিয়ে রাখা সোনার সন্ধান পাওয়া যায়!’
মামা হাততালি দিয়ে বলল, ‘তোরা তো মনে করিস, আমি কিছু বুঝি না। এখন তো বুঝলি, আমাকে ছাড়া তোদের দৌড় খাটের তলা পর্যন্ত। এর বেশি না!’
সুজন বলল, ‘জি মামা, বুঝলাম। তুমি ছাড়া আমাদের হাত নেই, পা নেই, শরীর নেই, মাথা নেই, মুণ্ডু নেই।’
‘হুঁ। কথাটা মনে রাখিস।’
সুমন বলে, ‘মামা, তাড়াতাড়ি বলো না কী করে তুমি বুঝলে?’
মামা একটু ভেবে বলল, ‘পুরোটা বলে দেওয়া ঠিক হবে না। তাহলে ভবিষ্যতে আর তোদের ধরা যাবে না। তবু কিছু বলি।’
‘ঠিক আছে কিছুটাই বলো। বাকিটা আমরা বুঝে নেব।’
‘আমি খেয়াল করেছি, তোদের মধ্যে যখন লুকানোর ব্যাপার থাকে, তখন তোরা আমার সঙ্গে একমত হয়ে যাস। আজ দুপুরে দেখলাম, বেশ একমত হয়ে যাচ্ছিস, তখনই সন্দেহ হলো।’
‘শুধু এই সন্দেহ থেকে...।’
‘তারপর দেখলাম, সুমন ওর বাবার কথা বলে আমাকে সরিয়ে দিতে চাইছে। এটা হলো সন্দেহ নাম্বার দুই। তারপর ইমন আমাকে যে সময়টার কথা বলল, সেই সময়টাতেই তোরা বাসায় ফিরেছিস। তোদের গলির মোড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা গেছে। এতগুলো ক্লু যোগ করে যদি জায়গামতো পৌঁছাতে না পারি, তাহলে আর আমাকে দিয়ে কী হবে?’
সুমন বলল, ‘না মামা, তোমাকে দিয়ে সব হবে। সব।’
মামা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এখন আমি যে আইডিয়া করেছি সেটা শোন।’
‘বলো মামা।’
‘এটা হবে প্রজেক্ট সোনার মানুষ।’
‘প্রজেক্ট সোনার মানুষ!’
‘সোনা দিয়ে ঘষে মানুষের পরীক্ষা।’
‘সেটা কী রকম? একটু বুঝিয়ে বলো।’
‘বলছি। আমরা কয়েকজন মানুষ খঁুজে বের করব। একজন হচ্ছে খুব লোভী। একজন হচ্ছে খুব নীতিমান। একজন হচ্ছে খুব গরিব। আরেকজন হচ্ছে বেখেয়ালি।’
‘তাদের দিয়ে কী করব?’
‘তাদেরকে আমরা সোনাগুলো দিয়ে দেব।’
‘বলছ কী তুমি?’ শোভন প্রায় আর্তনাদের মতো করে বলে।
‘এমন ভাব করছিস, যেন এগুলো সব তোদের জিনিস।’
‘আমাদের নয় বলেই তো আমরা এগুলো কাউকে দিতে পারি না। আজ হোক, কাল হোক, আমরা ধরা পড়বই। তখন সোনা চোরাচালান হিসেবে পত্রিকায় নাম ছাপা হবে। ক্লাসে মুখ দেখানো যাবে না।’
সুমন-সুজনও একমত। ক্লাসে মুখ দেখানো যাবে না। মেয়েরা ওদের দেখে হাসবে। কী লজ্জার ব্যাপার হবে!
শোভন বলল, ‘মামা আমাদের বরং চেষ্টা করা উচিত, এর আসল মালিক কে, সেটা বের করা।’
‘এর আসল মালিক বলে কেউ নেই। এগুলো চোরাচালানের জিনিস, এক হাত হয়ে অন্য হাতে যায়। শেষ পর্যন্ত যে আসল মালিক কে, তা কেউ জানে না।’
‘তাহলে পুলিশের কাছে দিয়ে দেই। আমাদের কাজ শেষ।’
‘পুলিশের কাছে দিয়ে দেওয়ার মধ্যে তো কোনো বাহাদুরি নেই। আর দশজন মানুষ পেলে যা করত আমরাও যদি তাই করি, তাহলে আর রাফি কোম্পানি আলাদা থাকল কোথায়? আর পুলিশ তো হাতের কাছে আছেই। যখন দরকার তখন পুলিশের কাছে যাব কিন্তু পুলিশ তো রোজই কত সোনা উদ্ধার করছে, অপরাধীদের ধরতে পারছে! পারছে না। খুব সম্ভব ধরার চেষ্টাও করছে না। মাঝেমধ্যে বরং নিজেরা ভাগ-বাঁটোয়ারাও করে নেয়। কাজেই পুলিশের কাছে গেলেও এমনভাবে যেতে হবে, যাতে তারা জিনিসটা মেরে দেওয়ার সুযোগ না পায়।’
সুমন বলল, ‘মালিককেও খঁুজব না! অপরাধীদের ধরার চেষ্টা করব না! আবার অন্যদের দিয়ে দেব। কেমন যেন গোলমেলে লাগছে মামা!’
মামা একটু ভাবে। ভেবে বলে, ‘আমরা দুটো কাজ করব। একটা হলো, সোনার পরীক্ষা করে সোনার মানুষ বের করা। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে অপরাধীদের ধরা। প্রথমে আসি প্রথম ব্যাপারটাতে। মানুষকে সোনা দিয়ে পরীক্ষা করতে গেলে সোনা হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি আছে। কাজেই পরীক্ষাটা করতে হবে নিজেরা নিরাপদ থেকে। সেটা করব আজ রাতেই।’
‘আজই? এত সব মানুষ কোথায় খঁুজে পাব?’ শোভন বলে।
‘তোদের কথা শুনেই আমি আমার পরিকল্পনায় একটু রবদবদল করেছি। বাইরের লোকের মধ্যে পরীক্ষা করতে গেলে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু বাসার ভেতরের মানুষদের মধ্যে পরীক্ষা করলে তো সমস্যা নেই।’
‘বাসার ভেতরে মানে...। এত লোক আমাদের বাসায় আছে নাকি?’
‘আমাদের এই বাসায় আমরা এবং ভাড়াটে মিলিয়ে সবচেয়ে লোভী লোক কে?’
সুমন মাথা নিচু করে বলে, ‘আমার বাবা।’
‘লজ্জার কিছু নেই। লজ্জার কিছু নেই। ছেলে অপরাধী হলে বাবার দায় থাকে, বাবা তাকে ঠিক শিক্ষায় মানুষ করতে পারেনি। কিন্তু বাবা অপরাধী হলে ছেলের কোনো দায় নেই। লজ্জাও নেই। তোর বাবা এবং আমার দুলাভাই এই বাসার মধ্যে সবচেয়ে লোভী মানুষ এই নিয়ে আমাদের কারও কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।’
সুজন বলল, ‘সবচেয়ে নীতিমান হচ্ছে আমার বাবা। সারাক্ষণ দেশ নিয়ে ভাবে। জাতি নিয়ে চিন্তায় তার ঘুম হয় না।’
‘ঠিক, আনোয়ার ভাই সবচেয়ে নীতিমান মানুষ। সবচেয়ে গরিব হচ্ছে আমাদের বুয়া শেফালি। আর সবচেয়ে বেখেয়ালি হচ্ছে শফিক। ঠিক।’
ওরা বেশ চমকে গেল। এত দিন খেয়াল করেনি কিন্তু এখন অবাক হয়ে দেখছে, ওদের বাসাতেই কত রকমের মানুষ!
