এক ছিল ছিমছাম ছোট্ট গ্রাম। সেই গ্রামে থাকত দুই ভাই। বড় ভাইয়ের ছিল খুব টাকাপয়সা। ছোট ভাই গরিব।
নতুন বছরের প্রথম দিন। উৎসব চলছে গ্রামজুড়ে। চারদিকে আনন্দ আর আনন্দ। কিন্তু ছোট ভাইয়ের মনে কোনো খুশি নেই। ঘরে খাবার চাল নেই। কী করবে সে?
গেল বড় ভাইয়ের কাছে। চাইল এক সের চাল। জাউ বানিয়ে খাবে সে। বড় ভাই ছিল হাড়কিপটে। চাল তো দিলই না, বরং গালাগাল করল।
মনে একরাশ দুঃখ নিয়ে ছোট ভাই ফিরে এল। মন খারাপ। বেজায় মন খারাপ তার। চলতি পথে এক বুড়োর সঙ্গে তার দেখা। বুড়ো ফিরছিল বন থেকে। ছোট ভাইকে দেখে কাঠুরে বুড়ো জানতে চাইল, ‘কী হে! মন খারাপ নাকি তোমার, কী হয়েছে?’
ছোট ভাই সব খুলে বলল বুড়োকে। বুড়োর মনটা ছিল বেজায় ভালো। বুড়ো বলল, ‘দুঃখ কোরো না ভাই। আমি তোমাকে একটা জিনিস দিতে চাই। এই জিনিস পেলে তোমার আর কোনো অভাব থাকবে না। দুঃখ ঘুচে যাবে জীবনের। তবে ভাই, আমার এই ভারী কাঠের বোঝাটা আর বইতে পারছি না। তুমি যদি একটু সাহায্য করো।’
সঙ্গে সঙ্গে ছোট ভাই কাঠের বোঝাটা নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিল। এমনিতেই তার মনে ছিল খুব দয়ামায়া। বুড়োর কষ্ট দেখে নিজের মনেও কষ্ট লাগছিল তার।
কাঠের ভারী বোঝা বাড়ি পৌঁছে দিল সে। বুড়ো খুব খুশি হয়ে দোয়া করল ছোট ভাইকে। তারপর তার হাতে দিল একটা পিঠে।
‘এই পিঠে নিয়ে তুমি চলে যাবে বনের পুব দিকের মন্দিরে। মন্দিরের পেছনে দেখবে রয়েছে একটা গুহা। গুহার মধ্যে থাকে অনেকগুলো ছোটখাটো মানুষ। বামন তারা। পিঠে খেতে খুব ভালোবাসে। ওরা পিঠে খেয়ে দাম দিতে চাইবে। পিঠের বদলে টাকাকড়ি নেবে না তুমি। শুধু চাইতে হবে একটা পাথরের জাঁতা। সেই জাঁতার অনেক ক্ষমতা।’
বুড়োর কথা শুনে ছোট ভাই খুব অবাক হলো। গেল সে মন্দিরে। সত্যি সত্যি গুহা খুঁজেও পেল সে। দেখল, অনেকগুলো বামন মিলে একটা গাছের ডাল গুহার ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করছে।
এই সব দেখে ছোট ভাই গাছটা গুহার ভেতরে নিয়ে গেল। যেতে যেতে হঠাৎ করে চিউ একটা চিৎকার শুনে চমকে গেল ছোট ভাই। পায়ের তলায় চাপা পড়েছে এক বামন। আদর করে তাকে হাতের তালুতে তুলে নিল ছোট ভাই। বামনটা হচ্ছে সেখানকার রাজার ছেলে।
হাতের তালুতে চড়েই সে দেখতে পেল পিঠেটা। পিঠে খুবই ভালোবাসে সবাই। বামন-রাজকুমার বলল, ‘এই পিঠেটা আমাকে দাও। এর বদলে যা চাও সব তোমাকে দেব।’
ছোট ভাই কিন্তু হীরা-মানিক কিছুই চাইল না। সে চাইল পাথরের জাঁতা। রাজকুমার গেল রাজার কাছে। চাইল পাথরের জাঁতা। রাজার একমাত্র ছেলে সে, রাজা আর কী করেন।
ছোট ভাই তো জাঁতা পেয়ে দারুণ খুশি। রাজা বললেন, ‘এই জাঁতাটা কিন্তু খুব দামি জিনিস। সাবধানে রাখবে। জাঁতা ঘুরিয়ে তুমি যা চাইবে তা-ই পাবে। ঘোরাতে হবে ডান দিকে। বাঁ দিকে না ঘোরানো পর্যন্ত জাঁতা থামবে না। সে তোমার চাওয়া জিনিস দিয়েই যাবে।’
