সুখী রাজপুত্র

অলংকরণ: প্রসুন হালদার

শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গাটাতে সুখী রাজপুত্রের মূর্তিটা দাঁড়িয়ে আছে। গাছের সোনালি পাতা দিয়ে মূর্তিটা ঢাকা। শহরের লোকজন যে-ই মূর্তিটার পাশ দিয়ে যায়, সে-ই এর প্রশংসা করতে থাকে।

একটা ছোট্ট বাচ্চা চাঁদের জন্য কান্না করছিল। মা তাকে বলল, ‘আমাদের এই সুখী রাজপুত্রের মতো তোমার হওয়া উচিত। সে কখনো কোনো কিছুর জন্য কান্না করেনি।’

একজন চরম হতাশ লোক রাজপুত্রের মূর্তিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘আহ্, আমাদের এই শহরে সুখী রাজপুত্রের মতো একজন সুখী মানুষ তাহলে আছে।’

এতিমখানা থেকে বাচ্চারা বের হয়ে আসছিল। তারা বলল, ‘দেখো, মূর্তিটা একদম দেবদূতদের মতো দেখতে।’

এক রাতে ছোট্ট পাখির ঝাঁক শহরের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পথের মাঝে একটা ছোট্ট পাখি দল থেকে বের হয়ে এসে শহরে থেকে গেল। শহরটা তার কাছে খুব ভালো লেগেছে। রাতের বেলা সে মূর্তিটার দুই পায়ের ফোকরে এসে আশ্রয় নিল। তার পাখা দুটো ভাঁজ করে যখন সে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই হঠাৎ তার মুখের ওপর এক ফোঁটা পানি এসে পড়ল। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, ঝকঝকে নীল আকাশ। তাহলে এ বৃষ্টির ফোঁটা কোত্থেকে এসে পড়ল? ভাবতে ভাবতেই আরেক ফোঁটা পানি তার মুখের ওপর পড়ল। সে ভাবল, মূর্তিটা যদি বৃষ্টির পানি না ঠেকাতে পারে, তাহলে এটার নিচে আশ্রয় নিয়ে কী লাভ? সে ডানা মেলে যখন ওড়ার প্রস্তুতি নিল, তখনই তৃতীয় ফোঁটা পড়ল তার মাথায়। ছোট্ট পাখিটা ওপরে তাকিয়ে দেখে মূর্তিটার চোখ থেকে পানি পড়ছে। সুখী রাজপুত্রের মূর্তিটা কাঁদছে। রাজপুত্রের সোনালি গাল বেয়ে পানি পড়ছে। পাখিটার খুব মায়া হলো।

সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’

‘আমি সুখী রাজপুত্র।’

‘তাহলে তুমি কাঁদছ কেন?’

‘আমি যখন জীবিত ছিলাম, তখন মানুষের হৃদয়ের মতো আমারও ছোট্ট একটা হৃদয় ছিল। কান্না কী জিনিস জানতামই না আমি। একটা রাজপ্রাসাদে থাকতাম। সেখানে কোনো দুঃখ প্রবেশের অনুমতি ছিল না। সারা দিন হইহল্লা করতাম। রাজপ্রাসাদের উঁচু চার দেয়ালের বাইরে কী আছে, তা জানতাম না। আমার দেশের লোকেরা আমাকে বলত সুখী রাজপুত্র। একদিন আমি মরে গেলাম। শহরের লোকজন সবচেয়ে উঁচু জায়গায় আমার মূর্তি বসাল। যেন আমি শহরের সব কুৎসিত বিষয় আর নোংরামি দেখতে পারি। এখন আমার হৃদয় কান্না ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।’

‘রাজপুত্রকে দেখতে খাটি সোনা মনে হচ্ছে।’ ছোট্ট পাখিটা মনে মনে বলল।

‘শহরের শেষ মাথায় এক গরিব মহিলার ছোট্ট একটা ঘর আছে। জানালা খোলা। আমি জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সেই মহিলা মহারানির সম্মানিত সেবিকার জন্য সুন্দর একটা পোশাক তৈরি করছে। সেখানে নানা রকম ফুলের কারুকাজ। বিছানায় তার ছোট্ট ছেলেটির জ্বর। ছেলেটি কমলার জুস খেতে চাচ্ছে। কিন্তু মায়ের কাছে নদীর পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। ছোট্ট পাখি, তুমি কি আমার তরবারির খাপ থেকে এক টুকরো মুক্তো নিয়ে সেই মাকে দিয়ে আসবে? আমার পা বাঁধা। নড়তে পারছি না আমি।’