এই চারতলা বাসাটার মালিক হচ্ছে রাফি মামা। এতক্ষণ আমরা যে রাফি মামাকে দেখলাম, তার পক্ষে এ রকম আস্ত একটা বাড়ির মালিক হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তার চেয়েও অস্বাভাবিক ব্যাপার হলো, এর বাইরেও রাফি মামার আরও বহু কিছু আছে। ঢাকা শহরে আরও দুটো বাড়ির মালিক রাফি মামা, একটা বিশাল মার্কেট আছে তাঁর। চট্টগ্রামে জাহাজের একটা অংশীদারি ব্যবসায়ও শরিক তিনি। এই বাড়িটা পৈতৃক কিন্তু বাকি সব রাফি মামার নিজের করা। মামা নিজে অবশ্য ব্যবসা দেখে না, তার বিশ্বস্ত লোক আছে, তারাই কাজ করে। এর মধ্যে একজন ঠকানোর চেষ্টা করেছিল, প্রথম সুযোগেই ধরা পড়েছে। মামা বেশি কিছু করেনি। শর্ত দিয়েছিল, হয় এক হাজার বার কান ধরে উঠবোস করবে অথবা মাথা কামিয়ে বিদায় নেবে। লোকটা মাথা কামিয়ে বিদায় নিয়েছে। এরপর তাই আর কেউ ও পথে যায়নি। ওদের কাছে যে রাফি মামা ওদেরই বয়সী সেই তিনি আবার বড়দের কাছে পাকা ব্যবসায়ী। ওরা অবাক হয়ে যায় যখন দেখে, বড়দের আলোচনায় রাফি মামার কাছে সবাই কেমন উড়ে যায়। শুরুতে অদ্ভুত লাগত, এখন বুঝেছে, রাফি মামা ওদের সঙ্গে মেশেন ওদের মতো করে। আবার বড়দের সঙ্গে বড়দের কাছে গিয়ে ঠিক বড় হয়ে যান। বাচ্চা হয়ে থাকা, ওদেরকে ভালোবাসার একটা একান্ত ব্যক্তিগত কারণ আছে। গভীর বেদনার কারণ, মামা কাউকে বলে না কিন্তু ওরা জানে। সেই গোপন দুঃখটা মাঝেমধ্যে যখন জেগে ওঠে, তখন মামা তার লাল রঙের গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দূরে কোথাও চলে যায়। সেদিন ওর মন থাকে বিষণ²। ওরা বুঝতে পারে। কথা বলে না। দুঃখ বাড়ায় না।
রাফি মামার এই বাড়িতে সুমনরা আশ্রিত শ্রেণির। রাফি মামা বাবার কাছ থেকে যা পেয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছিল সুমনের মা, অর্থাৎ রাফি মামার বোন। আমাদের দেশে অদ্ভুত হিসেবে মেয়েরা ছেলেদের অর্ধেক পায় কিন্তু রাফি মামা সেই হিসাব মানেনি। নিজে যা পেয়েছে তার চেয়ে বেশি দিয়েছিল আপাকে। সুমনের বাবা ওর হাত ধরে বলেছিলেন, ‘তুমি যা দিলে, একে দশ গুণ না করতে পারলে আমি আমার কান কেটে কুত্তাকে খাওয়াব।’
কান কেটে অবশ্য কুত্তাকে খাওয়াননি কিন্তু খাওয়ানো উচিত ছিল। কারণ, দশ গুণ দূরে থাক, শর্টকাট বিজনেস করতে গিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যে শেষ পর্যন্ত বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে। ভাড়াটে হিসেবে উঠে এসেছেন রাফি মামার বাড়িতে। মামা অবশ্য শর্ত দিয়েছে, ‘আর যা-ই করুন, ভাড়া দিতে হবে। ভাড়া না দিলে নিজেদের আশ্রিত মনে হবে। নিজের বোনকে আমি আশ্রিত শ্রেণির করে রাখতে পারব না।’
সুমনের বাবা কোনোভাবে ভাড়াটা জোগাড় করে দেন। এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অবশ্য নিয়ে নেন ধার হিসেবে। এভাবেই আছেন তিনি। সঙ্গে আছে তার ভাইও, ওদের শফিক চাচা। অনেক বছর ধরেই সুমনদের সঙ্গে থাকে। মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার আগে মাথায় কী এক ভূত চাপাতে পরীক্ষা বাদ দিয়ে সে মন দিয়েছে জ্ঞান সাধনায়। দিনরাত লেখালেখি করে আর বলে, পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষের একটা দাগ রেখে যাওয়া উচিত। সেই দাগটা সবচেয়ে বেশি রাখা সম্ভব খাতা-কলমে দাগাদাগি করে। অর্থাৎ লেখালেখি। সে জটিল জটিল বিষয়ে লেখে আর সবাইকে পরামর্শ দেয়, লিখো। যা দেখছ সব লিখে যাও। তুমি মারা গেলে এই লেখাই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।
সুজনের বাবা আনোয়ার সাহেব হচ্ছেন তাদের একমাত্র ভাড়াটে। অনেক বছর ধরে আছেন, রাফি মামার ঘোষণা অনুযায়ী আরও অনেক দিন থাকতে হবে। মামা বলেছে, তিনি সেদিনই বাড়ি ছাড়তে পারবেন, যেদিন নিজে বাড়ি করতে পারবেন। নইলে এখানেই বাকি জীবন। তার মধ্যে বাড়ি তৈরির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। একটা সরকারি চাকরি করেন আর দিনরাত দেশ নিয়ে ভাবেন। দেশ-জাতি-রাজনীতি এসব ছাড়া আর কোনো কথা তার মুখে শুনতে পাওয়া যায় না।
সুমনরা এত দিন তাদের এভাবেই দেখে এসেছে। আজ দেখছে, সবাইকে এক সারিতে দাঁড় করালে তাদের এই বাসাতেই লোভী, নীতিমান, বেখেয়াল, দরিদ্র—সব রকম মানুষ আছে। মামা তাদেরকেই পরীক্ষা করতে চায়।
সুমন শেষবেলা একটু প্রতিবাদ করে বলল, ‘আচ্ছা, আমার বাবাকে বাদ দেওয়া যায় না! আমরা তো জানিই, উনি লোভী। সোনাটা নিয়ে ভাঙানোর চেষ্টা করবেন।’
মামা কড়া গলায় বলল, ‘কোনো স্বজনপ্রীতি নেই। এখন আমরা সবাই পরীক্ষক।’
শোভন বলল, ‘কিন্তু অপরাধীদের ধরার অ্যাকশনের বিষয়ে তো কিছু হলো না।’
‘হবে।’
‘কীভাবে?’
‘এই কাজ আমরা করব না। ওদিক থেকেই হবে। যারা এ রকম সোনা ফেলে গেছে, ওরা চুপ করে বসে নেই। আমরা খঁুজতে গেলে ওদের পাব না কিন্তু ওরা ঠিকই আমাদের খঁুজে বের করবে।’
‘ওরা আমাদের খঁুজে বের করে ফেলবে?’
‘অবশ্যই। সেই সময়টা আমাদের হাতে আছে। ওরা খঁুজে বের করার পর কৌশলে ওদের ফাঁদে ফেলতে হবে। কাজেই এ ক্ষেত্রে আমাদের আগ বাড়িয়ে কিছু করার সুযোগ নেই।’
যুক্তিটা মেনে নেওয়ার মতো। এতগুলো সোনা যারা ফেলে গেছে তারা নিশ্চয়ই খোঁজখবরে লেগে গেছে। ওরাই খঁুজে বের করে আসবে। তখন ওদের ধরতে হবে।
মামা বলল, ‘পরীক্ষা কিন্তু আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে। সবাই তৈরি তো!’
সুমন বলল, ‘তৈরি আছি। লাইন অব অ্যাকশন বলো।’
কাজে নামলে এ রকমের শব্দ মামার খুব পছন্দ। আরও পছন্দ হলো, নিজের অফিসঘরে বসে অফিশিয়াল ভাষায় পরিকল্পনা তৈরি করা।
বলল, ‘অফিসে চল।’
হ্যাঁ। মামার একটা অফিস আছে। বাড়ির চারতলায়। দেখার মতো অফিস। সেখানে একজন পিয়ন আছে, যে দুনিয়ার সব শক্তি প্রয়োগ করে স্যালুট দেয়।
মামা বলল, ‘তোরা যা। আমি আসছি।’
ওরা অফিসের উদ্দেশে রওনা হলো। মামা গেল তৈরি হতে।
মামা অফিসে আসে অফিসের পোশাক পরে। শার্ট ইন করে, জুতা পরে। একটা চশমাও থাকে চোখে। মাঝেমধ্যে গলায় টাই।
ইন করা শার্ট পরে, টাই গলায় ঝুলিয়ে, গালে হাত দিয়ে গভীরভাবে ভেবে মামা তার প্রজেক্ট সোনার মানুষ তৈরি করে। সে অনুযায়ী সুমনের বাবা আশফাক চৌধুরী, বুয়া শেফালি, শফিক ও সুজনের বাবা আনোয়ার মোল্লা—এই চারজনের কাছে একটা করে সোনার বার পৌঁছে দেওয়া হবে। এমনভাবে রাখা হবে যেন প্রথম সুযোগেই তাদের চোখে পড়ে।
৪.
সুমন কঠোর গলায় বলল, ‘তোমার ছেলে তাহলে মারা যাবে?’
‘হ্যাঁ। ভাইজান। আমি রাইতের মধ্যে না গেলে...। হায় আল্লাহ রে... ও আল্লা...।’
‘আল্লাহকে সবকিছুর মধ্যে টানবে না। ছেলের হয়েছেটা কী?’
‘মরণজ্বর। এই জ্বর উঠলে না মইরা উপায় নাই।’
‘তোমাকে কে খবরটা দিল? ছেলে ফোন করেছিল?’
‘হুঁ।’
‘মরণজ্বর ওঠার পরও ফোনে কথা বলা যায়?’
বুয়া আবার চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, ‘ভাইজান, গরিব বলে আমাদের নিয়ে তামাশা করেন। গরিবের কি জ্বর উঠতে পারে না!’
সুমন তার চেয়েও জোরে চিৎকার করে, ‘খবরদার, গরিব হিসাবে বাড়তি কোনো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে না। দেখি, তোমার ফোন দেখি।’
পরীক্ষা করে দেখা গেল, বাড়ি থেকে এর মধ্যে কোনো ফোন আসেনি। বুয়াকে সেটা দেখিয়ে সুমন আবার বলল, ‘কই, তোমার বাড়ি থেকে তো কোনো ফোন আসেনি?’
‘আসছে ভাইজান।’
‘এখানে তো নাই।’
‘ভাই, গরিব বলে আমাদের কথা আপনারা বিশ্বাস করেন না। হায় রে, গরিব হওয়ার চেয়ে মরণ অনেক ভালো। আল্লা... পোলাটার লগে আমারেও তুই মরণজ্বর দে...। একলগে দুইজন যাই।’
সুমন আবার চিৎকার করে, ‘খবরদার, গরিব বলে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে না। খবরদার।’
মামার অফিসঘরে এই জিজ্ঞাসাবাদের আয়োজন। মামা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পুরো আলোচনাটা শুনছিল, সুমন দু-একবার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হস্তক্ষেপ করেনি। এখন করল।
ঠান্ডা গলায় বলল, ‘শেফালি, তুমি ধরা পড়ে গেছ। তোমার ছেলের কিছু হয়নি। যা হয়েছে সেটা হলো তুমি একটা সোনার টুকরা পেয়েছ। এখন সেটা নিয়ে বাড়ি যেতে চাও। গিয়ে বিক্রি করে জমি কিনে ঘর তুলতে চাও। তাই না?’
