শিয়াল পণ্ডিত

অলংকরণ: ষুভ

এক যে ছিল শেয়াল,
তার বাপ দিয়েছিল দেয়াল
তার ছেলে সে, কম বা কিসে?
তারও হলো খেয়াল!

ইয়া-ইয়া গোঁফে চাড়া দিয়া, শিয়াল পণ্ডিত শটির বনে এক মস্ত পাঠশালা খুলিয়া ফেলিল।

চিঁ চিঁ পোকা, ঝিঁ ঝিঁ পোকা, রামফড়িঙের ছা,
কচ্ছপ, কেন্নো হাজার পা,
কেঁচো, বিছে, গুবরে, আরশুলা, ব্যাঙ,
কাঁকড়া, মাকড়া-এই-এই-ঠ্যাং।

শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালায় এত এত পড়ুয়া।

পড়ুয়াদের পড়ায়
পণ্ডিতের সাড়ায়,

শটির বনে দিনরাত হট্টগোল

দেখিয়া শুনিয়া এক কুমির ভাবিল, ‘তাই তো! সকলের ছেলেই লেখাপড়া শিখিল, আমার ছেলেরা বোকা হইয়া থাকিবে?’ কুমির, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালায় সাত ছেলে নিয়া গিয়া হাতে খড়ি দিল।

ছেলেরা আঞ্জি ক খ পড়ে। শিয়াল বলিল, কুমির মশাই, দেখেন কী-সাত দিন যাইতে-না-যাইতে আপনার এক-এক ছেলে বিদ্যাগজগজ ধনুর্ধর হইয়া উঠিবে। মহাখুশি হইয়া কুমির বাড়ি আসিল।

পণ্ডিত মহাশয় পড়ান, রোজ একটি করিয়া কুমিরের ছানা দিয়া জল খান। এই রকম করিয়া ছয় দিন গেল।

কুমির ভাবিতেছে—কাল তো আমার ছেলেরা বিদ্যাগজগজ হইয়া আসিবে, আজ একবার দেখিয়া আসি। ভাবিয়া কুমিরানিকে বলিল, ‘ওগো, ইলিশ-খলিসের চচ্চড়ি, রুই-কাতলার গড়গড়ি, চিতল-বোয়ালের মড়মড়ি সব তৈয়ার করিয়া রাখো, ছেলেরা আসিয়া খাইবে।’ বলিয়া কুমির পুরান চটের থান, ছেঁড়া জালের চাদর, জেলে-ডিঙির টোপ পরিয়া একগাল শেওলা চিবাইতে চিবাইতে ভুঁড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে গিয়া উপস্থিত, ‘পণ্ডিত মশাই, পণ্ডিত মশাই, দেখি, দেখি, ছেলেরা আমার কেমন লেখাপড়া শিখিয়াছে।’

তাড়াতাড়ি উঠিয়া পণ্ডিত মহাশয় বলিলেন, ‘আসুন, আসুন, বসুন, হ্যাঁরে গুবরে তামাক দে, আরে ফড়িঙে নস্যির ডিবে নিয়ে আয়। হ্যাঁ রে, কুমির-সুন্দরেরা কোথায় গেল রে? বসুন, বসুন, আমি ডাকিয়া নিয়া আসি।’

অলংকরণ: ষুভ

গর্তের ভিতরে গিয়া শিয়াল পণ্ডিত সেই শেষ-একটি ছানাকে উঁচু করিয়া সাতবার দেখাইল। বলিল, ‘কুমির মশাই, এত খাটিলাম খুটিলাম, আর একটুর জন্য কেন খুঁত রাখিবে? সব ছেলেই বিদ্যাগজগজ হইয়া গিয়াছে আর এক দিন থাকিলেই একেবারেই ধনুর্ধর হইয়া ঘরে যাইতে পারিবে। ’

বোকা কুমির খুশি হইয়া চলিয়া গেল।

পরদিন শিয়াল পণ্ডিত বাকি ছানাটিকে দিয়া সর্বশেষ জলযোগ সারিয়া পাঠশালা পুঠশালা ভাঙিয়া পলায়ন!

