সিবুর পৃথিবী

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

বাবার সঙ্গে ঢাকায় থাকে নীরা। ঢাকায় দুটো গার্মেন্টস আছে ওর বাবা আফজাল সাহেবের। নীরার বয়স যখন চার, তখন তার মা মারা যায়। আফজাল সাহেব ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন বলে খুব একটা সময় দিতে পারেন না নীরাকে। মরিয়ম নামের একজন আধবয়সী নারী ওর দেখাশোনা করে। এ বছর ক্লাস সেভেনে উঠল নীরা। লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো সে। বাবা তাকে বলেছিলেন আবারও নীরা যদি ক্লাসে ফার্স্ট হয়, তবে তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। এবারও বার্ষিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে নীরা। তাই বাবার কাছে গ্রামের বাড়ি যাবার বায়না ধরেছে সে। নীরা কখনো গ্রাম দেখেনি। গ্রাম কেমন হয় সে জানে না। বাবা অফিস থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে নীরা বলল, ‘বাবা, আমরা গ্রামে যাব। তুমি না বলেছিলে এবার আমি ফার্স্ট হলে তুমি আমাকে গ্রামে নিয়ে যাবে?’ ‘যাব, কিন্তু এখন অনেক কাজ। কদিন পর যাই।’ ‘না না না, কদিন পরে আমার স্কুল খুলবে, তখন আর যাওয়া হবে না।’ ‘ওকে বাবা, কাল যাব।’ ‘আই লাভ ইউ, আব্বু’ বলে বাবাকে আদর করে নীরা নিজের ঘরে চলে গেল। পরদিনই বাবার সঙ্গে গ্রামে এল নীরা। গ্রামে নীরার চাচা আরমান আলী স্ত্রী আর তাঁর সাত বছরের মেয়ে ইনুকে নিয়ে থাকেন। নীরাকে দেখে সবাই খুব খুশি। নীরাকে আদর করে কুশল বিনিময় করে তাদের ঘরে নিয়ে গেলেন চাচা। এক দিনেই ইনুর সঙ্গে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল নীরার। নীরার কাছে সে শহরের কথা শোনে, শোনে স্কুলের কথা। নীরা ওকে পড়ায় এ ফর অ্যাপল, বি ফর বল, সি ফর ক্যাট। নীরা যখন বারান্দায় বসে ইনুকে পড়াচ্ছিল, তখন নীরার বাবা ও চাচা পাশে বসে গল্প করছিলেন। সে সময় একটা ছেলে এসে নীরার চাচাকে বলল, ‘চাচা, আব্বায় আইজ কামে আইতে পারব না। আব্বার শরীরটা বেশি ভালো না। আপনের আমের গাছগুলানে নাকি ঘিরা দেওয়া লাগবো। এই পাঁচ-ছয় দিন এগুলান আমি করমু, আপ্নে শুধু দেখাইয়া দেন।’ ‘বাড়ির পিছনে বাঁশ আছে, ওই কাঁঠালগাছের নিচে কাজ কর সিবু।’ বলে আরমান আলী ছেলেটাকে বাঁশগুলো দেখিয়ে দিলেন।

