স্কুলে একদিন

বিপনুর বাঁ পায়ে একটু সমস্যা আছে। ছোটবেলা থেকেই তার এই সমস্যা।
পোলিও হয়েছিল। তার পর থেকেই সে একটু টেনে টেনে হাঁটে। এবং খুব দ্রুত সে হাঁটতে পারেও না। নতুন যে স্কুলটায় সে ভর্তি হয়েছে, সেখানে ঠিক এই কারণে তার একটু সমস্যাও হচ্ছে। দুটো সমস্যা—
সমস্যা-১: সে স্কুলে প্রায় প্রতিদিন টিফিন মিস করছে, টিফিন খেতে পারছে না।
সমস্যা-২: তাকে তার ক্লাসের একটা বদ টাইপের ছেলে ল্যাংড়া বলে ডাকে। টিফিন খেতে পারছে না, এটাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সে মনে করছে না। কিন্তু তাকে যে ল্যাংড়া ডাকে একটা ছেলে, সে এটা মেনে নিতে পারছে না।
ছেলেটা তার চেয়ে বেশ বড়সড় এবং একটু মাস্তান টাইপের। তা ছাড়া ছেলেটা নাকি এলাকার এক নেতার ছেলে। তাই স্যাররাও এই ছেলেটাকে ঠিক ঘাঁটান না। যেমন কিছুদিন আগে এই ছেলেটা (ছেলেটার নাম রবীন। তার আবার একটা পার্টনার আছে, তার মতোই সাইজ তার, নাম বল্টু। সেও একই ক্লাসে পড়ে) আরেক ক্লাসের এক ছেলেকে স্কুলে সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে পিটিয়েছিল। সেই মার খাওয়া ছেলেটার বাবা স্কুলে এসে হেডস্যারকে নালিশও করেছিলেন; কিন্তু কিছু হয়নি শেষ পর্যন্ত।

এবার আসা যাক বিপনুর টিফিন মিস করার বিষয়টায়।

বিপনুর এই নতুন স্কুলে টিফিনের ঘণ্টা বাজলে, মানে চতুর্থ পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজলে সবাই হুড়মুড় করে ছুটে যায় তাদের ক্যানটিনে, এটাই এখানকার নিয়ম। সেখানে খালি প্লেট নিয়ে বসতে হয় সবাইকে। তারপর টিফিন ম্যানেজার স্যার তাঁর সহকারীদের নিয়ে তাদের প্রত্যেকের প্লেটে টিফিন দিয়ে যান। টিফিনও বেশ সুস্বাদু। একেক দিন একেক আইটেম। কখনো লাড্ডু আর কেক, কখনো প্যাটিস-সন্দেশ, কখনো পরোটা-ভাজি... বেশ ভালো ব্যবস্থা। প্রথম দিকে বিপনু টিফিন পেত। যদিও পা টেনে টেনে সে ক্যানটিনে পৌঁছাত সবার পেছনে, তার পরও সে টিফিন পেত। কিন্তু ইদানীং সে পায় না। যাওয়ার পর দেরি হওয়ার কারণেই কি না টিফিন শর্ট পড়ে যায়। টিফিন ম্যানেজার স্যার নিজেও অবাক হন, টিফিন কেন শর্ট পড়ল খোঁজখবর লাগান, পরে তাকে একটা ধমক লাগান, ‘দেরি করে কেন এসেছ?’ এর পর থেকে স্যারের ধমক খাওয়ার ভয়ে সে আর স্যারকে জানায় না। এক গ্লাস পানি খেয়ে কেটে পড়ে। তবে সে যে একাই টিফিন মিস করে তা নয়, সে দেরি করে আসে বলে সে তো মিস করেই, আরও অনেকেই নাকি করে। তার মানে টিফিন নিয়ে একটা কিছু সমস্যা হচ্ছে, এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

এর মধ্যে হঠাৎ স্কুলে ঘোষণা এল যে দুই সপ্তাহ পরে স্কুলে অ্যানুয়াল সায়েন্স ফেয়ার হবে। যারা আগ্রহী, তারা প্রজেক্ট জমা দেবে। প্রথমে যার যার প্রজেক্ট সম্পর্কে লিখে জমা দিতে হবে। বিপনু তো জমা দেবেই, সে অনেক আগে থেকেই একটা মজার বিষয় ভেবে রেখেছে। তার মাথায় দারুণ একটা আইডিয়া আছে। আইডিয়াটা পেয়েছে সে তার নানার কাছ থেকে। তার নানা ছিলেন ভূগোলের শিক্ষক। তারা যখন রাজশাহীতে নানার বাড়ি বেড়াতে যেত, তখন নানা তাকে নিয়ে মাঝে মাঝেই পদ্মার পারে বেড়াতে যেতেন। একদিন নানা বললেন,

দেখেছিস, নদী কেমন ভরে উঠেছে? বল তো কেন?

কেন?

কারণ, এখন জোয়ার।

বল তো জোয়ার কেন হয়?

কারণটা বিপনু জানত, চাঁদের আকর্ষণে জোয়ার-ভাটা হয়, সে সেটাই ব্যাখ্যা করল। নানা খুশি হলেন।

বাহ্, তুই তো ভালোই জানিস। তবে তুই আরেকটা বিষয় কি জানিস?

কী?

তোর কি মনে হয় পৃথিবীর সব নদীতেই জোয়ার-ভাটা হয়?

হ্যাঁ, কেন হবে না?

