লাইব্রেরি

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

ইউনিভার্সিটিতে নতুন ভর্তি হয়েছি। ক্লাস শুরু হবে দুই দিন পর। তাই বই কিনতে শহরের নামকরা একটি লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম সেদিন। শুনেছি ওটাই নাকি রংপুর শহরের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। প্রায় সব ধরনের বই পাওয়া যায়। লাইব্রেরিটিতে বই কেনার নিয়ম অন্যান্য লাইব্রেরির মতো নয়। কতগুলো অংশে ভাগ করা আছে এর ভেতরটা। যেমন ধরো, বিভিন্ন শ্রেণির বই এক পাশে আবার সাহিত্যের বইগুলো অন্য পাশে। সাহিত্যের বইগুলোর মধ্যেও আবার ভাগ আছে। কবিতার বই এক পাশে, গল্পের বই আরেক পাশে—এভাবে। পুরো লাইব্রেরি সিসি ক্যামেরার আওতাধীন। বই কিনতে হলে শেলফ থেকে বেছে নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে যেতে হবে। ক্যাশ কাউন্টারে বইয়ের টাকা দিয়ে তারপর লাইব্রেরি থেকে প্রস্থান।

লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকলাম। আমার পেছনে চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটি ছেলে, সাহিত্যের অংশ থেকে একটা উপন্যাসের বই বের করে পড়ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে একটা লোক এসে ছেলেটিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘অ্যাই ছেলে, তোমাকে আমি অনেকক্ষণ আগে যেতে বলেছি না? এখানে দাঁড়িয়ে বোকার মতো কী পড়ছ? আর এতই যখন পড়ার শখ, বইটা কিনে নিয়ে বাসায় গিয়ে পড়ো না!’

কিছুই বলল না ছেলেটা। মাথাটা একটু নিচু করে বইটা জায়গামতো রেখে চলে গেল। ওর পড়া বইটা বের করলাম আমি। বইটার নাম দ্য ওয়ার অ্যান্ড পিস। লিও তলস্তয়ের লেখা। অনেক বিখ্যাত উপন্যাস। অনেক বড়ও বটে, প্রায় ৮১৬ পৃষ্ঠা। বাংলায় অনূদিত বইটা পড়তে বেশ ধৈর্যের দরকার। আমার বাসায়ও আছে বইটা। পুরোটা পড়িনি। ২০০ কি ৩০০ পৃষ্ঠা পড়েই রেখে দিয়েছি। হঠাৎ একটা জিনিস দেখে অবাক হলাম আমি। ছেলেটা ৭০২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ে ফিতা দিয়ে চিহ্নিত করে রেখে গেছে! ছেলেটা সম্পর্কে জানার খুব ইচ্ছা হলো আমার। কিছুক্ষণ পর লাইব্রেরির ওই লোকটাকে ডাকলাম। ছেলেটার ব্যাপারে জানতে চাইলাম তাঁর কাছে। তিনি বললেন, ছেলেটার নাম রিহান। রংপুর জিলা স্কুলে পড়ে। যদিও ওর গায়ের পোশাক দেখেই বুঝতে পেরেছি সেটা। ছেলেটা নাকি প্রতিদিন লাইব্রেরিতে আসে। এসে অনেকক্ষণ ধরে বই পড়ে। লোকটা যখন রেগে চলে যেতে বলে, তখন চলে যায়।

শুনে আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল।

পরদিন ঠিক একই সময়ে আবার লাইব্রেরিতে গেলাম। ছেলেটা আজও এসেছে। আমাকে লক্ষ্যই করেনি, খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিল ও। আস্তে করে গিয়ে ওর কাঁধে হাত দিলাম আমি। চমকে গেল ও। ‘রিহান’ বলে ডাকতেই পেছনে ঘুরে আমার দিকে তাকাল সে। বড় বড় চোখে বিস্ময়। রিহানকে বললাম, ‘প্রতিদিন এই লাইব্রেরিতে আসো...ব্যাপারটা খুলে বলো তো।’ একটু ভেবে বলা শুরু করল সে।

রিহানের বাসা রংপুরের আলমনগরে। একটা চায়ের দোকান করে ওর বাবা। কোনোমতে সংসার চলে তাদের। পরিবারের মোট সদস্য ছয়জন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের ওপর খুব ঝোঁক রিহানের। যদিও অর্থের অভাবে বইটই কিনতে পারে না সে। তাই এভাবেই লাইব্রেরিতে এসে বই পড়ে প্রতিদিন। লাইব্রেরির কর্মচারীরা ওর ওপর রাগ করলেও কিছুই মনে করে না রিহান। এ রকম অনেক লাইব্রেরিতে ঘুরেছে সে, কিন্তু খুব বেশি বই পড়ে শেষ করতে পারেনি।

ওর কথাগুলো শুনে খারাপ লাগল আমার। দ্য ওয়ার অ্যান্ড পিস বইটা কিনে দিলাম ওকে। খুশি হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল রিহান।

ওকে আমার হলের নাম বলে দিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল। কোনো সমস্যা হলে কিংবা বই কেনার দরকার পড়লে যেতে বললাম আমার কাছে।

রিহানের সঙ্গে আর কিছুক্ষণ কথা বলে লাইব্রেরি থেকে বের হলাম আমি। হঠাৎ পেছন থেকে ‘ভাইয়া’ বলে ডাক দিল ও। আমাকে এক মিনিট অপেক্ষা করতে বলে ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে দেখাল রিহান। খাতার পৃষ্ঠা উল্টে দেখি মধ্যে অনেক সুন্দর সুন্দর ছোটগল্প, কবিতা লেখা। ‘কে লিখেছে?’ উত্তরে রিহান আমাকে বলল এগুলো ওরই লেখা। লেখাগুলো কিশোর আলোয় পাঠাতে বললাম ওকে। তখন ও আমাকে বলল, ‘ভাইয়া পাঠাব কী করে? আমার কাছে তো খাম কেনারই টাকা নেই!’ ওকে দশ টাকা দিয়ে বললাম, ‘খাম কিনে তোমার পছন্দের যেকোনো একটা লেখা পাঠিয়ে দাও।’ তারপর আমি লাইব্রেরি থেকে চলে এলাম।

পরের মাস আসতে আসতে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। ভালো লাগছে না বলে পাশের বেডের বন্ধুর কাছ থেকে ওর কিশোর আলোটা নিয়ে পড়ছিলাম। ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ এক পৃষ্ঠায় এসে থেমে গেলাম আমি। কারণ, সেই পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে রিহানের লেখা একটি কবিতা!

কবিতাটা পড়ে আমার কী যে ভালো লেগেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমার হাত ধরে একজন নতুন লেখকের উদয় ঘটল—ভালো লাগার কারণ বোধ হয় এটাই।