সমান্তরাল

এক.

তিন শ চৌদ্দ বছর পর মাউন্ট লুকানাস জেগেছে।

অরিত্র ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল, লুকানার প্রতিদিনের ঝকঝকে নির্মল আকাশ আজ কালো হয়ে গেছে ধোঁয়ায়। সুনসান নির্জন রাস্তায় টানা সাইরেন বাজছে। অন্ধকারে ভূতের চোখের মতো জ্বলছে লালচে এলইডি আলোগুলো। পুরো শহর জনমানবহীন। এমনকি কোনো যানবাহনও নেই। কী আশ্চর্য! অরিত্র বিষয়টা জানতে পারেনি কেন? সে কি ঘুমিয়ে ছিল এতক্ষণ? শহরের সবাই কি চলে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে? কী মুশকিল! ওর কথা কেউ ভাবেইনি!

অবশ্য কেই-বা ভাববে। এবার মনে পড়ে অরিত্রের। রেডক্রাফটে অরিত্রের কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। ইচ্ছা করেই সে কোনো বন্ধু বা সঙ্গী প্রোগ্রাম করেনি। সে এখানে একা থাকতে ভালোবাসে। মাউন্ট লুকানাসের পাদদেশে দারুণ সুন্দর আর সবুজ এক শহর লুকান সিটি। শহরের পেট চিরে চলে গেছে একটা শীর্ণ নদী, নদীটার নাম করোয়া। কাকের চোখের মতো টলটলে পরিষ্কার পানি করোয়ার। অরিত্রর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ১০ মিনিটের হাঁটাপথ নদীটির। তার ওপর এক কাঠের ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সে প্রতিদিন নদীর জলে স্যামন মাছ আর কাঁকড়াদের খেলা দেখে। মাঝেমধ্যে এক-দুই মুঠো গম ছড়িয়ে দেয় ব্রিজের পাশে পায়রাদের দিকে। করোয়া নদীতে শহরের শৌখিন মৎস্যশিকারিরা বড়শি ফেলে ঠায় বসে থাকে। তাদের দু-একজন কখনো তাকে দেখে হাত নাড়ে, অরিত্রও হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর জানায়। এসব ক্ষেত্রে কটা মাছ উঠল বা আজকের ভাগ্য কেমন—এসব জিজ্ঞেস করা দস্ত্তর। কিন্তু প্রতিবেশীরা জানে যে অরিত্র স্বল্পভাষী। এ ছাড়া রেডক্রাফটে সবাই যে যার মতো চলে। অন্যকে নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।

শেষ বিকেলে সূর্য হেলে পড়তে শুরু করলে অরিত্র ঝিরঝিরে মিষ্টি বাতাস কেটে কেটে ধীরপায়ে বাড়ি ফিরে আসে একা একা। ভারী ভালো লাগে এই জীবনটা। এই একাকিত্ব, নির্জনতা। এই নিজের মতো করে ডুব মেরে থাকাটা। কিন্তু আজ তার একটু ভয় লাগতে শুরু করল। এই ছোট্ট শহরের অধিবাসী সংখ্যায় খুবই কম। মাঝেমধ্যে সকালবেলা প্রতিবেশী এক বুড়িকে বাগানে নিড়ানি দিতে দেখা যায়। কিন্তু ওদিকে তাকিয়ে আজ কাউকেই দেখতে পেল না অরিত্র। বুড়ির বাগানটাও সুনসান। অরিত্র একটু ঘাবড়ে গিয়ে ঘরে ফিরে গোটানো স্ক্রিন খুলে খবর চালু করল। সচরাচর ওর কোনো সংবাদের প্রয়োজন হয় না বলে স্ক্রিনটা ভাঁজ করে এক কোণে ফেলে রেখেছিল। অবাক ব্যাপার, স্ক্রিনটা ঝিরঝির করছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। রেডক্রাফটে ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র কখনো অকার্যকর হয় না। অরিত্র তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এল আবার। বিষয়টা ভালো করে বুঝতে হবে।

বাতাসে একটা গরম হলকা। হলকাটা উত্তরে মাউন্ট লুকানাস থেকেই আসছে। অরিত্র হাঁটা শুরু করল পূর্বদিকে। ওদিকে বেশ খানিকটা হাঁটলে ওর একটা খামার আছে। খামারে গরু, ভেড়া আর হাঁসের সঙ্গে আছে ওর কয়েকজন মব। যদিও এরা কখনো কথাবার্তা বলে না। কেবল নীরবে কাজ করে যায়। অনেকটা রোবটের মতো—তবু ওখানে গেলে একটা সুরাহা পাওয়া যেতে পারে।

অরিত্র জোরে জোরে হাঁটতে থাকল প্রবল বাতাসের ভেতর দিয়ে। খামারের কাছাকাছি পৌঁছাতে হঠাৎ পায়ের নিচে দুলে উঠল পৃথিবীটা। ভূমিকম্প! অরিত্র এবার প্রায় ছুটতে লাগল। ছুটতে গিয়েই কিনা জানে না, খেয়ালই করেনি পাশ দিয়ে হুস করে চলে গেল একটা রেডকার্ট। কার্টে টুপি পরে কে যেন বসেছিল, তা-ও বোঝা গেল না। খেয়াল হতে আবার পেছন ফিরল অরিত্র। খানিকটা দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলল কার্টটা। ‘এই যে স্যার, শুনছেন। এই যে!’, চেঁচিয়ে উঠল সে। ওর চিৎকার শুনে কার্টটা থামল। সিটের ওপর বসা কানা টুপি পরা বুড়োটা পেছন ফিরে তাকিয়ে সবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘তুমি কে হে? এখনো এখানে কী করছ? পালাও।’

‘কিন্তু স্যার’, অরিত্র হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘আসলে হয়েছেটা কী? হঠাৎ করে লুকানাস খেপে উঠল কেন? কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।’

বুড়োটা মাথা নাড়ল গম্ভীরভাবে, ‘হুম। মোটেও কথা ছিল না। নিশ্চয় কোথাও কোন ঝামেলা হয়েছে। প্রোগ্রাম হ্যাক হয়েছে। লুকানাসকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ওর পেটের ভেতর টগবগ করছে গরম লাভা। অনেকবার উৎস বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেও কিছু হয়নি। এমনটা চলতে থাকলে আর ১ ঘণ্টা ২৭ মিনিটের মাথায় লুকান সিটি তরল গরম লাভার নিচে তলিয়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সবকিছু। টের পাচ্ছ না মাঝেমধ্যে ভূমিকম্পও হচ্ছে?’

