লোভ

অলংকরণ: সালমান সাকিব
অলংকরণ: সালমান সাকিব

প্রতিদিনের মতো আজও শান্তিতেই দিন কাটছিল গ্রিক সাম্রাজ্যের নেভেলটনবাসীর। সকালে শিশুরা ঘুমোচ্ছে, মাঠে যাচ্ছে কৃষক। জেলে জাল ফেলছে নদীতে। হাঁক দিচ্ছে দোকানিরা। সচরাচর এভাবেই কাটে দিনগুলো। তবে এত সুখশান্তির মধ্যে কেউ বুঝতে পারেনি কত বড় বিপদ আসছে সামনে।

নেভেলটনের রাজা ফ্রেড। এক দুপুরে সেনাপতি এডওয়ার্ডকে প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। এডওয়ার্ড ঠিক সময়ে উপস্থিত। তাঁকে দেখে রাজা ফ্রেড বললেন, ‘বীর সেনাপতি এডওয়ার্ড! আপনার তরবারির ভয়ে শত্রুরা এই নগরের একটি পাতা ছিঁড়তেও ভয় পায়। নেভেলটনের প্রতিটি মানুষ গায় আপনার জয়গান।’ এডওয়ার্ড প্রায় বাধা দিয়ে বলল, ‘আমি কিছুই না। কেবল আপনার আদেশ ও জনগণের ইচ্ছা পূরণ করি।’ রাজা ফ্রেড বললেন, নেভেলটনের মানুষেরা আপনাকে খুব ভালোবাসে। তাই আমি চাই, আমার সন্তান পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগেই আমার মৃত্যু হলে, আপনাকে রাজার মুকুট পরানো হবে। এতেই  সন্তুষ্ট হবে   মানুষ।

রাজার আগের কথাগুলোর তেমন গুরুত্ব না দিলেও শেষের কথাটি মন জয় করে নিল এডওয়ার্ডের। সেখানেই মাথা নত করে রাজাকে সম্মান জানাল সে।

 এ ঘটনার পর রাজার প্রতি সম্মান বেড়ে গেল এডওয়ার্ডের। একই সঙ্গে একটু হলেও রাজাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা শুরু করল সে।

প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে শহর দেখতে বের হলো এডওয়ার্ড। এখানকার বাড়িগুলো ছোট। তবে ছিমছাম। সবার কাছেই খুব শ্রদ্ধার পাত্র এডওয়ার্ড। তাকে যে-ই দেখে সে-ই সম্মান জানায়। সে-ও হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়।

হঠাত্ একটি শব্দে বুক কেঁপে ওঠে এডওয়ার্ডের।  এক জনমানবহীন গলি থেকে আসছিল শব্দটি। সাবধানে তলোয়ারটি বের করে গলিটায় গিয়ে এডওয়ার্ড দেখে বাঁশের এক লাঠিতে ভর করে তার দিকে আসছে একজন বৃদ্ধ। এডওয়ার্ড তলোয়ার উঁচু করে কঠোর স্বরে বলে উঠল, ‘কে তুমি? তোমাকে তো আগে দেখিনি এ শহরে!’

‘আমার নাম চার্লস। আমার স্বপ্ন আপনার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করা।’ অদ্ভুত স্বরে বলে লোকটি। ‘রাজা আজ আপনাকে যা কিছু বলেছেন, আমি তা শুনেছি।’ এ কথা শুনে এডওয়ার্ড তো বিস্মিত! এডওয়ার্ডকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চার্লস বলতে থাকল, ‘রাজা ফ্রেড তার বোকামির জন্য নিজেই  সিংহাসন হারাবেন। আর আপনি হবেন সেই সিংহাসনের মালিক।’

এডওয়ার্ড উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘তোমার ধারণা ভুল। রাজা ফ্রেড বোকা নন। তিনি আমাকে তাঁর মুকুট দেননি। তবে তুমি এখন এখান থেকে না গেলে আমার তরবারি থেকে বাঁচবে না।’

এডওয়ার্ডের হুমকি উপেক্ষা করে চার্লস বলল, ‘জানি ফ্রেড আপনাকে রাজা বানাননি। তাঁর অকালমৃত্যু হলে আপনাকে রাজা হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন কেবল।  তাহলে তো আপনি যেকোনো সময় তাঁর প্রাণ বধ করে সিংহাসন দখল করতে পারেন, তাই না?’

