রাসেল ও বিড়ালছানাটি

অলংকরণ: মাহফুজ রহমান

‘আজ কত তারিখ রে’, রাসেল জিজ্ঞেস করে তার ইশকুলের সহপাঠী রতনকে।

‘জুলাইয়ের এক তারিখ’, জবাব দেয় রতন।

‘চল আজকে আমি, তুই, বাবেল, শুভ আর কৌশিক সাইকেলে চড়ে সারা ধানমন্ডি চক্কর দেব।’

‘অন্য সবাই তো জানে না। জানাবি কী করে?’

‘কেন, আমি আর তুই ওদের সবার বাসায় গিয়ে ডাকব আর কথাটা বলব’, রাসেল বলে।

যাদের নাম বলা হলো, তাদের সবাই রাসেলের সঙ্গে একই ইশকুলে আর একই ক্লাসে পড়ে।

কথা বলছিল রাসেল আর রতন ধানমন্ডির রাসেলদের ৩২ নম্বরের বাড়ির দোতলার পুব দিকের কামরায় বসে। ওদের কথা শুনে মা ফজিলাতুন্নেছা এগিয়ে আসেন। রাসেলকে বলেন, ‘বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছ, তা-ই না?’

‘জি মা’, রাসেল বলে।

‘এখন বিকেল সাড়ে চারটার মতো বাজে। এক ঘণ্টার জন্য বাইরে যাবে। তার মানে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই ফিরে আসবে।’

‘ঠিক আছে মা।’

ফজিলাতুন্নেছা এবার রতনের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ওকে দেখে রাখবে। দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ঘরে থাকতেই চায় না।’

‘ঠিক আছে খালাম্মা। আপনি ভাববেন না’, রতন বলে।

রতন তার সাইকেল নিয়েই এসেছিল। সাইকেলটাকে গাড়ির বারান্দার পাশে রেখে ওপরে উঠে গিয়েছিল। এবার রাসেলকে নিয়ে সে সিঁড়ি ভেঙে দোতলা থেকে নেমে আসে। রাসেল তার সাইকেল নিয়ে রতনের পাশাপাশি হেঁটে বাড়ির গেটের বাইরে আসে। তারপর দুজনই সাইকেলে চেপে প্যাডেলে পা রাখে। চালাতে শুরু করে। একে একে যায় বাবেল, শুভ, আর কৌশিকদের বাড়ি। সবাইকে পাওয়া যায়। সবাই রাসেল আর রতনের প্রস্তাবে রাজি হয়। শুরু হয় পাঁচজনের সাইকেলে চেপে ধানমন্ডি পরিক্রমা। তবে বেশ সাবধানে। মাঝখানে রাসেল। দুই পাশে আগু-পিছু করে বাবেল, রতন, শুভ আর কৌশিক। পথ লোকজনের মধ্যে কেউই রাসেলকে চিনতে পারে না। কেননা, তার মাথায় ক্যাপ পরেছে। কপাল কিছুটা ঢাকা। সাইকেলে চলন্ত বলে পথচলতি কেউ তাকে চিনতে পারছে না—বঙ্গবন্ধু, দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতির সবচেয়ে ছোট সন্তান—রাসেল—সাইকেল চালিয়ে এই দলের মধ্যে আছে।

ওরা ধানমন্ডির লেকের পাড় ছাড়াতেই আসে ধানমন্ডি ৬ নম্বর সড়কে। ঠিক তখনই একটা দুর্ঘটনা ঘটে। ব্যাপারটা আসলে খেয়াল করেনি পাঁচজনের কেউ-ই। পাশাপাশি চলার সময় নিজেদের মধ্যে কথা বলতে গিয়ে ঘটনাটা ঘটে। অবশ্য ব্যাপারটাকে ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনাই বলতে হবে।