‘তাহলে এখন কি আর কিছুই করার নেই?’, অরিত্রর গলা চাপা পড়ে গেল একটা বিকট গর্জনে। আর বিরাট বড় একটা আগুনের পিণ্ড উড়ে এসে পড়ল ওর অনেকখানি পেছনে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে গেল ওদিকটায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরিত্র, ‘ওর খামারটা বুঝি পুড়ে ছাই!’

চোখ থেকে কাল চশমা খুলল এবার বুড়োটা। একটু নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল, ‘উপায় একটা আছে। সেটাই করতে যাচ্ছি আমি। সব প্রোগ্রাম ঘেঁটে জানলাম লুকানাসের একেবারে উৎপত্তিস্থলে মানে জিরো পয়েন্টে একটা অবসিডিয়ান ব্লক ছুড়ে দিতে হবে। তাহলেই অনেকটা চুপসে যাবে আগ্নেয়গিরিটা। তারপর বেশ খানিকটা সময় পাওয়া যাবে প্রোগ্রামটা ঠিকঠাক করার জন্য। সমস্যাটা হলো শহরের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বোকাসোকা শেরিফকেও না। একা একসঙ্গে দুটো কাজ কীভাবে করা সম্ভব?’

অরিত্র লাফিয়ে উঠে পড়ল কার্টটায়, ‘একা কেন স্যার? আমি তো আছি। আমার মনে হচ্ছে আমার যেন জন্মই হয়েছে এ রকম একটা মহান কাজ করার জন্য। উফ্। এত দিনে আমি মনের মতো একটা কাজ পেলাম স্যার। বেশ, এবার চটপট প্ল্যানটা করে ফেলা যাক। অবিসিডিয়ান ব্লকের ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। আর আপনি আমার বাড়ি মিকি’স ডেনে গিয়ে সুপার কম্পিউটার নিয়ে বসুন। বদমাশ হ্যাকারটাকেই হ্যাক করে ফেলুন। অথবা ওকে নিষ্ক্রিয় করা কোনো বিকল্প উপায় বের করুন।’

অরিত্রর কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল বুড়োটা। তারপর ধীরে ধীরে মুখ খুলল, ‘আমার মনে হয় আমি তোমাকে চিনতে পারছি। তুমি হলে লুইজির অনুসারী। এ রকম একটা পরিস্থিতির জন্য লুইজি তোমাকে তৈরি করেছিল। হ্যাঁ, মনে পড়ছে এক দিন পাবে বসে এমন একটা ছেলের কথা বলছিল লুইজি। ওয়েল, আমার নাম রিগান, লুইজির বন্ধু। তুমি?’

এ কথায় রোমাঞ্চিত হলো অরিত্র। লুইজি কে, কীভাবে তাকে চেনে এসব বৃত্তান্ত রহস্যময় হলেও তা পরে শোনা যাবে। এখন মোটেও সময় নেই। কাজে নেমে পড়তে হবে তাকে। সে হাত বাড়িয়ে দিল রিগানের দিকে, ‘আমি অরিত্র। চলুন তবে কাজে নেমে পড়ি। অবসিডিয়ান ব্লকটা কীভাবে প্রোগ্রাম করতে হবে বলে দিন।’

রিগান বলল, ‘অলরেডি আই হ্যাভ স্টার্টেড দ্য প্রোগ্রাম। এটাও লুইজিরই ডিজাইন করা। কিন্তু লুইজি যে অবসিডিয়ান ব্লকটা তৈরি করেছিল, তা কোথায় রেখেছে কেউ জানে না।’

‘অবসিডিয়ান ব্লকটা কী জিনিস স্যার?’, অরিত্র জিজ্ঞেস করে।

বুড়ো রিগান গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করে, ‘প্রাচীনকাল থেকেই আগ্নেয়গিরিকে থামানোর নানা চেষ্টা করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। তার কোনোটাই পুরোপুরি সফল হয়নি। এর মধ্যে জ্বালামুখের মধ্যে পানি বা বরফ ঢালা থেকে শুরু করে ভেতরে বোমা পর্যন্ত ফেলা হয়েছে। সাধারণভাবে গরম তরল লাভা যেখানে গিয়ে ঠান্ডা হয়ে জমে যায়, সেখানে কিছু বিশেষ ধরনের পাথর পাওয়া যায়। এর নাম অবসিডিয়ান ব্লক। এগুলো উচ্চমাত্রার তাপ সহনশীল। কিন্তু লুইজির ব্লকটা আরও বেশি কিছু। এর একটা বিশেষ তড়িৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করার ক্ষমতা আছে। জ্বালামুখের ভেতর ফেলে দিলে ওটা নিজে কখনো গলে যাবে না, কিন্তু একটা ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করে জায়গাটার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে। ফলে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসবে ভেতরটা। আর জমে কঠিন হয়ে যাবে লাভা।’

‘বেশ চমৎকার ব্যাপার তো!’ অরিত্র রীতিমত চমৎকৃত।

রিগান অবশ্য এখনো সন্দিহান, ‘কিন্তু ওটা নিয়ে লুকানাসের পেটের ভেতর ঢুকবে কীভাবে? কাজটা বিপজ্জনক অরিত্র।’

অরিত্রর মুখ উজ্জ্বল দেখায়, ‘ও নিয়ে মোটেও ভাববেন না স্যার। জলদি আমার খামারে চলুন। আমার একটা উড়ন্ত শিপ আছে। ওটাকে শিগগির গ্যারেজ থেকে বের করে চালু করতে হবে। জলদি করুন, স্যার। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

 দুই.

 ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে অরিত্র। এই, ক্লাসে যাবি না? নয়টা বাজে। অরিত্র, এই অরিত্র।’

মায়ের চেঁচামেচিতে চোখ খুলে তাকাল অরিত্র। মাথার ওপর ফ্যানটা ঘুরছে। ওপাশে চিরচেনা সবুজ পর্দা, দুলছে বাতাসে। বিছানায় আর মেঝেতে পড়ে রয়েছে কয়েকটা বই, সিডি। আর মুখের ওপর ঝুঁকে বকেই চলেছেন মা, ‘কী ছাইপাঁশ সব বিছানার মধ্যে,’ মায়ের হাতে অরিত্রর হেডফোনটা, ‘এগুলো মাথায় লাগিয়ে ঘুমাস কেন? মাথা ভোঁ ভোঁ করবে। আর ওই বিচ্ছিরি খেলনাটা—ওটা ছাড়া তোর জীবন চলে না বুঝি? ওঠ এবার।’

অরিত্র হতাশ ভঙ্গিতে উঠে বসে। কী মোক্ষম সময়েই না মা হেডফোনটা খুলে ফেলেছে। কত বড় ক্ষতি যে হয়ে গেল! রিগান এখন একা কীই-বা করতে পারবে! হাতে সময় আছে মোটে ১ ঘণ্টা ২৭ মিনিট। অরিত্র মন খারাপ করে বাথরুমে ঢুকল। ইচ্ছা করে একটু বেশি সময় নিল, যেন মা এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মায়ের গলা এখনো শোনা যাচ্ছে, ‘কী অবস্থা ঘরটার। কী ছিরিছাঁদ। ছি। আর ওই গেমগুলো। ওগুলো যদি আমি ডাস্টবিনে না ফেলেছি।’

অনেকক্ষণ গজ গজ করার পর মায়ের কণ্ঠস্বর থামলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল অরিত্র। মা আবার এই ঘরে ঢুকে পড়ার আগেই ক্রাফটপ্যাড নিয়ে ছাদে চলে যেতে হবে। আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে ফিজিকসের, চুলোয় যাক ফিজিকস। ওর প্রিয় শহর লুকানকে সে কিছুতেই ধ্বংস হতে দিতে পারে না। কিন্তু বাথরুম থেকে বেরিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে অরিত্র। মা সত্যি সত্যি ক্রাফটপ্যাডটা নিয়ে গেছে। সর্বনাশ! এখন কী হবে?

নাশতার টেবিলে বসে দ্রুত চিন্তা করছে অরিত্র। যেভাবেই হোক রিগানকে সাহায্য করতে হবে। মাকে পটাতে হবে তার আগে। তবে মা একবার রেগে গেলে সর্বনাশ। ওহ, ওর মা যদি রেডক্রাফটে ওর মবগুলোর মতো হতো, যাদের ইচ্ছেমতো চালানো যায়!

‘চুপচাপ খেয়ে ক্লাসে যাবে,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলছে মা, ‘হ্যাঁ, তোমার খেলনাটা আমার কাছেই আছে। দুদিন পর দেব। এগুলো বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে শুনেছি। সেদিন টিভিতে বলছিল এই খেলাটা নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। অনেকে ভয়ংকর সব বিপদের মুখোমুখি হয়েছে এগুলোর ভেতর। আমিও তা-ই মনে করি। এগুলো নিষিদ্ধ করাই উচিত।’

মুখ নিচু করে খেয়ে চলে অরিত্র, ‘মা, ঠিক আছে। নিষিদ্ধ হলে তো আর খেলতে পারব না। তার আগ পর্যন্ত ওটা আমার কাছেই থাক।’

‘না,’ চিৎকার করে ওঠে মা।

‘মা প্লিজ।’, অনুনয় করে অরিত্র। এই প্রথম সে একটা বীরত্বের প্রমাণ দিতে চলেছে। ওর এই নিঃসঙ্গ, বিরক্তিকর আর নিরানন্দ জীবনে এই প্রথম একটা বিশাল ঘটনা ঘটতে চলেছে। আর সেই ঘটনার কিনা একজন মূল নিয়ন্ত্রক সে নিজে। অথচ মা ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতেই পারছে না।

অরিত্রর করুণ মুখটার দিকে তাকিয়ে জেবার একটু মন নরম হলো। বাবাহীন ছেলেটা। সেই ছোটবেলা থেকেই নিঃসঙ্গ আর চুপচাপ। কোনো বায়না নেই, কোনো শখ-আহ্লাদ নেই। কেবল সারা দিন মুখ বুজে পড়ে থাকে প্রোগ্রামিংয়ে। আর এই নেশাটা ধরিয়ে দিয়েছে ওর শিক্ষক ডেভিড স্যার। সারা দিন দুজনে মিলে কী যে গুজগুজ করতে থাকে ওই ঘরে। জেবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ছেলেটাকে প্রায়ই তিনি বুঝতে পারেন না পুরোপুরি। মনে হয়, সে যেন এই জগতের হয়েও এই জগতের নয়। অনেক দূরের কেউ।

অরিত্র গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেলে জেবা অনেক দিন পর ডিজিটাল অ্যালবামটা নিয়ে বসলেন। অরিত্রর বাবাও এ রকমই একটু পাগল পাগল ছিলেন। বিজ্ঞানীর সঙ্গে সংসার করার স্বাদ তো জেবা আগেই পেয়েছেন। দিনমান কী এক নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরির নেশা পেয়ে বসেছিল তাকে। ল্যাব থেকে বেরোতেই চাইত না। আর বলত সব আজগুবি কথাবার্তা। বুঝলে জেবা, ‘একজন মানুষের নিউরন গুচ্ছেরই এত অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। তাহলে বলো তো, অনেকের নিউরন একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করলে কী অভাবনীয় কাণ্ড ঘটতে পারে। মানুষে মানুষে একটা সুশৃঙ্খল নিউরাল নেটওয়ার্ক একদিন আমি ঠিকই তৈরি করে ফেলব। সেদিন মানুষ হয়ে উঠবে অসম্ভব ক্ষমতাধর। ধরো অনেকগুলো মানুষের নিউরন একসঙ্গে ইচ্ছা করলে একটা গ্রহের অবস্থান পর্যন্ত টলিয়ে দিতে পারে। কিংবা পারবে প্রয়োজনে বৃষ্টি নামাতে, থামিয়ে দেবে সাগরের তুফান।’