শেফালি খুব একটা অবাক হয় না। বলে, ‘আপনে জানেন মামা?’
‘জানি।’
‘তাইলে তো আগে বলবেন। আমারে এত নাটক করতে হয় না। এখন তাইলে আমারে যাওয়ার অনুমতি দেন।’
‘কোথায় যাবে?’
‘বাড়ি যামু। গিয়ে একটা জমি কিনে রেখে আসি। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন মামা, এক পোয়া জমি কেনা। জমির দলিলটা হাতে নিয়া আমি ঘুরমু আর সবাইরে কমু, এই যে দেখো এইটা আমার জায়গা...।’
‘তুমি এই সোনা দিয়ে জমি কিনবে?’
‘হ মামা। জমি কিনুম। বড়লোক গো মতো খাইয়া-উড়াইয়া নষ্ট করুম না। দেইখেন। দলিল আইনা আপনার কাছে রাখুম। আপনি বিশ্বাসী মানুষ। নয়-ছয় করবেন না।’
মামা বলে, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ঠিক আছে।’
সুমনের মনে হয়, মামা গলে যাচ্ছে। মামা গলে গেলে সোনাটা সত্যি সত্যিই বুয়াকে দিতে পারে।
সুমন কড়া গলায় বলল, ‘শোনো, এই সোনাটা আমরা রেখেছিলাম তোমাকে পরীক্ষার জন্য। তুমি পরীক্ষায় ফেল করেছ। তোমার এই লোভের জন্য শাস্তি দেওয়া হবে। দাও। জিনিসটা বের করে দাও।’
বুয়া কী যেন ভাবল একটু। তারপর শাড়ির একটা গোপন জায়গা থেকে সোনাটা বের করে ফেলে দিয়ে বলল, ‘এই নেন মামা। গরিবের ভাগ্য আল্লা বদলাইতে চাইলেও আপনারা দেবেন না।’
বলেই সে আর একটু দাঁড়ায় না।
সুমন সোনাটা হাতে নিয়ে বলল, ‘যা ভেবেছিলাম তাই। এই গরিব মানুষেরা হচ্ছে এক নম্বরের লোভী।’
মামাকে একটু মনমরা দেখায়। বলে, ‘শেষ কথাটা খেয়াল করেছিস?’
‘কী?’
‘আল্লাহ ওদের ভাগ্য বদলাতে চাইলেও আমরা দেই না।’
‘চোরের মায়ের বড় গলা!’
‘না রে কথাটা শেষ পর্যন্ত ঠিক।’
‘চোরের আবার কথা...।’
‘মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল।’
শোভন একটু ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘মামা, এটা নিয়ে পরেও ভাবা যাবে। এখন কাজের কথাটা শোনো।’
‘না রে, এখন আর কাজের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। এখন মনের কথা শুনতে হবে। ভাবো, আমাদের বাড়িতে কাজ করে, আমাদের সবার এত সেবা করে অথচ তার সামান্য স্বপ্নের কথা আমরা জানি না। খুব অন্যায়। খুব অন্যায়।’
মামা সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলে। ওরা দুজন খুব বিরক্ত হয়। আবার কেন যেন ভালোও লাগে। তাদের এই মামাটা ভেজালের ভিড়ে কী খাঁটি মানুষ। ওরা নিশ্চিত মামার ঠিকই বিষয়টা মনে থাকবে। শেফালির জমির দলিল হয়েই গেল!
ওদের চোখেও মামার দেখাদেখি পানি চলে এসেছিল। শোভনের হঠাৎ মনে পড়ল, নিচ থেকে সুজন একটা খবর পাঠিয়েছে। খবরটা এখনই মামাকে জানানো দরকার।
মামা শুনে একটু হতাশ ভঙ্গিতে বলল, ‘তাই বলে আনোয়ার ভাইও লোভ সামলাতে পারল না! চল তো দেখি।’
নিচে নেমে এসে দেখল, সুজন খুব মন খারাপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে। মামা ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুই গেটে থাক। আমি দেখছি।’
সুজন কিছু বলে না। মাথা নিচু করে ধীর পায়ে হেঁটে গেটের দিকে আগায়।
রাফি মামা ঘরে ঢুকতেই একটু যেন চমকান সুজনের বাবা আনোয়ার সাহেব। সাধারণত মামা ঘরে ঢুকলে তিনি আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন। দেশ নিয়ে আলাপ করার একজন যোগ্য লোক পাওয়া গেল বলে। আজ কিন্তু তাকে খুব ব্যস্ত দেখায়। বলেন, ‘রাফি সাহেব, আপনি এলে আমি খুব খুশি হই। কিন্তু আজ এমন সময় আপনি পদধূলি দিলেন যে...।’
‘আপনি বেরোবেন নাকি কোথাও?’
‘হ্যাঁ। একটা খুব জরুরি কাজ।’
‘আজকাল চাকরির বাইরেও কিছু কাজ করছেন মনে হয়?’
‘করতে হয় রে ভাই। আপনি তো ফেলেছেন বিপদে। শর্ত দিয়েছেন, নিজের বাড়ি না করলে বাড়ি ছাড়তে দেবেন না! এত দিন ভাবিনি, এখন মনে হচ্ছে একটা চেষ্টা করা উচিত। ছেলে বড় হচ্ছে। তার জন্য তো একটা কিছু রেখে না দিলে কবর দেওয়ার পর গালাগালি করবে।’
মামা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আপনি একটু বসুন। একটা জিনিস দিতে আপনাকে এসেছিলাম, ফেলে এসেছি।’
‘পরে নাহয় দেবেন...।’
মামা খেয়াল করে, এই ফাঁকে তিনি পকেটে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে নেন, জিনিসটা ঠিকঠাক আছে তো। মূল্যবান কিছু সঙ্গে রাখলেও সমস্যা। বারবার ভয় হয়, কেউ নিয়ে গেল নাকি!
মামা বলল, ‘আসলে আপনার বাড়ির বিষয়েই কথা। একটা জিনিস দিলে আপনার সুবিধা হবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।’
মামা বেরিয়ে ওদেরকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই সময়ই মোবাইলে ফোন।
কার ফোন বুঝতে খুব সময় লাগল না। কারণ, মামার মুখটা একটু বেকুবের মতো হয়ে গেছে।
শুধু মীরা আপা ফোন করলে মামার চেহারা এমন বেকুবের মতো হয়।
৫.
মামা বেকুব মুখে ফোনটা নিয়ে ওপরে চলে গেছে। এখন মামার সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না বলে সুমনরা যায়নি। সময়টা কাজে লাগাতে ওরা রওনা দিল শফিক চাচার ঘরের দিকে। শফিক চাচার ঘরে কেউ যায় না, আসলে যেতে পারে না। প্রধান কারণ, বেশির ভাগ সময়ই তার কাপড়চোপড়ের ঠিক থাকে না। ডোরাকাটা হাফ প্যান্ট পরে খালি গায়ে বসে থাকে। সেই হাফ প্যান্টটা শেষ কবে ধোয়া হয়েছিল, এই নিয়ে নানা জনের নানা মত আছে, তবে কোনো হিসাবেই বছর দুয়েকের কম হবে না।
সুমনদের সমস্যা অবশ্য সেটা নয়। সমস্যা হলো গেলেই তিনি লিখতে বসিয়ে দেন। গত মাসে সর্বশেষ সুমন একবার কৌতূহলবশত উঁকি দিয়েছিল, শফিক চাচা খুব আদুরে গলায় বলল, ‘ভেতরে আয়।’
সুমন ভেতরে গেল। যেতেই চাচা বলল, ‘টেবিলে বসে যা।’
সুমন টেবিলে বসল।
চাচা বলল, ‘তোকে খুব সহজ একটা জিনিস লিখতে দিচ্ছি। লিখ, ‘এই জীবনে যাহা পাইলাম।’
আরেকটা মজার বিষয়, চাচার লেখালেখি সব সাধু ভাষায়। বলে, সাধু ভাষা হচ্ছে প্রকৃত সাধুদের ভাষা। চলতি ভাষা হচ্ছে গর্দভদের ভাষা।
সুমন মিনিট দশেক আজগুবি নানা কথা লিখে শেষে দৌড়ে পালিয়েছে। তারপর তার ঘরের সামনে দিয়ে যতবার গেছে পা টিপে টিপে গেছে। আজ ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে। কারণ শফিক চাচার ঘরেও পরীক্ষার অংশ হিসেবে একটা সোনার বিস্কুট রেখে আসা হয়েছে।
সুমনদের দেখে চাচাকে খুব একটা উৎসাহী দেখা গেল না। তিনি গভীর মনোযোগে একটা বই পড়ছিলেন, চোখটা বইতেই থাকল।
সুমন দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গলাখাঁকারি দিল। চাচা তার পরও চোখ তুলল না।
শোভন বলল, ‘চাচা, আছ কেমন?’
চাচা উত্তর না দিয়ে বলল, ‘পড়াশোনা করছি।’
‘কী পড়ছ?’
‘সোনা বিষয়ে।’
‘সোনা!’
‘হ্যাঁ। সোনা। গোল্ড।’
‘হঠাৎ সোনা বিষয়ে পড়াশোনা? কিছু লিখবে নাকি?’