না... হয় না। পৃথিবীর সব নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় না। নানা তখন এক গল্প বললেন তাকে।

তখন মোগল আমল। এক নবাব তাঁর রাজ্যটা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত। কী করে এই রাজ্যের উন্নতি করা যায়। প্রজারা ঠিকমতো খাজনা দেয় না। নবাবও একটু নরমসরম টাইপের। তখন নবাবের এক মন্ত্রী তাঁকে বুদ্ধি দিল, আপনি আপনার রাজ্যে সম্রাটকে দাওয়াত করুন।
তাতে কী হবে?
ওনাকে আপনার নদীর পাড়ে রাখার ব্যবস্থা করুন।
তাতে কী হবে?
উনি আপনার রাজ্যের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দেখবেন। আপনাকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। আপনাকে মোগল সাম্রাজ্যের আওতায় নিয়ে আসবেন।
তা-ই? বুদ্ধিটা খারাপ না।

তখন সেই নবাব সত্যিই নদীর পাড়ে সুন্দর করে তাঁবু গেড়ে সম্রাটকে একদিন মহাসমাদরে দাওয়াত করলেন। সম্রাট এলেন। তাঁবুতে থাকলেন দুই দিন। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করলেন। তারপর তৃতীয় দিনে তিনি ঘোষণা দিলেন, তিনি ফিরে যাবেন। এখানে আর এক মুহূর্ত নয়।

কেন, মহান সম্রাট, আপনার কি আমার রাজ্য পছন্দ হয়নি?

পছন্দ হয়েছে। তোমার রাজ্য অনেক সুন্দর, নদী সুন্দর, বন সুন্দর, প্রান্তর সুন্দর... সবই সুন্দর।

তাহলে কেন চলে যাবেন? আরও কটা দিন থাকুন।

আমি আসলে তোমার রাজ্যের দায়িত্ব নিতে পারব না, তুমি যে উদ্দেশ্যে আমায় দাওয়াত করেছ। তোমার প্রজাদের শাসন করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

কেন, মহান সম্রাট?

কারণ, তোমার রাজ্যের নদী সকালে যায় ডানে আর বিকেলে যায় বাঁয়ে। যে দেশে নদীই শাসন করা যায় না, সে দেশের মানুষকে আমি কীভাবে শাসন করব?

তার মানে সেই সম্রাট নদীর জোয়ার-ভাটা সম্পর্কে জানতেন না? বিপনু বলে।
না, হয়তো জানতেন না। সেটা বিষয় না, এর মধ্যে একটা দর্শন আছে, সেটা তোর এখন না বুঝলেও চলবে। ফেরার পথে নানা বললেন, আসলে পৃথিবীর সব দেশে কিন্তু নদীর জোয়ার-ভাটা হয় না। যেমন ধর আমেরিকার কলোরাডো নদী, সেখানে জোয়ার-ভাটা নেই। এত দূরে যাওয়ার দরকার কি, নেপালের গোমতী নদীতেও জোয়ার-ভাটা নেই। অর্থাৎ যেসব নদী সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেসব নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় না। সমুদ্রের পানি পূর্ণিমায় চাঁদের আকর্ষণে ফুলে-ফেঁপে উঠে তার সংযুক্ত নদীতে পানি প্রবাহিত করে। ফলে নদীতে নদীতে জোয়ার-ভাটা হয়। তার মানে সেই প্রাচীনকালের সম্রাটকে তুই দোষ দিতে পারিস না। তিনি হয়তো জোয়ার-ভাটা হয় এমন নদী দেখেননি কখনো।

তো নদীর এই বিষয়টা জানার পরই বিপনুর মাথায় আইডিয়াটা আসে। সে স্কুলের সায়েন্স ফেয়ারে নদীর এই জোয়ার-ভাটা নিয়ে একটা প্রজেক্ট করবে।

তারপর একদিন সে লিখিতভাবে তার নদীবিষয়ক সায়েন্স প্রজেক্ট জমা দিল স্যারের কাছে। প্রজেক্টের নাম ‘নদীর জোয়ার-ভাটা’। সবাই জমা দিচ্ছে মজিদ স্যারের কাছে। মজিদ স্যার অবশ্য বাংলা পড়ান। প্রজেক্ট জমা নেওয়ার কথা বিজ্ঞান স্যারের। বিজ্ঞান স্যারের ডেঙ্গু হয়েছে বলে স্যার কদিন ধরে আসতে পারছেন না। মজিদ স্যার ভ্রু কুঁচকে তার বিষয়টা পড়লেন। তারপর মাথা নাড়লেন।
তুই শিওর তো, পৃথিবীর সব নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় না?
শিওর স্যার।
সত্যি হলে তোর বিষয়টা ইন্টারেস্টিং। দেখিস জেনেশুনে প্রজেক্ট বানাস। আমি অবশ্য সায়েন্স অত বুঝি না।
স্যার কাগজপত্র জমা নিলেন।

কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর বিপনু যথেষ্ট উত্তেজনা বোধ করল। সে বাসায় জিনিসটা বানানোর পরিকল্পনা নিল। সে ভেবেছে, তার প্রজেক্টটায় সে একটা পাহাড় বানাবে। পাহাড় থেকে নেমে আসছে নদী। সেটা সমুদ্রে মিশছে... এক ধরনের নদী। আরেক ধরনের নদী হবে সমুদ্র বিচ্ছিন্ন, যেখানে জোয়ার হয় না। সে ঠিক করেছে, একটা হার্ডবোর্ডের ওপর মাটি দিয়ে প্রথমে একটা স্ট্রাকচার বানাবে। তারপর সেখানে নদী, পাহাড়, সমুদ্র—এসব তৈরি করতে হবে। এর জন্য বেশ কিছু মাটিও লাগবে। মাটি পাওয়া যায় কোথায়? তখনই তার মনে পড়ল তাদের স্কুলে ক্যানটিনের পেছনে অনেক মাটি জমে আছে। লাল মাটি। সেখান থেকে মাটি নেওয়া যেতে পারে।