‘আমাকে মিসর যেতে হবে। আমার বন্ধুরা সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা নীল নদের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে মহান রাজার সমাধিতে আমাকে যেতে হবে।’

‘ছোট্ট পাখি আজকের রাতটা তুমি আমার সাথে থাকো। আমার পক্ষ থেকে বালকটার কাছে যাও। বালকটা খুব তৃষ্ণার্ত। ওর মা খুব কষ্টে আছে।’

‘শিশুদের আমি পছন্দ করি না।’ পাখিটা বলল। ‘গত গ্রীষ্মে আমি যখন নদীর তীর দিয়ে উড়ছিলাম, তখন সেখানে দুটো ছেলে আমার দিকে পাথর ছুড়ে মেরেছিল।’

সুখী রাজপুত্রকে খুব দুঃখী মনে হলো। তাই ছোট্ট পাখির মনে দয়া হলো। সে বলল, ‘ঠিক আছে, শুধু আজকের রাতটা আমি তোমার সাথে থাকব। তোমার হয়ে কাজ করব।’

পাখিটা মূল্যবান মুক্তো নিয়ে দরিদ্র মহিলার ঘরে এসে দেখল মহিলা ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলেটা শুয়ে আঙুল দিয়ে খেলা করছে। ছোট্ট পাখি তার মহামূল্যবান নীলা পাথরটা মহিলার টেবিলের ওপর রাখল।

সুখী রাজপুত্র বলল, ‘ছোট্ট পাখি, ছোট্ট পাখি তুমি কি আর একটা রাত আমার সাথে থাকবে?’
অলংকরণ: প্রসুন হালদার

ফিরে এসে পাখিটা রাজপুত্রকে সব খুলে বলল। রাজপুত্র খুশি হলো। পরদিন পাখিটা মিসর চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। তখন সুখী রাজপুত্র বলল, ‘ছোট্ট পাখি, ছোট্ট পাখি তুমি কি আর একটা রাত আমার সাথে থাকবে?’

‘আমার বন্ধুরা মিসর আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’ পাখিটা বলল।

‘দেখো ওই অনেক দূরে একটা ঘরে আমি একজন দুঃখী যুবককে দেখতে পাচ্ছি। তার ঘরে এই শীতে কোনো গরম পোশাক নেই। খাবার নেই। সে মঞ্চ নাটকের জন্য একটা গল্প লিখছে। কিন্তু ক্ষুধায় কাতর হয়ে সে আর লিখতে পারছে না। আমার কাছে আর কোনো মূল্যবান জিনিস নেই। শুধু আমার চোখ দুটো ছাড়া। ভারত থেকে মহামূল্যবান নীলা পাথর দিয়ে আমার চোখ দুটো তৈরি। তুমি ওখান থেকে একটা নিয়ে যুবকটাকে দিয়ে এসো। এটা বিক্রি করে সে খাবার আর পোশাক কিনতে পারবে।’

পাখিটা সুখী রাজপুত্রের কথামতো কাজ করল। তার পরের দিন পাখি যখন মিসর যাওয়ার জন্য রাজপুত্রের কাছে বিদায় চাইল, তখন রাজপুত্র বলল, ‘ছোট্ট পাখি, তুমি আর একটা রাত আমার জন্য থাকো।’

‘কীভাবে থাকি বলো। এখানে শীত চলে এসেছে। আর মিসরে এখন উষ্ণ আবহাওয়া। আমার বন্ধুরা নদীর তীরে বাসা বানানো শুরু করে দিয়েছে।’