ওরা পাঁচজন যখন ৬ নম্বরের সড়ক ধরে যাচ্ছিল, তখন একটা বিড়ালছানা পথ অতিক্রম করতে গিয়ে রাসেলের সাইকেলের চাকায় পিষ্ট হতে হতেও বেঁচে যায়। তবে একটু আহত হয়। বিড়ালটার লেজের গোড়াটা থেঁতলে যায়। বিড়ালটা মিউমিউ করে কেঁদে উঠলে ওরা পাঁচজনই সাইকেল থেকে নেমে পড়ে। রাসেলই প্রথম নামে। কেননা, তার সাইকেলের চাকাতেই বিড়ালটা নিজের লেজে আঘাত পেয়ে কাতরে ওঠে। থেমে যায় ওর চলার গতি। রাসেল সাইকেল থেকে নেমেই বিড়ালছানাটাকে কোলে তুলে নেয়। হাতড়েপাতড়ে দেখে কোথায় সে আঘাত পেয়েছে। শেষে তার লেজে আঘাত পাওয়ার জায়গাটা খুঁজে পেতেই রাসেল তো বটেই, বাকি চারজনও বেশ বিমর্ষ হয়ে ওঠে। বিড়ালটা আঘাত পাওয়ার চোটে অবিরল মিউমিউ করে ডাকছিল। এ অবস্থায় রাসেলই প্রথম মুখ খোলে। বলে, ‘কী করা যায়, বল তো তোরা? বিড়ালছানাটারও তো প্রাণ আছে। ওর কান্না আমি সহ্য করতে পারছি না।’

কৌশিক বলে, ‘ওকে সামনের ফার্মেসিতে নিয়ে চল।’

‘ঠিক বলেছিস’, রাসেল বলে। ‘ফার্মেসির লোকজন ওর আঘাতটা দেখলেই ওষুধ বাতলে দিতে পারে। চল।’

বিড়ালটাকে এখন রাসেল আলতো করে তার ডান হাতে ধরে এগিয়ে চলেছে। বাঁ হাত দিয়ে ঠেলে নিয়ে চলেছে নিজের সাইকেলটা। ওর চার সঙ্গীও ওর সঙ্গে সঙ্গে চলেছে।

কাছে আসতেই বিড়ালছানাটাকে নিয়ে রাসেল সোজা ফার্মেসির ভেতরে ঢুকে যায় এবং কর্মচারী দুজনের একজনকে বলে, ‘বিড়ালছানাটা লেজে আঘাত পেয়েছে। কী করা যায় বলুন তো?’

‘আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে’, কর্মচারীটি বলেন।

‘আপনি আমাকে আপনি আপনি করে কথা বলছেন কেন,’ রাসেল বলে।

অন্য কর্মচারীটি বলেন, ‘আপনি বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ছোট ছেলে না?’

‘ওসব কথা রেখে এখন বিড়ালছানাটাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা কীভাবে করা যায় সে কথা বলুন’, রাসেল জোর দিয়ে বলে।

‘ঠিক আছে, আমরা দেখছি।’ কথাটা বলেই কর্মচারী দুজন বিড়ালটাকে নিজেদের হাতে নিয়ে নেন। নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে লেজটার কাছে চোখ পড়তেই তাঁরা বলেন, ‘লেজটায় একটু আঘাত পেয়েছে। ডাক্তার সাহেব থাকলে ভালো হতো। তাঁর আসতে দেরি আছে। আমরা ওষুধ দিয়ে লেজটায় ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। আশা করি, সেরে উঠবে।’

ওষুধ দিয়ে লেজ ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে বিড়ালছানাটাকে কর্মচারী দুজন রাসেলের হাতে তুলে দেন। রাসেল পকেট থেকে টাকা বের করে দিতে গেলে জিবে কামড় দেন ফার্মেসির কর্মচারী দুজন। বলেন, ‘কী বলেন, আপনি বঙ্গবন্ধুর ছেলে না? আপনার কাছ থেকে কি আমি পয়সা নিতে পারে?’

আর কথা বাড়ায় না রাসেল। বিড়ালছানাটাকে নিয়ে ওরা পাঁচ বন্ধু সাইকেল চালিয়ে আবার ৩২ নম্বরে আসে। আজ আর পুরো ধানমন্ডি সাইকেল চালিয়ে চক্কর দেওয়া হয় না। অন্য আরেক দিন এ অভিযান চালানো হবে বলে ঠিক করা হয়।

