সানু আর সুরুর গল্প

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

সানোয়ার ওরফে সানু কখনো কোনো দিন ঢাকা শহর দেখেনি। কেবল ঢাকার গল্পই শুনে এসেছে এদ্দিন ধরে। এর মুখে, ওর মুখে।

বাড়ি থেকে কদ্দুর হেঁটে গেলেই বাজার। বাজারে টাটকা শাকসবজি আর মাছটাছ যেমন বিকোয়, তেমনই মেলে ঢাকার টুকরো-টাকরা সংবাদ। কেউ বাজারের একমাত্র রেস্টুরেন্টের হাতলভাঙা চেয়ারে বসে চায়ে বনরুটি ডুবিয়ে খেতে খেতে, কেউ সবেধন সেলুনটিতে গালে সাবান মাখানোর বেলায় আয়েশ করে ঢাকার চেহারাসুরতের বর্ণনা দিয়ে সারে। ওরা যে সদ্য সদ্য ঢাকাফেরত, সে তথ্যটি আর দশজনকে আপন গদ্যে না শোনানো অবধি ওদের পেটের খাদ্য যেন হজম হওয়ার নয়। পথঘাটের চেকনাই, দালানকোঠার জেল্লা আর দোকানপাটের জৌলুশের কথা তারিয়ে তারিয়ে শুনিয়ে যায় ওরা। এতে অবশ্য শ্রোতাদের মন কাড়ে না। তাই কেউ কেটলিতে পুরোনো চায়ের পাতায় নতুন করে পানি ঢালে, কেউ ক্ষুর দিয়ে গাল কুপিয়ে দাড়ি উপড়ে আনে।

তবে সানুর কথা আলাদা।

সানু শহরফেরত মানুষজনের কথা বেশ মন দিয়ে শোনে। শোনে আর ঢাকা দেখবে বলে মনের মধ্যে একটা রাক্ষুসে জেদ চাপিয়ে দেয়।

মনের কথাটা একদিন টুপ করে বড় কাকার কাছে বলেই ফেলল সানু। বলল, কাকা, আমি ঢাকা শহর দেখব! ওখানকার গাড়িগুলো নাকি দোতলা!

বড় কাকা তখন সানুকূল মেজাজে হুঁকো টানছিল। ভাতিজার বায়না শুনে বড় কাকা যে বেজায় পুলকিত হলো, সেটা তার মুখচোখ দেখেই বোঝা গেল।

বড় কাকা হুঁকোটা সরিয়ে, চেহারাটাকে রাঙিয়ে, মুখে চাকুমচুকুম বোল তুলে বলল, শহরে যাবি! তা বেশ তো! তো, এ কথাটা এদ্দিন বলিসনি কেন আমাকে?

বলব কখন!—সানু মৃদু প্রতিবাদ শোনায়।—রাতদিন এত ব্যস্ত থাকো তুমি!

তা, বড় কাকা রাতদিন ব্যস্ত থাকে বৈকি! ঝগড়া করতে করতেই তো তার রাত কাটে, দিন কাটে। গাঁয়ের সবার সঙ্গে এটা-ওটা নিয়ে ঝগড়া বাধানোটাই যেন তার দরকারি কাজের মতো। বাজারের তরিতরকারির ব্যাপারীদের সঙ্গে তর্কাতর্কি, পড়শি গৃহস্থের সঙ্গে ধস্তাধস্তি-কোন্তাকুন্তি, মাঝি-মেছোদের সঙ্গে কলহ-কাজিয়া জমি-জিরেতের চাষি-মজুরদের সঙ্গে খণ্ডাখণ্ডি—এ তো বড় কাকার নিত্যদিনের কড়চা। বড় কাকার নিত্যরাতের খুনসুটি সহ্য করতে না পেরে বড় কাকি একদিন সেই যে বাপের বাড়ি চলে গেল আর ফিরে এল না। আহা, বড্ড ভালো মানুষটি ছিল এই বড় কাকি। পরনে ফুলের নকশা করা শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। নাকে নোলক। দুহাতে দুগাছা চুড়ি। গলায় ‘সানু ও সানু!’ ডাক। হাতে পায়েসের বাটি।...গাঁয়ের লোকেরা অবশ্য বলে বেড়িয়েছে—বউটা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে ভালোই করেছে, খুনির বাড়িতে আবার থাকা কেন?...এই না শুনে আলেম কাকাকে সানু জিজ্ঞেস করেছে, খুনির বাড়ি মানে? আমার বড় কাকা কি খুনি?...নয়তো কী? বড় হলে জানতে পাবি, তোর বাবা-মাকে তোর বড় কাকাই ভাতের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খুন করেছিল। এ কারণেই তো তোর আর সব কাকা-ফুপুরা ঘর ছেড়ে কেউ সান্তাহার, কেউ ভূরুঙ্গামারীতে গিয়ে ঘর তুলেছে।—বলেছে আলেম কাকা। সানু অবশ্য এসব অলক্ষুনে কথায় কান দেয়নি। বাবা-মা এক দিনের জ্বরে ভুগে বেহেশতে চলে গেছে, সেটা ও বড় কাকার মুখেই শুনেছে। বড় কাকা খিটমিটে মেজাজের মানুষ হলেও মিছে কথা কইতে পারে না।