‘আয় তোদের কিছু জ্ঞান দেই।’
‘লাগবে না চাচা। আমাদের জ্ঞান লাগবে না।’
চাচা অবাক হয়ে বলে, ‘জ্ঞান লাগবে না! তাহলে কী লাগবে?’
‘কিচ্ছু লাগবে না। আমরা যাই।’
উঠতে যাচ্ছিল। চাচা ধমক দিয়ে বলল, ‘বস। চুপ করে বস।’
তারপর বলতে শুরু করল, ‘তোরা কি জানিস, টাকার কাগজ চালুর আগে মানুষ কীভাবে জিনিসের কেনাবেচা করত?’
‘না। জানি না। জানতে যে খুব আগ্রহী তা-ও না।’ সুমন মুখ কালো করে বলে।
‘সোনা দিয়ে। সোনা-রুপা-তামা—এগুলোই ছিল মুদ্রা।’
‘জেনে ভালো লাগল।’
‘এটা জেনে অবশ্য লাগবে না যে, যে দেশগুলোতে সোনা পাওয়া যায়, মানে সোনার খনি আছে, সেই দেশগুলোর বেশির ভাগই দরিদ্র। জিজ্ঞেস কর, কেন?’
ওরা কিছু জিজ্ঞেস করে না।
‘সেগুলো হচ্ছে সিয়েরালিওন, তানজানিয়ার মতো দরিদ্র দেশ। আর দেশগুলোতে লেগে আছে জাতিগত দাঙ্গা। নিজেরা নিজেরা মারামারি করছে। আসলে নিজেরা করছে না, ওদের দিয়ে করানো হচ্ছে। ওরা করে মারামারি আর ধনী দেশগুলো সোনা নিয়ে যায়। সেদিক থেকে আমরা কত সুখে আছি। আমাদের সোনা নেই, মারামারি নেই।’
সুমন গম্ভীর গলায় বলল, ‘কে বলল আমাদের দেশে সোনা নেই। সোনা ছাড়া বিয়ে হয়? আমাদের জাফর চাচার মেয়ের বিয়েই তো ভেঙে গেল সোনার জন্য। আমাদের দেশেও সোনা নিয়ে মারামারি আছে।’
শফিক চাচা চমৎকৃত হয়ে গেল ওর কথায়। বলল, ‘ভালো বলেছিস তো! আমি তো ওভাবে ভেবে দেখিনি। গুড। এই নিয়েও কিছু লেখালেখি করা যায়। সোনা জিনিসটা তো লেখালেখির জন্য খুব আইডিয়াল।’
‘পয়সাওয়ালা হওয়ার জন্য এর চেয়েও আইডিয়াল।’ বলে উঠে গিয়ে সুমন ভালো করে চাচার টেবিলটা দেখে নেয়। না, নেই। ঘণ্টা খানেক আগে চাচা বাথরুমে থাকা অবস্থায় এখানেই রেখে গিয়েছিল।
মনমরা হয়ে বেরিয়ে আসে ওরা দুজন। কী লজ্জার কথা! তাদের বাড়িতে চারজনকে সোনা দিয়ে পরীক্ষা করা হলো, চারজনই ফেল। সবাই জিনিসটা বাগিয়ে নিতে চাইছে। সবাই এমন লোভী!
ধীর পায়ে ওপরের ঘরে গিয়ে দেখে মামার কাহিল অবস্থা। ফোনে বারবার বলার চেষ্টা করছেন, ‘এই তো আমরা অপেক্ষায় আছি। যার সোনা সে নিশ্চয়ই আমাদের খঁুজে বের করবে। তারপর ফাঁদে ফেলে...।’
মামার কথা শেষ হয় না। ওপাশ থেকে মীরা আপা বোধ হয় খুব ভয়ংকর কিছু বলল। মামার মুখটা একদম ঝুলে গেছে।
আরও কিছুক্ষণ ওপাশ থেকে ঝাঁজালো কিছু বলল মীরা আপা। মামা বোকা বোকা চেহারায় সেসব হজম করে ফোনটা রেখে বলল, ‘এ জন্যই মেয়েদের কিছু বলতে নেই।’
সুমন বলল, ‘বলতে গেলে কেন? মীরা আপাকে না জানানোর কথাই তো ছিল।’
মামা একটু লাজুক ভঙ্গিতে বলল, ‘পরে শুনলে তো আবার হইচই করবে। ভাবলাম, জানিয়ে দেই।’
সুমন বলল, ‘আমাদের আগেই জানানো উচিত ছিল। মীরা আপা জানলে তোমার এই অদ্ভুত পরীক্ষা করতে দিত না।’
‘পরীক্ষায় সমস্যা কী হয়েছে?’
‘সমস্যা হবে না! কী লজ্জার কথা, সবাই মেরে দেওয়ার তালে। এই বাড়িতে একজনও নির্লোভ মানুষ নেই।’
মামা একটু হেসে বলল, ‘শফিকও?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে।’
ঠিক এই সময়েই সুমনের মোবাইল বেজে ওঠে। সুমন পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফিসফিস গলায় বলে, ‘চুপ। মীরা আপা।’
মীরা আপা হ্যালো-ট্যালো না বলে ধমকে ওঠে, ‘কী ঝামেলা নাকি পাকিয়েছিস?’
‘আমি কী করলাম?’
‘তোরা তো একা কিছু করিস না। সব ঝামেলা করিস সবাই মিলে।’
‘তুমি কি আসবে?’
‘আমি এই রাতের বেলা কীভাবে আসব? দেখি এবার তোরা আর তোদের মামা নিজেরা ঝামেলা থেকে বাঁচতে পারিস কি না!’
‘আসো। আসো।’
সুমন ফোনটা রাখতেই মামা বলল, ‘মীরা আসছে না!’
‘না।’
‘ভালোই হলো। এলে মীরা এসে পুরো নেতৃত্বটা নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। আমরা নিজেরা যেন পারি না আরকি! এর পর থেকে আর মীরাকে আমাদের কোনো মিশনের কথা আমরা জানাব না। মনে থাকে যেন!’
‘আমাদের মনে থাকবে। তোমার থাকলেই হয়...।’ সুমন একটু বিদ্রূপের স্বরে কথাটা বলে। মামা মাথা নিচু করে সেটা হজম করে।
সুমন আরও কড়া কিছু বলত। বলার সুযোগ পায় না। তার আগেই তাঁর মা ঢুকে পড়েন ঘরে। তিনি সাধারণত এই ঘরে আসেন না, এখন হঠাৎ!
রাফি মামা বলল, ‘আপা তুমি! দুলাভাই কি কোনো ঝামেলা পাকিয়েছে?’
আপা হাতের মুঠোয় রাখা সোনার বারটা বের করে বলেন, ‘এটা তোর কাছে রাখ তো!’
‘তুমি পেলে কোথায়?’
‘তোর দুলাভাই দিল। তার ঘরে কীভাবে যে চলে এসেছে সে বুঝতে পারছে না।’
ওরা তিনজনই বিস্মিত। সুমনের বাবা এই জিনিস ফিরিয়ে দিতে পারেন!
মামা বলল, ‘দুলাভাই নিজে তোমাকে দিয়েছে?’
‘হ্যাঁ। দিয়ে বলেছে তোকে দিতে। সে একা পুলিশের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে, পুলিশ নাকি খুব ঝামেলা করে। বলল, তোকে একটু চিন্তাভাবনা করে পলিশের কাছে জিনিসটা পৌঁছে দিতে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আমাদের ঘরে এই জিনিস এল কীভাবে?’
রাফি মামা বলে, ‘তুমি চিন্তা করো না। আমরা দেখছি।’
আপা বেরিয়ে গেলে সুমন লাফ দিয়ে উঠে বলল, ‘আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না মামা। সত্যি বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘এসব ক্ষেত্রে বিশ্বাস না হওয়ার মতো অনেক কিছু ঘটে। মানুষকে পরীক্ষায় না ফেললে লোভী, না নির্লোভ বোঝা যায় না। আমরা করি কী, তার কথা আর আচরণেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখি। সেটাই সমস্যা। দেখছিস না, আমাদের হিসাবের বাইরে কত কী ঘটছে!’
সুমনের সত্যি খুব আনন্দ হচ্ছে। সবার আগে সোনা রেখে আসা হয়েছিল ওর বাবার ঘরে। বাবা বাথরুমে থাকা অবস্থায় সুমন গিয়ে তাঁর ঘরের টেবিলে রেখে আসে। ও নিশ্চিত ছিল, বাবা জিনিসটা নিয়েই লুকিয়ে ফেলবেন। ঘটনাও ঘটল তাই। বাবা টেবিলের কাছে এসে জিনিসটা দেখে একটু চমকান। তারপর একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঢুকিয়ে ফেলেন পকেটে। সুমন মন খারাপ করে বেরিয়ে এসেছিল। ওর কাছ থেকে ঘটনা শুনে অন্যরাও কেউ অবাক হয়নি খুব একটা। বাবার রেকর্ড অনুযায়ী এটাই তো হওয়ার কথা। অথচ সেই বাবা জিনিসটা ফিরিয়ে দিচ্ছেন! সামান্য ১০ টাকার জন্য যিনি মায়ের সঙ্গে যা-তা ভাষায় কথা বলেন, তিনি সোনার লোভকে তুচ্ছ করলেন!
এত দিন বাবা তাকে লজ্জাই দিয়েছেন শুধু, আজ সে খুব গর্বিত। পিতৃগর্ব বলে যে একটা কথা আছে, সেটার অর্থও আজ বোঝা গেল।
মা ঘর থেকে বেরোতেই মামা খুব একটা ভূমিকা দিয়ে একটা লম্বা বক্তৃতা শুরু করতে যাচ্ছিল, এই সময়ই শেফালি দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে মামার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘মামা, আমারে মাফ করে দেন।’
‘কী, হয়েছে কী?’