এবং একদিন সেই মাটি সংগ্রহ করতে গিয়েই সর্বনাশটা হলো—

দিনটা ছিল রোববার। থার্ড পিরিয়ডে সমাজ স্যার আসবেন না। ক্লাসে সবাই গুলতানি মারছে। সেই ফাঁকে বিপনু বেরিয়ে গেল মাটি সংগ্রহে। ক্যানটিনের পেছনে চলে গেল। নতুন বিল্ডিং হওয়ার কারণে এখানে লাল মাটি টাল দেওয়া আছে। পকেটে করে একটা ছোট ব্যাগ আগেই এনেছিল। পকেট থেকে ব্যাগটা বের করতেই কোথাও একটা শব্দ হলো কট করে। তাকিয়ে দেখে রবীন। রবীনের সঙ্গে তার সাগরেদ বল্টু। সে একটা ভাঙা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ক্যানটিনের পেছনের একটা জানালা খুলছে। সেই জানালা খোলার শব্দ। টুলটা ধরে আছে বল্টু। বিপনু আশ্চর্য হয়ে দেখল। ক্যানটিনের জানালা দিয়ে রবীন টিফিনের প্যাকেট চুরি করছে। ঠিক ওই জানালাটার পাশেই একটা টেবিলে টাল করে রাখা সব টিফিন। একটা, দুইটা, তিনটা, চারটা...অনেক প্যাকেট তারা একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। ওরা টুল থেকে নেমে আসবে যখন, তখন একটা মাটির ঢিবির আড়ালে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল বিপনু। তখনই দুর্ঘটনাটা ঘটল। দ্রুত সরতে গিয়ে পা পিছলে ধপাস করে পড়ল বিপনু। শব্দে ওরা দুজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বিপনুকে দেখে দুজনেই মনে হলো হকচকিয়ে গেল। দ্রুত এগিয়ে এল দুজন। বিপনু তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। হাত দিয়ে ঝেড়ে নিজেকে পরিষ্কার করছে। রবীন এসে কলার চেপে ধরল বিপনুর—

ওই ল্যাংড়া, তুই এখানে কেন?

ল্যাংড়া বলায় বিপনুর মাথায় একটা বিস্ফোরণ হলো যেন।

তোমরা এখানে কেন?

আমরা একটা কাজে এসেছি।

আমিও একটা কাজে এসেছি।

তুই কিছু দেখেছিস?

দেখেছি।

কী দেখেছিস?

দেখেছি, তোমরা দুজন টিফিন চুরি করলে।

না, তুই দেখিসনি।

দেখেছি। ওই ব্যাগে টিফিন আছে। অনেক প্যাকেট।

রবীন চোখ দিয়ে বল্টুকে কিছু ইশারা করল। বল্টু পেছন থেকে বিপনুর দুই হাত চেপে ধরল। বিপনু হালকা-পাতলা ছেলে। সে তুলনায় ওরা দুজন বেশ বড়সড়। রবীন হাতের আস্তিন গুটিয়ে ঘুষি পাকিয়ে বলল,

ওই ল্যাংড়া, বল, তুই কিছু দেখিসনি?

দেখেছি...তোমরা স্কুলের টিফিন চুরি করেছ।

রবীন এবার সত্যি সত্যি সিনেমা স্টাইলে বিপনুর পেটে একটা ঘুষি মারল। ককিয়ে উঠল বিপনু।

এই ল্যাংড়া, বল, তুই কিছু দেখিসনি?

দেখেছি...তোরা টিফিন চুরি করেছিস। দাঁতে দাঁতে চেপে কোনোমতে বলল বিপনু।

তৃতীয় ঘুষি খেয়ে বিপনু চোখে যেন সত্যি সত্যি সরষে ফুল দেখল। এবার সে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,

আমি দেখিনি...আমি দেখিনি...

কাউকে বলবি?

না।

ঠিক তো?

ঠিক।

বললে একদম স্কুল থেকে টিসি দিয়ে বিদেয় করে দেব। আমার বাবাকে চিনিস? এই স্কুলের সেক্রেটারি। এক কথায় এই স্কুল থেকে তোকে বিদেয় করে দেব, মনে থাকবে?

মাথা নাড়ে বিপনু। তার পেটে তখন প্রচণ্ড ব্যথা করছে। ওরা এবার ছেড়ে দিল। পেট চেপে ধরে বসে পড়ল বিপনু। রবীন ওকে একটা লাথি মেরে বল্টুকে নিয়ে চলে গেল।

এরপর যেটা হলো, বিপনু যখন একা থাকে ক্লাসে, রবীন আর বল্টু তখন কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, ‘মনে আছে তো? তুই কিন্তু কিছু দেখিসনি...’ মাথা নাড়ে বিপনু।

এভাবেই চলছিল। একটা অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে বিপনুর দিন কাটে। একে তো সে টিফিন পায় না। তার কারণটাও সে জানে, কেন পায় না। আর যার কারণে টিফিন খেতে পায় না, উল্টো তার কাছে মার খেতে হলো। বিষয়টা বুঝতে পেরেই কি না কে জানে একদিন বিপনুর ক্লাসের বেস্ট ফ্রেন্ড পলাশ এসে বলল—

কিরে বিপনু, তোর কিছু হয়েছে?