কেন সে বড় কাকার খিটমিটে মেজাজ, সারাক্ষণ কেন যে ভুরু জোড়ায় গিঁট মেরে রাখে—সেটা অবশ্য সানু কোনো দিন জানতে চায়নি। মোতালেব কাকাই একদিন অযাচিতে ফিসফিস করেছিল সানুর কানের কাছে—তোর বড় কাকা মেজাজ সারাক্ষণ তিরিক্ষে হয়ে থাকে কেন, তা জানিস?...সানু না-সূচক মাথা নাড়িয়েছে।...তোর জন্যই, বুঝলি কি না, তোর কারণেই তোর বড় কাকার মেজাজ বিগড়ে থাকে সারাক্ষণ।...সানু চোখ বড় করে মোতালেব কাকার দিকে তাকিয়েছে।...মোতালেব কাকা আরও বিশদ করেছে—এই সব ঘরবাড়ি, জমিজমা, পুকুর—এসব যে তোর নামেই রে।...এবারে সানুর চাউনিটা প্রশ্নবোধক।...মোতালেব কাকা জবাবে ব্যাখ্যায় চলে যায়—বুঝলি না বোকা, তুই না মরলে বড় কাকা তোর জায়গাজমি হাতাবে কেমন করে? তোর বাবাকে যে তোর বড় কাকা খুন করেছিল, এ তো বেবাক মানুষ জানে। তোকেও খুন করত, কিন্তু পারেনি তোর বড় কাকির জোরে—তোকে ভীষণ ভালোবাসে তো!—এখন সেও নাকি চলে গেছে বাপের বাড়ি। তাই একটু সাবধানে থাকিস।...মাথা ঝোলানো ভাব নিয়ে মোতালেব কাকার দিকে তাকায় সানু।...এদিক-ওদিক নজর ফেলে মোতালেব কাকা ফুসুরফাসুরে মাতে—তোকে কায়দা করে খুন করতে এখন তোর বড় কাকা যেন উঠেপড়ে লেগেছে। তা লক্ষ করেছিস? সাঁতার না শিখিয়েই নদীতে গোসল করতে পাঠিয়ে দেয় তোকে, আম পাড়তে গাছের মগডালে চড়িয়ে দেয়, মুরগি খুঁজতে রাতের আঁধারে সাপ-খোপে ভরাট ঝোপঝাড়ে ঠেলে দেয়, সে কি এমনি-এমনি? তাই বলি কি, সব দিক একটু বুঝে-সমঝে চল। তোর বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কমতির দিকে, তাই কথাগুলো বললাম।...মোতালেব কাকা তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, হায়! তোর আবার বুদ্ধিশুদ্ধি! তোর বুদ্ধিশুদ্ধি হবে বলেই তো বড় কাকা তোকে আজ পর্যন্ত কোনো ইশকুলে ভর্তি করায়নি।

