‘আগেও বলেছি, এখনো বলছি, তুমি চাইলেই ব্লক ছেড়ে বের হতে পারবে না!’
‘দেখো, আমাকে কেউ বেঁধে রাখেনি, চাইলেই বের হতে পারি। কিন্তু এখন হব না। আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। আমি চললাম। কলেজের দেরি হচ্ছে।’
‘ট্রাই করে দেখো।’
‘আমার বয়েই গেছে। ব্লক কর্মকর্তারা আমাকে গেটপাস দেবে না।’
‘উফফ, কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছে না। আমি যতবার ব্লক ছেড়ে বের হওয়ার চেষ্টা করেছি, একটা না একটা বাধা পড়ছেই। কিন্তু মা বলেছে ঠিকই পারব।’
আরিফের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল নিলু। তার তাকানো দেখে মনে হচ্ছে সে প্রমাণ চায় না। সে চায় আরিফ এসব উল্টাপাল্টা কথা বলা বন্ধ করে দিক।
‘আরিফ, তোমার স্কুলের সময় হয়ে গেছে। এই নাও তোমার চকলেট আর ড্রিংকসের ক্যান। ড্রিংকস আমি আর দিতে পারব না। এটা খুব বাজে জিনিস!’
নিলু আরিফের দুই বছরের সিনিয়র। কিন্তু দুজনের বেশ ভাব। আরিফ অঙ্ক আর বিজ্ঞানে ভীষণ ভালো। অনেক বড় বড় ক্লাসের অঙ্ক সে নিমেষে করে ফেলে। মাঝেমধ্যে নিলু ও তার কলেজের অন্যদের অঙ্ক দেখিয়ে দেয়। এ জন্য সবার কাছে আরিফের আলাদা কদর।
‘আজ ক্লাসে যাব না। মা বলেছে ঘুরতে নিয়ে যাবে।’
আরিফের বাবা নেই। অনেক আগেই মারা গেছেন। মায়ের কাছে মানুষ। তার মা আবার কেমিস্ট্রির নামকরা শিক্ষক। মাঝেমধ্যে মা তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। ইদানীং তার কেবলই মনে হচ্ছে মায়ের সঙ্গে অনেক দিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না।
রাস্তা থেকে বাসায় এল আরিফ। মা তৈরিই ছিলেন। আরিফকে দেখেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
‘জলদি তৈরি হয়ে নে।’
‘মা, আমরা কি ব্লকের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করব আজ?’
‘আজ আমরা একটা বিশেষ মিশনে যাব। মিশন ইম্পসিবল হলেও পসিবল করে ছাড়ব। এক মাস ধরে প্ল্যানটা করেছি।’
খুশিতে চকচক করে উঠল আরিফের চোখ।
‘তবে তার আগে কিছু কেনাকাটা করতে হবে।’
আরিফের মনে হলো বাবার অভাবটা পূরণের জন্য মা এ–জাতীয় কথাবার্তা বলছেন। বাবা তাকে নিয়ে প্রায়ই মিশনে যাওয়ার কথা বলতেন। কারও গাছ থেকে চুরি করে বরই পাড়াটাও ছিল বাবার কাছে বিশাল মিশন। আরিফ মাঝেমধ্যে বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করত না।
আরিফ খানিকটা গোঁ ধরার মতো করে বলল, ‘আমি ব্লকের বাইরে যাবই। ব্লক কর্মকর্তারা চাইলেই আমাদের আটকে রাখতে পারবে না। এমন কোনো আইন নেই।’
‘আমাদের মিশন সফল হলেই যেতে পারবি। তবে সেটার জন্য কিছু কাজ করতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। সাহস রাখ। আর চিন্তা কিসের! আমি আছি না!’
‘তুমি তো আর জেমস বন্ড না। তুমি নিলুদের কলেজে রসায়ন পড়াও।’
‘তো কী হয়েছে! ভুলে যাস না, আমি রসায়নে গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্রী! হুঁ!’