‘মামা আমার ছেলে...।’
সুমন কড়া গলায় বলল, ‘আবার কী হয়েছে তোমার ছেলের? মরণজ্বর তো এতক্ষণে কমে যাওয়ার কথা।’
‘ভাই, জ্বর না, অ্যাক্সিডেন্ট।’
‘অ্যাক্সিডেন্ট!’ মামা একটু অবাক।
‘জি মামা। আপনারা বিশ্বাস করতে চাইবেন না কিন্তু এই যে ফোন। আপনে ফোন করে দেখেন।’
মামার হাতে ফোনটা তুলে দেয়।
সুমন ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ কলগুলো পরীক্ষা করে দেখে, মাত্রই কিছুক্ষণ আগে ওর বাড়ির নাম্বার থেকে একটা ফোন এসেছিল। কিন্তু তাতে বিশ্বাস করা যায় না। যে একবার বানানো গল্প বলতে পারে, সে বারবার বলতে পারে।
পরীক্ষার জন্য সুমন সেই নাম্বারে রিং করে। করতেই ওপাশে হইচইয়ের শব্দ শুনতে পায়।
সুমন কিছু বলার আগেই একজন কান্নাজড়ানো গলায় বলে, ‘ভুলুর মা। দেরি করিস না। আমরা সদর হাসপাতালে নিয়া যাইতাছি। তুই আয় ভুলুর মা।’
সুমন আর কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে বলল, ‘মামা সত্যিই।’
মামা শেফালিকে হাত ধরে টেনে তুলে বলে, ‘আপাকে বলেছ?’
‘বলছি মামা।’
‘ঠিক আছে, আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, তুমি রওনা হয়ে যাও। গিয়ে দেখো, কী অবস্থা। বেশি খারাপ হলে ঢাকায় নিয়ে আসতে হবে। তুমি কোনো চিন্তা করো না।’
বলে মামা তাঁর ড্রয়ার থেকে এক শ টাকার একটা বড় বান্ডিল বের করে শেফালির হাতে ধরিয়ে দেয়।
শেফালি চলে গেলে মামা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চল, সুজনের বাবার কাছে একটু যাই। বসিয়ে রেখেছি। বেশি দেরি করলে বেরিয়ে যাবে। আর জিনিসটা নিয়ে বেরিয়ে গেলে খুব ঝামেলা হবে। চল।’
কিন্তু রওনা হওয়ার আগেই মামার মোবাইল বেজে ওঠে।
ওরা ভেবেছিল, মীরা আপার ফোন কিন্তু মামা ফোনটা ধরে একেবারে রোবটের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। একবারও কোনো কথা বলল না, শুধু ওপাশের কথা শুনে গেল।
ফোন রেখে এমনভাবে ধপ করে চেয়ারে বসল, যেন কেউ তাঁর শরীর থেকে সব রক্ত শুষে নিয়ে গেছে।
মামার এমন ভেঙে পড়া চেহারা সচরাচর দেখা যায় না। ঠিক এখন কথা বলা উচিত হবে কি না ঠিক করতে না পেরে দুজন দাঁড়িয়ে থাকে।
মামা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘শফিক পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে।’
‘শফিক চাচা... পুলিশ...। বলো কী?’
‘হ্যাঁ। থানা থেকে ফোন করেছিল।’
‘চাচা কি জিনিসটা বিক্রি করতে গিয়েছিল? কখন গেল?’
‘না। ও সরাসরি থানাতেই গেছে। পুলিশের কাছে সোনাটা জমা দিতে।’
রাগে-বিরক্তিতে সুমনের চোখ-মুখ কুঁচকে যায়। ‘পুলিশের কাছে জমা দিতে গেছে... বাড়িতে এত লোক থাকতে...।’
রাগ একটু কমলে তার খেয়াল হয় গেটে থাকা সুজনের তো তাদের শফিক চাচার বের হওয়ার খবরটা তাদের জানানোর কথা। সুজন কোথায়?
এক দৌড়ে নিচে নেমে এল ওরা।
না। সুজন গেটে নেই। এদিক-ওদিক সবদিক তাকিয়ে কোথাও খঁুজে পাওয়া যায় না।
শোভন দৌড়ে ঘরের ভেতরে যায়। সুমন বসে থাকে বিষণ² হয়ে।
রাফি মামারও সামলাতে একটু সময় লাগে। এত দিকের এতগুলো ঝামেলা! মীরাটা থাকলে ভালো হতো! কিন্তু আজ আবার প্রমাণ করতে হবে, ওকে ছাড়াও পারা যায়।
মামা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘চল। অফিসে চল। হাতে সময় বেশি নেই।’
সুমন উঠতেই চাচ্ছিল না। শোভন প্রায় টেনে নিয়ে চলে ওকে।
৬.
অফিসঘরে কিছুক্ষণ চুপচাপ সবাই। মামা হাঁটাহাঁটি করল এদিক-ওদিক। যখন মাথায় কিছু আসে না তখন মামা খুব হাঁটে। হাঁটলে নাকি মগজ নড়াচড়া করে। করলে বুদ্ধি বের হয়।
মগজ নড়াচড়া করছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, মামার মুখ দিয়ে কথাই বেরোচ্ছে না।
শোভন কথা বলল প্রথম, ‘শফিক চাচাকে কি থানায় আটকে রেখেছে?’
‘হ্যাঁ। অনেকটা সে রকম। বলল, শফিকের কথা নাকি খুবই রহস্যজনক। ওদের কাছে মনে হচ্ছে শফিকের আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ আছে।’
‘কথাটা কে বলল?’
‘থানার ওসিই বোধ হয়। থানায় যেতে বলেছে আমাকে।’
‘তাহলে তো সময় বেশি নেই। যেকোনো সময় থানা থেকে লোক চলে আসবে। আর আমরা সবাই থানায় চলে গেলে সব শেষ।’
একটু থেমে হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়েছে ভঙ্গিতে শোভন বলল, ‘আচ্ছা, এক কাজ করা যায় না!’
‘কী কাজ?’
‘আমরা যদি সোনার মালিককে খঁুজে বের করার চেষ্টা করি।’
‘ওদের পেলে তো ভালোই হতো। ওদের মাধ্যমে যদি শফিককে উদ্ধার করার একটা বন্দোবস্ত করা যেত। কিন্তু বের করব কীভাবে?’
সুমন হঠাৎ উল্লসিত গলায় বলল, ‘একটা ক্লু কিন্তু আছে।’
‘কী ক্লু?’
‘ব্রিফকেসের মধ্যে একটা কাগজ ছিল। সেই কাগজের ওপর এবিসি লিখে তারপর একটা মোবাইল নাম্বার দেওয়া। কিন্তু মোবাইলের ডিজিট একটা বেশি, ১২টা। এ জন্য আমরা আর খুব চেষ্টা করিনি।’
মামা অবাক হয়ে বলল, ‘আমাকে বলিসনি কেন? তাহলে তো এতক্ষণে...।’
সুমন এমন কড়া চোখে মামার দিকে তাকাল যে তাঁর মুখে আর কোনো কথা এল না। সে কাগজটা বের করছে, এই সময় আবার বাজে মামার ফোন।
মামা ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন গম্ভীর গলায় বলে, ‘মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনুন। আপনাদের কাজে লাগবে।’
মামা স্পিকারটা অন করে দেয়। ওপাশ থেকে গম্ভীর গলা বলে, ‘আপনাদের দুজন এখন আমাদের কাছে। আনোয়ার সাহেব সোনার দাম যাচাই করতে বেরিয়েছিলেন, তাঁকে ধরেছি। ছেলেটাকে গেট থেকে ধরে এনেছি তারও আগে। কিন্তু ওরা ভালোই আছে, কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছাও আমাদের নেই। থাকলে দুপুর থেকে এভাবে বসে থাকতাম না। ব্রিফকেসটা নিয়ে চলে আসুন। এদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান।’
মামা সবাইকে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করে কথা বলল নিজে। ‘আমাদেরও তো ঝামেলার কোনো ইচ্ছা নেই। বাচ্চারা খেলার ছলে জিনিসটা নিয়ে এসেছে এখন ফিরিয়ে দিতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু...।’
‘আবার কিন্তু কেন?’