জেবা তার অর্ধেক কথাই বিশ্বাস করতেন না। পাগলের প্রলাপ বলেই ধরে নিতেন। কারণ তাদের পারিবারিক বন্ধু ডা. নিয়াজ প্রায়ই বলতেন, ‘ওর মাথাটা আসলে একদম গেছে ভাবি। কিছু করার নেই। বিজ্ঞানীরা এ রকমই হয়। মেনে নিতে হবে আপনাকে।’

জেবা মেনেই নিয়েছিলেন। অরিত্রর বাবা সারা দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। আর রাতভর পড়ে থাকতেন ল্যাবে। অঙ্ক কষতেন, নেটওয়ার্কিং করতেন, প্রোগ্রাম করতেন। কী করে যে সংসারটা চলত, সে কেবল জেবাই জানেন। কিন্তু জেবা বা ডা. নিয়াজ যা ভেবেছিলেন, তা ঠিক নয়। অরিত্রর বাবার গবেষণার মধ্যে সত্যি কিছু একটা ছিল। নয়তো সায়েন্স কাউন্সিলের মতো অভিজাত আর উচ্চমানের কতৃ‌র্পক্ষ ওকে ডেকে পাঠাবে কেন। পৃথিবীতে ওদের ওপর কোনো কথা বলে, এমন একটি প্রাণীও নেই। তাই সায়েন্স কাউন্সিল যেদিন অরিত্রর বাবাকে নিতে শিপ পাঠাল, সেদিন অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি জেবা। অরিত্রর বয়স তখন মাত্র আট।

অরিত্রর বাবাকে হারানোর পর থেকে বড় বেশি সাবধান হয়ে উঠেছেন জেবা। একমাত্র ছেলেকে আর কিছুতেই চোখের আড়াল হতে দেন না। সারাক্ষণ আগলে রাখতে চান। এই ব্যাপারটা যে ছেলের পছন্দ নয়, তা বেশ বুঝতে পারেন তিনি। কিন্তু কী করবেন! ছেলেও যে হয়েছে বাবার মতো। ডেভিড স্যারের উসকানিতে সারা দিন পড়ে আছে রেডক্রাফট নামের এই অদ্ভুত প্রোগ্রামের মধ্যে। একই সঙ্গে সে দুটো ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন জগতে নাকি অবস্থান করতে পারে। ডেভিড স্যারও ওরই মতো পাগল, ‘বুঝলেন ম্যাডাম। আপনার জীবন হচ্ছে তা-ই, যেভাবে আপনি নিজেকে দেখতে চান। ধরুন, আপনি চান অরিত্রর বাবা বিজ্ঞানী না হয়ে একজন খামারের মালিক হলে ভালো হতো। আপনাদের একটা বড় খামার থাকত। গরু, ভেড়া বা হাঁস পুষতেন ওতে। আপনাদের একান্ত অনুগত কয়েকটা লোক থাকত ওখানে। প্রতিদিন কাজ শেষে আপনার দুজন গ্রামের শেষ মাথায় নদীর ধারে বেড়াতে যেতেন। হ্যাঁ, আপনি যা চান, তেমনটাই হতে পারে। আপনিই তৈরি করে নেবেন জীবনটাকে ওভাবে। না, ভাচু‌র্য়াল কোনো জীবন নয়। একেবারে সত্যিকারের জীবনই।’

শুনতে শুনতে জেবা প্রায় মুগ্ধ হয়ে যান মাঝেমধ্যে। আহা, এমন একটা জীবন যদি তিনি পেতেন! কিন্তু এই বিজ্ঞান জিনিসটাকে আজকাল তিনি ঘৃণাই করতে শুরু করেছেন। এসব নিয়ে আবার নতুন কোনো ঝামেলা হোক তা তিনি চান না। অরিত্রকে তিনি কোনো রকম ঝুঁকির মধ্যে কিছুতেই দেখতে চান না। না, অরিত্রকে ডেভিডের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। দুটোই যেন বদ্ধ উন্মাদ।

 তিন.

 ‘স্যার আমি এই প্রথম একটা বিরাট বিপদ মোকাবিলা করতে যাচ্ছি।’ মুখ-চোখ করুণ করে ফেলে অরিত্র। ‘আর এই মুহূর্তে কিনা আমি রেডক্রাফটে নেই? এটা হতে পারে না।’

ডেভিড স্যার বয়সে তরুণ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখে কালো রিমের চশমা। চশমাটা খুলে কাচ মুছতে মুছতে ডেভিড স্যার বলে, ‘তুমি নিজেই বোধ হয় একটু কনফিউজড, অরিত্র। নয়তো তুমি ব্যাপারটা কনটিনিউ করতে পারলে না কেন? তোমার ভেতর একটা অন্য রকম ভয় হয়তো ছিল। কিংবা রিপালশন। কিংবা তোমার মায়ের জন্য একটু আকুতি। পিছুটান। কিছু হয়তো আছে।’

অরিত্র থমকে গেল। বিষয়টা এভাবে সে ভাবেনি। সে কি সত্যি একটু পিছিয়ে আসতে শুরু করেছিল? ভয় পেয়েছিল? সে জন্যই রেডক্রাফট থেকে বেরিয়ে পড়েছে?

