সমস্যায় গুড্ডুবুড়া সমাধানেও গুড্ডুবুড়া

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

গুড্ডুবুড়া মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে গ্রামে। এর আগে কখনো সে গ্রামে যায়নি।

বাস থেকে নেমে একটা বেবিট্যাক্সি ভাড়া করে তারা পৌঁছাল কুসুমপুর গ্রামে।

এটা গুড্ডুবুড়ার নানির বাড়ি। তার মায়ের ফুফুর বাড়ি।

বেবিট্যাক্সি বাড়ি পর্যন্ত গেল না। কাঁচা রাস্তা। বর্ষার পানিতে একটা জায়গা ভেঙে গেছে। তারা বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে প্রায় সিকি মাইল হাঁটতে লাগল।

প্রথমেই বাবা বললেন, গুড্ডুবুড়া, এই যে দেখছ, এটা হলো ধানখেত। ওই গাছগুলো ধানগাছ।

গুড্ডুবুড়া বলল, ধানগাছে কী ফল হয়?

বাবা বললেন, ধানগাছে ধান হয়। গুড্ডুবুড়া, আমগাছে আম হবে, কাঁঠালগাছে কাঁঠাল হবে, ধানগাছে ধান হবে, তাই কি নিয়ম নয়? এটা কি একটা জিগ্যেস করার মতো প্রশ্ন?

গুড্ডুবুড়া বলল, তাহলে চালের গাছ কোনটা?

বাবা বললেন, ধান থেকেই চাল হয়।

গুড্ডুবুড়া বলল, আর চাল থেকে ভাত হয়। তাই না বাবা?

ঠিক বলেছ। এই তো আমার ছেলের মাথায় বুদ্ধি হচ্ছে।

গুড্ডুবুড়া তার বাবার হাত ধরে হাঁটছে। বাবার কাঁধে একটা ব্যাগ। মায়ের হাতেও একটা বোঝা।

গুড্ডুবুড়া বলল, বাবা, টাকা কোন গাছ থেকে হয়, আমি জানি।

বাবা বললেন, কোন গাছ থেকে?

মানিপ্লান্ট থেকে।

বাবা বললেন, না বাবা, ওইটা শুধু ওই গাছটার নাম। মানিপ্লান্টে কোনো ফলই ধরে না।

গুড্ডুবুড়া বলল, বাবা, ধানগাছ না লাগিয়ে ভাতগাছ চাষ করা যায় না?

বাবা বললেন, না, যায় না।

চালগাছ লাগানো যায় না?

না যায় না।

বাবা, এইটা কী গাছ?

এইটা পানগাছ?

পানগাছে পান ফল হয়, তাই না বাবা।

পানের ফল হয় না বাবা। পানের পাতা হয়।

বাবা, এইটা কী গাছ?

এটা জবা ফুলের গাছ?

বাবা, জবা ফল হয় না?

না বাবা, আমি তো দেখি নাই। জানি না।

বাবা, এটা কী?

মুরগি।

বাবা, তার সঙ্গে ছোট ছোট হলুদ এগুলো কী?

মুরগির বাচ্চা!

মুরগির বাচ্চা কী করে হয়?

মুরগি ডিম পাড়ে। ডিমের ভেতরে বাচ্চা হয়।

গুড্ডু হাসে। আমি জানি। আমি ছড়া পড়েছি—হাট টিমা টিম টিম/তারা মাঠে পাড়ে ডিম/তাদের খাড়া দুটো শিং। বাবা, মুরগি কি মাঠে ডিম পাড়ে?

না। মাঠে পাড়ে না। মুরগির বাসা আছে। সেখানে পাড়ে।

বাবা, তাহলে গরু মাঠে ডিম পাড়ে, তাই না বাবা।

না, গরু ডিম পাড়ে না।

কিন্তু গরুর তো শিং আছে বাবা।

তা আছে।

তাহলে তারা মাঠে ডিম পাড়ে না কেন?

বাবা কী বলবেন, ভাবছেন। এই সময় একটা বিড়াল তাদের সামনে এসে পড়ল। মিউ মিউ...