কী হবে?

নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।

মানে?

আমি খেয়াল করেছি।

কী খেয়াল করেছিস? তুই যখনই একা থাকিস তখনই রবীন আর বল্টু এসে তোকে কিছু বলে আর তুই মাথা নাড়িস। ওরা কী বলে?

কই না তো। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বিপনু।

আসলে বিপদ যখন আসে তখন নাকি চারদিক থেকে আসে। বিপনুর মনঃকষ্টের আরেকটা ঘটনা ঘটল। সেদিন স্কুলে গিয়ে শুনল স্কুলের নোটিশ বোর্ডে যারা যারা সায়েন্স ফেয়ারে প্রজেক্ট জমা দেওয়ার পারমিশন পেয়েছে, তাদের নাম দেওয়া হয়েছে। সবাই ছুটে গেল। বিপুনও গেল সবার শেষে। নোটিশ বোর্ডে গিয়ে দেখে সবার নাম আছে শুধু তার নাম নেই। সে হতভম্ব হয়ে গেল। এমন কি রবীন আর বল্টুর নামও আছে। প্রত্যেকের নামের পাশে তাদের সায়েন্স প্রজেক্টের নামও দেওয়া আছে। রবীন আর বল্টুর নামের পাশে সায়েন্স প্রজেক্টের নাম ‘বার্গার অ্যালার্ম’!!

বিপনু তখনই বিজ্ঞান স্যারের কাছে গেল। স্যার কী সব কাগজপত্র ঘাঁটছিলেন। সম্ভবত সায়েন্স প্রজেক্টের কাগজপত্রই হবে।
স্যার?
স্যার চোখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন
কী ব্যাপার?
স্যার, সায়েন্স প্রজেক্টে আমার নাম নেই।

তুই কোন ক্লাস?

স্যার, এইট।

প্রজেক্টের নাম কী?

স্যার, ‘জোয়ার-ভাটার নদী’।

স্যার চোখ তুলে তাকালেন। তারপর হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘ও তুমি সেই গর্দভ?... গাঁজা খাস?’

স্যারের কথা শুনে হকচকিয়ে গেল বিপনু। স্যার এবার মোটামুটি হুংকার দিয়ে উঠলেন।

বলি পৃথিবীতে সব নদী-সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা হয় চাঁদের কারণে। আর এই সামান্য সায়েন্সটাও তুই জানিস না। আর তুই এসেছিস সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে...সব নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় না...এই তথ্য তোকে কোন গাধা দিয়েছে? অ্যাঁ...?

বিপনু দুর্বল গলায় কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। কষ্টে তার চোখে পানি চলে আসে। আর তখনই স্যার শেষ হুংকারটা দেন, ‘গেট আউট!’

মুখ কালো করে সে বের হচ্ছে এমন সময় পলাশ ছুটে আসে।

স্যার কী বলল?

বলল যে আমার তথ্য নাকি ভুল।

সত্যি, তাই বলল?

হু।

আসলে কি ভুল?

না।

তুই এক কাজ কর।

কী?

তুই আমার প্রজেক্টটায় চলে আয়, তুই আর আমি মিলে প্রজেক্টটা করি।

তোর প্রজেক্টটা কী?

‘পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ’।

বিপনু কিছু বলে না। আসলে এই বিজ্ঞান প্রজেক্ট থেকেই তার মনটা উঠে গেছে। সে বইখাতা নিয়ে স্কুল থেকে বিদায় নেয়। তার মনে হয় এমন যদি হতো এই স্কুলে আর আসতে হবে না। তাহলে বেশ হতো। ঈশ্বর যেন বিপনুর এই ইচ্ছেটা শুনলেন।

বাসায় ফিরে বিপনু জ্বরে পড়ল। পরীক্ষা করে দেখা গেল তার ডেঙ্গু হয়েছে। তার রক্তের প্লাটিলেট দেড় লাখ থেকে নেমে এসেছে ৫০ হাজারে। ডাক্তার বলেছেন, আরও নামলে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। এখন শুয়ে শুয়ে পানি আর রসাল ফল খেতে হবে আর ফুল রেস্ট! ...ব্যস, কর্মসারা! স্কুলে যাওয়া বন্ধ, সারা দিন শুয়ে থাকা। মা খুব ব্যস্ত হয়ে গেলেন ছেলের জন্য। বাবা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ফেললেন। বিপনুর ভালো লাগল তার জন্য বাবা-মা কত ব্যস্ত আর স্কুলে...। সে আর ভাবতে চায় না। স্কুলের কথা চিন্তা করলে যেন মাথা ধরে যায়। এই বরং ভালো হলো ডেঙ্গুতে পড়ে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সায়েন্স ফেয়ারটা পার হয়ে যাওয়াই ভালো। যে সায়েন্স ফেয়ারে সে সুযোগই পেল না, সেখানে সে থাকতে চায় না। সে গল্পের বই পড়ে শুয়ে শুয়ে, মাঝে মাঝে বাবা আসেন।

কিরে বিপনু, কেমন আছিস?

ভালো।

তোর ডেঙ্গুর কারণে তোর সায়েন্সের প্রজেক্টটা মার খেলরে।

হু।

মন খারাপ?