ডেভিড স্যার ওর চোখের দিকে তাকালেন, ‘কনসেনট্রেট। আরও মনোযোগ দাও অরিত্র। তোমাকে লুকানা শহরে সত্যি সত্যি এক্সিস্ট করতে হবে। শহরটাকে ওউন করতে হবে তোমার। ভাবতে হবে, ওটা ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানে তুমি নিজেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া। আর কোনো অপশন নেই লুকানাকে রক্ষা করা ছাড়া। তুমি ভাবছ, ওটা তোমার রিয়েল লাইফ নয়, ওটা কেবলই একটা বানানো জগৎ। একটা প্রোগ্রাম। যা খুশি হোক। কিন্তু কী করে তুমি শিওর হলে? কে বলতে পারে যে জিনিসটা উল্টো নয়? ধরো এটাই একটা বানানো জগৎ। আমি বা তোমার মা, বা এই যে তোমার কলেজ, তোমার এই ঘর, কিংবা এই রাস্তা—এ সবই হয়তো অলীক। প্রোগ্রাম মাত্র। বরং ওটাই আসল। কী হতে পারে না?’

অরিত্র আরও থমকে গেল। তাকে যদি একটা জীবন বেছে নিতে বলা হয়, তবে সে কী করবে? লুকানায় আছে অ্যাডভেঞ্চার, অন্য কিছু করার তাগিদ। নিজের মতো করে বাঁচার উপায়। ইচ্ছে পূরণের চাবিকাঠি। প্রোগ্রাম হলেও ওটা তার আরাধ্য জীবন। আর যে জীবন সে চায়, উপভোগ করে, সেটাকেই বাস্তব করে নেওয়া উচিত নয় কি?

ডেভিড স্যার উঠে দাঁড়ালেন, ‘বেশ চলো। আমি তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলছি। কিন্তু তুমি ভেবে দেখো তার আগে। তুমি যে কাজটা করতে যাচ্ছ, তা কিন্তু বেশ বিপজ্জনক। সফল না হতে পারলে মৃত্যুও হতে পারে। আর তুমি যেহেতু জানো না যে আসলেই ওটা একটা প্রোগ্রাম না বাস্তব, সে ক্ষেত্রে সেই মৃত্যু আসলও হতে পারে। তাই না? তুমি যদি তারপরও কনফিডেন্ট থাকো, তাহলেই আমি প্রসিড করব।’

অরিত্রর মাথায় হাজার ভাবনা। কিন্তু রিগান! সে যে রিগানকে বিপদের মুখে ফেলে এসেছে। তাকে রিগানের জন্য হলেও ফিরতেই হবে।

ডেভিড স্যারের মুখে সব কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন জেবা। জীবনে অনেক কিছুই সহজে বিশ্বাস করতেন না আগে, কিন্তু এখন অল্পতেই বুক কাঁপে। অরিত্রর কল্পিত শহরের চিত্রটা তার বেশ মনে ধরেছে। বেশ, তাহলে ওদের ওখানে একটা বড় খামার আছে। সেই খামারে আছে গরু, ভেড়া আর হাঁসের দল। ওখানে খেতের গম আর ভুট্টা পাখিদের খাওয়ানো হয় রোজ সকালে। আর ঘুরে বেড়ানোর জন্য আছে একটা কাঠের কার্ট। আছে ছোট্ট একটা কাঠের বেড়া দেওয়া বাড়ি, যার নাম মিকি’স ডেন। অরিত্রকে ছোটবেলায় ওর বাবা আদর করে মিকি মাউস বলে ডাকত। বাবাকে তাহলে অনেক মিস করে অরিত্র। কিন্তু অরিত্রর ওই আকাঙ্ক্ষার জগতে কি ওর মা আছে?

প্রশ্নটা করলে অরিত্র আর ডেভিড দুজনেই চুপ করে রইল। জেবার চোখ দুটো ভিজে এল অভিমানে। অরিত্র তার জগতে মাকে চায়নি! তাহলে এরপর আর কী করার আছে!

অরিত্র উঠে এসে এবার মাকে জড়িয়ে ধরে। চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমি নিশ্চয় ফিরে আসব মা। তুমি একটুও ভেবো না। আমার ওপর ভরসা রাখো।’

জেবা এবার অরিত্রকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। কত দিন পর ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছেন তিনি। ছেলেটা কত দূরে সরে গেছে এই কয়েক বছরে। সংসারের ঝামেলায় তিনি যে ঠিকভাবে ছেলেকে ভালোবাসতেও ভুলে গেছেন।

 চার.

 খামারবাড়ি থেকে ধুলোমাখা শিপটা বের করে স্টার্ট দিতে গিয়ে অরিত্রর খেয়াল হলো, এতে জ্বালানি নেই। লুকানার আকাশ এখন ঘনঘোর অন্ধকার হয়ে উঠছে। এদিক-ওদিক থেকে ছুটে আসছে উল্কাপিণ্ড। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে মাঠে, খেতে, ব্রিজে। অরিত্র প্রথমে এসেই ওর পোষা প্রাণীদের গোয়ালের দরজা খুলে দিয়েছে। গরু-ভেড়াগুলো ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়েছে যে যেদিকে পারে। রিগানের সঙ্গে দেখা হয়নি। বুড়ো হয়তো এখন অরিত্রর ডেনে কম্পিউটার নিয়ে কাজ করছে। টিমওয়ার্কে দলের প্রত্যেককে সবচেয়ে আগে নিজের দায়িত্বটুকু শেষ করতে হবে। অন্যদিকে, মন দেওয়ার সময় নেই এখন। অরিত্র ওর রিস্টওয়াচের সুইচ টিপে মবদের ডাকল। দুই মিনিট পর তিন দিক থেকে তিনটা মব টলতে টলতে এসে হাজির। আগ্নেয়গিরির ধোঁয়ায় ওদের চোখগুলো লাল হয়ে আছে। একটু একটু কাশছে ওরা।

‘আমার ফুয়েল দরকার,’ চেঁচিয়ে বলে উঠল অরিত্র, ‘বুঝতে পেরেছ? শিপটা চালু করতে হবে।’

একটা মব মাথা নেড়ে বলল, ‘ফুয়েল নেই স্যার।’

