সহজ বুদ্ধি

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

রাফির একটা অসুখ আছে। অসুখের নামটা খুবই খটমটে, অতএব সেটা নাহয় আমরা না-ই জানলাম। খটমটে অসুখটার কারণে ওর একটা পা ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে। যে পায়ে একসময় ও ফুটবল খেলায় ফ্রি কিক নিত, সেই পায়ে ভর দিয়ে এখন হাঁটতেও কষ্ট হয়। তাই এই বয়সেই রাফি বুড়োদের মতো একটা লাঠি নিয়ে হাঁটে।

রাফি পড়ে ক্লাস সিক্সে। ‘পড়ে’ না বলে অবশ্য ‘পড়ত’ বলা উচিত। স্কুল থেকে এখনো ওর নাম কাটা যায়নি। মোমেন স্যার মাঝেমধ্যে বাসায় আসেন। হালকা ধমকের সুরে বলার চেষ্টা করেন, ‘সারা দিন তো শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছিস। ঘরে বসে ৫ নম্বর অধ্যায়ের অঙ্কগুলো করে ফেললেও তো পারিস। আমি কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করাব না। ওসব ডাক্তারি সার্টিফিকেট টিকেট দিয়ে কোনো লাভ হবে না।’ যাঁর ভয়ে স্কুলের সবাই থরকম্প হয়ে থাকে, রাফি আশ্চর্য হয়ে দেখে, সেই মোমেন স্যারেরই কথাগুলো বলার সময় গলা কেঁপে কেঁপে যায়। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে তিনি চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করেন।

কেউ বলে দেয়নি। কিন্তু রাফি জানে, ফাইনাল পরীক্ষাটা ওর দেওয়া হবে না। পরীক্ষার আগেই ও হয়তো এমন একটা জায়গায় চলে যাবে, যেখান থেকে কেউ কখনো ফিরে আসেনি। ব্যাপারটা যখন শুরুতে জানাজানি হলো, তখন আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেকেই বাসায় আসত। কেউ নিঃশব্দে, কেউ সশব্দে কাঁদত। এখন আর তেমন কেউ আসে না। সবাই বোধ হয় ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে।

মেনে নিতে পারেননি শুধু মা, বাবা আর বড় আপু। তাঁরা এখনো একটা না একটা কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওষুধপত্তর—সব বৃথা গেছে। ছোটখাটো একটা অপারেশন হয়েছিল, তাতে কোনো কাজ হয়নি। ভালো চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া দরকার, অত টাকা ওদের নেই। স্কুলের বন্ধুরা কিছু টাকা তুলেছে, বড় আপুর বন্ধুরা মিলে ভার্সিটিতে একটা ফান্ড খুলেছে, এসবে বোধ হয় খুব একটা ফল হচ্ছে না।

মা কেমন যেন পাগল-পাগল হয়ে গেছেন। অ্যালোপ্যাথিতে কাজ হচ্ছে না বলে তিনি হোমিওপ্যাথি, হামদর্দ, পড়া পানি, তাবিজ-কবজ...নানা কিছু দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যে যেখানেই কোনো ওষুধের কথা বলে, মা সেখানেই ছুটে যান। অদ্ভুত অদ্ভুত ওষুধ নিয়ে ফেরেন। রাফিকে ওষুধ খাইয়ে সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞেস করেন, ‘এখন কি একটু ভালো লাগছে রাফু? ভালো লাগছে? পায়ে জোর পাচ্ছিস?’ রাফি প্রতিবারই বলে, ‘হ্যাঁ মা, ভালো লাগছে।’ মাকে খুশি করার জন্য সে ঘরের ভেতর লাঠি ছাড়া একটু হাঁটাহাঁটিও করে। মা খুব আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন।