‘আমাদের একজন থানায়। পুলিশের কাছে।’
ওপাশে একটু চুপ। তারপর বলল, ‘আপনারা একটা অন্যায় করেছেন, সোনা নিয়ে খেলাধুলা শুরু করেছিলেন। এ জন্য কিছু শাস্তি আপনাদের পাওনা। একজন কয়েক দিন জেলে থাকুক।’
‘কিন্তু উনি বোকাসোকা মানুষ। কী বলতে কী বলে হয়তো আপনাদের ঝামেলায় ফেলে দেবে।’
ওপাশের মানুষটি হাসে। তারপর বলে, ‘আমাদের ঝামেলা আপনাদের দেখার দরকার নেই। সে জন্য আমরাই আছি।’
মামা এবার গলা একটু ভারী করে বলে, ‘আমরা জানি, আপনাদের অনেক ক্ষমতা। তাই দিয়ে আমাদের মানুষটিকে ছাড়িয়ে দিন। সে আসবে তার পরই আমরা আপনাদের ব্রিফকেসটা যেখানে বলবেন সেখানে পৌঁছে দেব। ও, হ্যাঁ, ওনার কাছে একটা বার আছে। উনি সহজ-সরল মানুষ তো! ওটা পুলিশের কাছে দিতে গিয়েছিলেন।’
ওপাশের গলা, ‘সহজ-সরল মানুষেরাই সব ঝামেলার মূলে। এর কিছুদিন জেলে পচা উচিত।’
মামা এবার কঠিন গলায় বলে, ‘দশ মিনিট সময়। আমাদের লোক আসবে। তারপর আমরা ব্রিফকেস নিয়ে রওনা দেব।’
বলেই ফোনটা কেটে দেয়।
মিনিট তিনেকের মধ্যেই আবার ফোন বাজে। তবে কল নয়। এসএমএস।
মামা পড়ে শোনায়, ‘ডান। দশ মিনিটের মধ্যে তোমাদের লোক পৌঁছে যাবে। তারপর এই ঠিকানায় ব্যাগটা পৌঁছে দেবে। আসবে একজন শুধু।’
মামা হাততালি দিয়ে বলল, ‘রক্ষা। শফিক চলে আসবে।’
শোভন বলল, ‘এই লোকই কি সেই এবিসি?’
মামা বলল, ‘এবিসি কে?’
শোভন ব্রিফকেসে সোনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কাগজটা মামার হাতে দেয়। দিয়ে বলে, ‘সুমন একটা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মোবাইল নাম্বারের ডিজিট একটা বেশি বলে কিছু করা যায়নি।’
মামা কাগজটা উল্টে-পাল্টে বলল, ‘মজার ব্যাপার দেখ। সি-এর আগে ছোট করে একটা মাইনাস চিহ্ন আছে।’
‘মাইনাস চিহ্ন!’ ওরা খুব ভালোভাবে খেয়াল করে বলে, ‘কিন্তু এটা কি মাইনাস চিহ্ন? আর তা হলেই বা কী?’
‘একটা পরীক্ষা করা যেতে পারে। এটা ওদের কোড নাম্বার হতেই পারে কিন্তু কোড নাম্বার এত বড় হওয়ার কথা না। দেখে মনে হচ্ছে মোবাইল নাম্বারই, সম্ভবত যার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা, ওর মোবাইল নাম্বার কিন্তু বেহাত হলে যেন কেউ বুঝতে না পারে এ জন্য একটা ডিজিট বেশি। এখন এমন হতে পারে যে ওপরের অক্ষরগুলো দিয়ে সংকেত দেওয়া আছে কোন নাম্বারটা বাদ দেওয়া হবে।’
‘হতে পারে।’
সুমন বলল, ‘আমি এমনি পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে প্রথম ডিজিটটা বাদ দিয়ে ফোন করেছিলাম।’
‘ফোনও করে ফেলেছিলি?’
‘হ্যাঁ। ধরল একজন বয়স্ক লোক। ওর গলা শুনে উৎসাহটা মরে গেল। তাই আর চেষ্টা করিনি।’
মামা বলল, ‘মাইনাস সি। এভাবে যদি আগাই, তাহলে দাঁড়ায় তিন নাম্বার ডিজিটটা বাদ যাবে।’
‘তাই তো হয়।’
‘প্রথম চারটা ডিজিট সবক্ষেত্রেই ঠিক থাকবে। এটা যে সিরিজের নাম্বার তাতে পাঁচ নাম্বার পর্যন্ত স্থির থাকার কথা। এখন যদি আমরা মাইনাস সি ধরি, তাহলে এর পর থেকে গোনা শুরু করে তিন নম্বরটা বাদ যাবে। বাদ দিয়ে যে নাম্বার হবে হয়তো সেটাই।’
মামা ফোন করল। ফোন করেই বলল, ‘আপনাদের জিনিস আমার কাছে।’
ওপাশ থেকে একটা বাচ্চা বাচ্চা গলার লোক জানতে চায়, ‘কী জিনিস?’
‘ও তাহলে আপনার না।’ বলেই মামা লাইনটা কেটে দেয়। দিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে বলে, না বোধ হয় আমাদের ফমুর্লাটা ঠিক না। এটা অন্য পদ্ধতির কোড।
মিনিট দুয়েক পরেই আবার বেজে ওঠে ফোন। ওপাশের লোকটি বলল, ‘জিনিসটা কী, সেটা না বললে কী করে বুঝব আমার জিনিস, না আপনার জিনিস?’
মামা একটু ভেবে বলে, ‘আপনার কি কোনো জিনিস হারিয়েছে?’
ওপাশে একটু চুপ থেকে বলে, ‘আপনি কোথায় আছেন?’
‘আমি একটু পরে আপনাকে এসএমএস করে জায়গাটা জানাচ্ছি।’
মামা ফোনটা রেখে একটা নিঃশ্বাস নেয়। তারপর বলে, ‘ঠিক লোক।’
‘তাই মনে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ।’
মামা আরেকটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল। তার আগেই শোনা যায় শফিক চাচার গলা।
সুমন ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে বাইরে বেরিয়ে বলল, ‘তুমি বেরিয়েছিলে কেন?’
শফিক চাচা মোলায়েম গলায় বলল, ‘বিরাট ইতিহাস। তাড়াতাড়ি লিখতে হবে। না হলে ভুলে যাব। লেখা শেষ করি তারপর পড়ে শোনাব।’
শফিক চাচা লেখার নতুন রসদ নিয়ে লাফাতে লাফাতে তার ঘরে যায়।
মামা বলল, ‘সময় কিন্তু আর বেশি নেই। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমাদের বেরোতে হবে।’
৭.
ওরা এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা একতলা বাড়ির ঠিক বাইরে। ওদের এত কাছের এ রকম একটা বাড়ি যে এই কাজে ব্যবহার হতে পারে, সেটা ওদের ধারণাতেই ছিল না। বাড়িটার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে এবিসির। তিনি খুব কাছাকাছি আছেন বলে জানিয়েছেন।
মামা পুরো পরিকল্পনাটা সাজিয়ে বলল, ‘আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব। এবিসি এসে নামলে তাঁকে নিয়ে যাবে ভেতরে। তখন দুই পক্ষের মধ্যে লেগে যাবে।’
‘দুই পক্ষের মধ্যে লাগবে কীভাবে?’
‘আমরা লাগিয়ে দেব। এবিসিকে বলব, আমরা আপনাকেই ব্যাগটা দিতে চাচ্ছিলাম কিন্তু এরা মাঝখানে ঢুকে আমাদের দুজনকে আটকে রাখায় কষ্ট করে আপনাকে এখানে আনতে হলো। অন্য একটা পক্ষ মাঝখান দিয়ে তাঁর জিনিস বাগিয়ে নেওয়ার তালে ছিল, এটা তো এবিসির পছন্দ হবে না। তিনি খেপে যাবেন ওদের ওপর। কাজেই তাদের মধ্যে লেগে যাবে।’
শোভন বলল, ‘তারপর? পুলিশকে জানাতে হবে না? আমরা তো ওদের আটকাতে পারি কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশ না এলে তো হবে না।’
রওনা হওয়ার আগেই পুলিশকে ফোন করার প্রসঙ্গ এসেছিল কিন্তু মামা রাজি হয়নি। তাঁর বক্তব্য, ‘পুলিশকে আগে জানালে দুটো সমস্যা হতে পারে। এক, খবরটা ফাঁস হয়ে যেতে পারে। আর দুই. পুলিশ এসে পুরো ক্রেডিট নিয়ে নেবে। এমনকি আমাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টাও করতে পারে। কাজেই ওদের ফোন করা হবে একেবারে শেষ মুহূর্তে।’
বাড়ির ভেতরে অপেক্ষা করে আছে একটা দল। এবিসির গাড়িও কাছাকাছি। মামার মনে হলো, এখনই পুলিশকে জানানোর সময়।
ফোন করা হলো ইমন চাচাকে। ইমন চাচা ঘটনা শুনে বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তোর ভাগিনারা তো অসাধারণ রে! আমার মতো দঁুদে পুলিশ কর্মকর্তাও ওদের ধরতে পারল না! অসাধারণ! ইউনিফর্ম ছাড়া এসে ওদের সঙ্গে একদিন গল্প করতে হবে।’
মামা বলল, ‘আজকে আবার ইউনিফর্ম ছাড়া আসিস না। ইউনিফর্ম-অস্ত্র সব লাগবে।’
‘আমি একটু দূরে আছি। মনে হয় আসতে পারব না। তবে ফোর্স চলে আসবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই। ততক্ষণ একটু সামলে রাখ।’
এই সময়ই একটা বিশাল গাড়ি এসে থামল সামনে। ভেতর থেকে যে মানুষটি নেমে এল, এই অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে তাঁর মাথায় চকচকে টাক। বিশাল ভুঁড়ির ভারে কুঁজো হয়ে হাঁটছে।
সুমন বলল, ‘সোনা খেয়ে খেয়ে পেট কী হয়েছে দেখেছিস? এটাকে বলে সোনার পেট! এই পেট কেটে আজ সোনা বের করব।’
এবিসি এদিক-ওদিক তাকিয়ে সামনে এগোয়। কাছাকাছি আসতেই মামা হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আসুন মিস্টার এবিসি।’
এবিসি স্পষ্ট গলায় জানতে চায়, ‘মাল কোথায়?’
‘আছে। ভেতরে চলুন।’
দরজায় একটা টোকা দিতেই একজন দরজা খুলে এবিসিকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলে, ‘বস আপনি?’