বাড়িতে ফিরেই ছোট ভাই দেখতে পেল বউ-ছেলেমেয়ে সবাই অপেক্ষা করছে তার জন্য। সারা দিন কিছুই খায়নি তারা। উপোস করে চেহারা সবার মলিন। খাবারের বদলে জাঁতা নিয়ে এসেছে কর্তা। তাই দেখে বউয়ের গেল মেজাজ বিগড়ে।
তাকে একটা মাদুর বিছাতে বলল ছোট ভাই। জাঁতাটাকে মাদুরের মধ্যে রেখে এবার ছোট ভাই ডান দিকে হাতল ঘোরাতে লাগল। আর বলতে লাগল, ‘চাল চাই। চাল চাই।’ সঙ্গে সঙ্গে ঘটল এক মজার কাণ্ড। জাঁতা থেকে চাল ঝরতে লাগল ঝরঝর করে। বাঁ দিকে হাতল ঘোড়াতেই চাল পড়া বন্ধ হলো। আবার ডান দিকে হাতল ঘুরিয়ে ছোট ভাই বলল, ‘মাছ চাই। মাছ চাই।’
অমনি মাছ পড়তে লাগল। রংবেরঙের মাছ। যা দরকার তা চাইলেই পাওয়া যায়। ছোট ভাই এভাবে বাড়ি চাইল। হাতি-ঘোড়া চাইল। সুখ এবং আনন্দের বন্যা বয়ে গেল তার সংসারে। হূদয় উপচানো আনন্দের জোয়ার বইতে লাগল। এবার ওরা ভাবল—এতই যখন সুখ হয়েছে তাদের, তখন গ্রামের সবাইকে নেমন্তন্ন খাওয়ানো দরকার। এক মহা ধুমধামে আনন্দভোজের আয়োজন করল তারা।
গাঁয়ের ছেলেবুড়ো সবাই এল। বয়ে গেল খানাপিনার ঢল। সবাই খুশি। একমাত্র দুঃখ পেল হাড়কিপটে বড় ভাই। কী করে এমন আঙুল ফুলে কলাগাছ হলো ছোট ভাই। রহস্যটি জানতেই হবে। ছোট ভাইয়ের বাড়ির মধ্যে চর লাগাল সে। রইল আড়ি পেতে। একদিন দেখতে পেল, জাঁতা ঘুরিয়ে মন্ডা-মিঠাই বের করছে তারা।
এই না দেখে বড় ভাইয়ের হলো ভারি লোভ। মাথায় খেলল তার দুষ্টু বুদ্ধি। যে করেই হোক জাঁতাটা তাকে পেতেই হবে।
ছোট ভাই রাতে একদিন ঘুমিয়ে আছে। গভীর ঘুম সবার। নিঝুম নিরালা পরিবেশ। বড় ভাই ঢুকল তখন বাড়িতে। চুপি চুপি জাঁতাটা নিয়ে পালিয়ে গেল সে। এক দৌড়ে গিয়ে উঠল ময়ূরপঙ্খি নৌকায়। আগেই ঠিক করে রেখেছিল সে পালিয়ে যাবে নির্জন কোনো দ্বীপে। তারপর জাঁতার জাদুতে হয়ে উঠবে সে আরও বিত্তশালী।
নৌকা চলা শুরু হলো। সাত-সাত চৌদ্দ দাঁড়ী দাঁড় বায়। নৌকার মধ্যে সবই নিয়েছিল বড় ভাই। কিন্তু নুন নিতে সে ভুলে গিয়েছিল। খেতে বসে দেখে নুন নেই।
আর তক্ষুনি—
জাঁতা ঘুরিয়ে সে বলল, ‘নুন চাই। নুন চাই’। জাঁতা থেকে তখন নুন বেরোতে লাগল। বেরোচ্ছে আর বেরোচ্ছে। থামাথামির নাম নেই। প্রথম প্রথম খুব আনন্দ হলো বড় ভাইয়ের। কিন্তু হঠাৎ করেই মুখ শুকিয়ে গেল তার। জাঁতা বন্ধ করতে হবে কীভাবে? এটা তো আর সে জানে না। নৌকা তখন মাঝসাগরে। এখন উপায়? এখন উপায়? নুনে নুনে ভরে গেল নৌকা। টুপ করে ডুবেও গেল। বড় ভাই ডুবল। জাঁতাও ডুবল।
তারপর থেকেই লোকে বলে, এখনো সাগরের তলায় সেই জাঁতা ঘুরেই চলেছে। সেই জাঁতা থেকে বের হচ্ছে নুন আর নুন।
তাই সাগরের জল এত লোনা।