গুড্ডুবুড়া বলল, এইটা বিড়াল। তাই না বাবা।

হ্যাঁ। এটা বিড়াল।

গুড্ডুবুড়া তার মায়ের ফুফুর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল। ইটের ঘর। ওপরে টিন।

নানি বেশ বয়স্ক মানুষ। তিনি তবু হাঁটাচলা করতে পারেন। তিনি নিজে এলেন এগিয়ে। সঙ্গে গুড্ডুবুড়ার একজন মামি এলেন হাসিমুখে। তাদের ঘরে বসতে দেওয়া হলো। গ্রামে বিদ্যুত্ও আছে। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে।

গুড্ডুবুড়ার সমান একটা মামাতো ভাইও জুটে গেল। তার নাম রাঙা।

রাঙা গুড্ডুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গ্রাম দেখাতে।

তারা প্রথমে গেল পেছনের সবজিখেতে। পাকা পাকা টমেটো গাছে ঝুলছে। একটা টমেটো গুড্ডুর হাতে দিয়ে রাঙা বলল, খাও।

গুড্ডু বলল, ছালটা ছিলে নিতে হবে না।

রাঙা হাসল। না না। টমেটো ছালসহ খেতে হয়। এভাবে। সে নিজে একটা টমেটো পেড়ে নিয়ে এক কামড় খেয়ে দেখাল।

গুড্ডুও কামড় দিল। মুখের ভেতরে টমেটোর বিচি। সে বলল, বিচি কী করব?

রাঙা বলল, খেয়ে ফেলো।

রাঙাও গুড্ডুবুড়ার সমান। বয়স ছয় কি সাত। তার পরনে হাফপ্যান্ট। গায়ে একটা নীল রঙের টি-শার্ট। পায়ে স্যান্ডেল।

গুড্ডু কিছুই খেতে চায় না। অতি কষ্টে টমেটোতে আরেকটা কামড় দিল সে।

এরপর তারা গেল একটা বরইগাছের নিচে। কতগুলো বড় বড় লাল পাকা বরই একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পাড়ল রাঙা। তারপর গুড্ডুবুড়াকে দিয়ে বলল, খাও।

গুড্ডু বলল, এই ফলের ছাল ছিলে দাও।

রাঙা হাসল। বলল, বরইয়েরও ছাল ছিলতে হয় না।

গুড্ডুবুড়া বরইটা বিচিসহ খেয়ে ফেলল।

রাঙা বলল, বরইয়ের বিচি কই?

গুড্ডুবুড়া বলল, টমেটোর বিচির মতো খেয়ে ফেলেছি।

রাঙা বলল, সর্বনাশ! এখন তো তোমার পেটে বরইয়ের গাছ হবে। তোমার মাথা ফুঁড়ে বরইয়ের গাছ বের হবে।

গুড্ডুবুড়া কাঁদতে লাগল।

তাকে তার মা-বাবার কাছে নিয়ে এল রাঙা। রাঙা হাসে। গুড্ডুবুড়া কাঁদে।

বাবা বলেন, কী হয়েছে?

গুড্ডুবুড়া বলে, আমি বরইয়ের বিচি খেয়ে ফেলেছি। আমার পেটে বরইয়ের গাছ হবে। মাথা ফুঁড়ে বরইয়ের গাছ বের হবে।

সবাই হাসে। কিন্তু গুড্ডুবুড়া কাঁদতেই থাকে।

এখন কী করা যায়!

গুড্ডুবুড়া রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারল না। ঘুমের মধ্যেও সে কাঁদে। আমার মাথা দিয়ে বরইয়ের গাছ বের হবে।

গুড্ডুবুড়ার মা-বাবার বেড়ানোর শখ মিটে যাওয়ার জোগাড়।

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

তখন রাঙা বলল, গুড্ডুবুড়া আসো। তোমার পেটের বিচি বের করে দিই। তোমার পেটের বিচি বের করব তোমার কান দিয়ে।

রাঙা একটা বরইয়ের বিচি আগে থেকেই তার ডান হাতটা ভাঁজ করে কনুইয়ের ফাঁকে রেখে দিল। তার হাতটা ত্রিভুজের মতো হয়ে রইল বটে। তবে বাইরে থেকে বিচি দেখা যাচ্ছে না।

সে গুড্ডুবুড়াকে বলল, দেখো তো আমার হাতে কিছু আছে?

