স্বপ্নের অ্যাডভেঞ্চার

আঁকা: সব্যসাচী চাকমা

আমরা যে বাড়িটায় থাকি, সে বাড়ির ছোট্ট ছেলে সাজু। অনেক অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়ে ফেলেছে সে, আবার ডায়েরিও লেখে। আমি সাজুর যে বইপড়া শেষ হয়ে যায়, সেটা কেটে ফেলি। আগে এতে আগে খুবই রাগ করত সাজু। কিন্তু একটা ঘটনার পর থেকে আর করে না।

এত এত অ্যাডভেঞ্চারের বই কেটে একটা অ্যাডভেঞ্চারে যেতে খুব ইচ্ছা হতো আমার। কিন্তু পরেই মনে হতো, না। এসব আমার জন্য নয়।

আমি তো মানুষই না।

একটা ইঁদুর।

তবে স্বপ্নটা একদিন পূরণ হয়েই গেল।

এক রাতের বেলা সাজুর ঘরে একলা বসে বই কাটছি। এ সময়টায় সে ঘুমায়, আজ কোথায়—ভাবতে ভাবতেই চোখ পড়ল লাল এক মলাটের ওপর। সেটা একটুখানি কেটেই বুঝতে পারলাম, সাজুর ডায়েরি এটা। রাগ করবে ভেবে রেখেই দিচ্ছিলাম, হঠাৎ আমার চোখ পড়ল একটা ঠিকানার ওপর। কেটে দেখলাম লেখা ‘ভূতের বাড়ি’। পরেই আরও লেখা, ‘যাচ্ছি ভূতের বাচ্চা আনতে। বাবা-মাকে ভূতের বাচ্চা দেখালেই আর বকা দিতে পারবে না।’

তাহলে সাজু এখন ওখানে?

উত্তেজনায় আমিও ভূতের বাচ্চা ধরা দেখতে রওনা দিলাম সেই বাড়ির দিকে। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ই শুনলাম ‘সাজু কোথায়’ বলে দারুণ চেঁচামেচি। একটুখানি হেসে ভাগ্যকে বললাম, ‘আমাকে কেউ খুঁজবে না কখনো।’

ভূতের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি, সেটা আসলে অর্ধেক বানানো একটা বাড়ি। সিঁড়ির সামনে যেতেই শুনি ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। সাজু কি তাহলে ভূতের বাচ্চা ধরেই ফেলল? অবশ্য দৌড়ে ওপরে ওঠার সময় কান্নাটাকে মানুষের বাচ্চার কান্নার মতোই লাগছিল। তিনতলায় এসে একটা ঘরের সামনে দাঁড়াতেই কানে এল মানুষের গলার ধমক। দরজা খোলার শব্দ পেলাম। তাড়াতাড়ি ভাঙা ইটের পেছনে লুকাতে গিয়ে দেখলাম ইয়া মোটা এক লোক দরজায় তালা মেরে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নিচে। ভূতের বাড়িতে মোটা মানুষ, বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আবার সাজুকেও দেখছি না, সবকিছু জট পাকিয়ে গেল আমার ছোট্ট মাথায়। তবে এটুকু বুঝেছি যে আমাদের আর এই বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না। সাজুকে খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। কোনো একটা গোলমাল নিশ্চয় আছে।

হঠাৎ নিচে তাকাতেই দেখি সেই মোটা লোক, ফোনে কথা বলতে বলতে হাত নাড়ছে সিঁড়ির জানালা দিয়ে। ফোনে কী বলছে শোনার জন্য একটু এগোলাম, ‘হ, সব এক্কেরে রেডি, তয় একটা সমস্যা হইসিল। কইত্তে একটা বাচ্চা উঁকি মারতাসিল, পরে ওইডারেও ধরসি। আপনেরা খাড়ান, সবগুলারে আমি পাঠাইতাসি।’ ওপাশের কথা একটু শুনে আবার বলল, ‘কেন পুলিশ আইতাসে, আহুক। কাম তো এখনি ফিনিশ হইব। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম, তাহলে এরা ছেলেধরা! আর এরাই সাজুকে আটকে রেখেছে। এখন কী হবে?

হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল। দৌড়ে ঘরটায় গিয়ে দেখি ভয়ে কাঠ হয়ে বসে আছে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। লোকটা ধমকে সবাইকে বলছে চুপ করে নিচে নেমে যেতে। আমি এক কোনায় সাজুকে একপলক দেখে নিয়ে শুরু করে দিলাম আমার কাজ। ইয়া মোটা লোকটার গা বেয়ে ওপরে উঠেই শুরু করে দিলাম আমার দাঁতের খেলা। লোকটার লাফালাফি-চিৎকারে বাচ্চারা থমকে গেলেও সামলে উঠল সাজু। সবাইকে নিয়ে নিচে নেমে গেল সে। আমিও লোকটাকে ছ্যাড়াবেড়া করে দিয়ে নেমে এসেছিলাম।

শেষ কথা

সাজু সবাইকে নিয়ে নিচে নেমে দেখে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত সবাইকে নিয়ে বাড়ির পেছনে লুকিয়ে পড়ে সে। মোটা লোকটার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে লোক দুটো যখন ওপরে উঠে, তখনই পেছন পেছন গিয়ে বাড়ির প্রধান দরজাটা লাগিয়ে দেয় সাজু। এটা দেখে বেকুব ড্রাইভার উল্টো গাড়ি ঘোরাতেই পুলিশ চলে আসে। সাজুকে ধন্যবাদ দেয় লোকগুলোকে ধরতে সাহায্য করার জন্য। শুধু তাই না, তাকে বাড়িতে পৌঁছেও দেয়। প্রথমে বাড়িতে খুব হইচই হলেও পরে টিভিতে মধ্যরাতের বিশেষ বুলেটিনে সাজুর সাক্ষাৎকার দেখার পর খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল সবাই।

আর আমি? সাজু যে আমার কথা বলেনি তা নয়, কিন্তু সাংবাদিকগুলো সেসব পাত্তাই দেয়নি। তার রাতের বেলা এভাবে বেরিয়ে যাওয়া আর এত বিপদেও মাথা ঠান্ডা রেখে লোকগুলোকে ধরিয়ে দিয়েছে—সেটাই প্রধান বিষয়। তবে আমি খুশিই। কারণ, আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে আর সাজু অনেকগুলো বই কাটতে দিয়েছে আমাকে। নাইবা হলাম বিখ্যাত, কিন্তু আমার বন্ধু তো হয়েছে!