সিবুর বয়স পনেরো বছর। লেখাপড়া করে না সে। বাবাকে খেতের কাজে সাহায্য করে। সিবু কাঁঠালগাছের নিচে বসে বেড়ার জন্য বাঁশ তৈরি করছিল। নীরা এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম সিবু?’ ‘জি, ভালো নাম হুমায়ুন, তয় লোকে সিবু কইয়া ডাকে’—সিবু উত্তর দেয়। নীরা বলল, ‘বাহ! তুমি হুমায়ূন আহমেদকে চেনো?’ ‘কোনো দিন নামই শুনি নাই’, সিবু উত্তর দিল। ‘সে কী, তুমি হুমায়ূন আহমেদকে চেনো না? এত বড় একজন লেখক! আমি মনে করছিলাম বাংলাদেশের সবাই তাঁকে চেনে। কেন তুমি বইয়ে পড়োনি?’ ‘জি না, আমি পড়ি না’, সিবুর সংক্ষিপ্ত উত্তর। ‘ও...সরি। তাহলে শোনো, হুমায়ূন আহমেদ মস্ত বড় একজন লেখক। হিমু, মিসির আলির মতো অদ্ভুত আর বিচিত্র চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। আচ্ছা সিবু, তুমি যে বাঁশ কাটছো, বলো তো বাঁশের ইংরেজি কী?’ ‘আমি ইংরেজি জানি না আফা।’ ওপাশ থেকে ইনু বলল, ‘ব্যাম্বু।’ আফজাল সাহেব বললেন, ‘বাহ্ ইনু, খুব চমৎকার।’ ইনু বলে, ‘নীরা আপু কাল রাতে ঘুমানোর সময় শিখিয়েছে।’ আফজাল সাহেব, আরমান আলী, নীরা সবাই হো হো করে হেসে উঠল। তারপর খাওয়ার জন্য বাড়ির ভেতর ঢুকল সবাই। পরদিন সকালে সবাই যখন বারান্দায় বসে গল্প করছিল, সিবু এসে বাঁশ নিয়ে কাজে লেগে গেল। নীরার বাবা ও চাচা বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন। কাঁঠালগাছের নিচে ইনুর সঙ্গে হাঁড়ি-পাতিল খেলছিল নীরা। হঠাৎ সিবু নীরাকে বলল, ‘আফা, একটা কতা কই। শহরে আপনাদের যে বিশাল বাড়ি তার যে ঘরটায় আপনি থাকেন তার বিছানার ডান পাশের টেবিলে একটা নীল রঙের ফুলদানি আছে, তাই না?

চমকে উঠল নীরা। ছোট একটা ধাক্কাও খেল সে। তারপর মুখে হাসি নিয়ে বলল, ‘তুমি জানলে কী করে?’ ‘আগে কন কাউরে কইবেন না।’ ‘আচ্ছা, কাউকে বলব না, বলো।’ ‘আমি কাইল স্বপ্নে দেখছি। আমি প্রায় প্রায় আগে থাইকা এ রকম স্বপ্ন দেখি। আমার দু-একজন বন্ধুরে বলছি, তারা আমারে পাগল মনে করে। তাই আর কাউরে কই না।’ নীরা বলল, ‘বাহ্ বেশ মজার তো।’ ‘আফা, আপনে কন, কাউরে কইবেন না।’ ‘বাবা, বলব না। আচ্ছা তুমি আর কী কী দেখো বলো তো?’ ‘আপনার আলমারিতে একটা বাক্স আছে, ওতে আপনি চশমার গ্লাস, চুম্বক, বিভিন্ন লোহা ও আরও যন্ত্রপাতি রাখছেন।’ নীরা এবার বড় একটা ধাক্কা খেল। দুই পা পিছিয়ে এল সে। কারণ, সত্যি সত্যি সে তার ঘরে বিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য একটা বাক্সে ম্যাগনিফাইং গ্লাস, চুম্বক, সোডিয়াম ধাতু, লিটমাস কাগজসহ অনেক কিছুই রেখেছে। শেষে বাবা তাকে বকা দেবেন, তাই বাবাকেও জানায়নি সে। এটা তো কারও জানার কথা নয়। নীরা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তাহলে তুমি স্বপ্নে দেখো এবং যা দেখো সব সত্যি?’ নীরার কথায় যেন লজ্জা পেল সিবু। বলল না কিছুই।