আরিফ ভেতরে ভেতরে গর্ববোধ করলেও মুখে খানিকটা বিরক্তি ভাব আনার চেষ্টা করল।
‘কিন্তু এখন যাবটা কোথায়? স্কুলও কামাই হলো।’
‘স্কুল তো মাঝেমধ্যেই ফাঁকি দিস। আজ মায়ের সঙ্গে ঘুরবি। সমস্যা কোথায়! কেউ তোকে বকা দেবে না। ভালো কথা, এই নিলু আবার তোকে পছন্দ–টছন্দ করে নাকি? সারাক্ষণ দেখি তোর জন্য এটা–ওটা গিফট নিয়ে আসে।’
‘আরে নাহ! কী যে বলো। মাঝেমধ্যে চকলেট–টকলেট...।’ লজ্জা পেল আরিফ। হাসলেন মা। কিছু বললেন না। ঝেড়ে–মুছে নিলেন মোটরসাইকেলটা। হেলমেট পরে নিল দুজন। মা তাঁর বড় ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন। এরপর ভোঁ করে নেমে পড়লেন রাস্তায়।
রাস্তায় নামতেই ঝাঁজাল রোদ জেঁকে ধরল। এ রোদ সহ্য করতে পারে না আরিফ। মা তাকে নিজের সানগ্লাসটা পরিয়ে দিলেন।
‘তোমার চোখে রোদ লাগবে না?’
এসব প্রশ্নের উত্তরে সাধারণত মায়েরা কিছু না বলে মুচকি হাসেন। কিন্তু আরিফের মা একটু আলাদা। কড়া টাইপের। ঝাড়ি মেরে বললেন, ‘বেশি পটর পটর করবি না। আমার চোখ নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে।’
আরিফ এদিক–ওদিক দেখছে। দুপাশে শোঁ শোঁ করে অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট চলে যাচ্ছে। একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন মা। কলেজে পড়ানোর পাশাপাশি বাসায় গবেষণাও চালান তিনি। সম্ভবত গবেষণার জন্য টুকটাক জিনিস কিনবেন। আরিফ বাইরে অপেক্ষা করল খানিকক্ষণ। মিনিট দশেকের মধ্যেই মা এলেন।
এমন সময় কোথা থেকে রঞ্জু এসে হাজির। আরিফের সহপাঠী। দুষ্টুমিতে ওস্তাদ। তবে পাকা শিকারি। গুলতি কখনো মিস হয় না।
‘যাচ্ছিস কোথায়?’
‘ব্লক ছেড়ে বের হব আজ, দেখিস।’
‘হুহ। পারবি না বলে দিলাম। হেহে। তবে কোনো কাজে লাগলে ফোন করিস।’
হুট করে আবার গায়েব হয়ে গেল রঞ্জু। মোটরসাইকেল স্টার্ট দিলেন আরিফের মা। দুদ্দাড় করে ছুটে চললেন বিশেষ গন্তব্যে। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে। দুজনে একটা খাবারের দোকানে ঢুকে পড়ল। নুডলস আর লাচ্ছি খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার সময় একবার ব্লকের দেয়ালটা চোখে পড়ল। তাকিয়েই রইল আরিফ। বুঝতে পারলেন মা।
‘আর কয়টা ঘণ্টা সবুর কর, রসুন বুনতে যাচ্ছি।’
‘হাহাহা।’
‘শোন, আমরা এখন যাব একটা পুরোনো ব্লক স্টেশনে। সম্ভবত সেখানে পাহারাদার আছে। তাদের কোনোরকমে কাবু করতে পারলে আরেকটা ঘর পড়বে। সব দেখে এসেছি।’
আরিফ মনে মনে ভয় পাচ্ছে। অ্যাডভেঞ্চার জিনিসটা বইতেই ভালো, বাস্তবে অত মজার মনে হচ্ছে না। তবে মা যতক্ষণ আছেন, ততক্ষণ ভয়ডর নেই।
গাছপালায় ঢাকা একটা এলাকায় এসে মোটরসাইকেল থামালেন আরিফের মা। সামনে পুরোনো আমলের বিশাল বড় একটা হলরুমের মতো বাড়ি। তার দুই পাশেই উঁচু পাঁচিল। এত উঁচু যে কারও পক্ষে বেয়ে ওঠা অসম্ভব। দেয়ালের নিচে দুজন অস্ত্রধারী পাহারাদারও দেখা যাচ্ছে।
‘আমরা কি জেলখানায় আছি নাকি, মা?’