...রইসুদ্দিনের হাত ধরে কদ্দুর নৌকার দোলা, কদ্দুর রেলগাড়ির দুলুনি, কদ্দুর বাসের ঝাঁকুনি আর কদ্দুর হাঁটাহাঁটির ঝকমারি শেষে সানু যখন ঢাকার বিমানবন্দরের লেজের দিকে এসে পৌঁছাল তখন বিকেল। নৌকোয় সানু একবারই উঠেছিল বড় কাকার সঙ্গে। বড় কাকাই বইঠা বেয়ে নৌকাটাকে মাঝ নদীতে নিয়ে গিয়েছিল! তারপর হঠাৎ করে কী যে হলো—নৌকাটা কাত হয়ে পড়ল কেমন করে যেন আর সানুও নৌকা থেকে ছিটকে নদীতে পড়ে হাবুডুবু—তারপর আর কিছু মনে নেই। পরে শুনেছে, পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা লঞ্চ থেকে কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে সানুকে উদ্ধার করেছিল। ডাঙায় এসে বড় কাকা নাকি সমানে কপাল চাপড়ে ‘হায় কপাল, হায় কপাল’ বলে মাতম করে গেছে। সবাই ভেবেছে, বড় কাকা বুঝি ডুবে যাওয়া নৌকাটার শোকে একেবারে বেদিশা।...তবে সানুর এই প্রথম বাস-ট্রেনে চড়া। দুলুনি-ঝাঁকুনির মুহুর্মুহু আক্রমণগুলো গা সওয়া হয়ে গেল শহর দেখতে পাওয়ার শিহরণ-কাঁপুনিতে। আর শহরে ঢুকতে না-ঢুকতেই গাঁয়ের সেলুন-রেস্টুরেন্টের খোশগল্পের সঙ্গে, আপন স্বপ্ন কল্পনার সঙ্গে, শহরের আসল আদর-সুরত মেলাতে লেগে গেল সানু। দেখা মিলল ইয়া ইয়া ঘর-দালানের।...খানিক বাদে দোতলা রাস্তা।...তারপর দোতলা বাস।...তারপর রাস্তার ওপর বড় কাকার চার মাথা সমান উঁচুতে, মানুষ চলাচলের জন্য সাঁকোর চাইতেও বড় একটা ইয়ে। সানু ভাবল, ওই সাঁকো দিয়ে একবার রাস্তার এধার-ওধার করতে হবে। সানু ভাবল, দোতলা রাস্তায়ও হাঁটাহাঁটি করে নেবে একসময়।

ম্যালা কাজের লোক—এই রইসুদ্দি। ঢাকা শহরে তার প্রায় নিত্যদিনের আনাগোনা। গাঁয়ের তেজপাতা থেকে গরু-ছাগল অবধি শহরে বিকোতে যায় রইসুদ্দি। এমন তেজারতি করে করেই বাজারে তার দু-দুটো দোকান। তবে কেউ বিদেশ যেতে চাইলে—এই দুবাই কি টুবাই—রইসুদ্দিরই ডাক পড়ে। ঢাকার আদ্দেক মানুষই নাকি তার চেনাজানা; ওদের কেউ কেউ আবার লোকজন বিদেশে নিয়মিত পাঠিয়ে থাকে। গাঁয়ের অনেকেই—যেমন সালামত, লোকমান...তারপর তিনটে বাড়ির পর সে ধলা ফুপু, সেই ধলা ফুফুর ছেলে খিজির রইসুদ্দির মারফতে এখন বিদেশে। বছর দুই বছর বাদে একটিবার করে দেশের বাড়ি ঘুরে যায়। মাস-মাস টাকা পাঠায় বাড়িতে। রইসুদ্দিই কষ্টমষ্ট করে ঢাকায় গিয়ে কোন্ আপিস থেকে যেন টাকাগুলো নিয়ে আসে, তারপর বাড়ি-বাড়ি বিলিয়ে কিছু টাকা নিজের পকেটে ঢোকায়—ওটা নাকি তার কমিশন। এতে অনেকেরই চোখ টাটানো অবস্থা। মোতালেব কাকা বলে, কেন বাবু, ঢাকায় গিয়ে টাকা আনতে হবে কেন? তিন কদম গেলে সরকারি ব্যাংক রয়েছে না? ওই ব্যাংকের মারফত ওরা কি টাকা পাঠাতে পারে না?...তাই না শুনে রইসুদ্দি পাল্টা ক্ষোভ ঝেড়েছে—আর আমি যে নিজের ব্যবসাপাতি ফেলে কষ্ট করে ঢাকায় গিয়ে টাকাগুলো মাস-মাস নিয়ে আসছি, যার যার পাওনা কড়ায়-গন্ডায় বুঝিয়ে দিচ্ছি, সে বুঝি খোলামকুচি? আসলে সৎভাবে দুপয়সা কামাই করছি বলে যত্তসব চোখ টাটানো।