না।

তোর নদীর আইডিয়াটা কিন্তু বেশ ভালো ছিল।

হু। বিপনুর মনোযোগ বইয়ে, সে মনোযোগ দিয়ে একটা অ্যাডভেঞ্চার বই পড়ছে।

তোর জন্য একটা গিফট আছে।

গিফট?

হ্যাঁ। বাবা মিটিমিটি হাসেন।

বিপনু বই বন্ধ করে কৌতূহল নিয়ে তাকায়। বাবা একটা প্যাকেট এগিয়ে দেন।

কী এটা?

খুলেই দেখ।

খুলে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় বিপনু। একটা ছোট্ট হ্যান্ডি মুভি ক্যামেরা। যেটাতে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট পর্যন্ত রেকর্ড করা যায়। কী আশ্চর্য, তার জন্য এত দামি গিফট?

তুমি কিনেছ?

না।

তাহলে?

আমার বন্ধু সালেককে মনে আছে?

হু, সালেক চাচা।

হ্যাঁ, সে অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে, তোর জন্য নিয়ে এসেছে এটা। বাসায়ই আসত, সময় নেই বলে অফিসে দিয়ে গেছে।

ওয়াও! চেঁচিয়ে উঠল বিপনু। তার মন ভালো হয়ে গেল। স্কুলে সায়েন্স ফেয়ারে যোগ না দেওয়ার মনঃকষ্টটা যেন মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল।

বিপনুর ইচ্ছে হলো এখনই উঠে গিয়ে কিছু একটা রেকর্ড করে ফেলে। কিন্তু বিছানা থেকে ওঠা বারণ। শুয়ে শুয়ে সে ঘরের এটা-সেটা রেকর্ড করে। ছোট্ট একটা সিডিতে আবার কপি করা যায়। সঙ্গে দুটো এক্সট্রা সিডি ফ্রি। রিরাইটেবল সিডি।

সময় বেশ ভালোই কাটছিল বিপনুর। এর মধ্যে একদিন বিকেলে পলাশ এসে হাজির।

কিরে, খবর কী তোর?

ভালো। তোদের কী খবর?

ভালো, সায়েন্স ফেয়ার তো পরশু।

হু। তোর প্রজেক্ট শেষ করেছিস?

মোটামুটি।

রবীনরাও কি প্রজেক্ট তৈরি করছে?

আর বলিস না, ওদের প্রজেক্টটা তো চুরি করা।

মানে?

বনফুল স্কুলের এক ছাত্রের থেকে মেরে দিয়েছে প্রজেক্টটা।

তাই নাকি? তোরা কীভাবে জানলি?

সবাই জানে। কেউ বলছে না ভয়ে, ওদের তো চিনিস।

হু। বিপনু কিছু বলে না।

তবে তোর জন্য একটা খবর আছে?

কী?

নতুন একটা আইটেম সায়েন্স ফেয়ারে ঢুকিয়েছে স্যাররা।

কী?

কোনো একটা ঘটনা নিয়ে তিন বা পাঁচ মিনিটের ভিস্যুয়াল ক্লিপ। তুই জমা দিতে পারিস। এটা সবার জন্য উন্মুক্ত। অনেকেই দিচ্ছে।

কীভাবে দিচ্ছে?

কেন মোবাইলে রেকর্ড করে...যেকোনো বিষয় নিয়ে হতে পারে।

আর যদি ভিডিও করে?

সেটাও হতে পারে? তুই দিবি?

নাহ্। উদাস হয়ে বলে বিপনু। পলাশকে মুখে না বললেও তার মাথার ভেতর তখন একটা অন্য চিন্তা চলতে থাকে। এবং ভেতরে ভেতরে সে এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করে।

পলাশ চলে যাওয়ার পরে বিপনু তার ভিডিওটা বের করে। শুয়ে শুয়ে এদিক-ওদিক তাকায় কী ভিডিও করা যায়। তিন মিনিট বা পাঁচ মিনিট। তারটায় অবশ্য ১০ মিনিট পর্যন্ত ভিডিও হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটাতে হালকা-পাতলা এডিট করার সুযোগও আছে। তখনই তার নজর যায় জানালার দিকে। জানালার ও পাশে একটা প্রজাপতি উড়ছে, তবে মার বাগানের কোনো ফুলের ওপর সে বসছে না। প্রজাপতিটা যদি কোনো একটা ফুলে বসত...সে তার ভিডিওটা চালু করে। প্রজাপতিটা উড়ছে...উড়ছে...কোথাও বসছে না। একসময় চলে গেল, দূর...!

সেদিন সে সারা দিন আর রাত ঘরের ভেতর এটা-সেটা ভিডিও করল। কোনোটাই মনে ধরে না। একটা ভিডিও বেশ ভালোই হচ্ছিল। ঘরের মোটাসোটা, পেটমোটা একটা টিকটিকি বাল্বের কাছে একটা পোকাকে ধরার জন্য খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে... যেই পোকাটাকে ধরতে যাবে, তখনই থপ করে টিকটিকিটা মাটিতে পড়ে গেল আর পোকাটা উড়ে গেল...দূর।