নীরা ইনুকে নিয়ে ভেতরে গেল। পরদিন সকাল পর্যন্ত ঘুম ছাড়া প্রায় সারাটা সময় নীরা সিবুর এই অদ্ভুত ক্ষমতার কথা ভেবেছে সে। সকালে আবার ইনুর সঙ্গে খেলছিল নীরা। সিবু কাজ করছিল আপন মনে। নীরাকে এখন অনেকটা স্বাভাবিক লাগছে। সিবুর এই ব্যাপারটা নিয়ে বোধ হয় আর মাথা ঘামাচ্ছে না। দূর থেকে নীরার বাবা বললেন, ‘মা তুমি লেখো, আমি ওই ঝোপের ধার থেকে একটু ঘুরে আসি।’ নীরা বলল, ‘ওকে বাবা।’ সিবু একটা অদ্ভুত আতঙ্ক নিয়ে নীরাকে বলল, ‘আফা, আপনে ওনারে যাইতে দিয়েন না আফা, যাইতে দিয়েন না।’ ‘কেন বলো তো?’ নীরা জবাব দেয়। ‘আফা, আমি কাইল স্বপ্নে দেখছি যে ওই ঝোপে আপনের আব্বারে সাপে কামড়াইছে। আপনি ওনারে যাইতে দিয়েন না।’ নীরা কী করবে বুঝতে পারল না। সে কি সিবুর এ অবাস্তব কথাগুলোকে মেনে নেবে? সত্যি কি তা হবে? তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত বলল, ‘আচ্ছা, সাপ কোথায় কামড়াবে বলো তো।’ ‘আফা বাম পায়ের গোড়ায়।’ নীরা দৌড়ে গিয়ে বাবার হাত ধরে বলল, ‘বাবা, তোমার যেতে হবে না।’ বাবা বললেন, ‘কেন, তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’ নীরা কী করবে বুঝতে পারছে না। সে কী করে বলবে কথাটা? তাহলে তো সবাই সিবুকে পাগল ভাববে। আর যদি সিবুর কথাই সত্যি হয়, ভাবতেই শিউরে উঠল নীরা। বাবা বললেন, ‘কী হলো?’ ‘আচ্ছা বাবা, তুমি যাও, তবে ওই ঘরে আমি একজোড়া বুট দেখেছি, সেগুলো ভারী আর হাঁটু পর্যন্ত লম্বা—ওগুলো পরে যাও।’ বাবা বললেন, ‘কেন?’ নীরা বলল, ‘অনেক ঝোপে কাঁটা থাকে, তোমার যদি ব্যথা লাগে।’ ‘ওকে।’ বলে বুট পরে বেরিয়ে গেলেন নীরার বাবা।

বাবা না ফেরা পর্যন্ত বারান্দার এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে লাগল নীরা। কী হবে? সত্যি কি বাবাকে সাপে কামড়াতে আসবে? তা কী করে সম্ভব! মানুষ কী করে আগে থেকে সব বলতে পারে। তা কী করে হয়? প্রায় ঘণ্টা খানেক পর দৌড়ে এসে নীরাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলেন নীরা। আর বললেন, ‘আজ তোর জন্য অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম মা।’ শুনে ইনুর আম্মু বেরিয়ে এসে বললেন, ‘ভাইজান কী হইছে?’ নীরার বাবা কাল ঝোপের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন, হঠাৎ একটা সাপ বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ছোবল মারল।’ ইনুর আম্মু আর্তস্বরে বললেন, ‘ভাইজান, আপনের কিছু হয় নাই তো?’ ‘আরে না, ভাগ্যিস নীরার কথামতো ভারী বুটগুলো পরে গিয়েছিলাম! তাই কিছু হয়নি। আজ নীরার কথা না শুনলে কী যে হতো কে জানে।’ সবাই নীরার বুদ্ধির প্রশংসা করতে লাগলেন। এ সময় বাড়িতে ইনুর বাবা ঢুকলেন। তিনি সব কথা শুনে নীরাকে আদর করতে করতে বললেন, ‘মা আমার খুব বুদ্ধিমতী।’ সবাই যখন নীরাকে নিয়ে ব্যস্ত, সিবু কাঁঠালগাছের নিচে কাজ করছিল বেড়া বানানোর জন্য। নীরা কারও কথাই যেন ভালোভাবে শুনল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিবুর দিকে। এ কী করে সম্ভব, কী হলো এটা, কেনই-বা হলো। সবাই ভেতরে ঢুকলে নীরা আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সিবুর কাছে চলে গেল। বলল, ‘সিবু, অনেক ধন্যবাদ। তুমি আজ আমাদের এত বড় উপকার করলে। আমি তো প্রথমে তোমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইনি। মনে করেছিলাম ব্যাপারটা কাকতালীয়। তুমি কিন্তু অসাধারণ একটা ছেলে।’ সিবু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আফা, আপনে এগুলো আর কাউরে কইবেন না। সবাই আমারে পাগল কইব।’