‘অনেকটা তা–ই। তবে বেশিদিন আর থাকতে হবে না তোকে।’
‘এ কারণেই কেউ ব্লক ছেড়ে যেতে পারছে না। কিন্তু মা, তাহলে...আমরা।’
‘তোকে বের করতেই এসেছি।’
‘যদি গুলিটুলি করে বসে!’
‘পটর পটর করবি না। চুপ করে বসে থাক। সব ব্যবস্থা নিয়ে এসেছি।’
মোটরসাইকেলটা নিরাপদ দূরত্বেই আছে। বড় হলরুমের দরজার সামনে থাকা পাহারাদাররা সেটা দেখতে পাচ্ছে না। সামনে অনেক ঝোপঝাড় আর বড় কিছু গাছ।
‘শোন, আমরা এখন যাব একটা পুরোনো ব্লক স্টেশনে। সম্ভবত সেখানে পাহারাদার আছে। তাদের কোনোরকমে কাবু করতে পারলে আরেকটা ঘর পড়বে। সব দেখে এসেছি।’
দুজন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল খানিকটা। দেয়াল থেকে ৩০–৪০ গজ দূরে আছে। ঝোপের আড়ালে। আরেকটু এগোলেই ধরা পড়বে গার্ডের চোখে। মূল দরজার সামনে দুজন। পায়চারি করছে তো করছেই। রোবটের মতো। ঝোলাব্যাগ থেকে দুটো গোলগাল জার বের করলেন আরিফের মা।
‘এটা হলো ক্লোরোফর্ম গ্যাস।’
‘বাহ, নাকের কাছে ধরলেই তো অজ্ঞান হয়ে যাবে ওরা।’
‘গাধা! সিনেমায় যে রকম দেখিস, এটা ওভাবে কাজ করে না। সাধারণ অবস্থায় মিনিটখানেক গিলতে হয় গ্যাসটা। তা না হলে অজ্ঞান হবে না। অবশ্য ডোজটা বাড়িয়ে এনেছি। সরাসরি যদি মাথায় ফেলা যায়, তবে তাড়াতাড়ি কাজ হবে। এখন প্রশ্ন হলো, এগুলো ওদের মুখের ওপর ফাটাব কী করে।’
‘একটা বুদ্ধি আছে। রঞ্জুকে আসতে বলি। ওর গুলতির নিশানা অসাধারণ।’
‘ঠিকাছে ফোন কর।’
ফোন করতেই মেট্রোরেলে চড়ে মিনিট দশেকের মধ্যে হাজির রঞ্জু। এর মধ্যে কাগজে–কলমে মাকে আরও কী কী সব ছক কষতে দেখল আরিফ। তার মানে এই দুই পাহারাদারকে কাবু করার পর আরও কাজ আছে।
‘বান্দা হাজির। বল, কী বাঁদরামি করতে হবে।’
‘এই নে জার দুটো। গুলতি দিয়ে দুই পাহারাদারের মাথা সই করে মারতে হবে।’
‘কিন্তু একজনের মাথায় মারলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন তো টের পেয়ে যাবে।’
এবার বললেন আরিফের মা। ‘আগে একজনের মাথা বরাবরই মারো, বাবা। বাকিটা আমি দেখব। একটা বুদ্ধি আছে আমার।’
মা যতবারই বলেন ‘একটা বুদ্ধি আছে’, ততবারই আরিফ নিশ্চিন্তে শ্বাস ছেড়ে মজার কিছু দেখার অপেক্ষায় থাকে।
নিশানা তাক করল রঞ্জু। মিস হলো না। হেলমেটে বাড়ি খেতেই ছড়িয়ে গেল কাচের ভাঙা টুকরো। রং ও গন্ধহীন ক্লোরোফর্মের অস্তিত্ব টেরই পেল না প্রথম পাহারাদার। তবে মাথা ঘুরে পড়ে যেতেই দৌড়ে এল দ্বিতীয়জন। আরিফ পাশে তাকিয়ে চমকে উঠল। মা নেই!