সানুর ঢাকা যাওয়ার বায়না-পূরণে বড় কাকার সদয়-সম্মতির লক্ষণ হিসেবে পরদিনই বাড়িতে রইসুদ্দির ডাক পড়ে।

এখন হাফ-বুড়োটা কোন্ ঝগড়া বাধাবে রইসুদ্দি সঙ্গে করে কোনকালে হাফ-বুড়োর কোন্ মর্জির বরখেলাপ করেছিল সে, এই নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ধড়ফড় করে সাতসকালে রইসুদ্দি বাড়ি এসে হাজির।

কী ব্যাপার কাকা? বাড়িতে লোক পাঠিয়ে ডেকে আনলেন—কী ব্যাপার? ধড়ফড় বুকে জিজ্ঞেস করে রইসুদ্দি।

আমার একটা উপকার করতে হবে বাবা!

অনুনয়-বিনয়ে ভারাক্রান্ত বড় কাকার মোলায়েম গলাটি। রইসুদ্দির বুকটা ধড়ফড়ানির তাল ছেড়ে ফুরফুরানি লয়ে চলতে থাকে।

কী উপকার বলুন? আপনার উপকার করতে তো আমি যাকে বলে তালগাছের মতন এক পায়ে দাঁড়িয়ে।

দাঁড়াতে হবে না বাবা, বস! কথা শোন আমার।

দাওয়ায় পাতা দ্বিতীয় জলচৌকিটাতে আসন পাতে রইসুদ্দি।

কী ব্যাপার বলুন শুনি?

সানুকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে তোকে।—বড় কাকা তার অনুরোধটি শোনায়—নিচু গলায়। যেন কোনো গোপন কথা বলছে।

ঢাকায় নিয়ে যাব? বেশ তো! তা বলে ভালোই করেছেন। আমি কালই তো যাচ্ছি ঢাকায়, দুদিন থাকব।

তা থাকিস, দুদিন-চার দিন, যত খুশি। ফিরেও আসিস-ওই দুদিন-চার দিন বাদে, তবে একা!

এক্কা!!-রইসুদ্দির গলায় টাকি মাছের কাঁটা বিঁধল যেন।

সানু ছেলেমানুষ। তাই ঢাকার মতন বড় এক শহর। শহর দেখতে দেখতে একসময় হারিয়েও তো যেতে পারে!—জ্ঞানবৃদ্ধের মতন চিবুক চুলকাতে চুলকাতে ধীরস্থির গলায় কথাগুলো বলল বড় কাকা। বলেই বাঁ চোখটা টিপল।

মনোযোগী ছাত্রের মতন মাথা চুলকাতে চুলকাতে ধীরস্থিরচিত্তে কথাগুলো শুনল রইসুদ্দি। শুনেই ডান চোখটা টিপল।

সেকেন্ড পাঁচ-সাত সাতসতেরো ভাবাভাবির পর রইসুদ্দি জানতে চায়, বাড়িতে একা ফিরে আমার লাভ?

জবাব দেওয়ার জন্য তৈরিই ছিল বড় কাকা। হাতের তর্জনীটা বাড়ির দক্ষিণ দিকে তাক করে বলল, ওই পুকুরের আদ্ধেকটা তোর।

বাড়ির দাওয়া থেকে পুকুরটা নজরে আসে না। মাঝখানে গেরস্থবাড়ি, ধানের খেত, গাছগাছালি...। রইসুদ্দি তাই চোখ বুজে পুুকুরের অর্ধেকটা দেখে নিল। বুকের ভেতর দুটো মৃগেল মাছ ঝপাস-ঝপাস ঘাঁই মেরে গেল, বুকের চড়ুই পাখিগুলো ফুড়ুত-ফুড়ুত উড়ে গেল।