নাই।

এবার তোমার কানে এই যে আমি হাত দিলাম।

বলে সে ডান হাত ঝাড়ল। অমনি কনুইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা বিচিটা ধপাস করে পড়ল ঘরের মেঝেতে।

এই যে তোমার বিচি। নাও, আর তোমার পেটে গাছ হবে না।

গুড্ডুবুুড়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

গুড্ডুবুড়ার বাবা-মা অনেক লজ্জা পেলেন ছেলের বোকামিতে। ঢাকায় ফিরেই তাকে নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে।

ডাক্তার সব দেখেশুনে বললেন, আপনার ছেলের সব ভালো। কিন্তু সে ঠিকভাবে খায় না। তাকে খেতে হবে। তাকে ভাত খেতে হবে, মাছ খেতে হবে, ডিম খেতে হবে, দুধ খেতে হবে, শাক খেতে হবে, ফল খেতে হবে, মিষ্টি খেতে হবে।

গুড্ডুবুড়া ঠিকঠাক খেতে শুরু করল।

কিছুদিনের মধ্যেই সে হয়ে উঠল ক্লাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলে।

তাদের স্কুলের ভেতরে একটা ট্রাক ঢুকেছে। সেই ট্রাকে করে আনা হয়েছে স্কুলের লোহার গেট। বেশ তোরণ মার্কা গেট। দুই দিকে পিলার, ওপরে একটা আর্চ। তাতে লেখা মেধা বিকাশ কিন্ডারগার্টেন।

আগামীকাল স্কুলে আসবেন শিক্ষামন্ত্রী। তাঁর সম্মানে এই গেট। গেটের পাশে একটা শ্বেতপাথরে লেখা থাকবে ‘তোরণ উদ্বোধন করেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী।’

ট্রাকটা যেখানে রাখা সেখানেই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অ্যাসেম্বলি হয়। আজ হতে পারল না।

পরের দিন সকালে সবাই তাড়াতাড়ি ভালো কাপড়চোপড় পরে এসেছে স্কুলে।

প্রিন্সিপাল স্যার চিত্কার-চেঁচামেচি করছেন। সরাও ট্রাক। এখানে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় ফ্লাগস্ট্যান্ডে দাঁড়াবেন। তিনি পতাকা তুলবেন। স্টুডেন্টরা সবাই স্যালুট করবে।

ট্রাকওয়ালা বলল, স্যার, একটা ভুল হয়ে গেছে, গেটের মাপটা একটু ছোট। ট্রাকটা আর বের হতে পারছে না। এক ইঞ্চিমতো আটকে যায়। পুরো গেটটা আবার খুলতে হবে। ট্রাক বের হবে। তারপর আবার লাগাব।

প্রিন্সিপাল স্যার কেঁদে ফেললেন। গেট খুললে শিক্ষামন্ত্রী উদ্বোধন করবেন কী?

তাহলে স্যার ট্রাকটা থাকুক। উনি চলে গেলে তখন গেট খুলে ট্রাক বের করা যাবে।

প্রিন্সিপাল স্যারের কান্না আরও বেড়ে গেল। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এসে দেখবেন পতাকাস্ট্যান্ডের সামনে একটা ট্রাক!

মহাসমস্যা। মহাসমস্যা।

এই সময় গুড্ডুবুড়া এগিয়ে এল। স্যার, এই সমস্যার একটা সমাধান আমি বাতলাতে পারব।

সবাই তাকালেন। সব স্যার, ম্যাডাম। গুড্ডুবুড়া আজকাল খুব বুদ্ধিমান হয়েছে। সে পারতেও পারে।

সে বলল, মাত্র এক ইঞ্চি তো। এটা কোনো ব্যাপারই না।

ফিজিক্যাল ট্রেনিং স্যার বললেন, হাতুড়ি-শাবল এনে গেটের নিচের রাস্তার পিচটা তুলে ফেললেই হয়।

গুড্ডুবুড়া বলল, না স্যার, এত কষ্ট করতে হবে না। ট্রাকের চাকার পাম্প ছেড়ে দেন। এতে ট্রাকটা দুই ইঞ্চিরও বেশি নিচু হয়ে যাবে। তারপর ট্রাকটা চালিয়ে গেটের বাইরে নিয়ে গিয়ে চাকা বদলে ফেললেই হবে।

আহ! গুড্ডুরে, তুই আমাকে বাঁচালি রে। প্রিন্সিপাল স্যার গুড্ডুকে কোলে তুলে নিলেন।

ট্রাকের চাকাগুলোর হাওয়া ছেড়ে দেওয়া হলো। অর্ধেকটা পরিমাণে ছাড়তেই ড্রাইভার বলল, চলব।

ট্রাকটা বেরিয়ে গেল স্কুলের মাঠ থেকে।

খানিকটা দূরে গিয়ে সেটা দাঁড়াল একটা গাড়ির চাকার হাওয়া দেওয়ার দোকানে।

স্কুলের মাঠ পরিষ্কার। একটু পরে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় আসবেন।

তাঁকে মালা দেওয়া হবে। সেটা দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছে গুড্ডুবুড়ার ওপর।