বিড়ালছানাটা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির নিবিড় বাসিন্দা হয়ে উঠতে থাকে। দিন যতই যেতে থাকে, ততই সে হয়ে উঠতে থাকে নাদুসনুদুস আর সবার চোখের মণি। তার জন্য বিশেষভাবে দুধ আর মাছ বরাদ্দ করা হয়। আর হয়ে ওঠে সে রাসেলের এক নম্বর নেওটা। রাসেল যতক্ষণ বাড়িতে থাকে না, ততক্ষণ তার নড়াচড়া নেই, ডাকাডাকি নেই। আর যে-ই ইশকুল ছুটি শেষে রাসেল বাসায় ফেরে, অমনি শুরু হয়ে যায় তার অবিরাম ডাকাডাকি, ছোটাছুটি আর বায়না ধরার পালা। রাসেল ছাড়া তার আনন্দ-ফুর্তি নেই। তাকে ঘিরেই তার সবকিছু। বঙ্গবন্ধু, কামাল, জামাল, বেগম মুজিব—সবারই সে আপনজন। অবশ্য হাসু আর রেহানা আপু তখন বিদেশে। হাসু আপুর স্বামী জার্মানিতে চাকরি করতেন বলে তারা তখন সেখানে। এখানে থাকলে তাঁরাও ওকে ভালোবাসতেন।

রাসেল এর মধ্যে বিড়ালছানার একটা ছবি এঁকে তার দোতলার শোয়ার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছে। বলে রাখি, বিড়ালছানার শোয়ার জায়গা রাসেলের খাটের নিচে।

দেখতে দেখতে আগস্ট মাস এসে যায়। এসে যায় ১৪ তারিখের রাত। ১৫ তারিখের ভোরের দিকে গোলাগুলির শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যায়। সবার আগে ঘুম ভাঙে রাসেলের মা বেগম মুজিবের। তিনিই ডেকে তোলেন সবাইকে। কামাল, জামাল, তাঁদের স্ত্রীদের, দেবর শেখ নাসের, বাড়ির কাজের লোকজন—সবাইকে। বঙ্গবন্ধু জেগে উঠেছিলেন বেগম মুজিবের সামান্য পরে। গোলাগুলি কেন, কেন সেই গোলাগুলি তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়ি লক্ষ্য করে, তিনি প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি। বুঝতে পারামাত্র তিনি সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে ফোন করেন, ফোন করেন কর্নেল শাফায়াত জামিলকে।

ঘাতকদের জিম্মায় জীবিত রাসেল। আর জীবিত তাকে ঘিরে ঘুরঘুর করা বিড়ালছানাটি। একজন সামরিক অফিসার রাসেলকে নিয়ে নিচে নেমে আসে। সে জিজ্ঞেস করে অফিসারটিকে, ‘আমাকে কেন এখানে নিয়ে এসেছেন?’

অফিসারটি জবাব দেয়, ‘একটু পরেই জানতে পারবে।’

এই সময় দ্বিতীয় একজন সামরিক সদস্য এগিয়ে আসে। রাসেলকে দেখে সে বলে, ‘কী চাও সোনামনি?’

‘আমি আমার মার কাছে যাব। আমাকে মার কাছে নিয়ে যাও।’

‘হ্যাঁ, তা-ই নিয়ে যাচ্ছি’, বলে রাইফেল হাতে ধরা অফিসারটি। অদূরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকা কাজের লোকজন, একজন বেসামরিক কর্মকর্তা নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে যান। সেই অবস্থায় তারা শুনতে পায় বিড়ালছানাটির একটানা মিউমিউ ডাক।

অভিযান পরিচালনাকারী উপস্থিত একজন সামরিক কর্মকর্তা বলে, ‘বিড়ালছানাটার সাহস তো কম নয়। বেঁচে যাওয়া লোকজনের কারও মুখে কোনো কথা নেই। আর ও কি না মিউমিউ করে ডেকে চলেছে। এ নিশ্চয় ওর প্রতিবাদ।’

‘কী করব বলুন,’ রাসেলকে হত্যাকারী মিলিটারি অফিসারটি জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যাঁ, বিড়ালছানাটির সাহসের বলিহারি যাই’, দ্বিতীয় অফিসারটি বলে।

‘তাহলে সাফ করে দেব?’

‘দাও।’

বলামাত্র রাসেলকে রাইফেলধারী সামরিক সদস্যরা একঝাঁক গুলি ছুড়ে মেরে ফেলে বিড়ালছানাটিকে।