স্বর্ণহাঁসিকা

সোনার ডিম পাড়ে না এমন একটি হাঁসের গল্প এটি। সোনার ডিম না পেড়েও তার জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। কীভাবে—সেটা আমরা এই গল্পে জানব। তবে যে জিনিসটা জানতে আমরা ব্যর্থ হব, সেটি হলো গল্পটির মোরাল বা নীতিকথা। সম্ভবত এই গল্পের কোনো মোরাল নেই।
অলংকরণ: রকিবুল হাসান

গ্রামের শেষ প্রান্তে এক চাষার ঘরে বাস করত এক হাঁস।

রোজ একটা করে ডিম পাড়ত হাঁসটা। লম্বাটে ধরনের ধবধবে সাদা ডিম।

সেই ডিম হাতে নিয়ে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত কৃষকের মুখ। হাঁসটার দিকে কৃতজ্ঞ চোখে একবার তাকাত সে। তারপর ডিম হাতে শিস দিতে দিতে ভেতরবাড়ির দিকে পা বাড়াত।

কৃষক চলে গেলে হাঁসটির পাশে এসে দাঁড়াত ভুলু। গম্ভীর মুখে বলত, হা হতোস্মি! কার ডিম, কার পেটে!

ভুলুর এ কথার কোনো মানে বুঝতে পারত না হাঁসটি। ভুলুর সব কথা বোঝা মুশকিল। সারাক্ষণ সে জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে।

ভুলু হলো কৃষকের পোষা কুকুর। একটু বয়স্ক। তবে ভীষণ জ্ঞানী। এই তল্লাটের প্রাণীদের মধ্যে ভুলুর মতো এত জানাশোনা আর কারও নেই। সন্ধ্যারাতে কৃষক তার ছোট্ট শিশুটিকে ঘুম পাড়ানোর জন্য যেসব গল্প বলে, একটু দূরে লেজ নাড়তে নাড়তে সেই গল্পগুলো সবই শোনার সুযোগ পায় ভুলু। শুনে শুনে সবকিছু জানা হয়ে গেছে তার। বিশেষ করে মানবজাতির স্বভাবচরিত্র তার নখদর্পণে। এ কারণে হাঁস খুব শ্রদ্ধা করে ভুলুকে। ভুলুর সব কথায় মাথা নাড়ে সে।

একবার হলো কী, পাশের গ্রামে গৃহপালিত পশুপাখির একটা গুরুতর রোগ ছড়িয়ে পড়ল। বিশেষ করে পাখিবর্গের প্রাণীরা বেশি করে আক্রান্ত হতে শুরু করল এই রোগে। চিকিৎসকেরা মাথা চুলকে বললেন, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার কোনো অচেনা স্ট্রেইন হতে পারে। আরও বেশ কিছু কঠিন কঠিন শব্দ বলতে থাকলেন তাঁরা।

রোগটি এই গ্রামে এল না। পাশ দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। কিন্তু যাওয়ার সময় কেবল এই গ্রামের একটি প্রাণীকে আক্রান্ত করে গেল বেচারা হাঁসটিকে।

হাঁসটির জ্বর হলো না, সর্দি হলো না, পেট খারাপ না, কিচ্ছু না। শুধু তার ডিমের খোলসের রং বদলে যেতে শুরু করল। প্রতিদিন ডিমের সাদা ধবধবে আবরণ একটু একটু করে তামাটে হলুদ হয়ে যাচ্ছে।

কৃষক ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে সেই ডিমের দিকে। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে ভেতরবাড়িতে চলে যায়। সে চলে গেলে ভুলু পাশে এসে গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, তোর জন্য খুব মায়া হচ্ছে রে, হাঁস।

হাঁস বিস্মিত হয়ে বলে, কেন, কেন?

তোর কপালে খারাবি আছে।

কিন্তু কেন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভুলু বলে, পোড়াকপালি, তুই সোনার ডিম পাড়তে শুরু করেছিস!

হাঁস এ কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না।

তখন ভুলু তাকে সেই গল্পটি বলে, কৃষকের আঙিনায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থেকে বহু সন্ধ্যারাতে যে গল্প বহুবার সে শুনেছে—সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্প।

গল্প শুনে শিউরে উঠে হাঁস নিজের গলায় আঙুল বোলায়।

এখন উপায়!

আফসোসের সুরে ভুলু বলে, কোনো উপায় নেই, রে। সোনার ডিম পাড়া হাঁসের ভাগ্যলিপি কেউ খণ্ডাতে পারে না।

হাঁসটার খুব মন খারাপ হয়।

সে তার ছোট্ট খুপরি ঘরে সারা দিন চুপচাপ বসে থাকে।

বিকেলের দিকে ভুলু বলে, একটাই উপায় আছে।

কী সেটা?

তুই পালা। পালিয়ে যা।

মাঝরাতে যখন পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে, ঝিঁঝি ডাকছে পেছনের বাঁশবনে, নিজের ছোট্ট চালাঘর ছেড়ে উঠানে পা রাখে হাঁস।

একবার তাকায় সে চেনাজানা গৃহস্থ বাড়িটার দিকে। কান্না পায় তার। অভিমান হয় সবার ওপর।

ভুলু বলে, পালা, গর্দভ কোথাকার। একবারও পেছন ফিরে তাকাবি না।

আচ্ছা—বলে ছুটতে শুরু করে হাঁস।

বাড়ির পুব দিকের পানাপুকুরের পিছল পাড় ছাড়িয়ে, চোরকাঁটায় ঢাকা স্কুলমাঠ ডিঙিয়ে, রমজান আলির কাঠের গোলাঘর পেছনে ফেলে ছুটতে থাকে সে।

অন্ধকারে।

ছুটছে আর কাঁদছে। কাঁদছে আর ছুটছে।