এখন তো কেবল অর্ধেক, পুরোটা দখল নিতে কতক্ষণ আর! তারপর পুকুর ভরাট করে দোকানপাট বসিয়ে দিলে আমাকে আর পায় কে!—রইসুদ্দি বলল। মনে মনে।

এখন তো কেবল পুকুরের টোপ, তারপর ছেলে অপহরণের দায়ে মামলা ঠুকে দেব যখন, তখন বুঝবি মজা।—বড় কাকা বলল। মনে মনে।

...বাসের ভেতর সানু রইসুদ্দিকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, প্রথমে আমরা কোথায় যাব রইস ভাই?

রইসুদ্দি বলল, ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস রে! তা, বিমানবন্দরে গেলে কেমন হয়, বল তো?

সানুর ফ্যালফ্যালে মুখের দিকে তাকায় রইসুদ্দি। তারপর কী সমঝে পরবর্তী কয়েক মিনিট ‘বিমানবন্দর’ সম্পর্কিত একটা নাতিদীর্ঘ রচনা সানুকে শুনিয়ে গেল। সানু মুগ্ধ হয়ে শুনল।

বিমানবন্দরের রানওয়ের মাথা নাকি লেজের কাছটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তাতে কী হয়েছে। ছোট-বড় হাওয়াই জাহাজ এই এখানে নামছে, ওই ওখানে উঠছে—দিব্যি দ্যাখা চলে। আজ সানুর জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন। স্মরণীয় দিন। ওর থমথমে নিরামিষ জীবনের অনেক কিছুরই প্রথম আজ, এই দিনে। জীবনে এই প্রথম রেলগাড়ি দেখা। জীবনে এই প্রথম বাসে চড়া। আর এখন এই হাওয়াই জাহাজ দেখতে পাওয়া। কী সৌভাগ্য? কী সৌভাগ্য! সানু একদিন ওই রকম এক পেটমোটা হাওয়াই জাহাজে চড়বে। তারপর যাবে দুবাই কি টুবাই। তবে তার আগে রইস ভাইকে বলেকয়ে একটু রাজি করাতে হবে—এই যা।

সানুর আশপাশে আরও জনা তিন কুড়ি উৎসুকে মানুষ। ওরা নিশ্চয়ই এখানে নিছক হাওয়া খেতে আসেনি; নিশ্চয়ই হাওয়াই জাহাজের ওঠা-নামা দেখতে এসেছে। আচ্ছা, ওরাও কি সানুর মতন এই প্রথমবার হাওয়াই জাহাজ দেখছে? ওরাও কি গ্রাম ছেড়ে শহরে—আজ এই প্রথমবারের মতন?

হাওয়াই জাহাজ দেখতে দেখতে চোখজোড়া আবেশে আপ্লুত হয়। হাওয়াই জাহাজের বিকট গর্জন ঠেকাতে কান চাপাচাপি করতে করতে কানজোড়া অবশ হয়ে আসে। এমনি করেই চোখ দেখাদেখি আর কান চাপাচাপি করতে করতে হঠাৎ ঝুপ করে কখন যে রানওয়ের আশপাশে রাত নেমে পড়েছে কে জানে! হাওয়া খেতে আসা কি হাওয়াই জাহাজ দেখতে আসা আশপাশের মানুষজনেরও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। দূরে একটা ঝালমুড়িওয়ালা বেশ চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছিল, সেও বুঝি ব্যবসার পাট চুকিয়ে কেটে পড়েছে।

চোখে আঁধার দেখে সানু।

এবং ওই সুনসান অন্ধকারের ভেতরে রইসুদ্দিকে খোঁজে।

‘তোর জন্য একটু ঝালমুড়ি কিনে নিয়ে আসি—শহরের ঝালমুড়ি—কী বলিস?’—বলে রইসুদ্দি সন্ধের আগে সেই যে কোথায় ফেরার হয়ে গেল—দূরের ওই ঝালমুড়িওয়ালার কাছেই বুঝি—এখনো যে ফেরার নামটি নেই!