‘ওফ!’, বিরক্তিতে মুখ কুঁচকায় অরিত্র, ‘তোমরা কোনো কাজের না। কী করা যায় এখন।’ ঠিক তখনই পাশের ভুট্টাখেতে এসে পড়ল লাভার টুকরো। আর আগুন লেগে গেল খেতে। সেদিকে তাকিয়ে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল অরিত্রর। আইডিয়া। লাভার জ্বলন্ত আগুন দিয়েই চালানো সম্ভব শিপটা। সে ক্ষেত্রে এনার্জি ট্রান্সফার প্রোগ্রাম করতে হবে একটা। ছোটখাটো একটা কম্পিউটার অরিত্রর রিস্টওয়াচেই ঢোকানো আছে। অরিত্র শিপে বসে ঢাকনা লাগিয়ে প্রোগ্রামিংয়ে বসে পড়ল। সে হলো প্রোগ্রামিংয়ের মাস্টার। ডেভিড স্যার ছাড়া আর কেউ তাকে এখন পর্যন্ত টেক্কা দিতে পারেনি।

কয়েক মিনিটের মাথায় অরিত্র জ্বলন্ত লাভার ধোঁয়ার তাপকে শিপের জ্বালানি হিসেবে স্টোর করে ফেলতে সক্ষম হলো। বাহ্‌! এ তো কইয়ের তেলে কই ভাজার মতো ব্যাপার। অনেক দিনের না ব্যবহার করা শিপটাতে স্টার্ট দিতেই ওটা উড়তে শুরু করল ওর খামারবাড়ির ওপর দিয়ে। ভাগ্যিস, একদিন শুয়ে থেকে কোনো কাজ ছিল না বলে এই শিপটা খেলাচ্ছলে প্রোগ্রাম করেছিল।

অবসিডিয়ান ব্লকের লোকেশনটা এবার জানতে হবে। রিগানের মতে, ওটা প্রোগ্রাম করেছিল লুইজি নামের এক বিজ্ঞানী, আর কোথায় যে লুকিয়ে রেখেছে, তা কেউ জানে না। অরিত্র তার বিশেষ জিপিএস চালু করল। তার শিপটা উড়ে চলল করোয়া নদীর ওপর দিয়ে, ব্রিজ পেরিয়ে, লুকানা শহরের আনাচকানাচে। নাহ্‌, শক্তিধর কোনো চৌম্বকীয় বস্ত্ত ধরা পড়ছে না তার জিপিএসে। হতাশ বোধ করতে লাগল অরিত্র। সময় রয়েছে আর ৩৫ মিনিট। মাউন্ট লুকানাস রীতিমতো গর্জাতে শুরু করেছে। শিলাবৃষ্টির মতো হচ্ছে আগুন বৃষ্টি।

দ্বিতীয়বারের মতো পুরো লুকানার ওপর চক্কর দিল অরিত্র। না কোথাও কিছু নেই। আচ্ছা, করোয়া নদীর পানি এমন ফুলে-ফে‌েঁপ উঠছে কেন? ভূমিকম্পের কারণে কী? সুনামির মতো কিছু হতে যাচ্ছে? মুহূর্ত মাত্র চিন্তা করে অরিত্র তার শিপটা নিয়ে নাক-বরাবর ডুব দিল করোয়া নদীতে। স্বচ্ছ টলটলে পানি। সামনে রঙিন মাছ। কয়েকটা কাঁকড়া। একটা কচ্ছপ। বেশ কিছু সামুদ্রিক গুল্ম। হ্যাঁ, জিপিএসে কিছু পাওয়া যাচ্ছে। অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বকীয় তরঙ্গ। অরিত্র আশাবাদী হয়ে ওঠে। জিপিএস তার শিপটাকে নিয়ে যায় একেবারে নদীর তলদেশে। ওই তো দেখা যাচ্ছে একটা কালো পাথর-খণ্ড। ওটা থেকেই চৌম্বকীয় তরঙ্গ বেরোচ্ছে চারদিকে। তাহলে এটাই তার রাক্ষস মারার প্রাণভোমরা। আর সে হলো ছোটবেলায় মায়ের বলা রূপকথার রাজকুমার। অরিত্র শিপের বাড়িয়ে ধরা আঁকশি দিয়ে টেনে তোলে কালো পাথরটাকে। তারপর সাঁই করে সোজা ওপরে আকাশে ভেসে ওঠে। এবার শিপটা উড়িয়ে দেয় মাউন্ট লুকানাসের দিকে।

 পাঁচ.

 বসার ঘরে পাথরের মতো বসে আছেন জেবা আর ডেভিড। ডেভিডের মুখ চিন্তাগ্রস্ত। জেবার মুখ ভাবলেশহীন। অরিত্র তাহলে এখানে এতই অসুখী ছিল! শেষ কবে অরিত্রকে প্রাণ খুলে কথা বলতে শুনেছেন, মনে করতে পারছেন না জেবা। তিনিই বা মা হয়ে বিষয়টা এত দিন খেয়াল করেননি কেন? কেন চেষ্টা করেননি অরিত্রর পরিপার্শ্বকে তার মতো করে সাজাতে? কেন বোঝেননি অরিত্র কী চায়?