পরদিন ১২টার সময় ঘুম ভাঙল বিপনুর। শরীরটা আজ বেশ ভালো লাগছে। দুর্বল ভাবটা আর নেই। গতকাল রক্তের টেস্টের রিপোর্ট এসেছে। প্লাটিলেট মোটামুটি নরমাল সংখ্যায় ফিরে এসেছে। আসলে সে সেরেই গেছে। কিন্তু মা-বাবা ছাড়ছেন না। বাবা অবশ্য আজ থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করেছেন। সোয়া একটার সময় বিপনুর মাথায় একটা চিন্তা এল। এখন স্কুলে থার্ড পিরিয়ড চলছে। তার মানে এখন মতলুব স্যারের ক্লাস চলছে। আর এখন ঠিক রবীন আর বল্টু টয়লেটে যাওয়ার কথা বলে বের হবে...ঠিক তখনই বিপনুর মাথায় একটা দারুণ চিন্তা এল। বিষয়টা চিন্তা করে তার প্রচণ্ড উত্তেজনা হলো। সে উঠে বসে পড়ল। এ সময় মা এক গ্লাস দুধ নিয়ে ঢুকলেন।

নে, নাক চেপে ধরে দুধটা খেয়ে নে।

বিপনু নাক না চেপেই ঢক ঢক করে দুধ খেয়ে ফেলল। মা একটু অবাক হলেন। বিপনু দুধ খেতেই চায় না, তার নাকি গন্ধ লাগে। আজ কী হলো নাক না চেপে দিব্যি খেয়ে ফেলল।

মা, আমি কি ১০ মিনিটের জন্য বাইরে যেতে পারি?

কেন?

একটু ভিডিও করব।

না।

কেন মা, আমি তো এখন সুস্থই।

না বাবা, আজকের দিনটা রেস্ট নাও, কাল থেকে বেরোতে পারবে।

মা, ১০ মিনিটের জন্য বের হই?...প্লিজ?

বিপনুর ঘ্যান-ঘ্যানানিতে শেষ পর্যন্ত মা ঘড়ি ধরে ১০ মিনিটের জন্য তাকে বাইরে যেতে দিতে রাজি হলেন। বিপনু দেরি করল না। দ্রুত তার ভিডিওটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তার বুকটা ধকধক করছে একটা অন্য রকম উত্তেজনায়। বিপনু বাইরে বেরিয়েই ছুটল স্কুলের দিকে। তার স্কুল বেশি দূরে নয়। হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিট। আজ বিপনু তিন মিনিটে পৌঁছে গেল। স্কুলের পেছনের দেয়াল টপকে সে চলে এল ক্যানটিনের পেছনে। তারপর একটা নিরাপদ জায়গায় বসে পড়ল ঘাপটি মেরে। এখন অপেক্ষার পালা।

সায়েন্স ফেয়ারের দিন বিপনু স্কুলে গেল। মজিদ স্যার তাকে দেখে অবাক—

কিরে, তুই এত দিন কোথায় ছিলি?

স্যার, আমার ডেঙ্গু হয়েছিল।

তা-ই? এখন ভালো?

জি স্যার।

তোর নদীর প্রজেক্ট দিয়েছিস?

না, স্যার।

কেন?

বিজ্ঞান স্যার আমারটা নেননি।

কেন?

স্যার বললেন আমার তথ্য নাকি ভুল।

স্যার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, তাই বললেন স্যার?

হ্যাঁ।

স্যার আর কিছু বললেন না।

সায়েন্স ফেয়ার বেশ জমে উঠল। অনেক গার্ডিয়ান এসেছেন। বিপনুর বাবা-মা অবশ্য আসতে পারেননি। একটা দাওয়াতে গেছেন। বিচারকেরা চলে এসেছেন। তাঁরা ঘুরে ঘুরে সবার প্রজেক্ট দেখছেন। রবীন-বল্টুর প্রজেক্টের সামনে অনেকক্ষণ ধরে তারা দাঁড়িয়ে দেখলেন কী করে এই বার্গার অ্যালার্ম কাজ করে। অবশ্য রবীন-বল্টুরটা এত গুরুত্ব নিয়ে দেখার কারণও আছে। রবীনের বাবা এলাকার নেতা আর স্কুলের সেক্রেটারি বলে কথা! রবীনের বাবাও বিচারকদের সঙ্গে আছেন। তিনি হাসিমুখে তাঁর ছেলের পিঠ চাপড়ে দিলেন।

বিপনু পলাশের সঙ্গে তার প্রজেক্টে দাঁড়িয়ে। পলাশের প্রজেক্ট হচ্ছে আগ্নেয়গিরি। সেটাও বিচারকেরা দেখলেন। মোটামুটি সবারটাই দেখা হলো।

হঠাৎ মাইকে ঘোষণা হলো। ‘এবার আমাদের উন্মুক্ত দ্বিতীয় পর্ব... ভিডিও ক্লিপ প্রদর্শন।’

সবাই ঘুরে তাকাল হলরুমের পর্দার দিকে। একটা বড় সাদা কাপড় আগেই টান টান করে টানানো হয়েছে। সামনে একটা অ্যাটম এনলার্জার সেট করা, যেটা কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত। সেটা দিয়ে ফোকাস করে ভিডিও ক্লিপ ফেলা হবে সামনের ধবধবে সাদা পর্দায়।

মাইকে আবার ঘোষণা হলো। ‘মোট ১২টি ভিডিও ক্লিপ জমা পড়েছে। বিষয় ছিল উন্মুক্ত। প্রথমেই আমরা দেখব ক্লাস সেভেনের সাকিব হাসানের ভিডিও ক্লিপ ‘শিকার’।

পর্দায় ভেসে উঠল নাম ‘শিকার’। তার পরই শুরু হয়ে গেল ক্লিপটা। ক্লিপটা বেশ মজারই, একটা বিড়াল গুড়ি মেরে এগোচ্ছে একটা ছোট্ট ইঁদুরের দিকে। তারপর হঠাত্ ঝাঁপিয়ে পড়ল ইঁদুরটার ওপর। সবাই বেশ মজা পেল। পরের ভিডিওটা কাকের ওপর। একটা কাক কী একটা কুড়িয়ে রাস্তায় রেখে এল। তারপর তার ওপর দিয়ে গাড়ি চলে যেতে জিনিসটা ভেঙে গেল। কাকটা তখন ভাঙা ওই জিনিসটা খেতে লাগল। সবাই অবাক হলো কাকের বুদ্ধি দেখে।

পলাশ ফিসফিস করে বলল—

তোর ক্লিপটা জমা দিয়েছিলি?