বিকেলবেলাটা রাফির খুব ভালো লাগে। একা একা সে বাসার সামনের রাস্তায় হাঁটে। বড় হতে কেমন লাগে সেটা তো তার কখনো জানা হবে না, তাই এই সময়টায় রাফি ‘বড়-বড়’ খেলে। ছোট চাচা রাফিকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছেন, সেটা সব সময় তার পকেটে থাকে। রাফি হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমধ্যে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে। এমন একটা ভাব করে, যেন তার খুব তাড়া। যেন ভার্সিটিতে ক্লাস আছে কিংবা অফিসে কত কাজ বাকি! এরপর রাফি রাস্তার পাশের চায়ের দোকানটায় বসে। বড়দের মতো বলে, ‘চিনি বাড়িয়ে এক কাপ চা দেন তো।’ চায়ের দোকানের লোকগুলো আগে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। ইদানীং তারা রাফির সঙ্গে একটু একটু গল্পও করে।

আজ চা খেয়ে রাফি যখন বাসায় ফিরছিল, তখনই ঘটনাটা ঘটল। তার সামনেই হাঁটছিল একটা মেয়ে। স্কুল ড্রেস পরা। হঠাৎ শাঁ করে একটা মাইক্রোবাস এসে মেয়েটার পাশে থামল এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে তুলে নিয়ে গেল। রাফি তখন বোকার মতো তাকিয়ে আছে। রাস্তাটা প্রায় খালি, অতএব চিৎকার করে কোনো লাভ হবে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে রাফি ভালো করে মাইক্রোবাসের নম্বর প্লেটটা দেখে রাখল।

মনে মনে নম্বরটা আওড়াতে আওড়াতে সে যখন দ্রুত পা ফেলার চেষ্টা করছে, তখনই মাইক্রোবাসটা আবার ফিরে এল। রাফি কোনো বাধা দেওয়ার সুযোগ পেল না। তার আগেই দুটো শক্ত হাত খপ করে ওকে ধরে মাইক্রোবাসের ভেতর তুলে নিল, ঝটপট ওকে একটা বস্তার ভেতর ভরে ফেলা হলো।

২.

বস্তাটা চোখের সামনে থেকে সরে যাওয়ার পরও রাফি কিছুক্ষণ ঘোলা দেখল। এই অবস্থায়ই সে শুনতে পেল, দুজন মানুষের মধ্যে কথা হচ্ছে।

‘গাধার বাচ্চা তুই আরেকটারে তুইলা আনছোস ক্যান? হুদাই ঝামেলা বাড়াইলি।’

‘আরে এই পোলা গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখতেসিল। আমি নিজ চোখে দেখসি।’

‘নাম্বার প্লেট দেখসে তো কী হইসে? আজাইরা আরেকটা ফ্যাসাদ আনলি।’

‘সমস্যা নাই। এইডা তো লুলা। এক থাবড় দিলে...’

বলতে বলতেই লোকটা এক হাত তুলে রাফিকে থাপ্পড় মারতে যাচ্ছিল। ঠিক এই সময় ঘরের আরেক কোণ থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘খবরদার!’

রাফি দেখল, সেই স্কুল ড্রেস পরা মেয়েটা। খুব ঠান্ডা গলায় মেয়েটা বলল, ‘ওর গায়ে হাত দিলে আমি কোনো সাহায্য করব না। আপনারা খুব ভালো করে জানেন, আমাকে আপনাদের দরকার। আব্বুকে ফোন করেন, আমি যা বলার বলছি।’

বাহ্, মামণির তো সাহস আছে।’ বলল অপেক্ষাকৃত মোটা একজন। ‘তোমার বাপরে আরেকটু উতলা হইতে দাও, তারপর ফোন দিমু। ওই আয়।’ বলে অন্যজনকে নিয়ে লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর আবার উঁকি দিয়ে বলল, ‘মামণি তোমরা দুষ্টামানি কইরো না কেমন? চুপচাপ থাইকো। আমরা কিন্তু লোক ভালো না। মুখের চেয়ে হাত বেশি চলে।’