কথাটা এডওয়ার্ডের মনে ধরল। তবু সে বলল, ‘রাজা ফ্রেড আমাকে সর্বোচ্চ পদ দান করেছেন। তাঁর কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার নেই। নিজ হাতে হত্যা করার তো প্রশ্নই ওঠে না।’

‘আপনাকে নেভেলটনে সবাই শ্রদ্ধা করে। আপনি রাজা হলে কারও কোনো অভিযোগ থাকবে না। সবাই আপনাকে সানন্দে বরণ করে নেবে। এ ছাড়া রাজাকে হত্যা করলে আপনার হাত রক্তাক্ত হবে না।’

চার্লসের শেষ কথায় আগ্রহী হলো এডওয়ার্ড।   চার্লসও খুশি। পকেট থেকে একটি চকচকে স্বর্ণমুদ্রা বের করল সে।

জীবনে প্রচুর সোনার মুদ্রা দেখেছে এডওয়ার্ড। তবে এত আকর্ষণীয় মুদ্রা সে কখনো দেখেনি। মুদ্রাটি দেখলেই যেন ছিনিয়ে নিতে ইচ্ছা করে।

চার্লস বলল, ‘এই অভিশপ্ত মুদ্রা যে-ই লোভের বশে তার হাতে তুলে নেয়, শিগগিরই অপমানজনক মৃত্যু ঘটে তার। শত বছর আগে থেকেই এটি দিয়ে বাদশাহরা মানুষের সততা যাচাই করতেন। চার্লস একটু হেসেই বলল, তবে কেউ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।’

এডওয়ার্ডের চিন্তাধারা তখন সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গেছে। সে চালর্সকে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে এ মুদ্রা তুলে যদি রাজা মারা যায়, তবে তার জন্য তো সে নিজেই দায়ী থাকবে।’ চার্লস সম্মতি জানিয়ে বলল,    ‘ঠিক ধরেছেন। আপনি শুধু মুদ্রাটি রাজার কাছে রেখে আসবেন।’

এ কথা বলেই মুদ্রাটি এডওয়ার্ডের হাতে রেখে দিল চার্লস। এডওয়ার্ড বলল, ‘তুমি আমাকে সাহায্য করছ কেন?’

‘রাজা হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আমি শুধু রাজা তথা আপনার পাশে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করতে চাই।’ চার্লসের সহাস্য উত্তর। তারপর ধীরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় হঠাত্ উধাও হয়ে যায় অদ্ভুত বৃদ্ধটি। এডওয়ার্ড একই সঙ্গে আশাবাদী ও চিন্তিত। মুদ্রাটি একটি থলেতে রেখে শক্ত করে ধরে রাখে সে। রাজপ্রাসাদের দিকেই যাচ্ছে এডওয়ার্ড। রাজাকে শহরের অবস্থা সম্পর্কে জানানো তার দায়িত্ব। এডওয়ার্ড হাঁটছে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে বারবার। কাছেই নদী। সেখানে মুদ্রাটি ফেলে দিলে সব দুশ্চিন্তা শেষ হয়ে যায়। আগের মতো হয়ে যাবে সবকিছু। কিন্তু তা করলে বাকি জীবন এই একই পদে থাকতে হবে। না, আমি শাসক হতে চাইলে রাজা ফ্রেডকে মরতেই হবে। নিজেকে এ কথা বলে উদ্দেশ্য স্থির করে ফেলে এডওয়ার্ড।