হ্যাঁ।

স্যার নিল?

প্রথমে নিতে চাননি। বললেন, না দেখে নেবেন না। পরে নিলেন। অবশ্য দেখে ফেললে হয়তো নিতেনই না। কে জানে।

কেন? তোর ভিডিও ক্লিপে কী আছে?

দেখবি, দেখলেই বুঝবি! বিপনু ঢোক গেলে, কাজটা কি ঠিক হলো? সে তাকাল রবীনের দিকে। রবীনদের টেবিলটা ঠিক তাদের উল্টো দিকেই। রবীন চোখাচোখি হতেই পা খোঁড়ানোর একটা ভঙ্গি করল। বিপনু মুখ ফিরিয়ে নিল। তার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।

আর তখনই দেখল মা ঢুকছেন। বিপনুর মনটায় হঠাৎ সাহস ফিরে এল। সঙ্গে সঙ্গে মাইকে ঘোষণা এল, আমাদের শেষ ভিডিও ক্লিপ ক্লাস এইটের বিপনু চৌধুরীর ‘স্কুলে একদিন’। বিপনুর বুকটা ধক করে উঠল। সে তাকাল রবীনের দিকে। রবীন আবার নিজে বাঁকা হয়ে খোঁড়ানোর একটা ভঙ্গি করল। বিপনু তাকাল স্ক্রিনের দিকে। সেখানে বড় বড় করে লেখা উঠেছে ‘স্কুলে একদিন’। নিচে লেখা বিপনু চৌধুরী, ক্লাস এইট। প্রথমেই লং শটে দেখা তাদের স্কুলটা। তারপর ক্যামেরাটা ঘুরতে ঘুরতে চলে এল তাদের ক্যানটিনের পেছনে। সেখানে মাটির ঢিবির ওপর ক্যামেরা স্থির হলো। তারপরই ক্যামেরা ঘুরে গেল একটা জানালার দিকে। আর তখনই দেখা গেল দুটো ছেলে আসছে, রবীন আর বল্টু। বিপনু তাকাল রবীনের দিকে। দেখে রবীন ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে। ঝট করে একবার তাকাল বিপনুর দিকে, ফের তাকাল স্ক্রিনের দিকে। বল্টুরও একই অবস্থা। সমগ্র হলে পিনপতন নিস্তব্ধতা।

আড়াই মিনিটের ভিডিওটা শেষ হলো। বিপনু তাকিয়ে দেখে সবাই যেন পাথর হয়ে গেছে। রবীনের বাবা মাথা নিচু করে বসে আছেন। হেড স্যার উঠে দাঁড়ালেন। কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন—

আমার মনে হয়, স্কুলের একটা বড় সমস্যা আমরা ধরতে পেরেছি। কেন প্রতিদিন আমাদের স্কুলের টিফিন কম পড়ত এবং অনেকেই টিফিন পেত না। যারা এটার সঙ্গে জড়িত, তাদের আমরা চিনতে পারলাম। স্কুলের আইন অনুসারে তাদের আর এই স্কুলে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। এখানে সেক্রেটারি সাহেব উপস্থিত আছেন, আমি তাঁর মতামত জানতে চাই।

সেক্রেটারি সাহেব একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, ‘ইয়ে, আপনারা যা সিদ্ধান্ত নেবেন তা-ই হবে।’ বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

‘আমার আরেকটা মিটিং আছে’ বলে দ্রুত উঠে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় সবার সামনে তাঁর ছেলের কান ধরলেন এবং একরকম হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন। আর কি আশ্চর্য, তখন বার্গার অ্যালার্মটা ক্যা ক্যা ক্যা করে বেজে উঠল। বল্টুকে অবশ্য আর দেখা গেল না। সে মনে হয় আগেই ভেগেছে!

এ সময় বিচারকদের একজন হাত তুললেন। তিনি কিছু বলতে চান। তিনি দাঁড়িয়ে বলা শুরু  করলেন—

আমার মনে হয়, আমরা মূল অনুষ্ঠানে ফিরে আসি। যে প্রজেক্টগুলো প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় হয়েছে, সেগুলোর নাম ঘোষণা করা যাক। আমাদের হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। তার আগে ‘স্কুলে একদিন’-এর পরিচালককে আমরা দেখতে চাই। সবাই তখন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ দেখতে চাই।’ আর তখন ঠেলেঠুলে বিপনুর বন্ধুরা বিপনুকে দাঁড় করিয়ে দিল। বিপনুর ভীষণ লজ্জা লাগছিল। তার কানে কিছু ঢুকছিল না কে কী বলছে, তবে সে শুধু তালির শব্দ শুনতে লাগল, ঠা ঠা করে তালি পড়ছে তো পড়ছেই।