‘ওই যে দূরে ছোট্ট একটা দুঃখী মেয়ে। মেয়েটা দেশলাই বিক্রি করে। আজকে তার সবগুলো দেশলাই নর্দমায় পড়ে গেছে। ওর বাবা খুব মারবে ওকে। তুমি আমার দ্বিতীয় চোখের মণিটা ওকে দিয়ে আসো।’

‘তুমি তাহলে আর কিছুই দেখতে পাবে না।’ পাখিটা বলল।

‘তোমাকে যা বলছি, তুমি তা করো।’

পাখিটা সুখী রাজপুত্রের দ্বিতীয় চোখের নীল মণি পাথরটা উঠিয়ে মেয়েটার হাতে রেখে এল। মেয়েটা খুব খুশি হলো। পাখি ফিরে এসে রাজপুত্রকে বলল, ‘তুমি এখন অন্ধ। তাই আমি আর কোথাও যাচ্ছি না। তোমার সাথেই সব সময় থাকব।’

রাজপুত্র বলল, ‘আমার শরীর মূল্যবান স্বর্ণ দিয়ে ঢাকা। তুমি এগুলো নিয়ে শহরের দুঃখী মানুষগুলোকে দাও’
অলংকরণ: প্রসুন হালদার

পরদিন সে রাজপুত্রের কাঁধে বসে থাকল। সুখী রাজপুত্রকে সে মিসরের নানা রকম গল্প বলে শোনাল। রাজপুত্র বলল, তোমার এসব গল্পের চেয়ে আরও আশ্চর্য আর গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমার শহরের দুঃখী মানুষের গল্প। তুমি সেখানে উড়ে যাও আর আমাকে শহরের গল্পগুলো এসে বলো।’

সেই মহান সুখী শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে পাখিটা দেখল, ধনীরা অনেক খরচ করে বিয়ের আয়োজন করছে আর দুঃখী ক্ষুধার্ত মুখগুলো বাড়ির দরজার সামনে বসে আছে। পাখিটা ক্ষুধায় কাতর ফ্যাকাশে শিশুদের মুখগুলোও দেখল। তারপর রাজপুত্রের কাছে এসে সবকিছু খুলে বলল। রাজপুত্র বলল, ‘আমার শরীর মূল্যবান স্বর্ণ দিয়ে ঢাকা। তুমি এগুলো নিয়ে শহরের দুঃখী মানুষগুলোকে দাও।’

পাখিটা রাজপুত্রের কথামতো কাজ করল। রাজপুত্রের শরীরের স্বর্ণগুলো সে গরিব মানুষগুলোর কাছে বিলিয়ে দিল। ফলে চোখহীন রাজপুত্রের মূর্তিটা তখন বেশ বিবর্ণ হয়ে পড়ল। এর মধ্যেই শীত চলে এল। ছোট্ট পাখিটা শীতে কাবু হয়ে পড়ল। পাখিটা বুঝতে পারল, সে আর বাঁচবে না। তাই সে রাজপুত্রের কাছে বিদায় চাইল। তারপর সুখী রাজপুত্রের পায়ের কাছে মরে গেল।

পরদিন সকালে শহরের মেয়র যখন তাঁর চাটুকার সহকারীদের সঙ্গে নিয়ে মূর্তিটার কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মূর্তিটা দেখে বললেন, ‘এহহে মূর্তিটা দেখতে কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। চোখ দুটো অন্ধ, শরীরে কোনো চাকচিক্য নেই। নাহ্, এই মূর্তিটা ভেঙে ফেলতে হবে। আবার মৃত পাখিও দেখা যাচ্ছে। মূর্তির চারপাশে যেন কোনো পাখি না আসতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এই মূর্তিটা ভেঙে এখানে আমার মূর্তি বসাব।’

মেয়রের দুই চাটুকার সহকারী বলল, ‘জি হুজুর, ঠিক বলেছেন। তাই করতে হবে।’

অস্কার ওয়াইল্ড (১৮৫৪-১৯০০): আইরিশ নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কবি। সাহিত্যের নানা ধারায় তিনি লিখেছেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে তিনি লন্ডনের সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হচ্ছে দ্য হ্যাপি প্রিন্স অ্যান্ড আদার স্টোরিস, দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে, হাউস অব প্রোমগ্রেনেটস।