আরিফের মা ছুটে গেলেন পাহারাদারদের দিকে। দূর থেকে আরিফ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কথাবার্তা। দ্বিতীয়জন অস্ত্র তাক করতেই আরিফে মা হাত তুলে বললেন, ‘আরে আমি একজন ডাক্তার। ওনাকে দেখলাম মাথা ঘুরে পড়ে যেতে।’ মায়ের হাতের পেছনে লুকানো দ্বিতীয় জারটা চোখ এড়াল না আরিফের। এদিকে ভয় পেয়ে রঞ্জুও একদৌড়ে চলে গেল কোথায় যেন।
দ্বিতীয় পাহারাদার কাছে আসতেই আরিফের মা তার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন দ্বিতীয় জারটা।
‘এটা ধরুন। এখানে ওষুধ আছে। সাবধান, যেন না ভাঙে।’
দ্বিতীয় পাহারাদার অস্ত্রটা কাঁধে ঝুলিয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে ক্লোরোফর্মের জার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এই সুযোগ! ধড়াম করে গার্ডের নাক বরাবর ওটাও ফাটিয়ে দিলেন আরিফের মা। পিঠ থেকে রাইফেল বের করার আগেই দ্বিতীয় জনও আছড়ে পড়ল মাটিতে। এবার দৌড়ে এল আরিফ। অস্ত্র সরিয়ে রেখে দুই পাহারাদারকে লুকিয়ে রাখল ঝোপের আড়ালে।
‘মা, তুমি?’
নাক থেকে দুটো ছিপির মতো বের করলেন। এরপর বড় করে দম নিলেন।
‘এতক্ষণ দম আটকে ছিলে!’
কথা বলে আর সময় নষ্ট করলেন না আরিফের মা। এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।
পুরোনো মরচে পড়া বড় লোহার দরজা। তার ওপর আবার বড় একটা পুরোনো আমলের লোহার তালা। গার্ডদের পকেট খুঁজেও চাবি পাওয়া গেল না। এখন উপায়?
ঝোলাব্যাগ থেকে আরেকটা বোতল বের করলেন আরিফের মা। এসবই তবে কিনতে গিয়েছিলেন দোকানে! আরিফ চোখ বড় বড় করে মায়ের কাণ্ড দেখছে। তার মনে হচ্ছে, সে একটা সিনেমা দেখছে। সত্যিকারের সিনেমা!
মোটামুটি বড় মোটা একটা কাচের বোল বের করলেন। মুখে শক্ত ছিপি আটকানো। তার মধ্যে সাদা একধরনের তরল। বোতলের ভেতরটা সাদা গ্যাসে ভর্তি। চটজলদি ব্যাগ থেকে দুই জোড়া গ্লাভস আর চশমা বের করলেন। আরিফকে কিছু বলতে হলো না। ঝটপট সব পরে নিল। কেমিস্ট্রির এসব জিনিসপত্র মানেই ঝুঁকিপূর্ণ জিনিস। নিরাপত্তার জন্য গ্লাভস, চশমা পরতে হয়।
‘এটা হলো লিকুইড নাইট্রোজেন। খুব ঠান্ডা। এতই ঠান্ডা যে এটাতে যদি তুই একটা গাঁদা ফুল এনে দুই সেকেন্ড ডুবিয়ে রাখিস, তবে মনে হবে ওটা কাচের ফুল হয়ে গেছে। হাত থেকে পড়লে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।’
আরিফের মুখ হাঁ হয়ে গেল। এমন ভয়ানক বস্তু মা কী নির্বিকারভাবে বয়ে বেড়াচ্ছেন। কাচের বোলের ছিপিটা খুলতে যাবেন, তার আগে থামলেন। আরিফকে ইশারায় দূরে সরে দাঁড়াতে বললেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরে দাঁড়াল আরিফ। ঘটনা ঘটল বেশ দ্রুত। আরিফের মা নিজে বেশ খানিকটা পিছিয়ে গেলেন। তারপর বোতলটার ঢাকনা খুলেই ভেতরের তরলটা ধীরে ধীরে ঢালতে লাগলেন পুরোনো লোহার তালাটার গায়ে। ধীরে ধীরে পুরো বোতলটাই শেষ করলেন। সাদা ধোঁয়া আর রাসায়নিক বিক্রিয়ার শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আশপাশে আর কোনো শব্দ নেই। বোতলটা শেষ হওয়ার পরই ব্যাগ থেকে দ্রুত হাতুড়ি বের করে জোরসে বাড়ি দিলেন তালায়। দুটো বাড়িতেই কাজ হলো। খসে পড়ে গেল তালার আংটা।
‘ইয়াহু!’