এতক্ষণে ডেভিড মুখ খোলে, ‘আশা করি অরিত্র ব্লকটা খুঁজে পেয়েছে। এতক্ষণে খুঁজে না পেলে আর কিছু করার নেই। কারণ, সময় খুব অল্প।’

জেবা অনেক দিন পর অরিত্রর বাবাকে খুব মিস করতে শুরু করেছেন। এই সময়ে ওর বাবার থাকাটা খুব দরকার ছিল। সত্যি যদি অরিত্রর বাবা নিউরাল নেটওয়ার্কিংয়ের কাজটা শেষ করতে পারত! যদি জেবা কিংবা ডেভিড বা ওর বাবা—সবাই মিলে একসঙ্গে অরিত্রকে সাহায্য করতে পারত। সে তো বলেছিল, একসঙ্গে কাজ করতে পারলে মানুষের অসাধ্য কিছু আর থাকবে না। যদি সাগরের তুফানকে থামানো যায়, তবে একটা আগ্নেয়গিরিকে কি আর শান্ত করা যেত না? একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন জেবা। আঠারো বছর! আঠারো বছর অরিত্রর বাবার কোনো খোঁজ নেই। কোনো খোঁজ নেওয়াও নিষেধ ওদের আইনে। সায়েন্স কাউন্সিলে কাজ করার সৌভাগ্য দেওয়া হয়েছে, এ-ই ঢের। সায়েন্স কাউন্সিলের কর্মীদের সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করার অনুমতি নেই। এতে বিজ্ঞানের ক্ষতি হয়।

ও মাই গড! হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় ডেভিড। অরিত্র কি ওর শিপটা টেম্পারেচার প্রুফ করে তৈরি করেছিল? সে কি কখনো ভেবেছে এটা তার কী কাজে লাগতে পারে? আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ভেতর কখনো ঢুকতে হতে পারে, এটা কি সে কল্পনাও করেছে? যদি না করে থাকে, যদি কেবল খেলার ছলে শিপটা তৈরি করে থাকে, তবে প্রচণ্ড তাপমাত্রায় তার সিলিকন বডিতে আগুন লেগে যাওয়ার কথা। কী সর্বনাশ! অরিত্র কি বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে? ডেভিড স্যার পায়চারি করতে শুরু করলেন।

 ছয়.

 মাউন্ট লুকানাসের খুব কাছে এসে পড়েছে অরিত্র। একটা রাগী ড্রাগনের মতো ফোঁস ফোঁস করছে পাহাড়টা। কালো মেঘ, /////পাংশুটে////// আকাশ, আর লাল লাভার উদ্গীরণ মিলেমিশে এক অপরূপ দৃশ্যের মুখোমুখি এখন অরিত্র। এই দৃশ্য যেন এই পৃথিবীর নয়। অরিত্রর শিপটা অবসিডিয়ান ব্লক নিয়ে লুকানাসের জ্বালামুখের দিকে উড়ে যায়। ঠিক এই সময়ে দেখা দেয় বিপত্তি। শিপের স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার ব্যবস্থা হঠাৎ গোলমাল করতে শুরু করে। অরিত্র তাড়াতাড়ি কী ব্যাপার দেখতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করে, উচ্চ তাপমাত্রায় শিপের সিস্টেম ডাউন করতে শুরু করেছে। ওহ নো। এই শিপটাকে সে বাতাসে-পানিতে-স্থলে সমানভাবে চলার উপযুক্ত করে তৈরি করলেও উচ্চ তাপমাত্রা সহনীয় করে তৈরি করেনি। কী বোকামি, কী বোকামি! নিজের প্রোগ্রামিং দক্ষতার ওপর ধিক্কার এল অরিত্রর। শিপের কাঁটাগুলো উল্টাপাল্টা ঘুরতে শুরু করলে হঠাৎ অজানা এক ভয় গ্রাস করে ফেলল তাকে। সে কী করবে এখন? রেডক্রাফট থেকে এক লহমায় বেরিয়ে পড়বে? হেডফোন খুলে নিষ্ক্রিয় করে দেবে প্রোগ্রামটাকে? রিগান আর লুকানা সিটিকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেবে? চকিতে মার মুখটা একঝলক ভেসে উঠল সামনে। মা বড় একা। একা এবং দুঃখী। অরিত্র না থাকলে মা কীভাবে বেঁচে থাকবেন? কিন্তু কাপুরুষের মতো বাকি জীবন বেঁচে থেকেই বা কী লাভ? শিপটা ঝাঁকুনি দিয়ে গোত্তা খেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। অরিত্র প্রাণপণে শিপটাকে জ্বালামুখের আরও কাছে নিয়ে যেতে থাকে। পড়বেই যখন, ব্লকসুদ্ধ ওই উৎসমুখের ভেতর গিয়েই পড়ুক। অন্তত কাজটুকু হয়ে যাবে। রক্ষা পাবে ওর প্রিয় শহর।

অরিত্রর নিচে এখন টগবগ করছে এক ভয়ংকর ক্রুদ্ধ পাহাড়ের উদর। ফুটন্ত পানির মতো ফুটছে লাল টকটকে লাভা। ছিটকে এসে পড়ছে মাঝেমধ্যে শিপের গায়ের ওপর। অরিত্র টের পায় শিপটা প্রায় বিকল হয়ে পড়ছে এখন। কোনো সিস্টেমই আর কাজ করছে না। বরং প্রচণ্ড উত্তাপ টের পাচ্ছে অরিত্র। তার মানে সিলিকন বডি গলে যেতে শুরু করেছে। অরিত্র চোখ বন্ধ করে অবসিডিয়ান ব্লকটা ভেতরে ছেড়ে দিল। ফুটন্ত লাভার একেবারে মাঝখানে গিয়ে পড়ল ব্লকটা। টুপ করে ডুবে গেল আগুনের গোলার ভেতর। অরিত্র চোখ বন্ধ করে একবার মার মুখটা ভাবল, মা, তোমাকে সত্যি ভালোবাসি। কখনো বলা হয়নি সেভাবে। কষ্ট পেয়ো না মা।

ঠিক তখনই হঠাৎ কেমন করে যেন তার মাথার ভেতর মা কথা বলে ওঠে, ‘তুই কিছুতেই হারবি না অরিত্র। আমি জানি। তুই হারতে পারিসই না।’

ডেভিড স্যার চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘অরিত্র, তোমার শিপে কি বাউন্সার আছে? থাকারই কথা। তুমি তো এমন ভুল করতে পারো না। ইউ আর অ্যান ইনটেলিজেন্ট বয়। জাস্ট গেট আ বাউন্স।’