রাজার অনুমতিতে তাঁর কামরায় প্রবেশ করল এডওয়ার্ড। রাজাকে শহরের অবস্থা বলতে শুরু করল সে। কোনো একটা দলিল পড়ছিলেন রাজা। কথার ফাঁকে এডওয়ার্ড কখন যে মুদ্রার থলেটি রেখে দিল, টেরই পেলেন না রাজা।

এডওয়ার্ডের কথা শেষে রাজা খুশি হয়ে বলে উঠলেন, ‘বাহ্, তোমার মুখে সব খবর শুনে খুশি হলাম। তোমাকে শহরের খবর আনতে বলার কারণ আছে। আগামীকাল স্কটল্যান্ডের বাদশাহ এখানে আসবেন। বড় একটা ভোজসভার আয়োজন করা হবে। তুমিও থাকবে সেখানে।’

রাজার মুখে এ কথা শুনে যেন এডওয়ার্ডের মনে সুই বিঁধল। তবে সে যখন পথে পা দিয়েই ফেলেছে, আর পিছু হটার সুযোগ নেই। গোমড়ামুখে আমন্ত্রণে রাজি হয়ে কামরা থেকে বের হয়ে এল সে। প্রায় দৌড়ে নিজের কক্ষে এসেই শুয়ে পড়ল।

হঠাত্ আবার সেই ভয়ংকর শব্দ শুনল এডওয়ার্ড। ধীরে ধীরে বেড়ে হঠাত্ থেমে গেল শব্দ। এডওয়ার্ড উঠে দেখে চার্লস দাঁড়িয়ে আছে।

এডওয়ার্ড চমকে বলল, ‘তুমি এখানে এলে কীভাবে?’

 জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল চার্লস, ‘আপনি কি মুদ্রাটি রাজার কাছে রেখে এসেছেন?

‘হ্যাঁ।’

‘বেশ, তাহলে রাজা ফ্রেড শিগগিরই মারা যাবেন।’

‘রাজা ফ্রেড নেভেলটনের বাদশাহ, তাঁর গুদামে স্বর্ণমুদ্রার পাহাড় আছে। কেবল একটি মুদ্রার লোভে তিনি মরতে পারেন না।’

‘যে চন্দ্র জয় করেছে, সে-ই তো সূর্যের পেছনে ছোটে।’

বলেই আবার উধাও হয়ে গেল চার্লস। ঘুমানোর চেষ্টা করছিল এডওয়ার্ড। মাথায় তার নানা চিন্তা। রাজা কি এখন মারা গেছে? কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে এল, নিজেও তা টের পেল না সে।

হঠাত্ প্রচণ্ড শোরগোলে ঘুম ভাঙল এডওয়ার্ডের। চোখ খুলে দেখে, একজন সৈনিক অস্থির হয়ে ডাকছে তাকে। এডওয়ার্ড উঠতেই  সে শঙ্কিত স্বরে বলল, ‘রাজা ফ্রেড মারা গেছেন!’

রাজার চিকিত্সাকক্ষে গিয়ে এডওয়ার্ড দেখে চারপাশে লোকজনের ভিড় জমেছে। তাদের চেহারায় দুঃখ নেই; মনে হলো ঘটনাটি এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তারা। এডওয়ার্ডকে দেখে সবাই জায়গা ছেড়ে দিল। এডওয়ার্ড দেখল, রাজার মৃতদেহ পড়ে আছে। চিকিত্সক জানাল, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তিনি পা পিছলে পড়ে যান।

পাশের টেবিলে রাখা থলেটা লক্ষ করল এডওয়ার্ড। চিকিত্সক বলল, ‘থলেটা রাজার পকেটে পাওয়া যায়।’ এডওয়ার্ডের মনে আর কোনো সন্দেহ ছিল না। সে মনে মনে বলল, একটি দেশের রাজার এমন মৃত্যু! চার্লসের প্রতিটি কথাই যেন সত্য হয়ে উঠেছে।