‘চিত্কার পরে দিস। এখনো কাজ বাকি।’
দরজা খুলতেই মাস্ক ভেদ করে বোঁটকা গন্ধ বাড়ি খেল নাকে। যেন কত দিন খোলা হয় না এ দরজা। আরিফের মনে হলো ব্লকটা তৈরির পর থেকে কাউকেই আর বের হতে দেওয়া হয়নি। গোলাকার রুমটার সিলিং অনেক উঁচুতে। ওপরে একটা প্রকাণ্ড ফুটো। সেটা দিয়ে সূর্যের কড়া আলো ঢুকছে ভেতরে। তাতে মোটামুটি আলো পড়ছে চারপাশে। আশপাশে জঞ্জাল ছাড়া আর কোনো জিনিসপত্র দেখতে পেল না।
সময় নষ্ট করতে নারাজ আরিফের মা। দেয়াল হাতড়ে এগোতে থাকলেন। পেয়েও গেলেন দরজাটা। দরজার মেঝে ঘেঁষে বড় একটা তালা ঝুলছে। সেটা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তালাটা ওপরের দিকে ঝোলানো হলে ঝামেলাই হতো।
‘ওটাই?’
‘হ্যাঁরে আরিফ। এটাই শেষ দরজা। এটা ভাঙতে পারলেই...।’ হাসলেন মা। হাসিটা দেখেই মন ভরে গেল আরিফের। দরজায় প্রকাণ্ড তালা ঝুলছে যদিও। কিন্তু তাতে কী! মায়ের নিশ্চিন্ত হাসির কাছে তালার সাইজ কোনো বিষয় না।
‘এত বড় তালা। লিকুইড নাইট্রোজেন তো সব শেষ, মা।’
‘আরে বোকা, আসল জিনিস আছে এখনো।’
‘তোমার এই এক ব্যাগে এত কিছু ধরে কীভাবে!’
‘পটর পটর করবি না। ওই জঞ্জালগুলো জড়ো কর কোনায়।’
হলরুমটা ফাঁকা হলেও এক পাশে অনেক লোহালক্কড়ের জঞ্জাল। মায়ের ইশারায় আরিফ সেগুলো নিয়ে দরজার কাছে রাখতে শুরু করল। যেন অন্য পাহারাদাররা টের পেলে সহজে ভেতরে ঢুকতে না পারে। গমগম শব্দটা কানে এল একটু পর। তার মানে ব্লকের অন্য পাহারাদাররা গাড়ি ছুটিয়ে আসছে। জঞ্জাল টেনে দুজনে মিলে যতটা সম্ভব দরজাটা আটকে দিল।
‘এবার?’