তার পরপরই শোনা যায় এক অপরিচিত গভীর কণ্ঠ, ‘উই হ্যাভ ডান আওয়ার জব অরিত্র। হ্যাকিং সিস্টেমকে অচল করে দেওয়া হয়েছে। ইউ আর নাউ সেফ। অবসিডিয়ান ব্লকের কাজ শুরু হয়ে গেছে। আর চার মিনিটের মাথায় শান্ত হয়ে যাবে মাউন্ট লুকানাস। ইউ হ্যাভ অনলি ফোর মিনিটস। রিটার্ন ইউরসেলফ বাই দেন। কনসেনট্রেট। কনসেনট্রেট। তুমি একা নও। আমরা সবাই আছি তোমার সঙ্গে।’

ঠিক তক্ষুনি যেন ভোজবাজির মতো বুদ্ধিটা চলে আসে ওর মাথার ভেতর। মাউন্ট লুকানাসের কেন্দ্রে আছে শক্তিশালী অভিকর্ষ বল, যা প্রতি মুহূর্তে নিচের দিকে টানছে শিপটাকে। এর চেয়ে বেশি বিকেন্দ্রীকরণ বল তৈরি করে বাউন্স করতে হবে তাকে। আর এই বাড়তি এনার্জি সে একমাত্র পেতে পারে শিপের উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার থেকে। শিপটাকে একনিমেষে ধ্বংস করে দিয়ে সেই এনার্জি ব্যবহার করে উল্টোদিকে বাউন্স করবে সে। অরিত্র ভালো করে সিটবেল্ট বেঁধে নেয় কোমরে। বাউন্সারের সুইচে হাত দেয় সাবধানে। আর আরেক হাত দিয়ে ডেসট্রাকশন মোড চালু করে দেয়। এক লহমার হেরফেরে শেষ হয়ে যেতে পারে সবকিছু। অরিত্র, সাবধান! খুব সাবধান! প্রায় একই সঙ্গে দুটো বোতাম টিপে দেয় অরিত্র। মুহূর্তের মধ্যে চুরমার হয়ে যায় ওর প্রিয় শিপটা। আর অরিত্র তার সিটসহ ছিটকে উড়ে যায় উল্টো দিকে। ধোঁয়া আর ছাই ভরা এক আকাশের মধ্য দিয়ে উড়তে উড়তে অরিত্র এসে পড়ে করোয়া নদীতে। ঝপাস করে শব্দ হয় একটা। অরিত্র দ্রুত সিটবেল্ট খুলে নিজেকে বাঁধনমুক্ত করে নেয়। তারপর সাঁতরে তীরে উঠেই ছুটতে থাকে মিকি’স ডেনের দিকে। ডেনের কাছাকাছি আসতেই দেখে বাইরে সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছে রিগান। মাথায় সেই কানা টুপি, আর চোখে কালো চশমা। অরিত্রকে জড়িয়ে ধরে বুড়ো, ‘ওয়েলডান মাই চাইল্ড। ব্রাভো।’

অরিত্র খুশিতে চেঁচায়, ‘ইউ আর অলসো জিনিয়াস স্যার। ঠিক সময়ে হ্যাকিংটাকে অচল করতে না পারলে যে কী হতো!’

‘ওয়েল,’ গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে রিগান, ‘সামওয়ান হেলপড মি আ লট। যেখানে যেখানে আটকে যাচ্ছিলাম, সেখানেই সে আমাকে পথ বাতলে দিচ্ছিল বারবার। সামওয়ান ভেরি জিনিয়াস অ্যান্ড ইনটেলিজেন্ট। ডোন্ট নো হু দ্যাট ইজ। বাট আই কুড ফিল, আমি একা নই। কেউ আমাকে সাহায্য করছিল।’

দূরে মাউন্ট লুকানাস শান্ত হয়ে এসেছে। খানিকটা ধোঁয়া বেরোচ্ছে এখনো। লাভাগুলো শক্ত হয়ে আছে পাহাড়ের বুকে। কালো ধোঁয়া সরে গিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশ উঁকি দিচ্ছে এখন। ঠান্ডা একটা বাতাস বইছে করোয়া নদীর দিক থেকে। আর কোত্থেকে যেন এখন গুটি গুটি করে বেরিয়ে আসছে লুকিয়ে থাকা লুকানা সিটির লোকজন। ঝটপট ডানা মেলে গমখেতে ভিড় করছে পায়রাগ‌ুলো। অরিত্রর প্রতিবেশী বুড়িটা গেট ঠেলে নিজের বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে একটা হাই-ফাইভ করল হাসতে হাসতে। নিজের কাঠের কার্টটাতে লাফিয়ে উঠে রিগানও হাত নাড়ল ওর দিকে, ‘গুডবাই অরিত্র। তুমি সত্যি লুইজির যোগ্য অনুসারী। হি শুড বি প্রাউড অব ইউ।’

রিগানের কার্টটা চলে যেতে হঠাৎ কী একটা মনে পড়তে চেঁচিয়ে ওঠে অরিত্র। ‘হেই স্যার, লুইজি কে? কী যেন সেদিন বলছিলেন! আমার জন্মবৃত্তান্ত। শেষ করে যান, প্লিজ।’

কিন্তু ততক্ষণে রিগানের কার্টটা ধুলো উড়িয়ে চলে গেছে দূরে। অগত্যা মিকি’স ডেনের দিকে ফিরতে শুরু করল অরিত্র। আর নিজের ঘরের কাছে এসে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল যেন। ওর ছোট্ট ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মা, খুব মজা করে হাসছে। আর তার হাত ধরে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, চিনতে কষ্ট হয় না তার। বাবা! বাবা-মা হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে হাসছে। কোনো দিন এই দৃশ্যটা দেখতে পায়নি এর আগে অরিত্র। ভীষণ মন ভালো হয়ে যায় ওর। মনে হয় যেন এই মাত্র নতুন করে জন্ম হয়েছে ওর। অরিত্র লুকানার ঝকঝকে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা বড় নিশ্বাস নেয়। ঠিক অরিত্র, এটাই তোমার রিয়েল লাইফ। আর ওটা ছিল একটা প্রোগ্রাম মাত্র।

অলংকরণ: আহমেদ তারেক