এডওয়ার্ড বলল, ‘জলদি এই থলে নদীতে ফেলে দাও।’ তার কথা শুনে সবাই অবাক হলো, তবে কেউ আর তখন প্রশ্ন করল না।

পরদিনই অনুষ্ঠান হলো রাজার স্মরণে।  স্কটল্যান্ডের বাদশাহও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। স্বীকার করতে কষ্ট হলেও এডওয়ার্ড বুঝল, এ রকম মৃত্যুর পর রাজা ফ্রেডের নাম কেবল হাসি-তামাশার আসরেই আসবে।

কয়েক দিন গেল। এডওয়ার্ডের অভিষেক আজ।  পুরোনো রাজার মৃত্যুশোক ভুলে নতুন রাজাকে বরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ  আয়োজন। দেশ-বিদেশ থেকে রাজা, পর্যটক, বণিকেরা এসেছে মহান এডওয়ার্ডের অভিষেক দেখতে। চার্লসও উপস্থিত সেখানে। নতুন রাজার অভিষেকের জন্য ঘরবাড়ি রাঙিয়ে তুলেছে নেভেলটনের বাসিন্দারা। চারদিকে উত্সবমুখর পরিবেশ। সবার মুখে হাসি। কেবল এডওয়ার্ডই উদাস। সারা অনুষ্ঠানে  অনুশোচনায় ভুগল সে। কোনো কিছুতেই আগ্রহ পেল না সে। অনুষ্ঠান শেষে সোনার মুকুট পরিয়ে এডওয়ার্ডকে নেভেলটনের রাজা হিসেবে মেনে নিল সবাই। শুধু সে নিজেই তা মানতে পারল না। কিন্তু এখন পিছু হটা অসম্ভব। রাজা হলো এডওয়ার্ড। চার্লস তার প্রধান উপদেষ্টা।

অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্ত এডওয়ার্ড রাজকামরায় ঘুমোতে গেল। আশ্চর্য! আগে এ কামরাটা কত বড় লাগত তার কাছে। বিছানায় ঘুমানো তো দূরের কথা, চোখ দুটোই বন্ধ করতে পারল না সে। তার মনে হলো স্বয়ং ফ্রেড এসে অভিশাপ দিচ্ছেন তাকে। আবারও সেই অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল সে। ‘রাজা এডওয়ার্ড!’ ল এডওয়ার্ড। সে দেখল, বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চার্লস। প্রথম দিনের মতো আজও তার মুখে সেই একই হাসি। এডওয়ার্ড পাগলের মতো চেঁচিয়ে বলে, ‘আর কী চাও তুমি? আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করেছি। উপদেষ্টা বানিয়েছি তোমাকে। আর কী চাও? আমি আর কিছু চাই না। আমার সব ইচ্ছা পূরণ হয়ে গেছে।’

হাসতে হাসতে চার্লস বলে, ‘ওই রকম কেবল একটি মুদ্রা ছিল না। ওই রকম অনেক মুদ্রা দিয়ে একটি রাজমুকুট বানিয়েছিলাম আমি। আজ আপনি লোভের বশে সেটাই পরেছেন।’

সব ফন্দি বুঝে ফেলে পাগলের মতো তলোয়ার নিয়ে চার্লসকে মারতে গেল এডওয়ার্ড। কিন্তু আঘাত করার আগেই উধাও হয়ে যায় চার্লস। এডওয়ার্ড পড়ে যায় মাটিতে।

এডওয়ার্ডের মনে যেন ঝড় নেমে আসে। লোভে পড়ে আমি কি অযথাই রাজা ফ্রেডের প্রাণ নিয়েছি? ওই শয়তান রাজা হলে নেভেলটনের কী হবে? আমি কি সত্যিই মারা যাব? এসব চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে এডওয়ার্ড। সবকিছু অসহ্য লাগে তার কাছে। হাতের তলোয়ারটা নিজের পেটেই ঢুকিয়ে দেয় সে। লোভের বশে শেষে নিজের প্রাণটাই বিসর্জন দেয় রাজা এডওয়ার্ড।