সঙ্গে সঙ্গে আরও দুজনও এগিয়ে আসে। একজন সোজা তাঁর পায়ের কাছে বসে গিয়ে বলে, ‘বস, আপনি কষ্ট করে এখানে আসতে গেলেন কেন? আমরা তো লোকেট করে ফেলেছি।’
এবিসি একটু অবাক হয়ে বলে, ‘তোমরা এখানে আছ, আমাকে তো ওরা বলেনি।’
ওই দলের একজন মামার দিকে ছুটে এসে বলে, ‘বসকে আসতে বলেছেন কেন?
মামা একটু থতমত খেয়ে যায়। ওরা ধরে নিয়েছিল, এই দুই দলের মধ্যে একটা গোলমাল শুরু হবে, সেই গোলমালের ফাঁকে ওরা আনোয়ার চাচা আর সুজনকে উদ্ধার করে নেবে। দুই পক্ষের মধ্যে লাগিয়ে দিয়ে কাজটা সহজেই হয়ে যাবে বলে মনে হয়েছিল কিন্তু এখন যে দুই পক্ষ মিলে গেল!
সুমন পরিস্থিতি সামাল দিতে তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে গিয়ে ব্রিফকেসটা একজনের হাতে দিয়ে বলে, ‘এই নিন আপনাদের জিনিস।’
লোকটা ব্রিফকেস খুলে পরীক্ষা করতে থাকে, সোনাগুলো ঠিকঠাক আছে কি না! আর সুমনের চোখ পড়ে সুজনের দিকে। ওকে আর আনোয়ার চাচাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে মাটিতে। খুব সম্ভব কিছু মারধরও করেছে। সুজনের গাল লাল হয়ে আছে।
সুমনের ইচ্ছে হয় এখনই গিয়ে সবগুলোকে একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলতে! কত বড় সাহস! ওদের বন্ধুর গায়ে হাত তোলে।
মামা একেবারে গলে যাওয়া গলায় বলল, ‘আসলে পুরো বিষয়টাই ভুল বোঝাবুঝি। বাচ্চারা খেলনা ভেবে বাসায় নিয়ে এসেছিল। আমরা তো আপনাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম। আপনারা এত দেরি করলেন বলেই না...।’
দরজা খুলে দেওয়া লোকটি কঠিন গলায় বলে, ‘তাই বলে তোমরা সোনা নিয়ে ছেলেখেলা করবে?’ তারপর এবিসির দিকে ঘুরে বলে, ‘বস, একজন সোনার একটা বার নিয়ে থানায় চলে গিয়েছিল। কী কষ্টে যে ম্যানেজ করতে হলো। আর এই যে বসে থাকা ভদ্রলোক, সে সোনা নিয়ে দোকানে চলে গিয়েছিল বেচতে।’
‘তাই নাকি? ইন্টারেস্টিং।’ এবিসি বলল।
মামা আবার একটু মোসাহেবি গলায় বলল, ‘আসলে এসব জিনিস তো আমরা দেখি না। ভাবলাম, যতক্ষণ আপনারা না আসেন, ততক্ষণ নিজেদের মধ্যে একটু খেলি। এত সোনা তো আর জীবনে দেখব না।’
সেই লোকটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। এবিসি বললেন, ‘কী খেলা খেলছিলে?’
‘আমরা পরীক্ষা করে দেখছিলাম, আমাদের মধ্যে কারা কারা সোনার লোভ সামলাতে পারে?’
‘কেউ কি পেরেছে?’
‘ফিফটি পার্সেন্ট। মানে চারজনের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। দুজন পাস করেছে। দুজন ফেল।’
দরজা খুলে দেওয়া লোকটি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বস, এদের সঙ্গে কথা বলে আর সময় নষ্ট করার দরকার কী?’
এবিসি মামার দিকে ঘুরে বলল, ‘আপনার নামটা কী যেন?’
‘রাফি।’
‘এই বাচ্চা দুটোকে এসব বাজে কাজে সঙ্গে এনেছেন কেন?’
‘আসলে ওরাই জিনিসটা কুড়িয়ে পেয়েছিল তাই।’
এবিসি খুব আন্তরিক গলায় বলল, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমরা যে বুদ্ধি দিয়ে আমার নম্বরটা বের করতে পেরেছ, এটা খুবই আনন্দের কথা। তা ছাড়া তোমরা আমাদের কোনো ক্ষতির চেষ্টা করোনি, বরং অন্য কারও হাতে পড়লে পুরো চালানটাই হাপিশ হয়ে যেতে পারত, তোমাদের তো পুরস্কারই দেওয়া উচিত। কিন্তু কী করব? আমরা তো লোক খারাপ। খারাপ কাজই করতে হবে। এই সবগুলোকে বেঁধে ফেল।’
এবিসি হঠাৎ এমন ভয়ংকর হয়ে গেল যে ওরা বিস্মিত হয়ে গেল। গলা বদলানোর পর আপনি থেকে সোজা নেমে গেছে তুই-তে। বলছে, ‘শালার বজ্জাতেরা, সোনা নিয়ে ছেলেখেলা করিস! আমাদের দুই পক্ষ ভেবে দুদিক দিয়ে লাগানোর তালে ছিলি, না!’
মামা বলে, ‘ঠিক তা না। আমরা চেয়েছিলাম সঠিক মালিকের হাতে জিনিসটা পৌঁছে দিতে। এরা ফোন করার পরও মনে হলো, আপনিই বোধ হয় আসল মালিক। তাই আপনার হাতে তুলে দিতেই...।’
মামার কথা শেষ করার আগেই প্রচণ্ড জোরে তার মুখে একটা ঘুষি মারে একজন। বলে, ‘ভেবেছিলি আমরা দুই দল মারামারি করব আর এই সুযোগে এই দুটোকে ছাড়িয়ে নিবি না!’
তারপর আরেকটা ঘুষি মারতে হাত তোলে।
সুমন-শোভনের মনে হয় এই ঘুষি মামার মুখে পড়লে মামাকে আর খঁুজে পাওয়া যাবে না। একে অন্যের দিকে চোখাচোখি করে।
শোভন ফিসফিস করে বলল, ‘প্ল্যান বি।’
কেউ এই কথাটা শুনল না কিন্তু শুনতে পেল পুলিশের গাড়ির আওয়াজ। আর শোনা গেল পুলিশ বলছে, ‘আমরা চারদিক থেকে তোমাদের ঘিরে ফেলেছি। পালানোর কোনো পথ নেই।’
এবিসি চমকে গিয়ে বলল, ‘তোরা পুলিশ নিয়ে এসেছিস?’
মামাকে ঘুষি মারা লোকটি বলল, ‘পুলিশ কোথায়? শালারা বাইরে থেকে চিৎকার করছে কেন? লোক জানাজানি হয়ে গেলে টিভি চলে আসবে। তখন তো আর সামাল দেওয়া যাবে না। টিভি-পত্রিকা ছাড়া পুলিশ হলে তো সমস্যা নেই। বস, বাইরে গিয়ে একটু দেখবেন নাকি?’
এবিসি পা বাড়িয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই শোনা যায় পুলিশের গলা, ‘খবরদার, কেউ এক পা নড়বে না। তোমাদের যার যা অস্ত্র আছে ফেলে দাও। ফেলে দাও।’
ওরা ঠিক কী করবে ভেবে পায় না। এবিসি ইঙ্গিত করলে অস্ত্র ফেলে দেয়। ফেলে দেওয়ার পর এবিসি চিৎকার করে বলে, ‘সব ফেলে দিয়েছি। মাইকে চিৎকারের তো দরকার নেই। ভেতরে আসো।’
সুমন চিৎকার করে বলে, ‘বেশি কথা বলবেন না। পুলিশ যা বলছে তা-ই করুন। নইলে গুলি-টুলি করে দেবে। এই আনোয়ার চাচা-সুজন এদিকে চলে আসেন। নইলে আপনাদেরও চোরাকারবারি ভেবে গুলি করে দিতে পারে।’
এবিসি বলল, ‘মহা মুশকিল হলো তো! কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এদিকে চিৎকার করছে!’
সে আবার উঠে দাঁড়ায়।
ঠিক সেই সময় শোভন তাঁর পকেট থেকে কী যেন একটা বের করে স্পে্র করতে শুরু করে। সাবানের ফেনার মতো জিনিস কিন্তু এবিসির চোখে লাগতেই ‘ও মাগো’ বলে চিৎকার করে শুয়ে পড়ে। বাকি তিনজনের চোখেও মুহূর্তে এই জিনিস।
সুমন বলল, ‘মামা এবার তোমার কাজ।’
রাফি মামা আর দেরি করল না। মামা কারাতে জানা লোক, এমনিতেই দু-তিনজনকে ঘায়েল করা সম্ভব। আর এখন শত্রুদের অস্ত্র নেই, চোখও বন্ধ প্রায়।
প্রথমে এবিসির ঘাড়ে এমন জোরে একটা আঘাত মারল যে এবিসি এবার বলল, ‘ও বাবাগো।’
তারপর তাঁকে ঘুষি মারা লোকটির মুখে এমন পাল্টা ঘুষি যে সে কয়েক গজ দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল।
একজন সামনে ফেলে রাখা পিস্তলের দিকে আগাতে যাচ্ছিল, কিন্তু চোখ প্রায় বন্ধ থাকায় ঠিকঠাক হাঁটতে পারছিল না। একটু পর ছিটকে গিয়ে পড়ল অনেক দূর। পেছন থেকে সুজনের বাবা এমনই জোরে লাথি মেরেছেন!