ঘরের দরজাটা কেউ লাগিয়ে দিল না। তার মানে লোকগুলো আশপাশেই আছে।

কিছুক্ষণ নীরবতা। মেয়েটাই প্রথমে মুখ খুলল। ‘আমি সারাহ। তুমি রাফি, তাই না? স্কুলে তোমার ছবিসহ পোস্টার দেখেছি।’

সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের পোস্টারে ছবি থাকে। রাফির ছবিও পোস্টারে দেখা যায়, এই তথ্য জেনে খুশি হওয়া উচিত কি না, রাফি ঠিক বুঝল না। সে মৃদু হাসার চেষ্টা করল।

‘ভয় পেয়ো না। এই লোকগুলো তো আমাকে চেনে না, চেনে আমার বাপকে। আমাকে চিনলে জীবনেও এই ভুল করত না। এখান থেকে বের হতে আমাদের ম্যাক্সিমাম দশ মিনিট লাগবে। আমি এরই মধ্যে কয়েকটা বুদ্ধি পেয়ে গেছি। শুনবে?’

রাফি এক পাশে মাথা কাত করল।

সারাহ এবার হাতে কিল দিয়ে বলতে শুরু করল:

‘দেখো, এই ঘরে একটাই দরজা আর জানালা। আমি এরই মধ্যে খেয়াল করেছি, বাসাটা রাস্তা থেকে অনেক ওপরে। ১০-১২ তলা তো হবেই। আমরা জানালায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করলে হয়তো কাজ হবে, কিন্তু ততক্ষণে ওই মোটু পাতলু চলে আসবে। আমরা যদি ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিই, তাহলে দরজাটা ভাঙতে একটু সময় লাগবে, আমরাও একটু সময় পাব।’

রাফি মন দিয়ে কথা শুনছিল। সারাহ কথা বলে একদম টিচারদের মতো। ক্লাসরুমে কথা বলতে হলে যেভাবে এক হাত তুলে টিচারের অনুমতি নিতে হয়, রাফি সেভাবে হাত তুলল।

কিন্তু সারাহর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বলেই যাচ্ছে, ‘ওয়েট, কথা শেষ করতে দাও। জানি, তুমি এখন বলবে ওদের কাছে যদি লকের চাবি থাকে, তাহলে কী হবে? দেখো, বোকাগুলো তোমার লাঠিটা নিয়ে যায়নি। আমরা যদি লকের পাশে লাঠিটা ঢুকিয়ে রাখি, তাহলে আর ওটা ঘোরানো যাবে না। দরজাটাও খুলবে না।’

রাফি আবারও হাত তুলল।

‘ওয়েট। কথা শেষ করতে দাও। এখন...আমরা নাহয় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলাম, কিন্তু নিচে যদি কেউ আমাদের কথা না শোনে? তখন ওপর থেকে একটা কিছু নিচে ফেলতে হবে। আমাদের হাতে আছে শুধু তোমার লাঠিটা। ঘরের ভেতর আর কিছুই নেই। কিন্তু লাঠি তো থাকবে দরজার সঙ্গে আটকা...’

রাফি আবারও হাত তোলার চেষ্টা করল।

‘উফ, হাত নামাও। আমাকে বলতে দাও। জানালায় পর্দা আছে, সেটা লক্ষ করেছ? জানালার পর্দা দিয়েও কিন্তু আমরা দরজার লকটা বেঁধে রাখতে পারি। তবে ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পর্দাটা খুলে নেওয়া একটা ঝামেলা হবে। সেটারও সমাধান আছে...’

রাফি এবার হাত না তুলেই বলল, ‘আমি একটা সহজ বুদ্ধি বলব?’

‘কী?’ সারাহ মনে হলো খুবই বিরক্ত।

রাফি এবার মুখ খুলল।

কী বলল সে?

উত্তর

রাফির সঙ্গে সব সময় একটা মোবাইল থাকে। মোবাইলের মাধ্যমে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করলে সহজেই ওরা উদ্ধার পেতে পারে।