‘এবার তুই ওই জঞ্জালের আড়ালে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাক। সামনের দরজাটা উড়িয়ে দেব।’
ব্যাগ থেকে কতগুলো পলিথিন বের করলেন আরিফের মা।
‘এটা গানপাউডার। দরজাটা উড়ে না গেলেও তোর বের হয়ে যাওয়ার মতো ফোকর একটা তৈরি হবে ঠিকই।’
আরিফ হাঁ করে তাকিয়ে মায়ের কাণ্ড দেখছে। আসলেই যেন অ্যাকশন সিনেমার দৃশ্য।
দেরি করলেন না আরিফের মা। গানপাউডারের দুটো ছোট ছোট ব্যাগ দরজার নিচের দিকে থাকা তালাটার ওপর রাখলেন। আরেকটা ব্যাগ ফুটো করে গানপাউডারের সরু একটা লেজ বের করে আনলেন রুমের মাঝ বরাবর। আরিফ জানে এরপর কী ঘটবে। একপাশে আগুন ধরিয়ে দিলে সেই আগুন গুটি গুটি করে এগিয়ে গিয়ে দরজার কাছে ধুড়ুম করে ফাটবে। হঠাৎ মায়ের চোখ কুঁচকে যেতে দেখল আরিফ। এমন টেনশনের ছাপ আগে দেখেনি ও। ব্যাগ হাতড়ালেন অনেকক্ষণ ধরে। এদিকে পেছনের দেয়ালে ভীষণ জোরে কী যেন ধাক্কা দিচ্ছে। পাহারাদাররা গাড়ি দিয়ে দরজাটা ভেঙে দিতে চাইছে সম্ভবত।
‘কী হলো, মা?’
‘বারুদের লেজে আগুন ধরাব কী দিয়ে! দেশলাই তো আনিনি। ইশ্ বোকার মতো কাজ হয়ে গেল রে।’
আরিফও তার কাঁধের ব্যাগের সব জিনিস বের করল। নাহ, দেশলাই থাকার কথা নয়। আছে কেবল নিলুর দেওয়া কোল্ড ড্রিংকসের বোতল আর একটা চকলেটের বার। সেগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মা। এরপর তাকালেন ছাদের ফুটোটার দিকে। ভেতরে এখনো কড়া সূর্যের আলো পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে একটা আইডিয়া পেয়েছেন মা। বারুদের লেজটাকে বাড়িয়ে নিয়ে গেলেন মেঝেতে সূর্যের রশ্মি যেখানটায় পড়ছে সেদিকে। কিন্তু সূর্যের গরমে তো আগুন ধরবে না। দৌড়ে এসে আরিফের কোল্ড ড্রিংকসের বোতলটা নিলেন। এদিকে দরজা যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়বে এমন দশা। দ্রুত হাতে খুলে ফেললেন চকলেটের মোড়কটাও। আরিফ কিছুই বুঝতে পারছে না। নিজের জামা থেকে এক টুকরো কাপড় ছিঁড়ে তাতে চকলেট মেখে দ্রুত ড্রিংকসের ক্যানের তলার গোলাকার দিকটায় ঘষছেন মা। ঘষতে ঘষতে একদম চকচকে বানিয়ে ফেলেছেন তলাটা। রীতিমতো আয়নার মতো প্রতিফলন হচ্ছে ক্যানের গোলাকার তলানিতে। দ্রুত জঞ্জাল থেকে তুলে নিলেন একটা চিকন তার। ক্যান থেকে পানীয় ঢেলে খানিকটা ভেজালেন তারটাকে। তারপর ওটার এক মাথায় মেখে নিলেন বারুদ। অনেকটা দেশলাইয়ের মতো হয়ে গেল ওটা।
‘এবার সূর্যের আলোতে বোতলের তলানির ফোকাল পয়েন্ট ধরলেই দেখবি আসল জাদু।’
‘ওহ হো! তার মানে এটা এখন আতশ কাচের কাজ করবে!’
সূর্যের আলো বরাবর ক্যানের গোলাকার চকচকে তলাটা ধরলেন মা। ফোকাল পয়েন্ট মানে একটা ছোট্ট সাদা বিন্দু। ভীষণ উত্তাপ ওটার। বারুদ মাখানো তারের টুকরোটা তাতে কয়েক সেকেন্ড ধরতেই আগুন জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সেটা বসিয়ে দিলেন নিচের বারুদের লেজে। ব্যস, হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল আগুন।
বিস্ফোরণ ঘটতেই ওপাশের ধাক্কাধাক্কি থেমে গেল। পাহারাদাররা ভেবেছে ভেতরের লোকজন বুঝি বেঁচে নেই। অবাক হয়ে সামনে তাকিয়ে আছে আরিফ। আর আরিফের মা তাকিয়ে আছেন আরিফের দিকে। সামনে তাকাল আরিফ। ফুটোর ওপাশে ছিমছাম সবুজে ছাওয়া একটা রাস্তা। সূর্যের কড়া রোদ নেই। বিকেলের ম্লান আলো চারদিকে। কোনো মানুষজনও নেই। তবে রাস্তায় একটা লাল–নীল আলো ছড়ানো বল শূন্যে উড়ে বেড়াচ্ছে।
মানসিক ধকল সামাল দিতে ডাক্তার জলদি করে হাসিমুখ করে তাকে বললেন, ‘আরিফ সাহেব, আপনি ছোটখাটো একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছিলেন। মাথায় আঘাত লাগায় ২০ দিনের মতো কোমায় ছিলেন। আপনার তেমন কিছু হয়নি। ঘাবড়াবেন না।’
‘যা আরিফ, দরজা পার হ।’
‘চলো, মা।’
‘নারে, আমি যাব না।’
‘কেন!’