শোভন স্পে্রর সঙ্গে সঙ্গে পকেটে পাতলা একধরনের দড়িও এনেছিল। তাই দিয়ে সবাইকে বেঁধে রাখা হলো এক লাইনে।
সুজন ধীর পায়ে এগিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা এবিসিকে এসে কষে একটা লাথি দিয়ে বলল, ‘এবার একসঙ্গে ও মাগো-ও বাবাগো বল।’
কী আশ্চর্য, এবিসি বাধ্য ছেলের মতো বলল, ‘ও মাগো-ও বাবাগো।’
সুজন বলে, ‘আবার বল।’
এবিসি আবার বলে, ‘ও মাগো-ও বাবাগো।’ এরপর সুর করে এমনভাবে বলতে থাকে যে ওর বাবা-মা বেঁচে থাকলে ইতিমধ্যেই ছুটে চলে আসার কথা।
এবিসি একবার শুধু ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আমাকে একা মারছিস কেন? সবাইকে মার।’
সুজন বলল, ‘আপনি করে বল। আপনি করে বল।’
‘সবাইকে মারুন। আপনাকে তো আমি মারিনি। ওরা মেরেছে।’
সুমন এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘সবাই কান ধর। কান ধর।’
ওদের অবাক করে দিয়ে এককথায় সবাই কানও ধরে ফেলল।
পুলিশ এল এখন। দেখেই এবিসি চিৎকার করে বলল, ‘বাইরে থেকে চেঁচাচ্ছিলে কেন?’
পুলিশ অবাক হয়ে বলল, ‘বাইরে থেকে কোথায় চেঁচালাম?’
সুমন পকেট থেকে ওর মোবাইলটা বের করে রেকর্ডটা শোনাল।
রাফি মামা অবাক হয়ে বলল, ‘তুই বাজিয়েছিস! কখন রেকর্ড করলি?’
‘একটা সিনেমা থেকে রেকর্ড করা। শখ করে করেছিলাম। আজ কাজে লেগে গেল।’
এবিসি বিস্মিত হয়ে বলে, ‘এটা রেকর্ড ছিল?’
তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘তোমরা এত বিচ্ছু। এত খারাপ! তখন বুঝলে তো...।’
সুজন এগিয়ে এসে বলে, ‘আবার মারব। আবার মাগো, বাবাগো বলাব?’
এবিসি সেই ভয়েই কিনা তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে।
শোভন বলল, ‘মামা, আমার প্রাপ্য ক্রেডিট তো পাচ্ছি না।’
‘তুইও গ্রেট। এই জিনিস পেলি কোথায়?’
‘আমাদের স্কুলে বিজ্ঞানমেলায় একজন বানিয়েছিল। ও একটা শেভিং ক্রিমের খালি বোতলে রঙিন পানি ভরে স্পে্র করেছিল। আমি এর মধ্যে একটু মরিচের গুঁড়া যোগ করেছি।’
মামা খেয়াল করে, সুমন-শোভনের কৃতিত্বের কথাগুলো শুনে সুজনের একটু মন খারাপ হয়। মামা এগিয়ে গিয়ে ওর পিঠে হাত রেখে। আর সুজন কান্নায় ভেঙে পড়ে।
মামা বলে, ‘তুই কাঁদছিস কেন? তুই কাঁদলে সবাই কেঁদে দেবে। এই আনন্দের মধ্যে কান্নাকাটির দরকার আছে নাকি?’
‘আমি তো কিছু করলাম না।’
‘তুই একটা মার খেয়ে দেখি, রাফি কোম্পানির নিয়ম ভুলে গেছিস। আমাদের নিয়ম কী?’
সুমন চিৎকার করে বলল, ‘আমাদের নিয়ম হচ্ছে একজনের করা মানে সবার করা। একজনের দুঃখ মানে সবার দুঃখ। একজনের আনন্দ মানে সবার আনন্দ।’
এই উল্লাসের মধ্যেই মামার চেহারা হঠাৎ একটু লাজুক লাজুক হয়ে যায়। ওরা ঠিক বোঝে, মীরা আপাকে ফোন করা হবে এখন।
মামা ফোনটা বের করে কী কী যেন বলে। বাচ্চাদের মতো উত্তেজনা গলায়। হাত-পা নাড়ে। মাঝেমধ্যে চেহারাটা ঝুলে পড়ে। কে বলবে, এই মামাই একটু আগে একের পর এক ফ্লাইং কিক মেরে কয়েকজনকে কাবু করেছে।
কখনো ছোট। কখনো বড়। কখনো লাজুক। রাফি মামাকে সবকিছুতে ঠিক মানিয়ে যায়।
মামার ফোনের শেষ কথাটা শোনা যায়, ‘শোনো মীরা, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। আমাদের দলের নামটা আমরা একটু বদলেছি। মানে, থ্রি এস থাকবে কাজ করার সময়। আর কাজ শেষে রাফি কোম্পানি। মানে এখন আমরা সবাইকে বলব যে আমাদের দলের নাম রাফি কোম্পানি।’
মীরা আপা ওদিকে থেকে বলল, ‘তাই তো হবে। আপনি এমন কাজ করলেন, আপনার দলের নাম রাফি কোম্পানি হবে না তো কি মীরা কোম্পানি হবে? যা ফ্লাইং কিক মারলেন!’
‘ফ্লাইং কিকের কথা তোমাকে কে বলল?’
‘আপনিই না বললেন!’
‘ও বলেছি নাকি? আসলে শুধু ফ্লাইং কিক না...কিল-ঘুষি-লাথি এমনকি আমাদের দেশীয় পদ্ধতির ল্যাংও ছিল। ল্যাং মারা বোঝো তো...আচ্ছা, একদিন দেখিয়ে দেব নাহয়... ঠিকমতো মারলে এক ল্যাংয়ে যা কাজ হয়, দশটা চায়নিজ ফ্লাইং কিকেও হয় না...।’
৮.
ওরা এখন লঞ্চে। যাচ্ছে চাঁদপুর। রাফি কোম্পানি কোনো সাফল্য দেখালে এরপর একটা ট্রিপ হয় সাধারণত, তবে এবারেরটা শুধুই আনন্দভ্রমণ নয়, উদ্দেশ্য আছে আরও।
লঞ্চের কেবিন থেকে ঢেউ দেখতে দেখতে মামা হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা, তোদের মনে আছে সোনা পেয়ে কে কী আচরণ করতে পারে, তাঁর একটা পরীক্ষা হয়েছিল?’
সুমন বলল, ‘থাক, আর মনে করার দরকার নেই। আমরা সবাই ফেল মেরেছি।’
মামা বলল, ‘না। সবাই ফেল মারেনি।’
‘তাই নাকি?’
মামা স্ট্যাপলার করা কাগজগুলো বের করে বলল, ‘মিলিয়ে দেখ।’
‘দেখা লাগবে না।’ সুমন বলে।
মামা তবু কাগজগুলো নেড়েচেড়ে বলল, ‘মজার ব্যাপার হলো তোরা তিনজন একেবারে হুবহু এক রকম লিখেছিস। একেবারে দাঁড়ি-কমাসহ এক।’
সুমনরা হাসে। তর্কে যায় না। ওরা তো সব সময় একাকার হয়েই থাকতে চায়।
মামা বলে, ‘কিন্তু লজ্জার বিষয় হলো, তিনজনের উত্তরই ভুল!’
শোভন বলল, ‘সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না মামা। আমরা কী করে ভাবব যে...।’ সুজনের দিকে চেয়ে শোভন থেমে যায়।
মামা রহস্য করে বলল, ‘একজন কিন্তু সঠিক উত্তর দিয়েছে।’
‘তুমি?’
মামা গৌরবের গলায় বলে, ‘পড়ে শোনাব?’
সুমন বলল, ‘মামা, পড়তে হবে না। আমরা বিশ্বাস করছি। তুমি গ্রেটেস্ট।’
মামা একটু ভেবে বলে, ‘ তবে এই পরীক্ষাটার একটা শিক্ষা কিন্তু আছে।’
সুমন বলে, ‘আগেই তো বলেছ। কে লোভ করবে আর কে লোভ করবে না, সেটা আগে থেকে বোঝা যায় না। জায়গামতো ফেললে তবেই বোঝা যায়।’
‘হ্যাঁ। সঙ্গে আরেকটা শিক্ষাও আছে। লোভ যারা করবে তারা সমস্যায় পড়বেই। কোনো না কোনোভাবে। দেখ, যে দুজন লোভ করেছিল, বুয়া এবং সুজনের বাবা, দুজনই কিন্তু ঝামেলায় পড়েছে।’
ঠিক। ঠিক। ওরা মাথা দোলায়।
নদী খুব সুন্দর করে বয়ে চলে। আর ওরা চলে রাফি মামা নামের এক অদ্ভুত মানুষের স্বপ্নের সঙ্গী হয়ে।
সেই কোন এক ফাঁকে বলেছিল, বুয়াকে একটা জায়গা কিনে দেবে। ভোলেনি। এখন চাঁদপুরে যাচ্ছে সেই জায়গা কিনতে।
জায়গা ঠিক করা হয়ে গেছে। মামা গিয়ে টাকা দেবে। তারপর বুয়া দলিল হাতে নিয়ে জমির ওপর দিয়ে হাঁটবে। সেটা ভিডিও করে রাখা হবে। ভিডিও ক্যামেরাও আছে ওদের সঙ্গে।
মামা যতবার ওদের দৃশ্যটার কথা বলে, ততবার তার চোখে পানি চলে আসে। পানি আসে ওদের চোখেও। সেই পানি বড় স্বচ্ছ। বড় পবিত্র। বড় বিশুদ্ধ।
অলংকরণঃ তুলি