নীরা ভেতরে গেল সবার সঙ্গে দেখা করার জন্য। সারারাত ঘুমাতে পারেনি সে। কী করে সম্ভব, এটা স্বপ্ন না বাস্তব। তবে বিজ্ঞান কি ভুল? পরদিন সিবু যখন কাজ করছিল, নীরা ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা সিবু, তুমি আর কী কী দেখো বলো তো?’ ‘আফা, দেখি শূন্যের মধ্যে আকাশের ওপর রেললাইন। কী জোরে ট্রেন যায়! মনে হয় বিমানের চেয়েও জোরে। আর দেখি কালো গর্ত দিয়ে নিচে যাইতেছি বাতাসের চেয়েও জোরে।’ নীরা বিড়বিড় করে নিজে নিজেই বলল, ‘ব্ল্যাকহোলস’। আচ্ছা সিবু, তোমার কাজ কখন শেষ হবে। ‘কেন আফা?’ কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে সিবু। ‘তুমি আমাকে আর ইনুকে ওই মাঠটা ঘুরে দেখাবে আজ বিকেলে।’ ‘কিন্তু সেটা তো হইব না আফা।’ নীরা বলল, ‘ও তুমি বাবার কথা বলছ? বাবা কিছু বলবেন না। আমার বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা। তুমি শুধু বলো পারবে কি না।’ ‘আপনের আব্বায় একটু পরে আপনেরে নিয়া ঢাকা যাইব।’ নীরা ছোট করে বলল, ‘স্বপ্নে দেখেছ বুঝি।’ সিবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিল। নীরা হো হো করে হেসে নিল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘সিবু, তুমি এই স্বপ্নটা বোধ হয় ভুল সময়ে দেখেছ। কারণ, কালই বাবা আমায় বলেছেন আমরা আরও দিন চারেক এখানে থাকব। সো ইউ আর রং।’ বলে হাসতে লাগল নীরা। সিবু কিছু না বলে কাজে মন দিল। ঠিক তখনই নীরার বাবা ভেতর থেকে এসে বললেন, ‘মা, একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে, এক্ষুনি আমাদের ঢাকায় রওনা হতে হবে। তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি করতে বলি।’ নীরা বলল, ‘তুমি না কাল বললে আমরা আরও চার দিন এখানে থাকব।’ ‘হ্যাঁ, বলেছি কিন্তু হঠাৎই খুব জরুরি একটা কাজ পড়ে গেল। ঢাকা থেকে ফোনে বলল। যাও তাড়াতাড়ি তৈরি হও’ বলে নীরার বাবা ভেতরে গেলেন। নীরা আর একটাও কথা বলতে পারল না।

চাচা, চাচি ইনুকে বিদায় দিয়ে নীরা ও বাবা গাড়িতে উঠল। চলতে লাগল গাড়ি। জানালা দিয়ে নীরা দেখল রাস্তাটাকে। আচ্ছা, রাস্তাটা পেছনে যাচ্ছে না আমরা সামনে যাচ্ছি? ভাবল নীরা। সিবু কি তবে এলিয়েন, না অন্য পৃথিবীর মানুষ? নাকি এমন পৃথিবী, যার বয়স পাঁচ শ বছরেরও বেশি। যে পৃথিবীর সবাই এই পৃথিবী সম্বন্ধে জানে। যে পৃথিবীতে আলোর বেগ 3'108ms-1 এর চেয়ে বেশি। আর এ ব্ল্যাকহোলস বা শূন্যের রেললাইন, যে রেলের গতি কিনা রকেটের চেয়েও বেশি। তাহলে কি আলোর চেয়েও দ্রুতগামী যান? তাহলে কি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র, কিংবা আইনস্টাইন অথবা স্টিফেন হকিং ভুল হতে চলেছে। কতটাই-বা পরিসীমা সিবুর পৃথিবীর—গাড়িতে বসেই এসব চিন্তা করতে লাগল নীরা। এগিয়ে চলল গাড়ি তার চেনা শহরের দিকে চেনা-অচেনা এক পৃথিবী ছেড়ে—যে পৃথিবীর একজন বাসিন্দা সিবু।