পিট্টান তো পিট্টান-কুমির আসিয়া দেখে-পড়ুয়ারা পড়ে না, শিয়াল পণ্ডিত ঘরে নাই-শটির বন খালি। কুমির তখন সব বুঝিতে পারিল। গালে চড়, মাথায় চাপড়, হাপুস নয়নে কাঁদিয়া, কুমির বলিল, ‘আচ্ছা পণ্ডিত দাঁড়া—

আর কি কাঁকড়া খাবি না?
আর কি খালে যাবি না?
ওই খালে তো কাঁকড়া খাবি—
দেখি কী করে
মুই কুমিরের হাত এড়াবি।’

কুমির চুপ করিয়া খালের জলে লুকাইয়া রহিল।

কদিন যায়, শিয়াল পণ্ডিত খালের ওই ধারে ধারে ঘুরে, প্রাণান্তও জলটিতে পা ছোঁয়ায় না। শেষে পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, তার উপর ওপারের চড়ায় কাঁকড়ারা ছায়ে পোয়ে দলে দলে দাঁড়া বাহির করিয়া ধিড়িং ধিড়িং নাচে—আর কি সয়? সব ভুলিয়া টুলিয়া, যাক প্রাণ থাক মান-জলে দিলেন ঝাঁপ!

আর কোথায় যায়, ছত্রিক গণ্ডা দাঁতের কুমির, পণ্ডিতের ঠ্যাংটি ধরিয়া ফেলিল!

টানাটানি হুড়াহুড়ি-পণ্ডিত এক নলখাগড়ার বনে গিয়া ঠেকিলেন। অমনি এক নলের আগা ভাঙিয়া পণ্ডিত বলিল, ‘হাঃ! কুমির মশাই এত বোকা তা তো জানিতাম না! কোথায় বা আমার ঠ্যাং, কোথায় বা লাঠি! ধরুন ধরুন, লাঠিটা ছাড়িয়া ঠ্যাংটাই ধরিতেন!’

কুমির ভাবিল, ‘অ্যাঁ,-লাঠি ধরিয়াছি?’ ধর ধর-ঠ্যাং ছাড়িয়া কুমির লাঠিতে কামড় দিল।

নল ছাড়িয়া দিয়া পণ্ডিত তিন লাফে পার, ‘কুমির মশাই, হোক্কা হুয়া। আবার পাঠশালা খুলিব, ছেলে পাঠাইও।’

অলংকরণ: ষুভ

আবার দিন যায়, শিয়ালের আর লোকটিতেও কুমির পা দিতে পারে না। শেষে একদিন মনে মনে অনেকে যুক্তিবুদ্ধি টুদ্ধি আঁটিয়া-সটান লেজ, রোদমুখে হাঁ, ঢেকি অবতার হইয়া—কুমির খালের চড়ায় হাত ছড়াইয়া একেবারে মরিয়া পড়িয়া রহিল। শিয়াল পণ্ডিত সেই পথে যায়। দেখিল, কুমির তো মরিয়াছে। যাই, শিয়ালীকে নিমন্ত্রণটা দিয়া আসি।’

কিন্তু পণ্ডিতের মনে-মনে সন্দেহ! গোঁফে তিন চাড়া দিয়া দাঁত মুখ চাটিয়া চুটিয়া বলিতেছে, আহা বড় সাধুলোক ছিল গো। কী হয়েছিল গো! কী করে গেলে গো! আচ্ছা, লোকটা যে মরিল তার লক্ষণ কী? হুঁ হুঁ-

কান নড়বে পটাপট
লেজ পড়বে চটাচট

তবে তো মড়া! এ বেটা এখনো তবে মরেনি।

কুমির ভাবিল, কথা বুঝি সত্যি-কান নাই তবু কুমির মাথা ঘুরাইয়া কান নাড়ে, চটচটাচট লেজ আছাড়ে।

দূরে ছিল কতকগুলি রাখাল—

‘ওরে! ওই সে কুমির ডাঙায় এল,
যে ব্যাটা সেদিন বাছুর খেল!’—

কাস্তে, লাঠি, ইট, পাটকেল ধড়াধ্বড় পড়ে—হৈ হৈ রৈ রৈ করিয়া আসিয়া রাখালের দল কুমিরের পিছনে লাগিয়া গেল।

শিয়াল পণ্ডিত তিন ছুটে চম্পট—

‘হোক্কা হোয়া, কুমির মশাই
নমস্কার! এবার পালাই!’

(দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের বানান ও ভাষারীতি অনুসারে)