মনে একটা অজানা-অচেনা ভয় নিঃশব্দে দানা বাঁধে। বুকের ভেতর কে যেন অদৃশ্য একটা চাপকল বসিয়ে দিয়েছে। সেই চাপকলে ধড়াস ধড়াস চাপ পড়তেই, চোখ দুটো দিয়ে নোনতা পানি উগরে বের হলো। গলায় আস্ত গোল সুপুরি পুরে দিল কে যেন—নইলে বার দুই ‘রইস ভাই রইস ভাই’ ডাক ছাড়লেও ডাকগুলো ‘রহ-হিসভ্ভাই হর-হিসভ্ভাই শোনাবে কেন?

না, সানুর ডাক রইসুদ্দির তরফ থেকে ‘এই যে আমি এখানে’-জাতীয় কোনো হাঁক শোনা গেল না। তার বদলে—।

তার বদলে পাশ থেকে কে যেন টিপ্পনী সুরে বলে ওঠে, কেটে পড়েছে।

সানু চমকে অন্ধকারে টিপ্পনীর উৎস খোঁজে।

না, একেবারে অন্ধকার নয়, দূরের রাস্তা আর রাস্তা লাগোয়া ঘরদোরের বাতিগুলো টিমটিমিয়ে উঠেছে তখন। সানুর আশপাশে তাই আধো আলো-আধো অন্ধকার। ওই আলো-আঁধারিতেই সানুর বয়সী এক ছায়ামূর্তির হদিস পেল সানু।

কে? কে কথা কয়?—ছায়ামূর্তিটিকে লক্ষ করে সানু পষ্ট গলায় বলে। সুনসান এলাকায় সানু সে আর একলাটি পড়ে নেই, সঙ্গী-সাথিও জুটেছে একজন, তা ভেবে ভয়ডর উড়াল দিয়েছে।

আমি সারোয়ার, ওরফে ঝাপটা সুরু।—ছায়ামূর্তির তরফ থেকে পরিচয়পত্র পেশ হয়।

দেখতে আন্দাজ যখন ছেলেমানুষ-ছেলেমানুষ, গলার স্বর তখন সানুর মতন কচিকাঁচা, তখন ছেলেটাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করলে বোধকরি কোনো অপরাধ হবে না। সানু তাই বলল, কেটে পড়েছে বললি যে? কে কেটে পড়েছে?

তোর রইস ভাই। কেটে পড়েছে। যাকে বলে ভোকাট্টা। আর এ মুখো হচ্ছে না।—ঝাপটা সুরুর কাটা কাটা জবাব।

যাহ্, কী বলিস? রইস ভাইকে তুই চিনিস বুঝি?

চিনব না কেন, খুব চিনি! খিজির ওস্তাদের খুব কাছের মানুষ, চিনব না তো কী! কতবার দেখেছি ওকে! মাস-মাস ওস্তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়, আর বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে টাকা তুলে দিয়ে বলে ওস্তাদ নাকি দুবাই থেকে টাকা পাঠিয়েছে।

ঝাপটা সুরুর মুখে নতুন তথ্য পেয়ে সানুর মাথার ঘিলুতে তখন আলুথালু অবস্থা।

খিজির? কোন খিজির? ধলা ফুপুর ছেলে খিজির ভাই নয়তো?—সানু রইসুদ্দি-প্রসঙ্গ ছেড়ে খিজিরের খোঁজে নামে।—কিন্তু খিজির ভাই তো দুবাই-টুবাই নাকি কোন দেশে আছে যেন!

দুবাই না ছাই! খিজির ওস্তাদ তোর ওই খিজির ভাই-ই হবে। বিদেশ পাঠানোর নাম করে এক দালালের হাতে ওস্তাদকে তুলে দিয়েছিল রইসুদ্দি। শুধু কি খিজির ওস্তাদ? তোদের গাঁয়ের সবাইকে অমন করেই দালালের কাছে ঠেলে দিয়ে তোর রইস ভাই বেশ পয়সা কামাই করে লালে লাল হয়েছে। তো, কাগজপত্রে কী সব গোলমাল নাকি ছিল, তাই হাওয়াই জাহাজে ওঠার আগেই ওস্তাদকে আর সবার মতো বিমানবন্দর থেকেই বিদেয় নিতে হয়েছিল। বাড়িতে ফেরত না গিয়ে ওস্তাদ শহরে এর সঙ্গে-ওর সঙ্গে মিলমিশ করে নিজেই একটা দল গড়েছে। দলে এখন ম্যালা মানুষের খাটাখাটনি।

খিজির-সংক্রান্ত দীর্ঘ খাজুরে আলাপ শুনে সানু তো থ! বলল, এত সব তুই জানলি কেমন করে?