তারপর আর কি, হেড স্যার আবার বক্তব্য দিলেন। তিনি বললেন, বিপনু চৌধুরীর ‘স্কুলে একদিন’ ভিডিও ক্লিপটি যদি আমি আগে দেখতাম, তাহলে হয়তো প্রচার করতে দিতাম না, আমাদের স্কুলের জন্য এটা খুব সম্মানজনক বিষয় নয়। তবে এটা মন্দের ভালো হলো। আমরা একটা বিষয় পরিষ্কার হতে পারলাম, স্কুলের টিফিন নিয়ে যে একটা অভিযোগ সব সময় আসত, সেটা পরিষ্কার হলো। এ জন্য আমি বিপনু চৌধুুরীকে একটি স্পেশাল পুরস্কার ঘোষণা করছি। আবার ঠা ঠা করে তালির শব্দ।

এরপর বিচারকেরা একে একে তিনজনকে সায়েন্স প্রজেক্টে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড পুরস্কার ঘোষণা করলেন। পলাশের ‘আগ্নেয়গিরি’ থার্ড পুরস্কার পেল। পলাশ তো মহা খুশি।

‘স্কুলে একদিন’ গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু শেষ হলো না।

সেদিন বাড়ি ফিরে বিপনু জানতে পেল তার বাবার আবার প্রমোশন হয়েছে এবং তিনি এখান থেকে বদলি হয়ে গেছেন। খুব শিগগিরই তাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। তার মানে বিপনুর এই স্কুলও ছাড়তে হবে। টিসি নিতে হবে স্কুল থেকে। বাবা একদিন বিপনুকে নিয়ে গেলেন স্কুলে। সরাসরি হেড স্যারের রুমে। হেড স্যার বাবাকে দেখে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। বিপনু আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করল, তার বাবা আসলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেক বড় একজন অফিসার। অন্য স্যাররাও ব্যস্ত হয়ে গেলেন বাবার জন্য। বাবা এবার হাসিমুখে বললেন—

আমি দুটো ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। প্রথম বিষয়টা হচ্ছে যে দুটো ছেলেকে আপনারা টিসি দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন, সেটা করবেন না। বরং আমার ছেলেকে টিসি দিন...

কী বলছেন স্যার? আপনার ছেলেকে টিসি দেব কেন...?

বাবা হেসে ফেললেন। ‘না না, আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। আমি এখান থেকে বদলি হয়ে গেছি। তাই...’

এরপর বাবা যেটা করলেন, সেটা ভয়ানক। বাবা বললেন। ‘আমি আপনাদের সায়েন্স টিচারের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’ সায়েন্স টিচার পাশেই ছিলেন। তিনি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘স্যার, আমিই সায়েন্স টিচার।’ বাবা এবার বিপনুর দিকে তাকালেন, ‘বিপনু, তুমি একটু বাইরে যাও!’

বিপনু বাইরে। কাজেই সে জানে না ভেতরে কী ঘটল। আর যা ঘটল, সেটা এ রকম—

আপনি আমার ছেলের সায়েন্স প্রজেক্টটা নেননি কেন?

ইয়ে স্যার...মানে...তোতলাতে শুরু করেন সায়েন্স টিচার।

আমার ছেলে কিন্তু আমার কাছে কোনো নালিশ করেনি। আমি জানতে পেরেছি অন্য একটা সোর্স থেকে। এই পর্যায়ে বাবার সঙ্গে চোখাচোখি হলো বাংলা স্যারের। ‘আপনার মনে হয়েছে, আমার ছেলে মূর্খের মতো একটা তথ্য নিয়ে এসেছে আপনার কাছে তাই না? যে কারণে আপনি সেটা বাতিল করেছেন। কিন্তু ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, তার তথ্য সঠিক। ১০০ শতাংশ সঠিক। আপনি না জেনে একটা বাচ্চা ছেলের মনে আঘাত দিয়েছেন, যেটা টিচার হিসেবে আপনি করতে পারেন না। নেভার এভার... ইজ ইট ক্লিয়ার?

জি জি স্যার।

আপনি আজকেই এ বিষয়ে পড়াশোনা করবেন এবং ব্যাপারটা জানবেন। একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের আরেকটু বেশি জানা উচিত...

জি জি স্যার...

আচ্ছা, আমি তাহলে উঠি।

সবাই তখন বাবাকে চা-বিস্কুট খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলেন। বাবা অবশ্য চা খেলেন না। বিপনুর টিসি নিয়ে বের হয়ে এলেন বাইরে।

এরপর আর বেশি দিন বিপনুরা ওখানে থাকেনি। তবে এর মধ্যে একদিন বিপনুর ক্লাসের কয়েকজন তাদের বাসায় এল বিদায় জানাতে। বিপনু তখন জানতে পারল, তার বাবার কারণে রবীন আর বল্টুকে টিসি দেওয়া হয়নি। তারা ক্লাস করছে। তবে তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। তাদের দেখলেই অন্য ছাত্ররা মুখে ‘ক্যা ক্যা ক্যা...!’  করে চেঁচিয়ে শব্দ করে। এটা হচ্ছে রবীন-বল্টুর বার্গার অ্যালার্মের সেই আওয়াজ। রবীন-বল্টু নাকি মুখ সূচালো করে ঘুরে বেড়ায়। আরেকটা নিয়ম হয়েছে তাদের জন্য, তাদের টিফিন দেওয়া হয় সবার পরে। আর হ্যাঁ, ভালো কথা। স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে এখন সবাই টিফিন পায়, কেউ বাদ যায় না।

সত্যি কখনো কখনো কত অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে।

অলংকরণ : মামুন হোসাইন