চিত্কার করে উঠল আরিফ।
‘বেশি পটর পটর করবি না। যেতে বলেছি যা! ওই যে দেখছিস লাল–নীল আলোর বলটা নাচছে। ওটার কাছে যা।’
‘কিন্তু মা, আমি তোমাকে ছাড়া যাব না।’
‘উঁহু। তুই একা যাবি। আমি এখানেই থাকব। তুই যেকোনো সময় চাইলে আমার কাছে আসতে পারবি। কেউ বারণ করবে না। এখন দেরি করিস না। দরজা বন্ধ হয়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে।’
অদ্ভুত একটা ব্যাপার টের পাচ্ছে আরিফ। শূন্যে ভাসতে থাকা লাল–নীল বলটা তাকে খুব টানছে। ইচ্ছে করছে এক ছুটে সেটার কাছে গিয়ে ওটা নিয়ে খেলতে। এদিকে মাকে ছেড়ে যেতেও কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। সামনে হাঁটতে শুরু করেছে আরিফ। শেষ দরজাটা পার হওয়ার আগে আরেকবার পেছন ফিরে তাকাল। মা ঘাড় বাঁকিয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন। আরিফ জানে, মায়েরা এভাবে নকল একটা হাসি দিয়ে সব সময় তাকিয়ে থাকেন। নকল হলেও হাসিটা দেখতে ভালো লাগে। চোখ মুছল আরিফ। কিন্তু বুঝতে পারছে না, লাল–নীল আলোটা এভাবে হাতছানি দিয়ে ডাকছে কেন তাকে। শেষ দরজাটা পার হলো আরিফ।
২
‘মা! মা! বাবা ঘুম ভেঙেছে...বাবা ঘুম ভেঙেছে।’
সাড়ে তিন বছরের জারা এখন মোটামুটি পরিষ্কার সব কথা বলতে পারে। তার কথা শুনে ডাক্তার–নার্সসহ যে যেখানে ছিল, সবাই ছুটে এসেছে। চোখ পিটপিট করে তাকিয়েছে আরিফ। যেন কত দিন পর চোখ মেলল। মানসিক ধকল সামাল দিতে ডাক্তার জলদি করে হাসিমুখ করে তাকে বললেন, ‘আরিফ সাহেব, আপনি ছোটখাটো একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছিলেন। মাথায় আঘাত লাগায় ২০ দিনের মতো কোমায় ছিলেন। আপনার তেমন কিছু হয়নি। ঘাবড়াবেন না।’
আরিফ সবাইকে দেখছে। তার স্ত্রী নিলু চোখ মুছতে মুছতে বলছে, ‘আর জীবনে যদি মোটরসাইকেল চালিয়েছ, তাহলে আমিই তোমাকে মেরে ফেলব।’ আরও অনেকেই অনেক কথা বলছে। কারও কথা কানে আসছে না আরিফের। সে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে তার মেয়ে জারার দিকে। জারার হাতে একটা প্লাস্টিকের বল। বলটা থেকে লাল–নীল আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। সেই আলো গিয়ে পড়ছে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সবার মুখে। সেই ভিড়ে শুধু একজন নেই। তিনি মারা গেছেন বছর দশেক আগে।