কেমন করে আবার!—ঝাপটা সুরু জানায় আরও।—আমি তো ওস্তাদের দলেরই একজন ছিলাম। ওর ঝাপটা পাট্টির একজন। মানুষজনকে ভিড়ের মধ্যে জাপটে ধরে কি ঝাপটা মেরে জিনিসপত্তর হাতিয়ে নিতে আমার জুড়ি ছিল না। তাই না আমার নাম ঝাপটা সুরু।

তুই জিনিসপত্তর লুট করিস!—সানুর চোখজোড়া ফের কপালে।

আমি আর এখন এসবের মধ্যে নেই।—ঝাপটা সুরু চুপিসারে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বলে মনে হলো। গলার স্বরে কেমন তেতো-তেতো ভাব।

খিজির ভাই শহরে লুটপাট করে বেড়ায়।—সানু আনমনে নিজেকে শোনায়। ধলা ফুফুর হাসিমুখটা ভেসে ওঠে আপনা থেকেই।

সানুর স্বগতোক্তি ভেসে সুরুর কানে গিয়ে থাকবে হয়তো। বলল, তা করে তো! শহরের সবাই তো এখন লুটপাটে ব্যস্ত।

সানুর মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ে। মাথাটাকে বাঁচাতে কান চেপে ওপরে তাকিয়ে দেখে, একটা হাওয়াই জাহাজ গলা ফাটানো শব্দ করে উড়ে গেল, নাকি নেমে পড়ল।

কান থেকে হাত দুটো সরিয়ে সুরুকে জিজ্ঞেস করে সানু, এখন তাহলে তুই কী করছিস?

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

কিছুই না! কিছুই করতে হয় না আমাকে এখন। —দারুণ খোশমেজাজে সুরু জানায়।—বেশ আরামে দিন-রাত কেটে যাচ্ছে। ঘুরে ঘুরে শহর দেখে বেড়াই শুধু। অনেক দিন বাদে এখানে হাওয়া খেতে এসে দেখি রইসুদ্দি, তোকে একা ফেলে কেটে পড়ছে। আমার বেলায়ও এমনটি হয়েছিল এককালে। ছোট কাকা আমাকে শহর দেখাবে বলে—সে যাকগে! তা, তোর ওপর মায়া হলো বেশ। রইসুদ্দির পিছু নিয়ে দেখি, ব্যাটা ওস্তাদের ডেরার দিকে যাচ্ছে। তাই তোকে সাবধান করে দিতে...।

আগে বললি না কেন? রইস ভাই যখন পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন বললি না কেন?—গলায় অভিমান ফোটায় সানু।

তখনো রাত নামেনি তো! দিনের বেলা মানুষজনের কাছে মুখ দেখাব না আর, ঠিক করেছি।

কেন? তা কেন?

খিজির ওস্তাদ ফের দেখতে পায় যদি আমাকে? ফের যদি গলা টিপে দেয় আমার?—ঝাপটা সুরুর গলায় আঁতকানো ভাব।

গলা টিপে ধরবে! কেন?

ওই যে—একবার একজনার হাতব্যাগ হাতিয়ে সেটা ওস্তাদের হাতে তুলে দিতেই ওস্তাদ দেখল কী, ব্যাগের ভেতর আপিসের কাগজপত্র ছাড়া কিস্যু নেই। ওটার ভেতর নাকি অনেক অনেক সোনার বিস্কুট থাকার কথা। ওস্তাদ আমার গলা টিপে সোনা কোথায় রেখেছি তা জানতে চাইল। আমি কিছু বলতে পারার আগেই ওস্তাদ আমাকে মোটরে করে ওই আশুলিয়ার ধারে বস্তায় ভরে ফেলে এল। তারপর থেকেই তো...। শেষের দিকে সুরুর গলাটা ধরে আসে যেন।

খিজিরের গলাটেপা স্বভাবে কথা শুনে অবাক হলো সানু। ধলা ফুফুর হাসিমুখ চেহারাটা মনে পড়ে গেল আবার।

সানুকে অতঃপর দারুণ অসহায়তায় পেয়ে বসে। সানু এদিকে তাকায়। সানু ওদিকে তাকায়। ঝাপটা সুরুর শরীরের আবছা আভাস আর থোকা থোকা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না।

কী করি এখন? আমি এখন কী করি?—প্রায় হাঁসফাঁস করতে করতে সানু তার অসহায়তার বাক্যরূপ দিয়ে বসে।

ঝাপটা সুরু অবিকল গলায় সান্ত্বনা দেয়।—এতটা উতলা হচ্ছিস কেন? তুই একটু দাঁড়া, আমি এই আসছি।

এই বলে ঝাপটা সুরু যে কর্ম্মটি করল, তাতে সানুর চক্ষু চড়কগাছ!

ঝাপটা সুরু করল কী হঠাৎ চরকির মতন ঘুরপাক খেতে খেতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তারপর খানিক বাদে ওই চরকির মতন ঘুরপাক খেতে খেতে, যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে কথা কইছিল খানিক আগে, সেখানটিতে ঘূর্ণির মতন কিছু একটা পাকিয়ে নিজেকে ফের হাজির কিংবা জাহির করল ঝাপটা সুরু।

হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তোর জন্য সুখবর আছে রে। দেখে এলাম—রইসুদ্দি সত্যি সত্যি ওস্তাদের ডেরায়। কথা কইছিল ওস্তাদের সঙ্গে। শুনলাম, তোকে নাকি দলে নেওয়ার জন্য ওস্তাদ লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। আপাতত চাঁদাবাজির শাখায় ভর্তি করিয়ে নেওয়া হবে তোকে। একটু সবুর কর, এই ওরা এল বলে।

সুরুর কথা শুনে আঁতকে ওঠে সানু। গলা কাঁপাতে কাঁপাতে বলল, ন্-না, ন্-না! সে ক-কী ক্-করে হয়? কক্খনো না! কক্খনো না!

কক্খনো না কী করে? চাঁদাবাজি তো সোজা সাদাসাপটা কাজ! ফি-হপ্তায় দু-চারটে রাস্তার দোকানপাটে যাবি আর খিজির ওস্তাদের নাম করে টাকা তুলে নিয়ে আসবি—এই তো কাজ! তা ছাড়া, ওস্তাদ নিশ্চয়ই তোর গলা চেপে ধরবে না কখনো—একই গাঁয়ের মানুষ—তাই খিজির ভাই বলে ডাকিস যখন!

না, না, না, আমি যাব না। খিজির ভাইয়ের কাছে যাব না আমি।—সানু চেঁচায়। প্রতিবাদের আর কোনো ভাষা ওর যে জানা নেই।

তাহলে যাবিটা কেথায় শুনি?—ঝাপটা সুরু শুধায়।

আকাশছোঁয়া ঘরসমান, দোতলা রাস্তা, দোতলা বাস, মাথার ওপর কুড়ি-কুড়ি তারা—তার মধ্যিখানে এক ফালি চাঁদ, এইমাত্র উড়াল দেওয়া একটা হাওয়াই জাহাজ—সবকিছু ছাপিয়ে একজনার মুখ ভেসে আসে। পরনে ফলের নকশা করা শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। নাকে নোলক। দুহাতে দুগাছা চুড়ি। গলায় ‘সানু! ও সানু!’—ডাক। হাতে পায়েসের বাটি।...

সানু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে বসে।

সানু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে বসে।

সানু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে করতে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে পুরো বিমানবন্দর কাঁপাতে কাঁপাতে চিৎকার দিয়ে ওঠে—আমি বড় কাকির কাছে যাব! আমি বড় কাকির কাছে যাব! সুরু রে, আমাকে বড় কাকির কাছে নিয়ে চল।